দেশে জ্বালানির চাহিদা যেমন বেড়েছে, তেমনি দিন দিন ঘাটতির পরিমাণও বেড়েছে। ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে অভ্যন্তরীণ কূপ অনুসন্ধানের পথে না হেঁটে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন পেট্রোবাংলা গ্যাস আমদানির দিকে ঝুঁকে পড়ে। ২০১৮-১৯ অর্থবছর থেকে শুরু হয় গ্যাস আমদানি। যদিও দেশের গ্যাস খাতের উন্নয়নে ২০১৭ সালে প্রণীত মহাপরিকল্পনায় উল্লেখ করা হয়েছিল, ২০২১ থেকে ২০৩০ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর বাংলাদেশের চাহিদা পূরণে গ্যাস আমদানিতে ব্যয় হবে ৩০০ কোটি ডলারের বেশি। এ পরিকল্পনা ডেনমার্কের প্রকৌশল ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠান র্যাম্বলকে দিয়ে করানো হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটির সুপারিশ ছিল, আন্তর্জাতিক জ্বালানি কোম্পানির বিনিয়োগের অপেক্ষায় না থেকে আমদানি ব্যয়ের অর্থ স্থানীয় পর্যায়ে গ্যাস অনুসন্ধান-উন্নয়নে কাজে লাগানো হলে প্রত্যাশিত মাত্রায় সুফল মিলবে। কিন্তু গ্যাস খাতের মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়নে র্যাম্বলের করা ওই সুপারিশ উপেক্ষিত রয়ে যায়। বিশেষ করে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত গ্যাসের ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রায় আমদানিনির্ভরতা তৈরি হয়। গত দেড় দশকে অনুসন্ধান কার্যক্রমে গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কৃত হয়েছে ছয়টি, যেগুলোর সবই স্থলভাগে। এসব গ্যাস ক্ষেত্রের মজুদ সব মিলিয়ে প্রায় এক ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট (টিসিএফ)। এ দেড় দশকে শিল্প ও বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ নানা খাতে গ্যাসের চাহিদা ব্যাপক বাড়লেও পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করা যায়নি। আমদানি করে গ্যাস সরবরাহ সামাল দেয়ার চেষ্টা হলেও ডলার সংকট নতুন করে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। সব মিলিয়ে গ্যাস সংকট তীব্র হতে থাকে, যার সবচেয়ে নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিদ্যুৎ খাতে।
একসময় দেশের বিদ্যুতের ৮০ শতাংশ উৎপাদন হতো প্রাকৃতিক গ্যাস থেকে, বর্তমানে তা প্রায় অর্ধেকের কাছাকাছি নেমেছে। এ অবনমনের জন্য দায়ী দেশীয় গ্যাস উত্তোলন বাড়ানো এবং নতুন গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানে পর্যাপ্ত উদ্যোগের অভাব। গত ১০ বছরে বড় কোনো মজুদ আবিষ্কার করা যায়নি। উল্টো নতুন গ্যাস ক্ষেত্র আবিষ্কার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনও করা হয়েছে আমদানিনির্ভর। সব মিলিয়ে এক ধরনের মুখ থুবড়ে পড়েছে দেশের জ্বালানি ব্যবস্থা। এদিকে কারিগরি ত্রুটির কারণে আদানি গ্রুপের কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এতে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে। আশঙ্কা রয়েছে আদানির বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরবরাহ শুরু না হলে লোডশেডিং আরো বাড়তে পারে। জানা গেছে, এরই মধ্যে বিদ্যুতের এ ঘাটতি মেটাতে পেট্রোবাংলার কাছে বাড়তি গ্যাস সরবরাহ চেয়েছে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি)।
এমন প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে গ্যাসের দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধির তাৎক্ষণিক সমাধান হিসেবে স্থলভাগে (অনশোর) গ্যাস অনুসন্ধানের যে প্রস্তুতি নিচ্ছে পেট্রোবাংলা তা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা অতীব জরুরি। বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, দুর্গম পাহাড়ি অঞ্চল থেকে এ কার্যক্রম শুরু হতে পারে বলে মনে করছেন পেট্রোবাংলাসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। সাগরে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তার চেয়ে কম সময়ে স্থলভাগের অনুসন্ধান কার্যক্রম সম্পন্ন করা সম্ভব বলে মনে করছে পেট্রোবাংলা। গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম চালাতে দ্বিমাত্রিক জরিপের ভিত্তিতে উচ্চ সম্ভাবনাময়, মাঝারি সম্ভাবনাময় ও ন্যূনতম সম্ভাবনাময়—এ তিন ক্যাটাগরিতে ব্লকগুলো ভাগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক দরপত্রে দেশীয় অনুসন্ধান কোম্পানিগুলোর অংশ নেয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে অনশোর উৎপাদন বণ্টন চুক্তিতে (পিএসসি)। এক্ষেত্রে কোম্পানিগুলোর টেকনিক্যাল, ফাইন্যান্সিয়াল ও মানবসম্পদের দক্ষতার ওপর ভিত্তি করে কাজ পাওয়ার সুযোগ রাখা হচ্ছে। বিশেষজ্ঞদের মত, স্থানীয় গ্যাসের উৎপাদন বাড়াতে স্থলভাগে বড় আকারে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের বিকল্প নেই। তাদের সুপারিশ, অনশোর পিএসসি এমনভাবে করা হোক, যেখানে দেশী-বিদেশী সব কোম্পানি কাজ করতে আগ্রহী হয়। দেশে গ্যাসের তীব্র সংকট বিরাজ করায় গ্রিডে দ্রুত গ্যাস প্রয়োজন। বরং এ পরিস্থিতি বিবেচনায় এককভাবে শুধু স্থানীয় কোম্পানি নয়, বিদেশী অনেক কোম্পানিও বাপেক্সের সঙ্গে যৌথভাবে এমনকি ঠিকাদার হিসেবে কাজ করতে পারে।
পেট্রোবাংলার তথ্যও বলছে, দেশের স্থলভাগে মোট ২২টি ব্লক রয়েছে। এর মধ্যে ১১টিতে এখনো কোনো অনুসন্ধান চালানো হয়নি। খালি থাকা ব্লকগুলো হচ্ছে ১, ২এ, ২বি, ৩এ, ৪এ, ৪বি, ৫, ৬এ, ২২এ, ২২বি ও ২৩ নম্বর। অর্থাৎ স্থলভাগে অনেক এলাকা এখনো অনাবিষ্কৃত রয়ে গেছে, যেসব এলাকায় গ্যাস পাওয়ার প্রবল সম্ভাবনা রয়েছে। এরই মধ্যে এসব ব্লকে কাজ করতে যোগ্যতম বিদেশী কোম্পানির সঙ্গে যৌথ কোম্পানি গঠন করে দরপত্রে অংশ নেয়ার সুযোগ তৈরি করছে পেট্রোবাংলা। তবে এক্ষেত্রে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও ভূতত্ত্ববিদদের অভিমত, অনশোর পিএসসি পরিমার্জন করে যদি বিদেশী কোম্পানি আনা যায় তাহলে দ্রুত গ্যাস পাওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পিএসসি আকর্ষণীয় হলে ভালো কোম্পানি পাওয়া যেতে পারে। তবে একই সঙ্গে নিজস্ব মুনাফার হিস্যাটাও বুঝে নেয়া প্রয়োজন, যাতে দেশের স্বার্থ সুরক্ষিত থাকে।
তাছাড়া ১৯৯৭ সালের পর স্থলভাগের তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে পিএসসি আর হালনাগাদ করা হয়নি। এই পিএসসি হালনাগাদ করতে গত ২২ ডিসেম্বর উড ম্যাকেঞ্জিকে নিয়োগ দেয়া হয়। সেই হিসাবে দীর্ঘ ২৭ বছর পর অনশোর পিএসসি হালনাগাদ করার উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সরকারের এ উদ্যোগ কার্যকর করতে তাই পিএসসি যথাযথভাবে হালনাগাদ হওয়া প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বহু আগে থেকে বলে আসছেন, আমদানিনির্ভর জ্বালানি খাত গড়ে তোলা হলে দেশের জ্বালানি নিরাপত্তা হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। সেটিই ঘটেছে মূলত দেশের জ্বালানি খাতে। টেকসই ও নিরাপদ জ্বালানি খাত গড়ে তুলতে হলে আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে আনার বিকল্প নেই। দেরিতে হলেও পেট্রোবাংলার প্রস্তুতিকে সাধুবাদ জানাতে হয়। তবে গ্যাস উত্তোলনে কূপ খননের গুরুদায়িত্ব সক্ষমতা বিচারে বণ্টন করা হবে এ প্রত্যাশা রয়েছে। নয়তো কার্যকর ফলাফল পাওয়া যাবে না। এ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার ঘাটতি থাকলে আগের মতো ব্যর্থতা কেবল পুনরাবৃত্তিই ঘটাবে। স্থানীয়ভাবে গ্যাস উত্তোলন বাড়বে না, গ্যাসের ঘাটতিও নিকট ভবিষ্যতে কমবে না।