আইন

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার অন্বেষণ

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলকরণ সম্ভবত এ মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত খবরের একটি।

যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কর্তৃক জন্মসূত্রে মার্কিন নাগরিকত্বের অধিকার বাতিলকরণ সম্ভবত এ মুহূর্তে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে আলোচিত খবরের একটি। এ আদেশের অর্থ হলো যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে জন্মগ্রহণকারী শিশুরা এখন থেকে আর কেবল মার্কিন ভূখণ্ডে জন্মসূত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবে না। এর আগে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প যুক্তরাষ্ট্রের এ ব্যবস্থাকে "জন্ম পর্যটন" হিসেবে অভিহিত করেছিলেন। অর্থাৎ শুধু সন্তান জন্মদানের উদ্দেশ্যে অনেকের যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমণ বন্ধ করতে চেয়েছেন। শপথ নেয়ার পর পরই তিনি এক শতাব্দীর অধিক সময় ধরে চলা এবং সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিত করা এ অধিকার বাতিল করলেন। তিনি ২০ জানুয়ারি আমেরিকান নাগরিকত্বের অর্থ এবং মূল্য রক্ষা" নামক নির্দেশিকায় স্বাক্ষর করেন। তবে আদেশটি স্বাক্ষরের ৩০ দিন পর কার্যকর হবে।

যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগত নাগরিকত্বের ইতিহাস: ১৭৭৬ সালে দেশটির স্বাধীনতার পর থেকে মার্কিন নাগরিকত্ব মূলত পৃথক রাজ্যের আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতো। যদিও ১৮৫৭ সালে বহুল সমালোচিত ড্রেড স্কট বনাম স্যান্ডফোর্ড মামলায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্ট (SCOTUS) রায় দিয়েছিলেন, যুক্তরাষ্ট্রে আনা দাস এবং তাদের বংশধরদের নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা যাবে না। তবে পরবর্তী সময়ে মার্কিন সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের আইনি স্বীকৃতি প্রদান করা হয়। এ-সংক্রান্ত বিখ্যাত ১৪তম সংশোধনীতে বলা হয়, যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী বা নাগরিকত্বপ্রাপ্ত সব ব্যক্তি এবং এর (যুক্তরাষ্ট্রের) এখতিয়ারের অধীন, তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং যে রাজ্যে বাস করেন সেই রাজ্যের নাগরিক।

পরবর্তী সময়ে যুক্তরাষ্ট্র বনাম ওং কিম আর্ক (১৮৯৮) মামলায় সুপ্রিম কোর্ট রায় দেন, কংগ্রেস কর্তৃক পাস হওয়া আইন এ দেশে জন্মগ্রহণকারীদের সংবিধানের স্পষ্ট শব্দের মাধ্যমে দেয়া নাগরিকত্বের অধিকার থেকে বাদ দিতে পারে না। আদালতে বিচারপতি হোরেস গ্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের পক্ষে সিদ্ধান্ত জানান যে ওংয়ের বাবা-মায়ের নাগরিকত্ব যা-ই হোক না কেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের"এখতিয়ারের অধীন"এবং সে দেশে জন্মগ্রহণকারী শিশু হিসেবে নাগরিকত্ব পাওয়ার জন্য যোগ্য ছিলেন। উপরন্তু আদালত নিশ্চিত করেন যে ওং কিম আর্ক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়ায় যে আমেরিকান নাগরিকত্ব অর্জন করেছিলেন তা তার জন্মের পর থেকে কোনো ঘটনার দ্বারা হারিয়ে যায়নি বা কেড়ে নেয়া হয়নি।

এরপর কংগ্রেস ১৯২৪ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী সব আদিবাসী আমেরিকানকে নাগরিকত্ব প্রদান করে। যুক্তরাষ্ট্রের ১৯৫২ সালের অভিবাসন ও জাতীয়তা আইন নাগরিকত্বের সংজ্ঞা নির্ধারণ করেছে এবং সেখানেও জন্মগত নাগরিকত্বের স্বীকৃতি রয়েছে। পরে ১৯৮২ সালে প্লাইলার বনাম ডো মামলায় পুনরায় সুপ্রিম কোর্ট অবৈধ অভিবাসীদের সন্তানদের জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার পুনর্ব্যক্ত করেছেন।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব অর্জন নীতির কোনো ব্যতিক্রম আছে কি?

হ্যাঁ, কূটনৈতিক দায়মুক্তিপ্রাপ্ত বিদেশী কূটনৈতিক কর্মকর্তার ঘরে জন্মগ্রহণকারী শিশু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নিলেও তাকে নাগরিক হিসেবে বিবেচনা করা হয় না। কারণ তারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারাধীন নয়। বরং ভিন্ন একটি স্বাধীন ভূখণ্ডের অধীন।

অধিকন্তু ২০২১ সালে সুপ্রিম কোর্ট ঘোষণা করেন যে আমেরিকান সামোয়ার অসংগঠিত অঞ্চলে জন্মগ্রহণকারী যে কেউ স্বয়ংক্রিয়ভাবে জন্মগত নাগরিকত্বের নিশ্চয়তা পাবে না, যদি না কংগ্রেস এ-সংক্রান্ত কোনো আইন প্রণয়ন করে তাদের নাগরিকত্ব প্রদান করে। এছাড়া শত্রু-দখলদারদের সন্তানরা জন্মগত নাগরিকত্বের অধিকার পায় না।

ট্রাম্পের নির্বাহী নির্দেশিকায় কী রয়েছে?

প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের এ নির্বাহী নির্দেশিকায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তিদের দুটি দলে ভাগ করা হয়েছে; যারা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের ভূসীমায় জন্ম নিলেই নাগরিকত্ব পাওয়ার অধিকারী হবে না। প্রথম দলে রয়েছে, যাদের মা অবৈধভাবে যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থিত ছিলেন এবং যাদের বাবা সন্তানের জন্মের সময় মার্কিন নাগরিক বা বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না এবং দ্বিতীয় দলে রয়েছে, যাদের মা যুক্তরাষ্ট্রে বৈধ কিন্তু অস্থায়ী ভিসায় ছিলেন, অর্থাৎ ছাত্র বা পর্যটক হিসেবে এবং যাদের বাবা তাদের জন্মের সময় মার্কিন নাগরিক বা বৈধ স্থায়ী বাসিন্দা ছিলেন না।

এ আদেশ সংবিধানের ১৪তম সংশোধনীতে ব্যবহৃত যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারের অধীন বাক্যাংশটির আইনি ব্যাখ্যার ওপর নির্ভর করে করা হয়েছে এবং ধরে নেয়া হয়েছে অবৈধ বা অ-নথিভুক্ত অভিবাসীরা যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারাধীন নয়; সুতরাং এ বিধানও তাদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। যদিও প্লাইলার বনাম ডো মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালত ১৯৮২ সালেই ঘোষণা করেছেন যে ১৪তম সংশোধনী অনুসারে বৈধভাবে প্রবেশকারী এবং অবৈধভাবে প্রবেশকারী অভিবাসীদের মধ্যে "কোনো যুক্তিসংগত পার্থক্য" নেই। কারণ উভয়ই তারা যে রাজ্যে বসবাস করেন সেই রাজ্যের দেওয়ানি ও ফৌজদারি আইনের অধীন। তাই ট্রাম্প প্রশাসনের এ যুক্তি আসলে আদালতে কতটুকু ধোপে টিকবে তা এখন দেখার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের প্রচলিত আইনি ব্যবস্থা অনুসারে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে সাংবিধানিক অধিকার কেড়ে নেয়া বা পরিবর্তন করা যায় না। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান পরিবর্তন বা সংশোধন বেশ জটিল প্রক্রিয়া, যার জন্য আইনসভার উভয় কক্ষের সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রয়োজন পড়ে।

এরই মধ্যে একজন ফেডারেল বিচারকের এ নির্দেশনার বিরুদ্ধে অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি

২৩ জানুয়ারি ওয়াশিংটন, অ্যারিজোনা, ইলিনয় ও ওরেগন রাজ্য জোটের মামলার ফলে মার্কিন বিচারক জন সি কফেনোর ট্রাম্পের এ-সংক্রান্ত নির্বাহী নির্দেশনার বিরুদ্ধে একটি অস্থায়ী স্থগিতাদেশ জারি করেছেন; যা আগামী ১৪ দিনের জন্য দেশব্যাপী জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব নিষিদ্ধের নির্বাহী আদেশটিকে সাময়িকভাবে স্থগিত করেছে। আদালত এ আদেশকে স্পষ্টতই ১৪তম সংশোধনীর সঙ্গে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক বলে অভিহিত করেছেন। তবে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের প্রশাসন জানিয়েছে, তারা এ অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার আদেশকে চ্যালেঞ্জ করবে।

জন্মসূত্রে নাগরিকত্বে অধিকার কেড়ে নেয়ার প্রভাব অভিবাসীদের ওপর কী হতে পারে?

ডোনাল্ড ট্রাম্প দাবি করেছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্রই পৃথিবীর একমাত্র রাষ্ট্র যেখানে জন্মসূত্রে সবাইকে নাগরিকত্ব প্রদান করা হয়। যদিও আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, কানাডা, মেক্সিকো, উরুগুয়ে, ভেনিজুয়েলাসহ বিশ্বের ৩০টিরও বেশি দেশে নাগরিকত্ব অর্জনের এ ব্যবস্থা রয়েছে। বিপরীতে যুক্তরাজ্য, আয়ারল্যান্ডসহ ২০টিরও বেশি দেশ তাদের এ-সংক্রান্ত নীতি পরবর্তী সময়ে পাল্টে ফেলেছে।

২০২২ সালের জানুয়ারিতে যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে আনুমানিক ১ কোটি ১০ লাখ অভিবাসী ছিল; যা কিছু বিশ্লেষকের মতে, এখন ১ কোটি ৩০ লাখ থেকে ১ কোটি ৪০ লাখ হবে বলে ধারণা করেন। তাদের যুক্তরাষ্ট্রে জন্মগ্রহণকারী শিশুদের সে দেশের সরকার মার্কিন নাগরিকত্বের অধিকারী বলে এখন মনে করে; যা এ নির্দেশিকা জারির পর জন্মগ্রহণকারী শিশুদের ক্ষেত্রে আর প্রযোজ্য হবে না। ফলে অবৈধ অভিবাসী বা স্বল্পমেয়াদি বা অস্থায়ী ভিসা গ্রহণকারীদের ওপর প্রভাব ফেলবে।

এ নীতির ফলে বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের অভিবাসীরা এবং এখন থেকে জন্ম নেয়া হাজার হাজার নবজাতকের ওপর প্রভাব ফেলবে। তাছাড়া নবজাতক শিশুরা মার্কিন নাগরিক হিসেবে এখন যেসব সুবিধা পায়; এ নীতির ফলে তারা তা থেকে এখন বঞ্চিত হবে। তাছাড়া এ নির্বাহী আদেশ আদালত থেকে বৈধতা পেলে তা যুক্তরাষ্ট্রের আইন ব্যবস্থায়ও নতুন প্রভাব ফেলবে। তখন দেখা যাবে, প্রেসিডেন্ট সিদ্ধান্ত নিতে পারবেন যে কে যুক্তরাষ্ট্রের এখতিয়ারের অধীন এবং কে নয়।

তবে আদালতের হস্তক্ষেপের কারণে ট্রাম্প প্রশাসন যদি এ নীতি বাতিল করে এবং তারা এ পন্থায় নির্দিষ্ট অভিবাসীদের সন্তানদের জন্মগত নাগরিকত্ব নিষিদ্ধ করতে না পারে; তাহলে ‘জন্ম পর্যটন’ ঠেকাতে ভিন্ন উপায় অবলম্বন করতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, গর্ভবতী ভ্রমণকারীদের জন্য স্বল্পমেয়াদি ভিসা বন্ধ বা সীমাবদ্ধ করার চেষ্টা করতে পারে, যাতে সেসব ভ্রমণকারী মার্কিন সীমান্তে তাদের সন্তান জন্ম দিতে না পারে এবং সেই সূত্রে স্বয়ংক্রিয় নাগরিকত্ব অর্জন করতে না পারে।

বাংলাদেশ কি জন্মগত নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেয়?

বাংলাদেশ তার নাগরিকত্ব আইনের অধীনে যুক্তরাষ্ট্রের মতো ভিন দেশের নাগরিকের সন্তানদের জন্মগত নাগরিকত্বকে স্বীকৃতি দেয় না। ১৯৫১ সালের নাগরিকত্ব আইনের ৪ ধারায় বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তির পিতা কোনো সার্বভৌম ক্ষমতার দূত হিসেবে বাংলাদেশে সুবিধাপ্রাপ্ত থাকেন এবং যদি তিনি বাংলাদেশের নাগরিক না হন, তবে তিনি জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাবেন না। এছাড়া কারো পিতা শত্রু দেশের নাগরিক হলে এবং কারো জন্ম শত্রু কর্তৃক দখলকৃত ভূমিতে ঘটলে তিনি জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিক হবেন না।

শত্রু দেশের নাগরিক হলেন এমন ব্যক্তি যারা বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, আঞ্চলিক অখণ্ডতা এবং স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দেয় না বা স্বীকৃতি দিতে অস্বীকার করে এবং যাদের নিজ দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর থেকে বাংলাদেশের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত ছিল বা আছে।

তবে নীতির ব্যতিক্রম হিসেবে জন্মসূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব অর্জন করা যেতে পারে, যদি কারো পিতা-মাতার পরিচয় বা জাতীয়তা অজানা থাকে। কিন্তু এক্ষেত্রে বাংলাদেশে জন্মগ্রহণকারী ব্যক্তি শত্রু বিদেশীদের সন্তান, অবৈধভাবে বা শরণার্থী হিসেবে বসবাসকারী হলে সেই ব্যক্তি এ ব্যতিক্রমের আওতাভুক্ত হবে না। এ কারণেই বাংলাদেশের ভূখণ্ডে জন্ম নেয়া রোহিঙ্গা শিশু এবং ১৯৭১ সালে আটকে পড়া পাকিস্তানি বিহারি সম্প্রদায়ের শিশুরা ২০০৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায়নি। সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগ ২০০৮ সালে এক রিট পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে মো. সাদাকাত খান (ফাক্কু) এবং অন্যান্য বনাম প্রধান নির্বাচন কমিশনার, বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশন মামলায় বাংলাদেশে আটকে পড়া পাকিস্তানি উর্দুভাষীদের নাগরিকত্ব ও ভোটাধিকার প্রদান করে।

রাইসুল সৌরভ: আয়ারল্যান্ডের গলওয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে ডক্টরেট (পিএইচডি) গবেষক; ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির আইন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক (শিক্ষা ছুটিতে)

আরও