অভিমত

দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি: দুর্বলতা বাজার নাকি তথ্য ব্যবস্থাপনায়?

কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম হুট করেই বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্য পাঁচ-সাত গুণ বাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল কাঁচামরিচের বাজার। বিগত সময়গুলোর মতো এবারো বাজার তদারকিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর কেউই দায় নিতে চাচ্ছে না। অস্থিতিশীলতার দায় একজন আরেকজনের ওপর চাপাচ্ছেন। আদতে

কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন খাদ্যপণ্যের দাম হুট করেই বেড়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা গেছে। মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে কোনো কোনো পণ্য পাঁচ-সাত গুণ বাড়ার ঘটনাও ঘটেছে। সম্প্রতি লাগামছাড়া হয়ে উঠেছিল কাঁচামরিচের বাজার। বিগত সময়গুলোর মতো এবারো বাজার তদারকিতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংস্থাগুলোর কেউই দায় নিতে চাচ্ছে না। অস্থিতিশীলতার দায় একজন আরেকজনের ওপর চাপাচ্ছেন। আদতে দুর্বলতা কোথায়? বছরে খাদ্যপণ্য কত উৎপাদন হচ্ছে তার তথ্যে? নাকি বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এর জন্য দায়ী। নাকি তথ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা দুটোই এখানে কাজ করছে।

ঈদের তিন-চারদিন আগেও রাজধানীতে কাঁচামরিচ প্রতি কেজি ২৫০ টাকার নিচে বিক্রি হয়েছে। এর আগের সপ্তাহে দাম আরো কম ছিল। অথচ ঈদের তিনদিন পর সে দাম গিয়ে ঠেকে ৫০০-৭০০ টাকায়। ঝিনাইদহে ১ হাজার টাকাও প্রতি কেজি বিক্রি হয়েছে। দেশের বিভিন্ন স্থানে ৭০০-৮০০ টাকা প্রতি কেজির দাম নিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। তাহলে মাত্র এক সপ্তাহের ব্যবধানে কী এমন হলো যে কাঁচামরিচের দাম হুহু করে বাড়তে বাড়তে এক হাজার টাকায় পৌঁছাল। যদিও এখন গ্রীষ্মকালীন মরিচের মৌসুম চলছে। ভরা মৌসুমে কাঁচামরিচের বাজারে অস্থিরতা কেন দেখা দিল? এর প্রেক্ষাপট জানতে একটু পেছনে ফিরে যেতে হবে। 

গত এপ্রিল ও মে মাসে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে কয়েক দফায় তীব্র তাপপ্রবাহ দেখা দেয়। সাধারণত মে মাসে গ্রীষ্মকালীন মরিচের ফুল আসা শুরু হয়। কিন্তু তীব্র তাপপ্রবাহের কারণে এ বছর পর্যাপ্ত ফুল আসেনি। যা এসেছে তা একেবারেই কম। আবার জুনে বৃষ্টি শুরু হলে মরিচ গাছগুলোর গোড়ায় পচন ধরতে শুরু করে। সাধারণত জুনের মাঝামাঝি থেকে শুরু করে মোট তিন মাস গ্রীষ্মকালীন মরিচ উত্তোলন করেন কৃষকরা। কিন্তু যেহেতু পর্যাপ্ত ফলন নেই বা মরিচ গাছ পচে যাচ্ছে সে কারণে আগে থেকেই অনুমেয় ছিল মরিচের সংকট দেখা দিতে পারে। তার ওপর জুনের শেষেই ছিল কোরবানির ঈদ। ঈদে মানুষ মসলা ও মরিচ এগুলোর ব্যবহার বেশি করে থাকে।

দেশের বাজারে কাঁচামরিচের দাম বাড়তে শুরু করলে গত ২৫ জুন থেকে আমদানির অনুমতি দেয়া শুরু করে কৃষি মন্ত্রণালয়। ২৬ জুন ৩৮ হাজার ৬৭১ কেজি কাঁচামরিচ আমদানি হয়। এর পর থেকেই ঈদের ছুটির কারণে আমদানি বন্ধ হয়ে যায়। ছুটি শেষে গত রোববার থেকে ফের আমদানি শুরু হলে আবার কমতে থাকে মরিচের দাম। যেহেতু আগে থেকেই অনুমেয় ছিল প্রতিকূল আবহাওয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় কাঁচামরিচের সংকট হতে পারে তাহলে আগে থেকেই কেন আমদানির অনুমতি দেয়া হলো না। যদিও কৃষি কর্মকর্তারা বলছেন, দেশে কাঁচামরিচের উৎপাদন খুব একটা কমেনি। তাহলে কি মাঠ পর্যায়ের তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার বিস্তর ফারাক রয়েছে? হঠাৎ বাজারে সংকট তৈরি হয়ে কেন কয়েক গুণ দাম বেড়ে গেল? এর দায় কার?

কিছুদিন আগে একইভাবে পেঁয়াজের দাম বাড়তে শুরু করে। তখন কৃষক কেবল খেত থেকে পেঁয়াজ উত্তোলন করেছেন। অর্থাৎ সংকট হওয়ারও কোনো কারণ নেই। যদিও উৎপাদনের তথ্য বলছে, চাহিদার চেয়ে দেশে কয়েক লাখ টন বেশি পেঁয়াজ উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু পেঁয়াজের ভরা মৌসুমে হুট করেই বাড়তে থাকে পেঁযাজের দাম। মাত্র সপ্তাহখানেকের ভেতর প্রায় দ্বিগুণের বেশি মূল্যবৃদ্ধি পায়। এরপর তড়িঘড়ি করে পেঁয়াজের আমদানির অনুমতি দেয়া হলে দাম কমতে শুরু করে। 

পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও এ বছর কাঁচামরিচের মতো উৎপাদন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। আবহাওয়ার পাশাপাশি ভেজাল বীজের কারণে বেশকিছু জেলায় কৃষকরা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন। অনেকের পেঁয়াজ খেতে কোনো ফলন হয়নি। আবার কিছু মানুষের খেতে বিভিন্ন বীজের মিশ্রণ থাকায় বিভিন্ন আকারের পেঁয়াজ হয়। যেগুলো নির্ধারিত সময়ের আগেই পচন শুরু হয়। সে কারণে কাঁচামরিচের মতো পেঁয়াজের ক্ষেত্রেও আগে থেকেই অনুমেয় ছিল পেঁয়াজের সংকট হতে পারে। কিন্তু কৃষি মন্ত্রণালয়ের উৎপাদনের পরিসংখ্যানের দিকে তাকালে দেখা যাবে পেঁয়াজের উৎপাদন চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। তথ্যে কি তাহলে ঘাটতি রয়েছে? সংকট দেখা দিচ্ছে কেন? আমদানিই বা করতে হচ্ছে কেন?

শুধু পেঁয়াজ কিংবা মরিচ নয়, অন্যান্য উৎপাদনের তথ্যের ক্ষেত্রেও সরকারি বিভিন্ন সংস্থার মধ্যে বিস্তর ফারাক লক্ষ করা যায়। আবার আন্তর্জাতিক সংস্থার পরিসংখ্যানে তা আরো অনেক কমে যায়। গত আমন মৌসুমে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ১ কোটি ৭০ লাখ টন চাল উৎপাদন হয়। সাধারণত তিন মৌসুমের চাল, গম, আলু ও পাটের তথ্য সমন্বয় করে থাকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো ও কৃষি সমন্ত্রণালয়। প্রতিবারই দেখা যায়, কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে উৎপাদনের যে তথ্য দেয়া হয় পরবর্তী সময়ে সমন্বয়ের ফলে বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী উৎপাদন আরো অনেকটা কমে যায়। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ আমনের উৎপাদন ১ কোটি ৪৬ লাখ টন হবে বলে জানিয়েছে। 

বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৯৭ লাখ টন। বছরে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত হিসেবে চালের ব্যবহার হয় ৩ কোটি ৫৫ লাখ টন। অর্থাৎ ৪২ লাখ টন চাল উদ্বৃত্ত থাকার কথা। কিন্তু ছয় মাস আগেও আমরা দেখেছি সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা চাল আমদানির জন্য দেশে দেশে সফর করছেন। আমদানির জন্য দেয়া হয়েছিল শুল্কছাড়ও। আবার ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রায় সাড়ে ১০ লাখ টন চাল আমদানি করতে হয়েছে। তাহলে উদ্বৃত্ত থাকা চাল কোথায় এমন প্রশ্নে রয়ে যাচ্ছে। আমাদের চালের চাহিদার তথ্যে ঘাটতি রয়েছে নতুবা আমাদের উৎপাদনের তথ্যে দুর্বলতা রয়েছে।

তথ্য ব্যবস্থাপনা সঠিকভাবে করতে না পারলে কোনো বিষয়েই সঠিক পর্যবেক্ষণ দেয়া যাবে না। নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও সঠিক নীতি গ্রহণ করা যাবে না। বর্তমান বিশ্বে তথ্যকে সবচেয়ে বেশি শক্তিশালী ধরা হয়। তথ্যে যে বেশি শক্তিশালী তাকে সবচেয়ে বেশি ক্ষমতাবান বলে ধরে নেয়া হয়। সঠিক তথ্যের কারণে অনেক বড় বিপর্যয় থেকেও মুক্তি পাওয়া সম্ভব। আবার তথ্য সঠিক না হলে ঠুনকো বিষয়েও মানুষকে অনেক বেশি ভুগতে হয়। যেটা বর্তমানে দেশের বাজারে দেখা যাচ্ছে।

কাঁচামরিচের মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে বাণিজ্যমন্ত্রী গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘কাঁচামরিচ কৃষিজাত পণ্য। উৎপাদন কত হলো এবং দাম কেন বেড়েছে, তা কৃষি মন্ত্রণালয় ভালো বলতে পারবে।’ কিন্তু বাজার নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা রয়েছে। হুট করে যদি কোনো পণ্যের দাম আকাশচুম্বী হয়ে যায় তাহলে এর দায় কে নেবে? যারা বাজার অস্থিতিশীল করে তুলছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা কে নেবে? 

কয়েক মাস আগে একইভাবে পোলট্রি ও ডিমের দাম মাত্র কয়েকদিনের ব্যবধানে দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি পায়। পোলট্রি মুরগির কেজি ৩০০ টাকাও বিক্রি হয়। অথচ প্রতি কেজি মুরগির মাংস উৎপাদনে খামারি পর্যায়ে খরচ হয় ১৬০-১৬৫ টাকা। আর করটোরেট পর্যায়ে তা আরো কমে ১৪০ টাকার মতো। এ তথ্য পোলট্রিসংশ্লিষ্ট একটি প্রতিষ্ঠানের জ্যেষ্ঠ এক কর্মকর্তাই গণমাধ্যমের কাছে স্বীকার করেন। উৎপাদন খরচ হিসাব করে ভোক্তা পর্যায়ে সর্বোচ্চ ২০০-২২০ টাকা হতে পারে। কিন্তু তা ৩০০ টাকা কীভাবে হলো তার সুষ্ঠু জবাব পাওয়া যায়নি। এই হুটহাট দাম বেড়ে যাওয়া বাজারের নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব তাহলে কার? বাজার নিয়ন্ত্রণে আমাদের যে দুর্বলতা রয়েছে তার দায়ভার কার?

ঠিক এ রকমভাবেই চিনির বাজারও অস্থিতিশীল। সরকারের বেঁধে দেয়া দাম অনুযায়ী বাজারে কিনতে পাওয়া যায় না। সবসময় ১৫-২০ টাকা বেশি দিয়ে প্রতি কেজি চিনি কিনতে হয় ভোক্তাদের। চিনি আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে সমন্বয় করেই এ দাম নির্ধারণ করে থাকে সরকার। তাহলে বেশি দাম দিয়ে কেন ভোক্তাদের কিনতে হচ্ছে?

বাজার অস্থিতিশীল হলে কৃষকরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হন। কারণ কারসাজির মাধ্যমে কোনো পণ্যের দাম কয়েক গুণ বাড়লেও কৃষকরা সে দাম পান না। মধ্যস্বত্বভোগীদের পকেটে সে টাকা চলে যায়। আবার আমদানি করা হলে সে কৃষকরা উৎপাদন খরচও তুলতে পারেন না। লোকসানেই বিক্রি করে দিতে হয় তাদের। এতে অনেক কৃষক চাষবিমুখ হয়ে পড়বেন। প্রতিনিয়ত আমাদের কৃষিজমি কমছে। এর ভেতরে অনেকেই কৃষি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। বৃহৎ এ জনগোষ্ঠীর খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কৃষককে কৃষিতে টিকিয়ে রাখার বিকল্প নেই। করোনার পরবর্তী সময়ে অনেক দেশ অর্থনৈতিকভাবে মারাত্মক সংকটে পড়লেও বাংলাদেশ খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। এর অবদান নিঃসন্দেহে কৃষির। 

এ কারণে বাজারসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো একে অন্যের ওপর দোষ না চাপিয়ে বরং সমন্বয় করা এখন বেশি জরুরি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোকে তথ্য ও বাজার ব্যবস্থাপনা মজবুত করার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে। কারা বাজার অস্থিতিশীলতার পেছনে দায়ী তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তবে এর জন্য প্রয়োজন সমন্বয়। সমন্বয় করতে না পারলে অদৃশ্য এ শক্তির হাতে দেশের মানুষকে প্রতিনিয়ত ভুগতে হবে। কখনো পেঁয়াজ, কখনো কাঁচামরিচ, কখনো চিনি, পোলট্রি, তেল বা অন্য কোনো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে নতুন ভোগান্তি আমাদের সামনে হাজির হবে। 

শাহাদাত বিপ্লব: সাংবাদিক

আরও