ইলেকট্রনিক (ই-বর্জ্য) বর্জ্য বলতে বোঝায় পরিত্যক্ত বা উপযোগিতাহীন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম। এ বর্জ্যগুলো মূলত মানুষের বাসাবাড়িতে দৈনন্দিন ব্যবহৃত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি যেমন: টিভি, কম্পিউটার, মোবাইল, ওভেন, ফ্রিজ, ওয়াশিং মেশিন, চার্জার, বাল্ব, ব্যাটারি ইত্যাদি। বর্তমান বিশ্বে বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে এ ধরনের বর্জ্যের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও অব্যবস্থাপনার জন্য মানব স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়তে শুরু করেছে।
ই-বর্জ্যের মধ্যে সাধারণত থাকে লোহা, ইস্পাত, অ্যালুমিনিয়াম, রৌপ্য, তামা, সিসা, ক্যাডমিয়াম ইত্যাদি। এসব লৌহজাত, অলৌহজাত ও বিষাক্ত পদার্থের বাণিজ্যিক মূল্যের পাশাপাশি রয়েছে মানবস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ বিভিন্ন উপাদান। তিনটি উৎস থেকে বাংলাদেশে ই-বর্জ্য মূলত উৎপন্ন হয়। যেমন এক. প্রাথমিক ব্যবহার ও মেয়াদোত্তীর্ণ-পরবর্তী পণ্য। দুই. প্রবাসী শ্রমিকদের মাধ্যমে বিদেশ থেকে আনা বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি এবং তিন. উন্নত দেশগুলো থেকে অবৈধভাবে আনা পুরনো বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি।
ই-বর্জ্যে সিসা, পারদ, ব্রোমিনেটেড ফ্লেম রিটাডেন্টের মতো বিষাক্ত পদার্থের উপস্থিতির কারণে এটি পরিবেশের জন্য হুমকি সৃষ্টি করছে প্রতিনিয়ত। এর অপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনা, যত্রতত্র পোড়ানো ও ভূমি ভরাটের মাধ্যমে মাটি, পানি ও বায়ুকে দূষিত করে। পরবর্তী সময়ে এ দূষণ বাস্তুতন্ত্রকে প্রভাবিত করে মানবস্বাস্থ্যকে বিপন্ন করে। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র বিশ্বেই ক্রমাগত এর পরিমাণ ও ধরন বাড়ছে।
মানুষের ক্রয়ক্ষমতা ও চাহিদা পূরণে বাজারে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক পণ্য। এছাড়া মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বিবেচনায় বাজারে রয়েছে বিভিন্ন নিম্নমানের ইলেকট্রনিক ডিভাইস এবং সচেতনতার অভাবে এসব পণ্য ও কোম্পানির চাহিদা বেড়েই চলেছে। ফলে অল্প কিছুদিন ব্যবহারের পরই অনুপযোগী ইলেকট্রনিক ডিভাইস রূপান্তরিত হচ্ছে ই-বর্জ্যে, যা পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
বৈশ্বিক ই-ওয়েস্ট মনিটর ২০২৪-এর হিসাবে, ২০২৩ সালে সমগ্র বিশ্বে ৬২ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়েছে, যা পরিবহন করতে প্রায় ১ কোটি ১৫ লাখ ট্রাকের প্রয়োজন পড়ে। সাম্প্রতিক এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ টন পরিমাণ মেমোরি কার্ড ও মাদারবোর্ড থেকে প্রায় ৬০০ গ্রাম স্বর্ণ, সাড়ে সাত কেজি রুপা, ১৩৬ কেজি তামা ও ২৪ কেজি টিন পুনরুদ্ধার করা সম্ভব, যার বাজারমূল্য প্রায় ৫০ লাখ টাকা। আবাসিক ও বিভিন্ন অফিসে ব্যবহৃত কম্পিউটার হার্ডডিস্কের অন্যতম একটি উপাদান হলো অ্যালুমিনিয়াম ও স্টেইনলেস স্টিল, কম্পিউটার হার্ডডিস্ক হতে পারে এ দুটি উপাদানের ভালো একটি উৎস। অন্যদিকে জিংকের একটি উল্লেখযোগ্য উৎস হতে পারে ড্রাইলেস পরিত্যক্ত ব্যাটারি। এ উৎস থেকে ১৬ দশমিক ৯৮ শতাংশ জিংক পাওয়া যায়। মোবাইল ফোনের ব্যাটারি ও ল্যাপটপের লিথিয়াম আয়ন ব্যবহার হয় বলে এ উৎস থেকে লিথিয়াম সল্ট প্রস্তুত করা সম্ভব।
২০৩০ সালের মধ্যে ই-বর্জ্য খাতে বছরে প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের শিল্প গড়ে তোলা সম্ভব বলে ধারণা করা হয়। ২০১০ সালের আগের এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ই-বর্জ্য উৎপাদিত হয় জাহাজভাঙা শিল্প থেকে। যেসব পুরনো জাহাজ ভাঙার জন্য আনা হয় সেখানে মূলত সেসব দেশের ই-পণ্য বা ইলেকট্রনিক বর্জ্য বিদ্যমান থাকে। জাহাজ ভাঙার সময় এবং তৎপরবর্তী এসব বিষাক্ত ই-বর্জ্য মাটিতে ও পানিতে মিশে চক্রাকারে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে। এইচএসবিসি বৈশ্বিক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ বিশ্বের নবম বৃহত্তম ভোক্তা বাজারে পরিণত হবে, যার বৃহৎ একটি অংশ হবে ইলেকট্রিক পণ্য। বাংলাদেশে বর্তমানে মোবাইল ফোনের গ্রাহকের সংখ্যা প্রায় ১৯ কোটি, সে হিসাবে প্রতিবছর কয়েক কোটি মোবাইল ডিভাইস যুক্ত হচ্ছে ই-বর্জ্যের ভাগাড়ে। বাংলাদেশ সরকারের অর্থায়নে বুয়েট কর্তৃক পরিচালিত ২০১৮ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ২০১৬ ও ২০১৮ সালে বাংলাদেশে ই-বর্জ্যের আনুমানিক পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ১০ হাজার টন ও ৪ লাখ টন এবং প্রতি বছর ই-বর্জ্যের উৎপাদন বৃদ্ধির হার প্রায় ২০ শতাংশ, যা ২০৩৫ সালের মধ্যে পৌঁছাতে পারে ৪৬ লাখ টনে।
অন্য এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশে বর্তমানে বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন টন ই-বর্জ্য তৈরি হয় এবং এসব ই-বর্জ্যের ৮০ শতাংশ আসছে অন্য দেশ থেকে। ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রায় ৩০ লাখ টন ই-বর্জ্য উৎপন্ন হয়, এর মধ্যে মাত্র ৩ শতাংশ রিসাইকেল করা হয়, অবশিষ্ট ই-বর্জ্য ভাগাড়ে নিক্ষেপ করা বা পুড়িয়ে ফেলা হয়। ইলেকট্রনিক পণ্যে এক হাজারের অধিক ধরনের বিষাক্ত বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্য থাকে। বিভিন্ন গবেষণায় ই-বর্জ্যে মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর সিসা, মারকারি, জিংক, ক্রোমিয়াম, ক্যাডমিয়ামসহ বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। পণ্য উৎপাদনসংক্রান্ত এক হিসাবে বলা হয়, ২০৩০ সাল নাগাদ দেশে প্রতি বছর বিলিয়ন ইউনিট স্মার্ট পণ্য উৎপাদিত হবে। এসব পণ্যের ই-বর্জ্যের প্রভাবে পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠবে। ফলে মানুষের শরীরে নানা প্রকার জটিল ও প্রাণঘাতী রোগ ছড়াবে, বিশেষ করে ই-বর্জ্যের কারণে প্রতিবন্ধী শিশুর জন্মহার বৃদ্ধি পাবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্পে নিয়োজিত রয়েছে প্রায় ৬০ হাজারের অধিক শিশু এবং এখানের বিষাক্ত পদার্থের সংস্পর্শে ৮৩ শতাংশের বেশি শিশু প্রতি বছর অসুস্থ হয়ে পড়ে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, ইলেকট্রনিক বর্জ্য যথাযথ প্রক্রিয়ায় রিসাইক্লিং করা না হলে এর সঙ্গে যুক্ত মানুষের গর্ভাবস্থা, কিশোরকাল ও শৈশবকাল কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ ব্যাহত হতে পারে এবং ফুসফুসের গঠনগত বিকাশ ও কার্যকারিতা প্রভাবিত হয়। ই-বর্জ্যের সঠিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে জনসাধারণের মধ্যে সচেতনতার ব্যাপক অভাব রয়েছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা শিল্পে নিয়োজিতদের উচ্চ রক্তচাপ, কিডনি ও ফুসফুসের ক্ষতি, বিষণ্নতা, শ্রবণশক্তি হ্রাস, পঙ্গুত্বসহ বিভিন্ন প্রকার জটিল রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। সুতরাং ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে বাঁচতে এখনই সচেতন হওয়া জরুরি।
বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম ও বন্দরনগরী খ্যাত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন এলাকায় ই-বর্জ্যের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনায় এখনো কোনো ধরনের আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। ই-বর্জ্যের পরিবেশসম্মত ব্যবস্থাপনা বলতে বোঝায় ই-বর্জ্য সংগ্রহ, পরিবহন, পুনঃপ্রক্রিয়াজাত, পুনর্ব্যবহার এবং পরিত্যাজন বা ধ্বংসকরণের সমন্বিত প্রক্রিয়া, যা পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যকে ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে রক্ষা করে। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের হিসাবে চট্টগ্রাম নগরীতে দৈনিক প্রায় ২১০০ থেকে ২৫০০ টন বর্জ্য উৎপন্ন হয়। সাধারণ গৃহস্থালি বর্জ্যের সঙ্গে হাসপাতাল, শিল্প-কারখানা ও ইলেকট্রনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চলছে গতানুগতিক ও সনাতন পদ্ধতিতে। চট্টগ্রাম শহরের ইলেকট্রনিক বর্জ্য মূলত সিডিএ মার্কেট, কদমতলী, ভাটিয়ারী, আইস ফ্যাক্টরি রোড ও কাক্রি মার্কেট এবং নগরীর বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিদ্যমান আইন ও নিরাপত্তাসামগ্রী ব্যতীত রিসাইক্লিং করা হচ্ছে। যা নগর পরিবেশের স্বাভাবিক পরিবেশের অবক্ষয়ের জন্য অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে সর্বত্র ইলেকট্রনিক যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে কিন্তু পর্যাপ্ত রিসাইকেলের ব্যবস্থাপনা না থাকায় যত্রতত্র ই-বর্জ্য নিক্ষেপ করা হচ্ছে। বাংলাদেশ সরকার ই-বর্জ্যের ক্ষতিকর দিক ও গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ই-বর্জ্যের ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নিয়েছে। ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগগুলোর মধ্যে রয়েছে ই-বর্জ্যের সঠিক নিষ্পত্তি ও পুনর্ব্যবহারের জন্য নির্দেশিকা। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫-এর ধারা ২০-এ প্রদত্ত ক্ষমতাবলে ‘ঝুঁকিপূর্ণ বর্জ্য (ই-বর্জ্য) ব্যবস্থাপনা’ বিধিমালা ২০২১ প্রণয়ন করে। এ বিধিমালা অনুযায়ী, ই-বর্জ্য সংগ্রহ কেন্দ্রের দায়িত্ব হলো পরিবেশসম্মতভাবে ই-বর্জ্য সংগ্রহ করা; প্রস্তুতকারক, মেরামতকারী, চূর্ণকারীর কাছে পাঠানোর আগে সংগৃহীত ই-বর্জ্য পরিবেশসম্মত উপায়ে নিরাপদে সংরক্ষণ করা এবং ই-বর্জ্যের নিরাপদ পরিবহন নিশ্চিত করা। কিন্তু এ বিধিমালার যথাযথ প্রয়োগ সম্ভব হচ্ছে না বলে আমাদের প্রতিনিয়ত পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এ সমস্যা থেকে উত্তরণে, মানুষের জীবনে ই-বর্জ্যের প্রভাব, ই-বর্জ্যের পুনর্ব্যবহার ও সঠিক পদ্ধতিতে ব্যবস্থাপনাসহ সচেতনতা বাড়াতে হবে। ই-বর্জ্য কমানোর জন্য উদ্যোগ প্রয়োজন, অর্থাৎ সহজে যাতে ইলেকট্রনিক পণ্য বর্জ্যে পরিণত না হয় সেদিকে নজর দিতে হবে। ইলেকট্রনিক পণ্য উৎপাদনকারীদের টেকসই ও পরিবেশসম্মত পণ্য উৎপাদনে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সঙ্গে ই-বর্জ্যের ক্রমবর্ধমান সমস্যা চিহ্নত করে যথাযথ ব্যবস্থাপনার লক্ষ্যে ব্যাপক প্রচার এবং বাস্তব আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা জরুরি। ই-বর্জ্যের সমস্যা নিরসনে স্কুলের পাঠ্যসূচিতে এ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করে সবার অংশগ্রহণ প্রয়োজন। সর্বোপরি দেশব্যাপী ব্যাপক আকারে টেকসই ই-বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে তুলতে সবার সম্মিলিত অংশগ্রহণ প্রয়োজন।
ড. মো. ইকবাল সরোয়ার: অধ্যাপক, ভূগোল ও পরিবেশবিদ্যা বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়