গত সপ্তাহে বহিঃস্থ সদস্য হিসেবে একটি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে একাডেমিক কার্যক্রমে অংশ নিতে গিয়েছিলাম। সভা শেষে ভিসি মহোদয়ের কক্ষে আড্ডা দিচ্ছিলাম কয়েকজন। আমাদের তিন-চারজনের আড্ডায় অন্য আরেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন উপাচার্যও ছিলেন। তারা বর্তমান রেজিমের আস্থাভাজন বলেই হয়তো এ পদে বহাল হয়েছেন। দেখলাম তাদেরও মনঃকষ্ট আছে। দুই উপাচার্যই আমার জানামতে সজ্জন ও মেধাবী মানুষ। অতীতে শিক্ষক রাজনীতিতে তারা আওয়ামীপন্থীদের ধারেকাছেও ছিলেন না। তার পরেও কথা প্রসঙ্গে একজন বললেন, ‘জুলাই আন্দোলনের পর ছাত্রদের মধ্যে যৌক্তিক বিবেচনা অনেকটা কমে গেছে। শুধু বিশ্ববিদ্যালয় বলে নয়, সর্বত্রই। যেকোনো বিষয়ে দাবি তোলা এবং দাবি আদায়ের জন্য যেন বেপরোয়া হয়ে ওঠা এখন নৈমিত্তিক হয়ে উঠেছে। হয়তো এর মনস্তাত্ত্বিক কারণ থাকতে পারে। ওরা ভাবতে পারে অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি শক্তিশালী রেজিমের পতন ঘটাতে পেরেছে, সুতরাং ওদের ক্ষমতা অপ্রতিরোধ্য। তাই মতের মিল না হলে আমরাও যখন তখন ‘স্বৈরাচারের দোসর’ অভিধা পেয়ে যাই। মব সংঘটিত করার এটি একটি বড় অস্ত্র এখন।’
আমার পরিচিত একজন শিল্পপতি বলছিলেন, একেবারে রাজনীতিতে জড়িত থাকা অল্পসংখ্যক ব্যবসায়ী ছাড়া ব্যবসায়ী এবং ধনিক শ্রেণী সাধারণত নির্দিষ্ট কোনো রাজনৈতিক দলের চিহ্নিত অনুগত হতে চান না। সব সরকারের আস্থাভাজন থাকতে চান। যাতে নিজের ব্যবসায়ের ক্ষতি না হয়। তাই ব্যবসায়ীরা সব সরকারের রাজনৈতিক দলগুলোকেই চাঁদা দিয়ে থাকেন। আমার পরিচিত এই শিল্পপতি বললেন এখনকার শক্তিমানদেরও চাঁদা দিতে হচ্ছে। তবে দেশের মুদ্রাস্ফীতির মতো চাঁদার রেটও বেড়ে গেছে। এখন ভয় বেশি। কারণ কখন আমার বা আমার প্রতিষ্ঠানের প্রতি নারাজ হয়, আর ‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে মব সৃষ্টি করে ভাংচুর চালায় বা প্রতিষ্ঠানে আগুন লাগিয়ে দেয় সেই ভয়ে থাকতে হয়। অন্যায় জেনেও অনেক কিছু মেনে নিতে হয় আমাদের।
বর্তমান সরকারের আস্থাভাজন আমার এক সাংবাদিক বন্ধু আছেন। ১১ মার্চ নবগঠিত রাজনৈতিক দলের আয়োজিত ইফতার পার্টির নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হোটেল শেরাটনে যাচ্ছিলেন। আমি বললাম, ওরা এত বিশাল খরচ করতে পারছে কীভাবে? বন্ধু বললেন, ওদের কিছু করতে হয় না। ‘স্বৈরাচারের দোসর’ ট্যাগ থেকে বাঁচতে অনেকেই আছেন যারা এ রকম আয়োজনের স্পন্সর হতে নিজেরাই এগিয়ে আসেন।
আমার মনে পড়ল আইয়ুব খানের আমলের একজন ইউনিয়ন বোর্ডের প্রেসিডেন্টের কথা। আব্বার কাছে গল্প শুনেছি। তিনি আমার আব্বার মামা। সেই সূত্রে আমার দাদা। ছেলেবেলায় তাকে প্রেসিডেন্ট দাদা বলে ডাকতাম। তার প্রকৃত নাম আমরা কখনো জানার চেষ্টা করিনি। আইয়ুব খানের মৌলিক গণতন্ত্রের আশ্রয়ে তারা প্রেসিডেন্ট (এখনকার ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান), মেম্বার হতেন। সে যুগটায় রাজনীতিবিদদের স্পন্সর করার এত মানুষ ছিল না। নিজগুণেই তারা মানুষের সমর্থন পেতেন। আমার প্রেসিডেন্ট দাদা নাকি আমৃত্যু প্রেসিডেন্ট ছিল। নির্বাচনে তার প্রতিপক্ষ হিসেবে কাউকে পাওয়া যেত না। দাদার অনেক ভূসম্পত্তি ছিল। জনকল্যাণ করতে করতে প্রায় নিঃস্ব হয়ে পড়েছিলেন। দাদার মৃত্যুর পর অর্থ সংকটে পড়েছিলেন আমার চাচারা। আত্মীয়-স্বজনদের সহযোগিতায় তাদের টিকে থাকতে হয়েছিল। রাজনীতিটা ওই রকমই ছিল তখন।
সময় এবং বাস্তবতায় মানুষের চিন্তারও পরিবর্তন হয়। ২০১১ সালে প্রকাশিত আমার লেখা একটি বই রয়েছে—‘সমাজ-রাজনীতির এক দশক’। এখানে ২০০০ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত আমার বেশ কয়েকটি নির্বাচিত কলাম রয়েছে। আজকের এ কলাম লেখার আগে বইটি উল্টাচ্ছিলাম সেই সময়টাকে বোঝার জন্য। একটি লেখায় দৃষ্টি নিবদ্ধ হলো। নিবন্ধটি ২৩ জানুয়ারি ২০০৭-এ দৈনিক জনকণ্ঠে ছাপা হয়েছিল। দেখলাম সে বছর ১৬ জানুয়ারি আজকে আমাদের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মো. ইউনূস বার্তা সংস্থা এএফপিকে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘এদেশের রাজনীতিকরা কেবল অর্থের জন্য রাজনীতি করেন।’ সেসময় এ বক্তব্যের বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেছিলেন রাজনীতিবিদ অনেকে। কিন্তু আমাদের মতো মানুষ যারা চলমান রাজনীতি থেকে শত হাত দূরে থাকি তাদের কাছে অধ্যাপক ইউনূসের এ বক্তব্য তাৎপর্যপূর্ণ বলে মনে হয়েছিল। এর প্রমাণও কি আমরা পাইনি! এক-এগারোর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আমরা কি দেখিনি ক্ষমতায় থাকা বিএনপি নেতারা কতটা দুর্নীতির পাহাড় গড়েছিলেন। এরশাদ সরকারের জাতীয় পার্টির অনেক নেতার বিরুদ্ধেও কি দুর্নীতির কেচ্ছা প্রচার পায়নি! আর আওয়ামী লীগের ১৬ বছরের টানা শাসনকালে আওয়ামী লীগ নেতারা কি দুর্নীতির রেকর্ড গড়েননি! চাঁদাবাজি, লুণ্ঠন ও দখলদারত্বের রামরাজত্ব তৈরি হয়েছিল। তাহলে মানতে হবে বর্তমান কালেও এ দেশের রাজনীতির সঙ্গে অন্যায়ভাবে টাকা কামানোর নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। শ্রদ্ধেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূস ২০০৭ সালে অরাজনৈতিক অবস্থানে দাঁড়িয়ে অমোঘ সত্যই উচ্চারণ করেছিলেন। অবশ্য ২০২৫ সালে তার চিন্তা-ভাবনা অভিন্ন আছে কিনা আমরা বলতে পারব না।
২০২৪-এর জুলাই অভ্যুত্থান খুব তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আওয়ামী লীগ ও এর সরকার জগদ্দল পাথরের মতো বসেছিল। দলটির গণতন্ত্রহীন আচরণ ও সন্ত্রাস-দুর্নীতির লাগামহীন চর্চা এবং কঠোর দলীয়করণ নীতির কারণে অনেকেই ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিলেন। কিন্তু কোনো পথ দেখা যাচ্ছিল না এ আধিপত্যবাদী দাপুটেদের হাত থেকে নিষ্কৃতি মিলবে কীভাবে! কিন্তু এ প্রায় অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছিল ছাত্র-জনতা। সফল গণ-অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ সরকারের বিদায় ঘটিয়েছিল।
এ বাস্তবতায় দেশবাসীর মধ্যে তৈরি হয়েছিল নতুন আকাঙ্ক্ষা। প্রত্যাশা ছিল বিপ্লবী ছাত্ররা সতর্ক পাহারাদার হবে এবার। তারা পচে যাওয়া রাজনীতিবিদদের মতো হবে না। তাদের মধ্যে রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ দেখা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর পাশাপাশি নতুন অন্তর্বর্তী সরকার যাতে পথভ্রষ্ট না হয়ে পড়ে এর জন্য প্রেসার গ্রুপ হিসেবে সদা সতর্ক থাকবে। কিন্তু আশার আলো নিভে যেতে থাকল তখনই যখন সরকারের অংশ হতে থাকলেন কোনো কোনো ছাত্রনেতা। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ প্রকাশ পেতে থাকল পুরনো ঢঙেই। তবুও মনে করি নষ্ট রাজনীতির অচলায়তন ভেঙে যদি রাজনীতির আকাশে নতুন আলো ছড়ায় তবে নতুন আশাবাদ তৈরি হবে। মুক্তগণতন্ত্রের মধ্য দিয়ে যদি সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে এ নতুন রাজনীতি জনগণের মনে ঠাঁই পায় তবে এর চেয়ে ভালো কিছু হতে পারে না। কিন্তু তেমন আশাবাদ কি তৈরি হচ্ছে?
‘স্বৈরাচারের দোসর’ বলে সুবিধাবাদী ধমক এখনো যত্রতত্র শোনা যাচ্ছে। অভ্যুত্থান-উত্তর দুই-তিন মাস এ শব্দযুগল জনমনে যে দ্যোতনা তৈরি করেছিল এখন কি একই ছন্দ তৈরি করে! প্রথম দিকে ‘স্বৈরাচারী’ আর ‘ফ্যাসিবাদী’ শব্দ দুটি যথার্থই আওয়ামী লীগ ও এর নেতা নেত্রীদের ওপর সীলমোহরের মত ছাপ পড়েছিল। কিন্তু ক্রমাগত উচ্চারণ ও যত্রতত্র প্রয়োগ হতে থাকায় শব্দগুলো এখন অপপ্রয়োগ দোষে দুষ্ট হয়ে পড়ছে। শব্দ দুটির অর্থ, সংজ্ঞা ও তাৎপর্য এখন খুঁজছে মানুষ। তারা দেখছে, এখন অচরণে অনেকেই স্বৈরাচারী ও ফ্যাসিবাদী হয়ে উঠছে। আওয়ামী লীগের নেতা নেত্রীদের সৌভাগ্য এতে তাদের ভার অনেকটাই লাঘব হবে।
যে তারুণ্য অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে এতবড় একটি বিজয় অর্জন করল এখন তাদের মধ্যেই এত অস্বস্তি কেন! যারা নতুন করে ক্ষমতার বলয় তৈরি করতে চাইছে তাদের সঙ্গে জুলাই অভ্যুত্থানে মাঠে থাকা তরুণ অনেকেই একমত হতে পারছে না কেন! কেন অনেক তরুণই হতাশ হয়ে পড়ছে! কেন অনেকেই নিজেদের গুটিয়ে ফেলছে! কেন অনেকেই ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করছে! এর প্রতিক্রিয়া কি সাধারণ মানুষের ওপর প্রতিফলিত হচ্ছে না? মনে রাখতে হবে ভোটের মাঠে এ দেশের সাধারণ ভোটার অনেক ভালো বিচারক। দুই-চার লাখ মানুষ জড়ো করা আর ১২ কোটি ভোটার এক কথা নয়।
একটি মহৎ রূপান্তর ঘটাতে হলে দেশের ইতিহাস ঐতিহ্যের স্পষ্ট পাঠ ধারণ করতে হবে। সময় অনেক পাল্টে গেছে। এখন অশিক্ষিত বা স্বল্প শিক্ষিত একজন রিকশাচালকও চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ করার ক্ষমতা রাখে। কিন্তু এ দেশের তারুণ্য যেভাবে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে এর পরিণতি ভয়ংকর। এগারো শতকে এ দেশের সেন বংশীয় শাসকরা মনে করেছিল সাধারণ মানুষকে শিক্ষাবঞ্চিত করে ইতিহাস-ঐতিহ্য থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। ফলে মূর্খ জাতিকে শাসন-শোষণ করা সহজ হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সফল হতে পারেনি। ১৯৪৭-এর পর পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকরা একই উদ্দেশ্যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের বাংলা ভুলিয়ে উর্দু চাপাতে চেয়েছিল। তারাও ব্যর্থ হয়েছে। এখনো যদি সুবিধাবাদী কোনো পক্ষ বর্তমান প্রজন্মকে ইতিহাস বিচ্ছিন্ন করতে চায় তবে তারা হোঁচট খেতে বাধ্য। তবে এটি ঠিক, শেখ হাসিনা সরকার দুর্নীতি ও অপরাজনীতিতে এতটাই আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছিল যে দীর্ঘ ১৬-১৭ বছরে ইতিহাস-ঐতিহ্যচর্চা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছিল বর্তমান প্রজন্মকে। দুইদিন আগে টেলিভিশনে একটি ভিডিও দেখে খুব কষ্ট পেলাম। বইমেলা থেকে বেরোচ্ছে তরুণ-তরুণীরা। একজন প্রতিবেদক তাদের কয়েকজনকে ‘ভাষা আন্দোলন কোন বছরে হয়েছিল’?, ‘২৬ মার্চ কোন জাতীয় দিবস’? এ জাতীয় প্রশ্ন করলেন। অবাক বিষয়, কেউ সঠিক জবাব দিতে পারল না। বয়স বিবেচনায় ও সাজ-পোশাকে মনে হলো এরা শহরকেন্দ্রিক স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। এসব দেখে কোনো পক্ষ যদি আনন্দিত হয় এই ভেবে যে প্রজন্মের মাথা থেকে অতীত মুছে গেছে তবে তা কি ভুল হবে। এরা মব তৈরির মতো বড়জোর এক-দুই লাখ মানুষই হবে। ১২ কোটি ভোটার নয়!
আমরা এমনটা চাই না। রক্তমূল্যে জগদ্দল পাথর সরেছে ঠিকই—তবে দেশ-জাতি যথার্থ মুক্তির পথে হাঁটতে না পারলে সবাই ব্যর্থ হয়ে যাবে। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষের আবর্তে পড়ে আমরা যাতে আবার পুরনো তিমিরে হারিয়ে না যাই।
ড. এ কে এম শাহনাওয়াজ : অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়