নতুন আকাঙ্ক্ষার পথে হাঁটছে বাংলাদেশ। এ পাটাতন রচিত হয়েছে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে সংঘটিত গণ-অভ্যুত্থানে। আমাদের সামনে অভাবিত এক সম্ভাবনা হাজির হয়েছে। দেখা দিয়েছে নতুন করে দেশটাকে নির্মাণের অভাবনীয় এক সুযোগ। এ লক্ষ্যে চলছে নানামুখী সংস্কার। নেয়া হয়েছে বিভিন্ন উদ্যোগ। মানুষ স্বপ্ন দেখছে, প্রত্যয়ী হচ্ছে। কারণ এবার আর সে হার মানতে চায় না। আমরা মানুষের সেই আকাঙ্ক্ষাকে সম্মান করি। সাধুবাদ জানাই। ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানুষ সত্যি সত্যি এবার বুঝে পাক তাদের ন্যায্য হিস্যা।
আমরা চাই রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালিত হোক ইনসাফের ভিত্তিতে। মানবাধিকার বাস্তবায়ন হোক। গণতন্ত্রের অনুশীলন ঘটুক সব স্তরে। এ শুভ প্রত্যাশা রেখে আমরা এই প্রশ্ন এবারের বিজয় দিবসে হাজির করতে চাই—এসব নিশ্চিত করার জন্য যে বুদ্ধিজীবী সমাজ দরকার, তা কি আমাদের আদৌ আছে? বুদ্ধিজীবিতার চর্চা কি এ দেশে হচ্ছে? এ চর্চা জারি রাখার জন্য যে ধরনের পরিবেশ থাকা দরকার সেটা কি দেয়া সম্ভব হচ্ছে?
রাষ্ট্রযন্ত্রের যে শাসক ও প্রশাসকরা, তাদের কাছে বুদ্ধিজীবিতা ছিল দলদাস হওয়ার নামান্তর। সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বর্তমান সময়ে কি কোনো উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে। এখন তো ভিন্ন এক সময়। বুদ্ধিজীবিতা দাঁড়িয়ে থাকে যেসব প্রতিষ্ঠানের ওপর সেসব যেন আরো বেশি বিকশিত হয় সেই লক্ষ্যে কোনো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে? নেয়া না হলে সেসব করার এখুনি সময়।
আমাদের বুদ্ধিজীবিতার লক্ষণ কেমন এবং তার স্বরূপ কী তা নির্ণয় হয়ে গেছে জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানের দিনগুলোয়। হয়তো এখনই প্রকৃত পরিস্থিতি বা সত্যটা স্পষ্ট হচ্ছে না, আরো সময় লাগবে। তবে মোটামুটিভাবে পরিষ্কার একটা ধারণা পাওয়া গেছে। তবে এ সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা হাজির করতে পারবে গণমাধ্যম। বিশেষ করে সেই সব গণমাধ্যম, যারা জুলাই গণ-অভ্যুত্থানে নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার চর্চা করেছে। কারণ তারাই জানে শুধু ওইরকম পরিস্থিতিতে কতজন বুদ্ধিজীবীর কাছে তারা লেখা চেয়েছেন এবং কী প্রত্যুত্তর পেয়েছেন। বুদ্ধিজীবীরা লেখা দিতে অপারগতা করেছেন—এ সংখ্যা কেমন? স্বতঃস্ফূর্তভাবে কোনো লেখা কি কোনো বুদ্ধিজীবী পাঠিয়েছিলেন?
এসব প্রসঙ্গের অবতারণা এ কারণে যে বুদ্ধিজীবিতার চর্চাকে যদি নিশ্চিত না করা যায় তাহলে যত সংস্কারই হোক না কেন সেসবে সুফল আসা দুরূহ। বুদ্ধিজীবীরাই কেবল পারবে ক্রমাগত প্রশ্ন করে, এ সম্পর্কে লেখালেখি চালিয়ে, সেমিনার-সিম্পোজিয়ামে এসবের ভালো-মন্দের প্রতিতুলনা জারি রেখে প্রত্যেকটি জিনিসকে সঠিক পথে পরিচালিত করতে। এ কারণে এ মুহূর্তে সংস্কার যেমন জরুরি, পাশাপাশি বুদ্ধিজীবীদের প্রযত্ন দেয়া, বুদ্ধিজীবিতা উৎপাদিত হয় যেসব প্রতিষ্ঠানে সেসবের বিকাশ ঘটানো অনিবার্য। বুদ্ধিজীবিতা সঠিক ও যথার্থরূপে জারি থাকলে আখেরে যে আমাদেরই মঙ্গল হবে এ সত্য আমরা যেন ভুলে না যাই।
ফরাসি কথাসাহিত্যিক আনি এরনো নোবেল পেয়েছিলেন ২০২২ সালে। বয়স ছিল তখন ৮২ বছর। ওই বয়সে তিনি হেঁটেছিলেন মিছিলের অগ্রভাগে, ফ্রান্সজুড়ে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে। জীবনভর তিনি প্রশ্ন করে গেছেন ন্যায্যতা নিশ্চিত করার জন্য। কেবল লিখে নয়, কর্মেও পালন করেন বুদ্ধিজীবীর ধর্ম।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঘটে এ দেশেও। বরং ফ্রান্সের চেয়ে তুলনামূলকভাবে বেশিই বাড়ে এবং সেটা অধিকাংশ ক্ষেত্রে কোনো যুক্তি ছাড়া, যথার্থ কোনো কারণ ব্যতিরেকে। দুই মাসে তিনবার বাড়ে বিদ্যুতের দাম। দাম বাড়ার এ অবস্থা এমন জায়গায় পৌঁছেছে যে মানুষের অবস্থা সত্য সত্যই নাভিশ্বাসে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশে, রাজধানী ঢাকায় একজন কবি-সাহিত্যিকেরও দেখা মেলেনি যিনি একটা পোস্টার হাতে দাঁড়িয়ে রয়েছেন দ্রব্যমূল্য অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ার প্রতিবাদে। লেখা হয়নি বিশেষভাবে উল্লেখ করার মতো একটা কবিতা, ছড়া কিংবা কোনো গল্প-উপন্যাস।
স্বাধীনতার আগে এ ভূখণ্ড যখন ব্রিটিশ শাসনের নিগড়ে বন্দি তখন আমাদের লেখক-কবিরা কিন্তু ঠিকই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করেছেন। তাহলে কি স্বাধীনতা এসেছে আর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম? স্বাধীন দেশে বুদ্ধিজীবীর কোনো দায় ও দায়িত্ব কি নেই?
বুদ্ধিজীবীর ধর্ম পালন করে গেছেন ডিরোজিও, রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরসহ আরো অনেক লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক। তুলনারহিত উদাহরণ সৃষ্টি করে গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও কাজী নজরুল ইসলাম।
সবার বিপরীতে দাঁড়িয়ে অকপটে চরম সত্যিটাই বলাটাই বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। যেমনটা বলে শুধু নয় বাস্তবে করেও গেছেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। ঊনবিংশ শতকের ফ্রান্সে এমিল জোলা পালন করেছিলেন যে ভূমিকা। রবীন্দ্রনাথ জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ব্রিটিশরাজ প্রদত্ত নাইটহুড পদবি ছুড়ে ফেলে দিয়েছেন। শুধু কি ব্রিটিশরাজের অন্যায়-ভুলের সমালোচনা ও প্রতিবাদ করেছেন? স্বজাতির, স্বদেশের মানুষের যথার্থ সমালোচনাও করেছেন। মহাত্মা গান্ধীর মতো সর্বজনপ্রিয় নেতার ভুলকেও তিনি ভুলই বলেছেন। আজকের ভারতবর্ষে যদি রবীন্দ্রনাথ এ সত্য প্রকাশে অবিচল থাকতেন তাহলে নির্ঘাত তাকে কারাবরণ করতে হতো এবং রবীন্দ্রনাথ সেটা জেনেও সত্যটাকেই উপস্থাপন যে করতেন, এ ব্যাপারে কোনো দ্বিধা কিংবা সংশয়ের অবকাশ নেই।
কেবল কবি হিসেবে নয়, সাহিত্যিক হিসেবে নয়, বুদ্ধিজীবীর ভূমিকায় রবীন্দ্রনাথ ছিলেন নির্ভীক ও দৃঢ়চেতার অধিকারী। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলনে তিনি কেবল স্বদেশ পর্যায়ের গানগুলো লিখেই দায় ও দায়িত্ব পালন করেননি, মাঠে সক্রিয় থেকেছেন, সভা-সমাবেশ করেছেন, ভাইফোঁটায় অংশ নিয়েছেন। রাখি বেঁধেছেন। বঙ্গভঙ্গবিরোধী আন্দোলন সংঘটিত করতে লেখায় ও কাজে একজন মানুষের পক্ষে যতটা করা সম্ভব তার সবটাই সর্বোচ্চ রকমে করেছেন রবীন্দ্রনাথ।
সুভাষচন্দ্রসহ বহু যুবককে ১৯১৪ সালে ৩ নং রেগুলেশন আইনে কারান্তরীণ করা হয়। প্রতিবাদে রবীন্দ্রনাথ লেখেন ‘পত্র’ কবিতা, যা সুনজরে দেখেনি ব্রিটিশ সরকার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ বুদ্ধিজীবীর ধর্ম থেকে বিচ্যুত হননি।
বুদ্ধিজীবীর ধর্মে স্বাদেশিকতা-স্বদেশপ্রেম বলতে কী বোঝায়, কীভাবে ও কতভাবে জারি রাখতে হয় তার নিবেদন, সেসবের অসামান্য এক জারি রেখে গেছেন কাজী নজরুল ইসলাম। ‘ধূমকেতু’ পত্রিকায় যার সাক্ষ্য মিলেছিল এখন থেকে ঠিক ১০০ বছর আগে। ১৯২২ খ্রিস্টাব্দের ১১ আগস্ট প্রকাশিত হয় দ্বিসাপ্তাহিক এ পত্রিকা। বন্ধ হয়ে যায় বছর না ঘুরতেই ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দের মার্চে। নাম ধূমকেতু, ভাগ্যও ছিল যেন অনুরূপ। হ্যালির ধূমকেতুর কথা আমরা জানি বিজ্ঞানের সুবাদে। পৌনে এক শতাব্দীতে দেখা মেলে তার। কিন্তু হাজির হয় মহাজাগতিকতার বিপুল বিস্ময় নিয়ে। নজরুলের ধূমকেতুর বয়স শত পেরিয়ে গেল, কিন্তু তার সঙ্গে তুলনীয় কারো দেখা হলো না আজও। সাংবাদিকতায়-সম্পাদকতায় বুদ্ধিজীবীর ধর্ম যেভাবে ধারণ করেছেন তিনি, তা শুধু বিস্ময়ের নয়, তুলনারহিত ঘটনাও বটে।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সিতে তো বটেই, ভারতবর্ষেই ‘বিদ্রোহী’ কবিতা দিয়ে বিপুল সাড়া ফেলে দিয়েছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ফেরত একজন কবি। বিদ্রোহীর আগে যার পরিচয় ছিল সৈনিক কবিরূপে। বিদ্রোহীর মধ্য দিয়ে আবির্ভূত হলেন বিদ্রোহী কবি হিসেবে। তার সম্পাদকতায় প্রকাশিত ধূমকেতু পত্রিকার সূচনাতেই স্পষ্ট করে উল্লেখ করা হয়—‘সর্বপ্রথম ধূমকেতু ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা চায়। স্বরাজ-টরাজ বুঝি না, কেননা ও কথাটার মানে এক এক মহারথী এক এক রকম করে থাকেন। ভারতবর্ষের এক পরমাণু অংশও বিদেশীর অধীন থাকবে না। ভারতবর্ষের সম্পূর্ণ দায়িত্ব, সম্পূর্ণ স্বাধীনতা রক্ষা, শাসনভার সব থাকবে ভারতীয়দের হাতে। তাতে কোনো বিদেশীর মোড়লি করার অধিকারটুকু পর্যন্ত থাকবে না। যারা এখন রাজা বা শাসক হয়ে এ দেশে মোড়লি করে দেশকে শ্মশানভূমিতে পরিণত করেছেন, তাদের পাততাড়ি গুটিয়ে, বোঁচকাপুঁটলি বেঁধে সাগরপারে পাড়ি দিতে হবে। প্রার্থনা বা আবেদন-নিবেদন করলে তারা শুনবেন না। তাদের এতটুকু সুবুদ্ধি হয়নি এখনো। আমাদের এ প্রার্থনা করার, ভিক্ষা করার কুবুদ্ধিটুকু ছাড়তে হবে। পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে হলে আমাদের বিদ্রোহ করতে হবে, সবকিছু নিয়মকানুন-বাঁধন-শৃঙ্খল মানা নিষেধের বিরুদ্ধে।’
ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকার শুরু থেকেই নজর রেখেছিল ধূমকেতুর ওপর। ১৯২২ সালের ২৬ সেপ্টেম্বরের ১২তম সংখ্যায় সম্পাদকীয় হিসেবে প্রকাশিত হলো নজরুলের আলোড়ন সৃষ্টিকারী কবিতা ‘আনন্দময়ীর আগমনে’। দীর্ঘ এ কবিতার প্রথম কয়েক চরণ হলো—‘আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি-আড়াল?/স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি-চাঁড়াল।/দেশশিশুদের মারছে চাবুক, বীর যুবাদের দিচ্ছে ফাঁসি/ভূভারত আজ কসাইখানা—আসবি কখন সর্বনাশী?/দেবসেনা আজ টানছে ঘানি তেপান্তরের দ্বীপান্তরে,/রণাঙ্গনে নামবে কে আর তুই এলে কৃপাণ ধরে?’ ব্রিটিশ সরকার এ সংখ্যাটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। ২৩ নভেম্বর কুমিল্লা থেকে নজরুলকে গ্রেফতার করে পরের দিন কলকাতায় আনা হয়। ২৫ নভেম্বর কোর্টে নেয়া হয়, ২৯ নভেম্বর পড়ে মোকদ্দমার দিন।
বিচার চলাকালে নজরুল অনশন করেন, যা রবীন্দ্রনাথকেও বিচলিত করে এবং তিনি অনশন ভাঙার জন্য অনুরোধ জানিয়ে একটা তারবার্তা পাঠান, যা পৌঁছে না দিয়ে ব্রিটিশ পুলিশ প্রশাসন ঠিকানা খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে ফেরত পাঠায়। বিচারে নজরুলের এক বছরের কারাদণ্ড হয়। নজরুলের কারান্তরীণের মধ্য দিয়ে ধূমকেতুর ভাগ্যেও নেমে আসে অমানিশার অন্ধকার। ১৯২৩ সালের মার্চে বন্ধ হয়ে যায় পত্রিকাটি। তার আগে প্রকাশিত হয় নজরুল সংখ্যা। যেখানে স্থান পায় কবির ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’ লেখাটি। এই হচ্ছে বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত লড়াই করার প্রত্যয়। জনচেতনা জাগ্রত করার লক্ষ্যে কবিতা লিখে জেলে গিয়েও যিনি লিখতে পারেন ‘রাজবন্দীর জবানবন্দী’র মতো চেতনাসঞ্চারী লেখা, তিনিই তো বুদ্ধিজীবীর প্রতিভূ।
নজরুল ধূমকেতুর উদ্বোধনী সংখ্যায়ই স্পষ্ট করেন কী অভিপ্রায়ে এ পত্রিকার আত্মপ্রকাশ। লেখেন: ‘রাজভয়-লোকভয় কোনো ভয়ই আমাকে বিপথে নিয়ে যেতে পারবে না। যার ভিতরে ভয়, সেই তার ভয় পায়। আমার বিশ্বাস যে নিজেকে চেনে, তার আর কাউকে চিনতে বাকি থাকে না। অতএব যে মিথ্যাকে চেনে, সে মিছামিছি তাকে ভয়ও করে না। যার মনে মিথ্যা, সেই মিথ্যাকে ভয় করে। নিজেকে চিনলে মানুষের মনে আপনা-আপনি এত বড় একটা জোর আসে যে সে আপন সত্য ছাড়া আর কাউকে কুর্নিশ করে না—অর্থাৎ কেউ তাকে ভয় দেখিয়ে পদানত রাখতে পারে না।’
সাহিত্যিক-দার্শনিক রাসেল জীবনভর মানবিকতার আদর্শ প্রতিষ্ঠার লড়াই করে যাওয়ার মধ্য দিয়ে পালন করে গেছেন বুদ্ধিজীবীর ধর্ম। এমনকি শতবর্ষের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেও। প্রথম যুদ্ধের সময় একজন শান্তিবাদী হিসেবে তিনি যুদ্ধবিরোধী প্রচার পুস্তিকা রচনা করে অবস্থান নেন যুদ্ধের বিপক্ষে। যার জন্য দিতে হয় অর্থদণ্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসলীলায় ও পারমাণবিক বোমার ব্যবহারে তিনি অসহায় বোধ করেন, ক্ষুব্ধও হন। শঙ্কায় পড়েন পৃথিবীর ভবিষ্যৎ নিয়ে। যুদ্ধ বন্ধে এবং পারমাণবিক নিরস্ত্রীকরণে বিশেষভাবে উদ্যোগী হন। এ লক্ষ্যে আয়োজিত সম্মেলনে পালন করেন সভাপতির দায়িত্ব।
গ্রামশি বুদ্ধিজীবীদের দেখেছেন দুভাবে। এক. পরম্পরাভিত্তিক বুদ্ধিজীবী; যেমন শিক্ষক, পুরোহিত কিংবা প্রশাসক, যারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে একই রকম কাজ করে চলেছেন। দুই. জৈব বুদ্ধিজীবী, যাদের স্বার্থ হাসিলের জন্য ও ক্ষমতা আদায়ের জন্য কাজে লাগানো হয়। জৈব বুদ্ধিজীবীরা চলমান, গতিময়।
বাংলাদেশের এ সময়ের লেখক কবি-সাহিত্যিকরা এখন দ্বিদলীয় ছাতার নিচে নিজেদের অবস্থান নিশ্চিত করেছেন। দল নিরপেক্ষ কোনো লেখক, কবি-সাহিত্যিকের দেখা মেলা এখানে দুরূহ নয় কেবল অসম্ভবও হয়ে উঠেছে। বুদ্ধিজীবীর কোনো দল থাকতে পারে না; এ বোঝাবুঝির ধারেকাছেও নেই এ দেশের লেখক, কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সম্পাদক, আইনজীবী ও অধ্যাপকরা। দলের আয়নায় আদর্শ ফেরি করা হয়ে গেছে এখনকার সৃজন ও মননশীল মানুষের বৈশিষ্ট্য।
আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সম্পর্কে একশটা প্রশ্ন থাকতে পারে। তার পরও এখনো যে কেউ কেউ কথা বলেন, তার প্রমাণ আমরা পেয়েছি জুলাই-আগস্টের গণ-অভ্যুত্থানে। একজন সলিমুল্লাহ খান, একজন আহমাদ মোস্তফা কামাল যে ভূমিকা পালন করেছেন তা সদর্থক অর্থেই বুদ্ধিজীবীর ধর্মকেই উচ্চকিত করেছে।
রাজনৈতিক সরকার না হয় প্রকৃত বুদ্ধিজীবীদের বিপরীত মতের মানুষ জ্ঞান করেন, বর্তমান সরকারও কি সেই পথে হাঁটছেন? যদি না হাঁটেন তাহলে তাদেরকে তার প্রমাণ দৃশ্যমানরূপে হাজির করতে হবে। প্রযত্নের নজির, পাশে থাকার উদাহরণ দৃশ্যগ্রাহ্য করতে হবে। মনে রাখতে হবে বুদ্ধিজীবী শূন্য কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র কিন্তু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হয়ে উঠত পারবে না। যে রাষ্ট্রে বুদ্ধিজীবীর কদর নেই, সেই রাষ্ট্রে তার নাগরিকের কদর বা সম্মানও থাকে না। কারণ সমাজ-রাষ্ট্রকে বিনির্মাণের প্রশ্নে দায় ও দরদের স্বাক্ষর রাখেন বুদ্ধিজীবী সমাজ।
সেই দায় পূরণ থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে ৮২ বছর বয়সেও ফ্রান্সের রাস্তায় মিছিল-প্রতিবাদ জারি রাখেন নোবেল বিজয়ী আনি এরনো। আমাদের বুদ্ধিজীবীদের কি এরনোর এ বুদ্ধিজীবিতা থেকে কিছুই শেখার নেই, কিছুই জানার নেই, কিছুই করার নেই? এরনোর উদাহরণ হাজির করা হয়েছে—এ থেকে বুদ্ধিজীবীদের যেমন শিক্ষণীয় রয়েছে তেমনি বুদ্ধিজীবীর জন্য রাষ্ট্রের করণীয় কী তারও বার্তা রয়েছে। একজন এরনো এমনি এমনি তৈরি হন না। এসবের নেপথ্যে রাষ্ট্রের-সমাজেরও করণীয় রয়েছে। বিষয়টা একে অন্যের পরিপূরক।
সংস্কারের যে আয়োজন চলছে, তাকে প্রকৃত অর্থেই যদি সার্থক করে তুলতে হয় তাহলে খোঁজ করতে হবে বুদ্ধিজীবীর। প্রযত্ন দিতে হবে বুদ্ধিজীবিতা যাতে চর্চিত হয়, বিকশিত হয় তার পরিবেশ-উপাদান ও অনুষঙ্গকে। এসব করা রাষ্ট্রের বৃহত্তর স্বার্থেই জরুরি।
ড. কাজল রশীদ শাহীন: সাংবাদিক ও গবেষক