গণ-অভ্যুত্থানের গানে তরুণদের ‘দেশ’ ভাবনা

কোন মানুষের কথা বলা হচ্ছে এখানে? পারশা ধিক্কারের সঙ্গে লিখছেন, ‘বেঁচে থাকো তুমি বেঁচে থাকি আমি, লা**শের ওপরে দাঁড়িয়ে’। গণ-অভ্যুত্থানে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে কেমন মানুষের কথা ভাবা যেতে পারে? আমরা এ ছোট গানে তার পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু যে মানুষ এ বীভৎস হত্যাকাণ্ড দেখেছে সে কি পূর্বের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার একই মানুষটি আছে? এ রক্ত, নির্ঘুম রাত, লাশ আর ক্ষমতার দম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগে-ক্ষোভে মত্ত অসহায় মানুষের ভেতরটা একই থাকে কী করে?

গণ-অভ্যুত্থান-পরবর্তী বাংলাদেশে যে শব্দটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়েছে তা হচ্ছে আমরা নতুন দেশ পেয়েছি। দেশ নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হবে। দেশকে গড়তে হবে সম্পূর্ণ নতুন আঙ্গিকে। স্বৈরাচার-ফ্যাসিবাদের নিশ্বাসমুক্ত দুর্নীতির কালো থাবার বাইরের একটি দেশ, যা সবার হয়ে উঠবে। কিন্তু এ দেশ যদি নতুনভাবে গড়তে হয় আগে তো বুঝতে হবে তরুণদের কাছে দেশ মানে কী! বিশেষত বোঝা দরকার এ গণ-অভ্যুত্থানের সময়ে, রাজনৈতিক সন্ধিক্ষণে দেশ কী রূপে ধরা দিয়েছে তাদের কাছে। দেশ কি নেহাতই একটা ভূখণ্ড? দেশ মানে কি একটা ভূখণ্ডের জনগণ? একটি রাষ্ট্র? নাকি আরো বড়, ভিন্ন কিছু?

তরুণদের এ দেশভাবনা প্রকাশ হয়েছে নানা মাধ্যমে। গানে, স্লোগানে, ফেস্টুনে, গ্রাফিতিতে কিংবা কবিতায়। এ প্রজন্মকে বুঝতে হলে তাদের দেশভাবনার গভীরতা অনুধাবন ও হৃদয়ে ধারণ করতে হলে দরকার এসব শিল্প-সাহিত্যের ক্রিটিক্যাল পর্যালোচনা। প্রয়োজন গণ-অভ্যুত্থানের চাপে ও তাপে সৃষ্ট নানা শিল্পকর্মের গভীর কিন্তু সহানুভূতিশীল পাঠ। অর্থাৎ এ শিল্পকে তরুণদের আবেগের বহিঃপ্রকাশ, ট্রেন্ডের অংশ হিসেবে কিংবা আমাদের পূর্বনির্ধারিত ছকে না দেখে তাদের সঙ্গেই ভাবতে শিখতে হবে। পুরনো শিল্প বিচারের চশমা ফেলে চোখে পড়তে হবে নতুন চশমা, নতুন ফ্রেম। তাদের শিল্পকর্মকে দেখতে হবে একেবারে স্বচ্ছ, সব কলুষতামুক্ত লেন্সে। খুঁজে বের করা দরকার তরুণদের সৃষ্ট শব্দের ভেতরে, আবেগের গহিনে লুকিয়ে থাকা বিচ্ছিন্ন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ ভাবনার জগৎ। ওই ভাবনার মালা গেঁথে তৈরি করতে হবে তাদের দেশ ভাবনার, দেশ গড়ার তাত্ত্বিক পাটাতন।

গণ-অভ্যুত্থানে সৃষ্ট শিল্প-সাহিত্যকর্মের মধ্যে চোখে পড়ার মতো অসংখ্য গান তৈরি হয়েছে। বেশির ভাগই র‍্যাপ সংগীত। আন্দোলনের মাঠে শহীদের রক্তেই নির্মিত হয়েছে শরীরে কাঁপন ধরানো এসব গান। অন্য মেলোডি গানের সংখ্যাও কম নয়। এ রকম একটি গান আমার বিশেষ দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। ‘চলো ভুলে যাই’ গানটি লিখেছেন ও গেয়েছেন নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী পারশা মাহজাবীন পূর্ণী। লিখেছেন মানে শিল্প সৃষ্টির মহৎ উদ্দেশ্যে সচেতন প্রয়াসে গান রচনা করেছেন এমনটা নয়। বরং আন্দোলনের তীব্রতা, স্বৈরাচারের হাতে খুন হওয়া শিক্ষার্থীদের আত্মার আর্তনাদ, দানবীয় রাষ্ট্রশক্তির সামনে অসহায় ধুঁকতে থাকা এক তরুণী প্রকাশ করেছেন নিজের কষ্টের-অসহায়ত্বের ভাব। পারশা এক সাক্ষাৎকারে বলছেন, ‘আন্দোলনের মধ্যে নেট বন্ধ, ফোনে পাচ্ছিলাম না তেমন কাউকে। মানুষ মারা যাচ্ছে...কিন্তু কিছু করতে পারছিলাম না...একটা দম বন্ধ করা অবস্থা। রাত ২টায় মাত্র ১০ মিনিটে লিখি গানটা’। কী এমন ভাব যা তাকে লিখতে বাধ্য করল এ গান? কী আছে এ গানে? না র‍্যাপ সংগীতের মতো সরকার, রাষ্ট্রপ্রধান, পুলিশ ও তাদের সহযোগীদের তির্যক মন্তব্য ও সরাসরি সমালোচনা নেই এতে। তার পরও পারশার বাবা গানটিকে তখন প্রকাশ করতে নিষেধ করেছিলেন। বাবার মনে ভয় ছিল পারশার নিরাপত্তা নিয়ে। ওই সময়ে শিক্ষার্থীদের যেভাবে ক্রিমিনাল-সন্ত্রাসী হিসেবে আখ্যা দেয়া হচ্ছিল, যেকোনো সময়ই তুলে নেয়া হতে পারত পারশাকে। বাবার নিষেধের বিপরীতে পারশা যা বলেছিলেন তা বিশেষ তাৎপর্য বহন করে, ‘পরে দিলে তো গানটার আর মর্ম থাকবে না। গানটা তো এখনকার জন্য’। অর্থাৎ যে ভাব যুদ্ধের দামামা রাজনৈতিক বীভৎসতা গানটি লিখিয়ে নিল ওই সময়, সে প্রেক্ষাপটেই গানটি প্রকাশ করতে হবে। অন্য স্বাভাবিক সময়ে গানটি প্রকৃত তাৎপর্য হারিয়ে যেতে পারে। তখন মানুষের হৃদয়ের যে ভাষা গানটি প্রকাশ করছে তা ধরা হয়তো স্বাভাবিক সময়ে সম্ভব হবে না। অর্থাৎ গণ-অভ্যুত্থান-সংগ্রামের ভেতরে যে গান তৈরি হয়েছে তার প্রাসঙ্গিকতা ওই সময়ের মধ্যেই দেখতে হবে। সেই সময় ও প্রেক্ষাপটের জোশ ফিকে হওয়ার আগেই গানগুলো সংগ্রহ ও পর্যালোচনা জরুরি।

এবার আসি গানে। গানটি শুরু হয় এভাবে:

‘ভুলে যাই আমি ভুলে যাও তুমি ভুলে যাক পুরো জাতি

কীভাবে মানুষ মরেছে অকালে কীভাবে কেটেছে রাতি

আমি ভুলে যাই কীভাবে বুলেট ছিদ্র করেছে মুগ্ধকে

তুমি ভুলে যাও আবু সাইদের বিশ্বাসে ভরা বুকটাকে

জাতি ভুলে যাক কালরাত আর স্মরণ করুক রেলটাকে

চলে যাক নেট, নিভে যাক জাতি, হায়**নাতে খা*ক দেশটাকে’

অন্ধকার সময়ে বসে অন্ধকারের গল্প বলছে গানটি। একদিকে আছে চলমান বীভৎস হত্যার বয়ান, অন্যদিকে বলা হচ্ছে চলো ভুলে যাই এসব। অর্থাৎ মনে করি এ রক্তে রঞ্জিত হত্যার উল্লাসে ভাসা দেশ আমার নয়। এটা নেহাতই একটা স্বপ্ন। এই যে চোখে দেখাকে বিশ্বাস করতে না পারা স্বপ্ন ভাবা শুধু পারশা নয়, গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোয় দেশের বেশির ভাগ মানুষেরই ওই অবস্থা হয়েছিল। বিশ্বাস করতে পারছিল না কীভাবে শুধু ক্ষমতায় টিকে থাকতে নিরীহ, নিরপরাধ ছাত্র-জনতাকে পাখির মতো গুলি করে হত্যা করা যায়! এ বীভৎসতার প্রকোপে ঘুমাতে পারছিল না মানুষ। রাতের পর রাত। কিন্তু গানটা কি আসলে আমাদের এসব ভুলে যেতে বলছে? না। বরং বলছে এ বীভৎসতা-পশুত্ব কখনই ভুলে যাওয়া যাবে না, আরো বেশি করেই মনে রাখতে হবে। যে রাজনৈতিক দল কিংবা রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে মানুষের জীবনের চেয়ে মেট্রো রেল বড়, নিজের দেশের মানুষের মৃত্যুতে যাদের বুক কাঁপে না, অস্থিরতা বোধ করে না যে পিশাচের দল, তারা মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করতে পারে না। মানুষের হত্যায় যে রাষ্ট্রপ্রধানের কিছু যায় আসে না, বরং চোখে জল আসে রেলের ধ্বংস দেখে, তার কাছে মানুষ-জাতি-দেশ কোনোভাবেই নিরাপদ না। দেশ এখানে একটা বিশেষ অর্থে ধরা দেয়। দেশ মানে শুধু একটা ভূখণ্ড কিংবা কিছু মানুষের সমষ্টি নয়। কিংবা রাষ্ট্রের স্থাপনা-উন্নয়নও দেশ নয়। গানের এক জায়গায় বিদ্রূপের সুরে বলা হয়—চলো শহীদ মুগ্ধ, আবু সাইদ, ফাইয়াজদের হত্যা ভুলে দেখে নিই ‘বাতাবী লেবু লটকনে’ ভরা দেশকে, ‘কেঁদে ফেলি ফ্লাইওভার আর মেট্রো রেলটা জড়িয়ে’। কার দিকে আঙুল তোলা হচ্ছে আমাদের বুঝতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। উন্নয়নের প্রয়োজনীয়তা কে অস্বীকার করবে? কিন্তু উন্নয়নের সঙ্গে যদি সাধারণ মানুষের আত্মিক সম্পর্ক তৈরি না হয়, সে উন্নয়ন মানুষের হয়ে ওঠে না। জনগণের টাকায় করা, জনগণের ওপর চাপানো ঋণে নির্মিত রেল-সেতু মনে হয় যেন একটা গোষ্ঠীর, শ্রেণীর সম্পত্তি; আবির্ভূত হয় নিষ্পেষণ-অত্যাচার-দুর্নীতির প্রতীক হিসেবে। এ ধরনের প্রতীক যত বড় হয়, তার সামনে মানুষ তত ছোট হতে থাকে। উন্নয়ন তখন মানুষের সুখের উপলক্ষ না হয়ে পরিণত হয় দুঃখের প্রতীকে। গানে পরিষ্কার ইঙ্গিত আছে যে এ চাপিয়ে দেয়া উন্নয়নের, মানুষের মর্যাদায় আঘাত হানা দেশ তরুণদের নয়।

এ গানে দেশ ধরা দেয় অনেকটা বিমূর্ত ধারণা হিসেবে, যেখানে একটা আইডিয়াল মানব সম্পর্কের কল্পনা আছে। শাসক-শাসিতের সম্পর্কের একটা ইঙ্গিত আছে। আশা করা হচ্ছে, শাসক ‘আরশের মানুষ’ হয়ে শূন্যে থাকবে না, থাকবে না গদি আঁকড়ে ধরে। নেমে আসবে মানুষের কাতারে। ধারণ করবে মানুষকে অন্তর থেকে। বলপূর্বক শাসন নয় তরুণদের কল্পিত দেশে থাকবে শাসক-শাসিতের একটা সহজ সম্পর্ক। শাসক আসবে চলে যাবে, কিন্তু মানুষ থেকে যাবে। দেশ ধারণ করবে মানুষকে।

কোন মানুষের কথা বলা হচ্ছে এখানে? পারশা ধিক্কারের সঙ্গে লিখছেন, ‘বেঁচে থাকো তুমি বেঁচে থাকি আমি, লা**শের ওপরে দাঁড়িয়ে’। গণ-অভ্যুত্থানে লাশের ওপর দাঁড়িয়ে কেমন মানুষের কথা ভাবা যেতে পারে? আমরা এ ছোট গানে তার পরিষ্কার ধারণা পাওয়ার কথা নয়। কিন্তু যে মানুষ এ বীভৎস হত্যাকাণ্ড দেখেছে সে কি পূর্বের ‘স্বাভাবিক’ অবস্থার একই মানুষটি আছে? এ রক্ত, নির্ঘুম রাত, লাশ আর ক্ষমতার দম্ভের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা রাগে-ক্ষোভে মত্ত অসহায় মানুষের ভেতরটা একই থাকে কী করে? যতই ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করুক, যতই স্বপ্ন মনে করুক ওই মানুষের একটা নতুন রূপ তৈরি হয়ে গেছে। একটা নতুন সত্তা জন্ম হয়েছে—সময় ও প্রেক্ষাপটের সঙ্গে মানুষের তৈরি হয়েছে একটা নতুন বোঝাপড়া। গানে যখন বলছে ‘মূল্যবোধের রক্তক্ষরণ আকাশ থেকেই ঝরুক’, তখন এমন একটি দেশ-সমাজের কল্পনা চলে আসে যেখানে মানুষ চিহ্নিত হবে তার মূল্যবোধ দ্বারা। মূল্যবোধ বর্গটি অবশ্যই এখানে ব্যবহৃত হয় বৃহৎ অর্থে, যার সঙ্গে মিশে আছে ব্যক্তি, সমাজ, রাষ্ট্রের রীতিনীতির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটা স্থানিক নৈতিকতার বোধ। যে নৈতিকতা ধর্ম-সমাজ থেকে অর্গানিকভাবে উঠে আসে, সমাজের সঙ্গে মিশে থাকা ব্যক্তির সত্তাকে নির্মাণ করে। নতুন রূপ দেয়। এমন একটা বোধ সম্পূর্ণ মানুষের চিত্র উঠে আসে এ মূল্যবোধের আলাপে যে অন্যায়কে অন্যায় বলার সাহস রাখে। সাদা কে সাদা এবং নির্দ্বিধায় কালোকে কালোই বলতে দ্বিধা করবে না। যার বিবেক থাকবে, বিবেকের তাড়না থাকবে। থাকবে ন্যায়বিচারের ধারণা ও অনুশীলন। ওই মানুষের কথা এখানে উঠে এসেছে যে অন্যের মতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবে—বন্দুকের কিংবা পদ-পদবির জোরে নিজের গাঁজাখুরি মত অন্যের ওপর চাপিয়া দেবে না। পারশা ব্যঙ্গ করে বলছেন: ‘মায়োপিক জাজে মুখ চে*পে ধরে উপস্থাপিকা মা**রুক’।

অর্থাৎ তিনি বলছেন একচোখা বিচারে অন্যের মুখ বন্ধ করা দেশ তার প্রজন্মের নয়। এমন মানুষের কথা এ গানে এসেছে যে সত্যিকার অর্থে সাহসী। এ সাহস শুধু নিজেকে রক্ষায় সীমাবদ্ধ থাকবে না; থাকবে অন্যকে রক্ষায়, দেশ রক্ষায়। গণ-অভ্যুত্থানে-সংগ্রামের সময়ে-প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে পারশা গানটি শেষ করছে এ বলে ‘পরে কোনো গানে ফিরব আবার এই প্রাণটা থাকে যদি!’ মানে সে জীবন বাজি রেখে নিজের ভাবনা প্রকাশ করছে। বুঝিয়ে দেচ্ছে তার প্রজন্ম সত্যের জন্য ন্যায়ের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে পিছপা হবে না। না স্লোগানের সুরে মানুষকে আন্দোলনে-সংগ্রামে ডাকছে না পারশা। তার আহ্বান শান্ত, ধীর। নিজের ভাবনা, ভাব, আবেগকে প্রকাশ করছে গানে। একান্ত নিজস্ব উপায়ে। গানে যে মানুষের কথা উঠে এসেছে তার আত্মার সঙ্গে এক ধরনের দেশাত্মবোধ যুক্ত। দেশকে নিজের করে নেয়ার চেষ্টা থাকবে তার মধ্যে। হাজারো সমস্যা আছে জেনেও ছুড়ে ফেলে দেবে না দেশকে। যেমনটা গানে বলা হয়: ‘আমার শ্মশান বাংলা ভালো নেই আজ, তবু তাকে আমি ভালোবাসি’। যে প্রজন্ম একাত্তর দেখেনি, দেশ নির্মাণের একাত্তরের ‘প্রকৃত’ ইতিহাস যাকে জানতে দেয়া হয়নি, তার কাছে দেশকে ভালোবাসার মানে কী? সে যখন বলছে ‘বাংলা মা আজ বানভাসি’, বাংলা-মা-দেশের কি সম্পর্ক তৈরি হয়? এই যে দরদ, দেশের মায়ের কষ্টে হৃদয়ে অনুভূতি তৈরি হচ্ছে, রক্তক্ষরণ হচ্ছে, একই সঙ্গে আকুতি এবং মাকে উদ্ধারের সংকল্প ঘোষণা করা হচ্ছে, এখানে দেশ কি একটি নতুন চেহারা পাচ্ছে না?

গানে দেশ হাজির হয় একটা নিজস্ব কর্তা সত্তা নিয়ে। প্রতীয়মান হয় এমন একটি এনটিটি হিসেবে যাকে নিয়ে ভাবতে হয়, যার জন্য দরদ থাকতে হয়। যার বিপদে আবার রুখে দাঁড়াতে হয়। মানে মানুষের কল্পনার বাইরেও দেশের নিজস্ব একটা খোলা চিরন্তন রূপ আছে যা আমরা প্রত্যেকে নিজেদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রেক্ষাপট থেকে নিজেদের সময়ের আলোকে ভিন্ন ভিন্ন রূপে কল্পনা করি। দেশ কল্পনায় এখানে আবার এক ধরনের বৈপরীত্যও দেখা যায়। দেশ একই সঙ্গে একটি বিমূর্ত ধারণা—একটা ইউটপিয়া—আবার একই সঙ্গে হাজির হয় নিজস্ব রূপ, কর্তা সত্তা নিয়ে। একদিকে দেশ বিমূর্ত যেখানে মানুষের মঙ্গলের জন্যে সম্প্রীতিতে বসবাসের নিমিত্তে ঐতিহ্য, ধর্ম, সামাজিক রীতিনীতির সঙ্গে আধুনিক রাষ্ট্র, অধিকার, ও ন্যায়বিচারের নানা ধারণার মধ্যে একটা নিয়ত আপস-আলোচনা চলতে থাকবে। অন্যদিকে দেশের একটি মূর্ত রূপ আছে যেখানে দেশ আমাদের সময়ের ও স্থানিক কল্পনার বাইরে নিজস্ব একটা চেহারা নিয়ে হাজির থাকে। গণ-অভ্যুত্থানের শিল্পে-সাহিত্যে এ দুই রূপের উপস্থিতিই লক্ষ করা যায়। এতে এমন একটি দেশের ইঙ্গিত আছে যার কেন্দ্রে আছে মানুষ। না মানুষ শুধু একটা ফাঁকা বুলি, খোলস নিয়ে থাকছে না। গণ-অভ্যুত্থানের অভিজ্ঞতায় নির্মিত নতুন সত্তায় ভর করে মানুষ ক্রিয়াশীল থাকছে তার ধর্মীয়-সামাজিক ঐতিহ্যের মধ্যেই নৈতিকতা, মর্যাদা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার একটা চলমান লড়াইয়ে।

জীবন দিয়ে তরুণরা যে দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন তা বাস্তবায়নে, শুধু প্রতিষ্ঠিত ধারণার আলোকে রাষ্ট্র সংস্কার নয়, দরকার গণ-অভ্যুত্থানের শিল্প-সাহিত্যে প্রকাশিত তাদের গুরুত্বপূর্ণ চিন্তা, কল্পনা ও ধারণার গভীর পর্যালোচনা ও তত্ত্বায়ন। ওই আলোকে দাঁড় করাতে হবে দেশের একটা নতুন দার্শনিক ভিত্তি। তাহলেই চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান শুধু একটি রাজনৈতিক ঘটনা হিসেবে নয়, ইতিহাসে স্থান করে নেবে সাতচল্লিশ ও একাত্তরের মতো একটা জনগোষ্ঠীর সত্যিকার অর্থে রাজনৈতিক হয়ে ওঠার ঐতিহাসিক মাইল ফলক হিসেবে।

মো. মিজানুর রহমান: পিএইচডি গবেষক, ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়, সান্তা ক্রুজ

আরও