ছাত্ররাজনীতির গুণগত পরিবর্তন হলে জাতীয় রাজনীতিও উন্নত হবে

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই তরুণ। বর্তমানে দেশের অন্যতম বড় সংকট হলো শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনার্স-মাস্টার্স পাস বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি।

আকরাম হুসাইন, জাতীয় নাগরিক কমিটির সদস্য। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তরে অধ্যয়নরত। সম্প্রতি গ্লোবাল লিডারশিপ এক্সচেঞ্জ প্রোগ্রামে যোগ দিতে বাংলাদেশের ছাত্রনেতা হিসেবে আকরাম হুসাইনকে নির্বাচন করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নীতিনির্ধারক ও ছয় সদস্যের লিয়াজোঁ কমিটির সদস্য ছিলেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুর দিকে ‘সমাজচিন্তা’ নামে একটি পত্রিকার সম্পাদনা ও প্রকাশনার সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি একটি আইটি ফার্মের উদ্যোক্তাও। উচ্চ শিক্ষা, ছাত্ররাজনীতি ও জাতীয় রাজনীতির সংস্কারসহ নানা প্রসঙ্গ নিয়ে সম্প্রতি কথা বলেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। ছাত্র-জনতার একটি বড় দাবি ছিল শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার, কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা এবং তরুণদের উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ। আপনারা কীভাবে শিক্ষা ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করবেন এবং তরুণদের উন্নয়নের জন্য কী পদক্ষেপ নেবেন?

বাংলাদেশের জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশই তরুণ। বর্তমানে দেশের অন্যতম বড় সংকট হলো শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা। অষ্টম শ্রেণীর শিক্ষার্থীদের তুলনায় অনার্স-মাস্টার্স পাস বেকারের সংখ্যা অনেক বেশি। এ সমস্যার মূল কারণ দক্ষতার অভাব। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যে শিক্ষাক্রম চালু করেছে, তা দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এ কারণেই দেশে বেকারের সংখ্যা ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেখা যাচ্ছে, কেউ ১৮ বছর শিক্ষাজীবন শেষ করার পরও তার প্রত্যাশা অনুযায়ী কর্মসংস্থান পাচ্ছেন না। চাকরির বাজারেও কাজের সুযোগ নেই তা নয়, কারণ কয়েক লাখ ভারতীয় বাংলাদেশে এসে কাজ করছে এবং বড় বড় প্রতিষ্ঠানে বিদেশী জনবল নেয়া হচ্ছে। এর প্রধান কারণ আমাদের দেশের মধ্যে দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়া। তাই প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাইরে থেকে জনবল নিতে হচ্ছে।

এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি মনে করি, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা বৃদ্ধির দিকে সর্বাধিক মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে আমাদের আগামী দিনের জন্য বাজার উপযোগী শিক্ষা ব্যবস্থার দিকে গুরুত্ব দিতে হবে। আমরা যদি এসব নিয়ে কাজ করতে পারি, তাহলে বেকার সমস্যা থেকে ধীরে ধীরে উত্তরণের সম্ভাবনা রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থার মৌলিক সংস্কার একটি দীর্ঘমেয়াদি প্রক্রিয়া। এখন থেকেই কাজ শুরু করলে ৫-১০ বছরের মধ্যে ভালো ফলাফল আশা করা যায়।

আপনি নিজেও একজন তথ্যপ্রযুক্তি উদ্যোক্তা। বলা হচ্ছে, সামনের দিনগুলোয় তথ্যপ্রযুক্তি খাতের বড় সম্ভাবনা রয়েছে। তবে আমাদের তরুণ জনগোষ্ঠী এখনো এ সম্ভাবনাময় খাতকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি। গত ১৫ বছরে আমরা ‘ডিজিটাল’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’-এর কথা শুনছি। আমরা যদি সত্যিকারভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সুযোগ নিতে চাই, তাহলে কী পদক্ষেপ নিতে হবে?

আমাদের দেশে গত ১৫-১৬ বছরে তরুণ উন্নয়ন, তথ্যপ্রযুক্তি ও ডিজিটালাইজেশনের নামে অনেক বড় বিনিয়োগ হয়েছে। কিন্তু এর সুফল জনগণের কাছে পৌঁছেনি। বরং শেখ পরিবার ও তাদের ঘনিষ্ঠদের দ্বারা এ খাতে বড় ধরনের দুর্নীতি হয়েছে। যদি গত সরকারের আমলের তিনটি খাতের মধ্যে সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত খাত চিহ্নিত করা হয়, তবে তথ্যপ্রযুক্তি খাত অন্যতম। এখানে বিপুল অর্থ চুরি ও পাচার হয়েছে। বিশেষ করে প্রশিক্ষণের নামে বিশাল লুটপাট হয়েছে।

বর্তমানে এ খাতে উন্নতি আনতে হলে প্রশিক্ষণ যাতে সঠিকভাবে হয় এবং শিক্ষার্থীরা যাতে প্রকৃতভাবে শিখতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে তথ্যপ্রযুক্তির সুযোগ-সুবিধা সবার জন্য নিশ্চিত করতে হবে। এ খাত বিশ্বায়নের সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত এবং এ খাতে বাংলাদেশের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের গার্মেন্ট শিল্প যেমন স্বল্প মজুরির মাধ্যমে বিশ্ববাজারে স্থান করে নিয়েছে, তেমনই আমাদের বিশাল তরুণ জনগোষ্ঠী রয়েছে। বলা হয়, জনসংখ্যার প্রায় ৬০ শতাংশ তরুণ। তাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে কাজে লাগানো গেলে দেশে বসেই বিদেশী কোম্পানিতে কাজ করা সম্ভব, যা অন্য কোনো খাতে সম্ভব নয়। এজন্য আমি মনে করি, এ খাতে প্রশিক্ষণে শূন্য দুর্নীতি নিশ্চিত করতে হবে এবং প্রশিক্ষকরা যেন সর্বোচ্চ জবাবদিহিতার আওতায় থাকে, তা নিশ্চিত করতে হবে। এ খাতে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনা সম্ভব।

আমাদের জনসংখ্যার প্রায় সাড়ে আট কোটি মানুষের গড় বয়স ২৬। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডের ব্যাপারে আমাদের বিশাল সম্ভাবনার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু আমাদের শিক্ষিত বেকার লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীকে কোন কোন খাতে দক্ষ মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তুলতে পারি?

স্নাতকদের জন্য সরকারি বা বেসরকারিভাবে নতুন বাজার খোলার প্রবণতা নেই। আমাদের জন্য অন্যতম বড় বাজার হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। আমাদের দেশের ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, হিসাববিজ্ঞানী কিংবা বিবিএ করা শিক্ষার্থীরা, যারা সাধারণত সাদা পেশার চাকরির জন্য প্রস্তুতি নেয়, তাদের জন্য নতুন বাজার তৈরি হচ্ছে না। আমি মনে করি, সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য একটি বড় সুযোগ আছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে, যেমন সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাই ইত্যাদির সঙ্গে একটি সংযোগ স্থাপনের। সৌদি আরবের বড় কোম্পানিগুলো যদি বাংলাদেশে এসে চাকরির মেলা আয়োজন করে, তাহলে আমাদের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সহজেই চাকরি পেতে পারেন।

মধ্যপ্রাচ্যে আমরা শ্রমিক পাঠাই, তবে সেখানে আমরা যথাযথ সম্মান পাই না। কিন্তু এসব দেশে আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকেও পাঠানোর সুযোগ রয়েছে, যা আমাদের ভেবে দেখা উচিত। এদিকে মনোযোগ দিলে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হতে পারে। আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো, যেমন ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলংকা ও চীন এ সুযোগগুলো ভালোভাবে কাজে লাগাচ্ছে। শুধু উদ্যোগের অভাবে আমরা এ সুযোগগুলো কাজে লাগাতে পারছি না। শ্রমিক পাঠানোর পাশাপাশি সাদা পেশার চাকরির জন্যও যদি আমরা জনবল পাঠাই, তাহলে মধ্যপ্রাচ্যে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি হবে।

ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া, এমনকি চীনে চাকরির বাজারে বাংলাদেশ কোন কোন খাতে নিজেকে তুলে ধরতে পারে?

এসব দেশের ক্ষেত্রে আমরা দক্ষ জনবল পাঠাতে পারি না। স্বল্প শিক্ষিত কাউকে শুধু প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ জনবলে রূপান্তর করা কিছুটা কঠিন। তুলনামূলকভাবে শিক্ষিত কাউকে দক্ষ করে তোলা সহজ। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া বা স্নাতক করা জনবলের ছয় থেকে দশ মাসের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে নির্দিষ্ট দেশের প্রয়োজনীয় দক্ষতা এবং ভাষা শিক্ষা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের দেশে এমন একটি ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে স্নাতকোত্তর করার পর তিন-চার বছর সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতে লেগে যায়। চাকরির বাজারে সরকারি চাকরির প্রতি যে প্রবণতা তা কমিয়ে দেশের বাইরের কাজের সুযোগকে সহজতর করতে হবে। এখানে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সিন্ডিকেট, যার ফলে শিক্ষার্থীরা বাইরে গিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা সম্পর্কে জানতেই পারে না। এক্ষেত্রে বিদেশে জনবল পাঠানোর প্রক্রিয়াকে আরো সহজ করতে হবে এবং খরচ কমাতে হবে। ভারত থেকে যখন একজন শ্রমিক মাত্র ১ লাখ টাকা খরচ করে মধ্যপ্রাচ্যে যেতে পারে, বাংলাদেশে কেন সেই খরচ ৭-৮ লাখ টাকা হবে? এই সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পরও এই সিন্ডিকেট ভাঙা হয়নি। আমরা দেখছি, আগে মালয়েশিয়ায় যে ১০০টির মতো প্রতিষ্ঠানের সিন্ডিকেট ছিল তা এখনো বহাল আছে।

সিন্ডিকেট ভেঙে বিদেশে জনবল পাঠানো এবং তাদের যাতায়াত সহজ করতে হবে, যাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময়ই শিক্ষার্থীরা এক্সপেরিমেন্টালভাবে বিদেশে যেতে পারে। বিমান ভাড়া কমানো গেলে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা ভ্রমণে যেতে পারবে, যা তাদের ক্যারিয়ার নিয়ে নতুন চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করবে এবং আরো সম্ভাবনা খুঁজে পাবে। আমাদের একটি সমস্যা হলো, আমরা বৈশ্বিক পরিমণ্ডলে চিন্তা করতে পারি না। বিশ্ব দেখতে আমাদের অনেক দেরি হয়ে যায়। ততক্ষণে আমাদের অনেক সময় নষ্ট হয়ে যায়। আমরা যদি বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকতেই বিশ্বের সঙ্গে পরিচিত হতে পারি, তাহলে আমাদের অর্থনৈতিক অগ্রগতির নতুন ধারা তৈরি হওয়ার সুযোগ থাকবে।

দক্ষ জনবল তৈরি না হওয়ার পেছনে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার দায় রয়েছে, বিশেষ করে প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে। শিক্ষা ব্যবস্থার সার্বিক উন্নতির জন্য আপনি কী কী প্রস্তাব করবেন?

আমার ব্যক্তিগত মতামত হলো, আমাদের শিক্ষকদের বেতন খুবই কম। বণিক বার্তার এক প্রতিবেদনে আমরা দেখেছি, এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশে প্রাথমিক শিক্ষকদের বেতন সবচেয়ে কম। যদি শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন নিশ্চিত করা না যায়, তাহলে কখনই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। প্রাথমিক শিক্ষা খাতে সবচেয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে। পাশাপাশি গ্রাম পর্যায়ের স্কুলগুলোর কাঠামোতেও উন্নয়নের অনেক সুযোগ রয়েছে। যদি শিক্ষকদের সর্বোচ্চ বেতন কাঠামো নিশ্চিত করা যায়, তাহলে সমাজে শিক্ষকদের জন্য সম্মান পুনরুদ্ধার হবে। পূর্বে শিক্ষকদের জন্য সমাজে যে মর্যাদা ছিল, আওয়ামী লীগ সরকার গত ১৫ বছরে তা ধ্বংস করেছে। শিক্ষকদের সামাজিক মর্যাদা নিশ্চিত করতে না পারলে মেধাবীরা শিক্ষকতা পেশায় আকৃষ্ট হবে না। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীরা সাধারণত প্রশাসন বা বিদেশী ক্যাডারে ঝোঁকে। তাদের এ ঝোঁক শিক্ষকতার দিকে নিয়ে আসতে হবে। তা না হলে আমাদের সামগ্রিক শিক্ষা ব্যবস্থায় পরিবর্তন আসবে না। এক্ষেত্রে আমাদের আরো কাজ করার সুযোগ রয়েছে। শিক্ষা ব্যবস্থায় সংস্কার ছাড়া দক্ষ জনবল তৈরি সম্ভব হবে না।

আপনারা দীর্ঘদিন রাজনৈতিক সংস্কারের দাবিতে সক্রিয় ছিলেন। ছাত্ররাজনীতি তথা জাতীয় রাজনীতিতে কী কী গুণগত পরিবর্তন আপনারা চান?

‘ছাত্ররাজনীতি করবে ছাত্ররা’—আমরা দীর্ঘদিন এ দাবি জানিয়ে আসছি। একই সঙ্গে ছাত্ররাজনীতি হতে হবে ছাত্রদের স্বার্থে। আমাদের দেশে যে সংগঠনগুলো বিদ্যমান, সেগুলোর নেতৃস্থানীয় পদগুলোয় যারা আসেন তাদের বয়স ৩০-৩৫ বছর হয়। তারা নিয়মিত ছাত্র নন। দলগুলোকে অবশ্যই এ পদগুলো দিতে হবে নিয়মিত ছাত্রদের। পাশাপাশি নিয়মিত ছাত্র সংসদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে। এ দুই পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা গেলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে বিশাল এক পরিবর্তন আসবে।

জাতীয় রাজনীতিতে শূন্যতার কারণ কী? লক্ষণীয় যে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে একটা শূন্যতা তৈরি হচ্ছে। এর মূল কারণ হলো, আমরা তরুণদের মধ্য থেকে নেতা পাই না, কারণ ছাত্র সংসদ নির্বাচন হয় না। বর্তমান সিস্টেমে কেউ যদি ছাত্ররাজনীতি করতে চান, তাকে একটি সিন্ডিকেটের মাধ্যমে যেতে হয়। আমরা এ ধরনের রাজনীতির বিলুপ্তি চাই।

একজন শিক্ষার্থী রাজনীতি করবে শিক্ষার্থীদের ভোটে এবং নেতা হবে শিক্ষার্থীদের ভোটে। নেতৃত্বের গুণাবলি শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় বিকশিত হতে হবে। শিক্ষার্থী থাকা অবস্থায় যদি সঠিক নির্বাচন দেখে, তাহলে তার মধ্যে ভোটের মাধ্যমে নির্বাচিত হওয়ার এবং জনগণের কাছে যাওয়ার মানসিকতা তৈরি হবে। কিন্তু বর্তমান সিস্টেমে ছাত্রনেতাদের শিক্ষার্থীদের কাছে যেতে হয় না, কারণ তাকে নেতা বানায় তার দল। ছাত্র সংগঠনগুলোর মধ্যে সঠিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া নেই। যখন বাস্তবিকভাবে ছাত্র সংসদ নির্বাচন এবং সঠিক নির্বাচনী প্রক্রিয়া থাকবে, তখন সত্যিকারের যোগ্য ব্যক্তিরাই নেতা হবে এবং জাতীয় রাজনীতিতেও ভূমিকা রাখতে পারবে। এভাবেই ছাত্ররাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তন আসবে। এটি আমাদের জাতীয় রাজনীতিকে সাহায্য করবে এবং ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গঠনের জন্য আমরা নেতা পাব। ছাত্র সংসদ নির্বাচন ছাড়া এক্ষেত্রে একটি বড় শূন্যতা তৈরি হবে।

পরবর্তী ছাত্র সংসদ নির্বাচন কবে প্রত্যাশা করছেন?

আমি মনে করি, যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন দিতে হবে এবং এ নির্বাচন অবশ্যই অনুষ্ঠিত করতে হবে। অনেকের ভয় থাকে যে ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিলে রাষ্ট্রে বিশাল নেতিবাচক ঘটনা ঘটবে। প্রকৃতপক্ষে এমন কিছুই হবে না। সর্বশেষ ঢাকসুর নির্বাচনে নুরুল হক নুর ভিপি হয়েছিলেন, কিন্তু পরে তিনি সরকার ফেলে দেয়ার মতো কিছু করেননি। ইলেকশন কেন্দ্র করে অনেক ঘটনা ঘটে, কিন্তু এজন্য কি আমরা নির্বাচন বন্ধ রাখব? ইলেকশন দিলে সমস্যা হবে, এমন ভয় দেখিয়ে নির্বাচন বন্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়। আওয়ামী লীগও নির্বাচনে বিএনপি বা জামাত এলে নানা অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটবে বলে ভয় দেখিয়ে ক্ষমতায় থেকেছে। ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়েও অনেকে ভয়ভীতি দেখাতে পারেন, কিন্তু ছাত্র সংসদ নির্বাচন দিতেই হবে। নিয়মিত নির্বাচন হলে এ ধরনের সমস্যা থেকে আমরা উত্তীর্ণ হতে পারব। যদি নির্বাচন না হয়, তাহলে আমরা এ সমস্যার সমাধান পাব না। ফলে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতেও শূন্যতা থেকে যাবে এবং এক সময় রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ ভেঙে পড়তে পারে। এজন্য যেকোনো মূল্যে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্র সংসদ নির্বাচন নিয়মিত আয়োজন করতে হবে এবং বৈধ শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

আপনারা কেমন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেন?

আমরা এমন একটি বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি যেখানে আমাদের পরবর্তী প্রজন্মকে আমাদের মতো একই জায়গায় স্ট্রাগল করতে হবে না। আমেরিকায় গণতন্ত্রের বয়স দু-তিনশ বছর। এ দীর্ঘ সময়ের পরও এখনো তাদের স্ট্রাগল করতে হয়। যেকোনো রাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক স্ট্রাগল প্রতিটি প্রজন্মকেই করতে হয়। তবে একই বিষয় নিয়ে যাতে আমাদের দীর্ঘকাল স্ট্রাগল করতে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে হবে। যেমন ছাত্র সংসদ নির্বাচন, ক্যাম্পাসে দমন-নিপীড়ন, নির্যাতন নিয়ে আমরা লড়াই করেছি। আমি নিজেও ভুক্তভোগী। আমার পরবর্তী প্রজন্ম যারা আসবে, তারা যাতে আমাদের লড়াইয়ের সুফল ভোগ করতে পারে। ক্যাম্পাসে কোনো ধরনের নির্যাতন না থাকে, সব শিক্ষার্থী যেন মত প্রকাশের স্বাধীনতা পায়। মেধার ভিত্তিতে যেন সিট বণ্টন নিশ্চিত হয়। ছাত্র সংসদ এবং একটি স্বাধীন, সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া থাকতে হবে। জাতীয় নির্বাচনে জনগণ যেন একটি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় ভোট দিতে পারে। জনগণের ভোটের মাধ্যমে যাতে সরকার গঠন ও বিদায় হয়।

শ্রুতলিখন: মিনহাজুল আবেদীন

আরও