সময়ের ভাবনা

বিআরটি প্রকল্প ও বাংলাদেশ

সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তারই একটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পথে বিআরটি হচ্ছে। প্রকল্পের কোথাও উড়ালপথে, কোথাও বিদ্যমান সড়কে বিশেষ বাস চলাচল করার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

সড়কে নির্বিঘ্নে চলাচল নিশ্চিত করতে সরকার বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করেছে। তারই একটি বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে গাজীপুরের জয়দেবপুর পর্যন্ত ২০ দশমিক ৫০ কিলোমিটার পথে বিআরটি হচ্ছে। প্রকল্পের কোথাও উড়ালপথে, কোথাও বিদ্যমান সড়কে বিশেষ বাস চলাচল করার কথা রয়েছে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়।

২০১২ সালের ডিসেম্বরে শুরু হওয়া কাজ চার বছরেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু ১১ বছর অতিক্রম হলেও প্রকল্পটি এখনো শেষ হয়নি। উপরন্তু ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে বিআরটির কাজ চলায় ভোগান্তি এখন নিত্যসঙ্গী। কবে এ প্রকল্পের কাজ শেষ হবে সংশ্লিষ্ট কেউই বলতে পারছেন না। সময়মতো কাজ শেষ না হওয়ায় প্রকল্পের ব্যয় দুই হাজার কোটি টাকার বেশি বেড়ে গেছে।

উন্নত বিশ্বের যোগাযোগ ব্যবস্থার আদলে আমাদের দেশে বিআরটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়। এক্ষেত্রে অন্য দেশগুলো সফল হলেও বাংলাদেশ এখনো বিআরটি যুগে প্রবেশ করেনি। ১৯৭৪ সালে ব্রাজিলের কিউরিটিবা শহরে প্রথম বিআরটি প্রকল্প শুরু হয়। ইউরোপের ১৪টি দেশে বিআরটি চালু রয়েছে। চীন, আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, কলম্বিয়া, ভিয়েতনাম, ভারত, পাকিস্তান, তুরস্ক প্রভৃতি দেশেও বিআরটি সফলভাবে চলছে। এক্ষেত্রে ভিয়েতনামের উদাহরণটি বেশ চমকপ্রদ। দেশটিতে প্রথম বিআরটির সফলতার পর দ্বিতীয় বিআরটি রুটের পরিকল্পনা করা হয়েছে। 

২০১৩ সালে ভিয়েতনামের রাজধানী হ্যানয়ে বিআরটি প্রকল্প নেয়া হয় সড়কে শৃঙ্খলা আনার জন্য। ২০১৭ সালে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ প্রকল্পে যানবাহন চলাচল শুরু হয়। 

বিআরটির ফলে শহরটিতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহার হ্রাস পেয়েছে, ট্রাফিক জ্যাম কমেছে এবং গন্তব্যে যেতে মাত্র অর্ধেক সময় প্রয়োজন হচ্ছে। সেখানে প্রতি রুটে বাস চলাচলের জন্য ১৪.৭ কিলোমিটার দীর্ঘ পথ রাখা হয়েছে। এজন্য হ্যানয় শহরজুড়ে ৩৫টি পরিবহন ও ট্রাফিক সিগন্যাল, ২১টি স্টেশন, ২টি টার্মিনাল (কিম মা এবং ইয়েন এনঘিয়া), একটি ডিপো (ইয়েন এনঘিয়া), ১০টি পথচারী পারাপারের সড়কের ব্যবস্থা করা হয়েছে। 

হ্যানয়ের পরিবহন বিভাগের তথ্য অনুযায়ী বিআরটি বাস স্টেশনে পিক আওয়ারে প্রতি ৫ মিনিট পর বাস আসে। দিনের বেলায় অফ পিক আওয়ারে ৭ মিনিট পরে এবং সন্ধ্যায় ১০ মিনিট পর বাস পাওয়া যায়। এ বাস সার্ভিসের ৮০ শতাংশই শিক্ষার্থী ও অফিসে যাতায়াতকারী। সুবিধার কথা বিবেচনা করে ২৩ শতাংশ মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ি এমনকি মোটরসাইকেল বাদ দিয়ে এখন বাসে যাতায়াত করছে। উল্লেখ্য, হ্যানয় শহরে ৫ লাখের বেশি মোটরসাইকেল এবং আনুমানিক ৫ লাখ ৮৫ হাজার ব্যক্তিগত গাড়ি রাস্তার ৮৫.৮ শতাংশ দখল করে রাখে। বিআরটির কারণে শহরের পরিবেশেরও উন্নতি হচ্ছে, এসব গাড়ি চলাচল কমে আসায় ২০২৫ সালের মধ্যে সেখানকার ১,২২,১৭৭ টন কার্বন নিঃসরণ কমে আসবে।

বিআরটির জন্য মোট ৩৫টি বাস রাখা হয়েছে, এর মধ্যে ২৪টি বাস বিআরটি রুট ১-এর জন্য এবং বাকিগুলো বিআরটি রুট ২-এর জন্য রাখা হয়েছে। ভিয়েতনাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অষ্টম দেশ হিসেবে বিআরটি বাস্তবায়ন করেছে। বিআরটি সিস্টেমে বাসের গতি এবং মান নিশ্চিত করা হয়েছে। দ্রুত যাওয়ার জন্য বাসের আলাদা লেন রয়েছে, কিন্তু বাসগুলো কয়েকটি প্রশস্ত সমন্বিত লেনে চলাচল করতে পারে। তবে অন্য পরিবহনগুলো বাসের জন্য নির্দিষ্ট লেন ব্যবহার করতে পারে না। এবং যেখানে বাসের যাত্রী ওঠানামা করে সেখানে গাড়ি পার্ক করে না।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের একটি প্রতিনিধি দল তানজানিয়া ঘুরে এসে দেশটিতে ২০১৬ সালে বিআরটির কার্যক্রম শুরু করে। বর্তমানে দেশটির আহমেদাবাদে ‘বিআরটিএস’, ইন্দোরে ‘আইবাস’ এবং ভোপালে ‘মাই বাস’ নামে এটি চলছে। ভারতের বিআরটি প্রকল্প ছয়টি অংশে বিভক্ত, ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে প্রথম অংশ ২১.১ কিলোমিটারের কাজ সম্পন্ন হয়। রুটে ২৯টি স্টেশন রাখা হয়েছে। বিআরটির মাধ্যমে সরকারি বাসকে আরো দ্রুত, আরামদায়ক ও নারীর জন্য নিরাপদ করা হয়েছে। ২২.৩ কিলোমিটার দীর্ঘ রুটে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত বাসগুলো কয়েক মিনিট পর পর এসে দাঁড়ায়। বিআরটির ফলে অন্য বাসগুলোও আগের চেয়ে ১৫ মিনিট আগে আসতে পারে। পাঁচজন যাত্রীর মধ্যে একজন অন্য পরিবহন বাদ দিয়ে বিআরটিতে ভ্রমণ করে। এটিকে ভারত সরকারের ‘বেস্ট ম্যাস ট্রানজিট প্রজেক্ট’ ঘোষণা করা হয়েছে।

পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদে ২০১২ সালে শুরু হওয়া বিআরটি প্রকল্পের ফলে কার্বন নিঃসরণ হ্রাস হচ্ছে এবং দূষণ কমছে। নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত অধিবাসীদের জন্য সরকারি বাসে যাতায়াতের সুযোগ তৈরি হয়েছে এবং অনেক সময় সাশ্রয় হচ্ছে। এছাড়া সেখানে নারীরাও বিআরটির বাসে চলাচলে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছে। সিটিস ডেভেলপমেন্ট ইনিশিয়েটিভ ফর এশিয়ায় প্রকাশিত সংবাদে বিআরটির রাওয়ালপিণ্ডি-ইসলামাবাদ রুটে যাতায়াত করা তরুণী আয়েশা ইফতেখার জানান, মেট্রো বাস আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে যাওয়া সহজ করেছে। এমনকি আমার যদি সন্ধ্যায় ক্লাস থাকে, আমি বাসে একা যেতে ভয় করি না।

করাচিতে ২৬.৬ কিলোমিটার রাস্তায় বিআরটি প্রকল্প নেয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের ফলে শহরটির ১৫ লাখ মানুষ উপকার পাচ্ছে। ধুলা, গরম, দূষণ, কোলাহল থেকে মুক্তি পেতে পিক টাইমে হাজারো নাগরিক বিআরটিতে ভ্রমণ করছে। ২৮টি স্টেশনে ২৮ কিলোমিটার বিআরটি করিডরে ২টি ডিপো রাখা হয়েছে। বিআরটি প্রজেক্টের ফলে প্রতি বছর শহরটিতে আনুমানিক ৭৭,৯৭৯ টন কার্বন নিঃসরণ হ্রাস হবে।

উন্নত বিশ্বের পাশাপাশি প্রতিবেশী দেশগুলোতে বিআরটির সফল কার্যক্রম আমাদের আশান্বিত করে। কিন্তু আমাদের দেশে বিআরটি প্রকল্পের শুরুতেই গলদ ছিল। এটি গাজীপুর থেকে বিমানবন্দর হয়ে কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত হওয়ার কথা থাকলেও হচ্ছে গাজীপুর-বিমানবন্দর রুটে, যা ঢাকা শহরের যানজট নিরসনে খুব একটা কাজে আসবে না বলেই ধরে নেয়া হচ্ছে। কেননা বিমানবন্দর রোড থেকে গাজীপুর পর্যন্ত সড়কে যানজটের তেমন প্রকোপ ছিল না। মোটামুটি স্বাভাবিকভাবেই এ সড়কে যাতায়াত করা যেত। কিন্তু বর্তমানে বিআরটির জন্যই সারা বছরই রোডটিতে জ্যাম লেগে থাকে। এ প্রকল্পের কাজ শেষ না হওয়ায় আসন্ন ঈদে ঘরে ফেরা মানুষকে তীব্র দুর্ভোগ পোহাতে হবে এমন আশঙ্কা করা হচ্ছে। নিকট অতীতে খোদ মন্ত্রী পর্যায় থেকে বিআরটিকে গলার কাঁটা বলা হয়েছে। এখন এ প্রকল্প থেকে বের হয়ে আসার সুযোগও নেই। বাকি কাজটুকু যেভাবেই হোক শেষ করতে হবে। আর কাজগুলো এমনভাবে করা হয়েছে যার ফলে এর ডিজাইন পরিবর্তন করাও যাবে না। ঢাকার মূল সড়কের মধ্যে না হয়ে মহাসড়কে হওয়ায় মহাসড়কটির সক্ষমতাও উল্লেখযোগ্য মাত্রায় হ্রাস পেয়েছে। যদিও বিআরটি কর্তৃপক্ষ মহাসড়কের উন্নয়ন হয়েছে বলে দাবি করছে। অন্যদিকে বিআরটির জন্য আর্টিকুলেটেড বাস কেনার কথা, সেটিও কেনা হয়নি। অবশ্য প্রকল্পই যেখানে শেষ হয়নি, সেখানে অহেতুক বাস কেনারও তো দরকার নেই। 

এ শহরে প্রচুর ধুলো ওড়ে, ট্রাফিক জ্যামে সবার প্রাণ ওষ্ঠাগত, প্রচণ্ড ভিড়ে নারীদের জন্য আমাদের গণপরিবহনও স্বাচ্ছন্দ্যে চলাচলের উপযোগী নয়। শহরে ব্যক্তিগত গাড়ির তুলনায় পর্যাপ্ত গণপরিবহন নেই। আমাদের জন্য উন্নত দেশগুলোর মতো কার্যকর একটি উদাহরণ হতে পারত বিআরটি। ‍কিন্তু এটি এখন ভোগান্তির অন্য নাম হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্ট কেউই বলতে পারছেন না এ ভোগান্তি কবে নাগাদ শেষ হবে।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও