অভিমত

গতানুগতিক কৃষি ঋণ নীতিমালার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি (২৭.১২.২০২২) প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র কৃষি পরিবারের সংখ্যা ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ, মাঝারি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও বড় কৃষি পরিবারের সংখ্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। আর এ ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারই হলো কৃষির চালিকাশক্তি। এসব কৃষক কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে ফলন বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সম্প্রতি (২৭.১২.২০২২) প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায়, বর্তমানে দেশে ক্ষুদ্র কৃষি পরিবারের সংখ্যা ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ, মাঝারি ৭ দশমিক ৭ শতাংশ ও বড় কৃষি পরিবারের সংখ্যা মাত্র শূন্য দশমিক ৬ শতাংশ। আর এ ৯১ দশমিক ৭ শতাংশ ক্ষুদ্র কৃষক পরিবারই হলো কৃষির চালিকাশক্তি। এসব কৃষক কৃষির আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগে ফলন বৃদ্ধিতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। বিশুদ্ধ বীজ, সেচ, সুষম মাত্রায় সার প্রয়োগ, সমন্বিত বালাই ব্যবস্থাপনা, নিরাপদ শাকসবজি ও ফলমূল উৎপাদন এবং বিদেশে কৃষিপণ্য রফতানিকাজে রয়েছে তাদের উল্লেখযোগ্য অবদান। অথচ তারা কৃষি ঋণের সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাহলে কীভাবে হবে কৃষির টেকসই উন্নয়ন?

আন্তর্জাতিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইফপ্রি) বলছে, এনজিও, আত্মীয়স্বজন, বেসরকারি ব্যাংক ও দাদন ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন বেসরকারি উৎস থেকে কৃষক ৮১ শতাংশের বেশি ঋণ গ্রহণ করেন। এসব ঋণের সুদ ১৯-৬৩ শতাংশ। আর সরকারের কৃষি ব্যাংক ৯ শতাংশ সুদে যে কৃষি ঋণ দেয়, তার পরিমাণ মাত্র ৬ শতাংশ। এ থেকেই বোঝা যায় দেশের সিংহভাগ কৃষক সরকারি বিশেষায়িত ও বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো থেকে ফসল চাষের জন্য প্রয়োজনীয় কৃষি ঋণ পান না।

এসব কারণে কৃষকের দরজায় ঋণ নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্যাংক। প্রতিটি ব্যাংকের শাখায় চালু করা হবে কৃষি ঋণ বুথ। এনজিওর মাধ্যমে ঋণ বিতরণ কমাতে হবে। চলমান পরিস্থিতি বিবেচনা করে খাদ্য উৎপাদন বাড়াতে এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে সরকার। সরকারের এ সিদ্ধান্তকে আমরা স্বাগত জানাই। চিনিকলে কৃষকের মধ্যে উপকরণ ও নগদ টাকা হিসেবে যে ঋণ বিতরণ করা হয়, তা আখ উন্নয়ন কর্মীরা (সিডিএ) কৃষকের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পৌঁছে দেন। সিডিএরা শুধু ঋণই দেন না, কৃষককে আখ চাষের আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শিখিয়ে দেন। আখ বিক্রির জন্য প্রয়োজনীয় অনুমতিপত্র (পুর্জি) প্রদানের ক্ষেত্রেও মুখ্য ভূমিকা পালন করেন। ফলে প্রতিটি চিনিকলেই এখন শতভাগ কৃষি ঋণ আদায় হয়।

প্রান্তিক পর্যায়ে দরিদ্র কৃষকের মাঝে কৃষি ও পল্লী ঋণ সহজ করতে ব্যাংক ও কৃষকের মধ্যে দূরত্ব কমিয়ে আনতে করণীয় নির্ধারণে সম্প্রতি কৃষি মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে অনুষ্ঠিত সভা থেকে জানা যায়, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তায় সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়েছে সরকার। বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে বেশি সুদে ঋণ বিতরণ কমিয়ে ব্যাংকগুলোকে সরাসরি ঋণ নিয়ে কৃষকের দরজায় যেতে বলা হয়েছে। সহজে কৃষকের কাছে ঋণ পৌঁছানো নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সরকার ঋণ বিতরণে এনজিওগুলোর অংশগ্রহণ কমানোর জন্য বেশকিছু নির্দেশনা দিয়েছে। 

বেশির ভাগ বেসরকারি ব্যাংক সরাসরি কৃষি ঋণ বিতরণ করে না, বরং বিতরণে বেসরকারি সংস্থাকে নিয়োগ করে। এনজিওর মাধ্যমে বিতরণ করা ঋণের সুদ ২৪ শতাংশ পর্যন্ত। ব্যাংকগুলো বিতরণ করছে ৮ শতাংশ সুদে। বর্তমানে বেসরকারি ব্যাংকগুলো তাদের কৃষি ঋণের ৭০ শতাংশ বিতরণ করে এনজিওর মাধ্যমে।

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বলা হয়, যত দ্রুত সম্ভব এনজিওগুলোর ঋণ বিতরণের হার ৩০ শতাংশে নামিয়ে আনতে হবে। কারণ যখনই এনজিওগুলো ঋণ বিতরণ করে, তখই সুদের হার বেড়ে যায়। এনজিওগুলোর সুদের হার কমাতে বাংলাদেশ ব্যাংককে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে বৈঠকে। দেশের সব ব্যাংক শাখায় একটি কৃষি ঋণ বুথ খুলতে বলা হয়; যাতে কৃষক বুঝতে পারেন কোথায় যেতে হবে ঋণের জন্য? সভায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলোকে জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কৃষি ঋণ মেলার আয়োজন করতে বলা হয়, যেখানে ব্যাংকার ও কৃষক অংশ নেবেন। কারণ কৃষক নানা কাজে মাঠে ব্যস্ত থাকেন এবং ব্যাংকে যাওয়ার জন্য তাদের সময় নেই বললেই চলে। মেলায় অংশ নেয়া ব্যাংকগুলো কৃষকের মাঝে তাৎক্ষণিক আবেদনপত্র বিতরণ ও গ্রহণ এবং ঋণ অনুমোদন করবে। এছাড়া সভায় কৃষি, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ বিভাগকে প্রতিটি উপজেলার কৃষকের তালিকা তৈরি করতে নির্দেশ দেয়া হয়। যাদের ঋণ প্রয়োজন, উপজেলা খামার-ঋণ কমিটি তাদের তালিকা তৈরি করে ব্যাংকগুলোকে দেবে। এরপর ব্যাংক কর্মকর্তারা কৃষকের বাড়ি গিয়ে ঋণ বিতরণ করবেন। কৃষি ঋণ বিষয়ে কৃষি বিভাগ কৃষকের জন্য যেসব প্রশিক্ষণ কর্মসূচির আয়োজন করে, সেখানে ব্যাংকারদের আমন্ত্রণ জানাতে হবে, যাতে ব্যাংকাররা সেখানে বসে ঋণের আবেদনপত্র বিতরণ এবং ঋণ অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু করতে পারেন। কৃষিঋণ নীতিমালা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলোকে মোট ঋণের ২ দশমিক ১০ শতাংশ কৃষি খাতে বিতরণ করতে হবে। এর মধ্যে ৬০ শতাংশ ফসল, ১০ শতাংশ মাছ চাষ, ১০ শতাংশ পশুসম্পদ এবং ২০ শতাংশ অন্যান্য কৃষি, কৃষি উপখাতে বিতরণ করতে হবে। বাংলাদেশ ব্যাংক চলতি অর্থবছরে ৩০ হাজার ৯১১ কোটি টাকা কৃষি ঋণ বিতরণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, যা গত অর্থবছরে ছিল ২৮ হাজার ৩৯১ কোটি টাকা। তবে ব্যাংকগুলো বিতরণ করেছিল ২৮ হাজার ৮৩৪ কোটি টাকা।

‘পদকজয়ী সেই কৃষকেরা এখন নিঃস্ব’ (প্রথম আলো, ১১ নভেম্বর, ২০২২) শিরোনামে দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে সম্প্রতি প্রকাশিত খবরে কৃষক ও কৃষিসংশ্লিষ্টদের মনে কৃষি ঋণ নিয়ে একধরনের আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। প্রশ্ন জেগেছে যে কৃষক করোনার ভয়াবহ সময়ে মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে ফসল ফলিয়ে আমাদের জীবন বাঁচিয়েছেন, তারা সামান্য ঋণের দায়ে জেলে যাবেন কেন? কেন তাদের কোমরে রশি পরানো হবে? আর যারা তথাকথিত ব্যবসার নামে ব্যাংক থেকে কোটি কোটি টাকা ঋণ গ্রহণ করে খেলাপি হয়ে বুক ফুলিয়ে বাংলার সবুজ প্রান্তরে ঘুরে বেড়ান, তাদের নামে কেন মামলা হবে না, বিষয়টি মোটেও বোধগম্য নয়। 

দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটে পাবনার ঈশ্বরদী উপজেলায়। ছিদ্দিকুর রহমান ওরফে ‘কুল ময়েজ’ নামে পরিচিতি স্বশিক্ষিত এ কৃষক বিশেষ কৌশল প্রয়োগ করে কুলের পরাগায়ন বাড়িয়ে ফলন বাড়াতে সক্ষম হন। তার উদ্ভাবিত প্রযুক্তিটি সারা দেশে কুলচাষীদের মধ্যে ব্যাপক সাড়া ফেলে। এজন্য তিনি ২০১০ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পান। সেই ময়েজ উদ্দিন এখন ঋণের দায়ে সর্বস্ব হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। নিজের কেনা জমি ও ঘরবাড়ি ব্যাংকের কাছে দায়বদ্ধ। ঋণখেলাপির মামলায় তার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হয়েছে। জাতীয় পদক পাওয়া নিঃস্ব হওয়া কৃষকের মধ্যে আরো আছেন আব্দুল জলিল ওরফে কিতার ম্লল। যিনি ‘লিচু কিতাব’ নামেই বেশি পরিচিত। জাহিদুল ইসলাম ‘গাজর জাহিদ’ এবং হাবিবুর রহমানের নামটিও ‘মাছ হাবিব’ নামে পরিচিত। এসব কৃষক নিজেদের চেষ্টা, মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় পদকে ভূষিত হন। অতি অল্প সময়ে ধনী হওয়ার নেশায় তারা ব্যাংক থেকে বড় অংকের ঋণ গ্রহণ করেন। কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা ও প্রশিক্ষণ ছাড়াই ঋণের টাকায় গো-খামার করেন কেউ কেউ। কৃষি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ব্যাংক থেকে ২-৫ কোটি টাকা ঋণ প্রদানকালে এসব কৃষকের খামার ব্যবস্থাপনার সক্ষমতা ও কোনো প্রশিক্ষণ ছিল কিনা তা বিবেচনা করা হয়নি। ঝুঁকি নিরসনের ব্যবস্থা হিসেবে কৃষি বীমাও ছিল না এসব কৃষকের। ঈশ্বরদীতে কৃষিতে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য জাতীয় পুরস্কার পান ১৫ জন কৃষক। বিপাকে পড়া চারজন কৃষকের একজন ঋণখেলাপি কৃষক কিতাব আলী ম্লল সফল লিচুচাষী ছিলেন। ২০০৯ সালে সফল লিচুচাষী হিসেবে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পদক পান আব্দুল জলিল ওরফে কিতাব ম্লল। এখন তার লিচুবাগান নিলামে উঠেছে। তিনি ২০১০ সালে ২০০ গরুর খামারের জন্য অগ্রণী ব্যাংক থেকে ৭৫ লাখ টাকা ঋণ গ্রহণ করে সময়মতো পরিশোধ না করে মহাবিপদে পড়েছেন। ভারইমারী গ্রামের জাহিদুল ইসলাম ২০১৩ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার পান। গাজর চাষের মুনাফা থেকে তিনি ৩০ বিঘা জমি কেনেন। সে জমিতে গরুর খামার করেন। খামারে ১৭৫টি গরু ছিল। খামারের জন্য ২০১২ সালে তিনি ৫ কোটি টাকা ব্যাংক থেকে ঋণ নেন। জাহিদুল দুধের ভালো দাম না পাওয়ায় খামারের আয় দিয়ে ঋণ শোধ করতে পারেননি। খেলাপি হওয়া ও চেক প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় ব্যাংক মোট আটটি মামলা করে তার বিরুদ্ধে। এখন ঢাকায় মামলার হাজিরা দিতেই তার অধিকাংশ সময় কাটে।

মুলাডুলির হাবিবুর রহমানের বাড়িঘর, খামার সব নিলামে উঠেছে। ১১টি মামলা তার নামে চলমান। তিনি ২০১০ সালে জাতীয় মৎস্য পুরস্কার ও ২০১১ সালে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার অর্জন করেন। খামারে ২০০ গরু ছিল, ৫০ বিঘা আয়তনের পুকুরে মাছ ও পাঁচ হাজার মুরগি ছিল। ২০১২ সালে তিনি ঋণে জড়িয়ে পড়েন। খেলাপি হিসেবে ২০২১ সালে ব্যাংক তার বিরুদ্ধে মামলা করে। তার সম্পদও এখন নিলামে উঠেছে। অগ্রণী ব্যাংকের ঢাকা প্রিন্সিপাল অফিস থেকে ময়েজ উদ্দিন ও কিতাব ম্লল ঋণ গ্রহণ করেন। আর হাবিবুর রহমান ও জাহিদুর ইসলাম মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ঈশ্বরদী শাখা থেকে ঋণ গ্রহণ করেন। ব্যাংক কর্তৃপক্ষের অভিযোগ, তারা ঋণ নিয়ে যথাযথ ব্যবহার করেননি। 

আমাদের কথা: গতানুগতিক কৃষি ঋণ ব্যবস্থার মাধ্যমে আর যাই হোক টেকসই কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। এর আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। কৃষি মৎস্য ও পশুপালন খাতে ঋণের সঙ্গে প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। বিনিয়োগকারীকে দিতে হবে প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ। সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে বিনিয়োগকারীর থাকতে হবে পূর্ব অভিজ্ঞতা। এছাড়া উৎপাদিত পণ্যের সুষ্ঠু বাজারজাতের ব্যবস্থাও থাকতে হবে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে কৃষককে বাঁচানোর জন্য থাকতে হবে কৃষি বীমার ব্যবস্থা। এসব ছাড়া কৃষি ঋণ বিতরণ একেবারেই অর্থহীন। তাই দেশের প্রখ্যাত কৃষিবিদ, কৃষি গবেষক, কৃষি সম্প্রসারণ কর্মী, ব্যাংকার, কৃষি অর্থনীতিবিদ, কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিনিধি ও কৃষক নেতাদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় কমিটি গঠন এবং সেই কমিটির সুপারিশের আলোকে বিদ্যমান গতানুগতিক কৃষি ঋণ নীতিমালার আমূল পরিবর্তন প্রয়োজন। 

নিতাই চন্দ্র রায়: সাবেক মহাব্যবস্থাপক (কৃষি)

বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশন

আরও