ড. মুস্তফা কে মুজেরী, ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ। এছাড়া বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) মহাপরিচালক ও সিরডাপের গবেষণা পরিচালকও ছিলেন। ব্যাংক ও আর্থিক খাতের নানা সংকট, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বিভিন্ন নীতি পর্যালোচনাসহ অর্থনীতির নানা ইস্যুতে সম্প্রতি কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবিদিন ইব্রাহিম
অর্থনীতির বিকাশে ব্যাংক খাত কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে?
বর্তমানে বাংলাদেশের অর্থনীতি যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে তাতে ভবিষ্যতে অর্থনীতিতে ব্যাংক খাতের ভূমিকা আরো বাড়বে। পুঁজিবাজারের প্রয়োজনীয়তাও আরো বাড়বে। দেশের অর্থনীতি আধুনিকতার দিকে অগ্রসর হবে, বিনিয়োগ আরো বাড়াতে হবে, ঋণ প্রদানের প্রয়োজনীয়তা বাড়বে। ক্ষুদ্র, কুটির, ছোট ও মাঝারি শিল্প (সিএসএমই) খাতকে এগিয়ে নিতে ব্যাংক খাতকেই ভূমিকা রাখতে হবে। অর্থনীতির আগামীর চালিকাশক্তি হবে সিএসএমই খাত। এ খাতকে গড়তে যে ঋণ ও আর্থিক সহায়তার প্রয়োজন সেটি ব্যাংক খাত থেকে নিশ্চিত করা না গেলে ভবিষ্যতে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে না। কাজেই এসব বিষয় মাথায় রেখেই বাংলাদেশকে অতীতের অনিয়ম-দুর্নীতির সংস্কৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। একটি নতুন দিনের সূচনা করতে হবে, যেখানে শুধু ব্যাংক ব্যবস্থায় নয়, সামগ্রিকভাবে আর্থিক ব্যবস্থায় শৃঙ্খলা এবং বিকাশ ঘটে সেটি নিশ্চিত করতে হবে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের তথ্যমতে, (বিএফআইইউ) দেশ থেকে প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। এখানে বাংলাদেশ ব্যাংকের দায় আছে কিনা? এ অর্থ ফিরিয়ে আনার কোনো উপায় আমাদের আছে কী?
প্রতি বছর ১৫ বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। অর্থ পাচারের বিভিন্ন প্রাক্কলন পাওয়া যাচ্ছে। কী পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা বের করার জন্য অন্তর্বর্তী সরকার বিভিন্ন কমিটি গঠন করেছে। তবে বাংলাদেশ থেকে প্রচুর অর্থ পাচার হয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত করার সুযোগ নেই। গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে, লন্ডনে একজনের নামেই ৬০০টির বেশি বাড়ি আছে। এটি তো একজনের কথা বলেছি। কিন্তু এ রকম আরো অনেক লোক আছে।
পাচারকৃত অর্থ দেশের ব্যাংক খাতসহ বিভিন্ন খাত থেকে বিদেশে পাচার করা হয়েছে। কাজেই গত ১৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে একটি বিষয় সহজেই বোঝা যাবে যে সে সময় উন্নয়নের যেসব গল্প শুনেছি সেসব গল্পের মধ্যে সত্যতা যেমন আছে তেমনি বিপুল পরিমাণ অর্থ অপচয়, আত্মসাৎ ও পাচারও হয়েছে, যা অকল্পনীয়। যে পরিমাণ অর্থ পাচার হয়েছে তা যদি দেশের অর্থনীতিতে বিনিয়োগ হতো তাহলে দেশের অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি বাড়ত। এসব কর্মকাণ্ড আগামী দিনের পথকে নানাভাবে অবরুদ্ধ করে তুলেছে। দেশের ঋণের বিরাট একটি দায় এবং বিভিন্ন প্রকল্প, বিশেষ করে অধিকাংশ মেগা প্রকল্পই দেশের জন্য আর্থিক বোঝা। অর্থাৎ যে প্রকল্প ১ হাজার কোটি ডলারে করা সম্ভব সেটি আমরা ১০ হাজার কোটি ডলারে করেছি। এগুলো বিরাট দায়।
বিশাল এ ঋণের দায়ভার পোহাতে আমাদের কেমন চ্যালেঞ্জের মধ্য দিয়ে যেতে হবে?
আমাদের আগামী দিনের চলার পথে এসব দায় বিশাল বাধা হিসেবে কাজ করবে। পাচারকৃত অর্থ ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান সহায়তা করে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমেও এগুলো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। যে অর্থ দেশের বাইরে চলে গেছে তা ফিরিয়ে আনা যেমন একটি জটিল তেমনি দীর্ঘকালীন প্রক্রিয়াও বটে। কারণ যেসব দেশে অর্থ পাচার হয়েছে তাদের সহযোগিতা যেমন দরকার তেমনি পাচারকৃত অর্থের সঠিক হিসাব, কাগজপত্র বা প্রামাণ্য দলিল দস্তাবেজ যথাযথভাবে সংগ্রহ করা প্রয়োজন। এছাড়া আইনি যেসব প্রক্রিয়া রয়েছে সেগুলোও খুব জটিল ও সময়সাপেক্ষ। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরি হয়েছিল, সেটির এখন পর্যন্ত আমরা স্বল্প পরিমাণে টাকা ফিরে পেয়েছি। কিন্তু বড় অংশটিই উদ্ধার করা যায়নি এবং আদৌ ফেরত পাওয়া যাবে কিনা সে বিষয়েও সন্দেহ আছে। আর পেলেও কবে পাব তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। এখন পর্যন্ত আমরা ওই অর্থ ফেরত আনতে সক্ষম হইনি। কাজেই একটি বিষয় মাথায় রাখা দরকার, যে দেশে আমাদের বিপুল পরিমাণ অর্থ রয়েছে, একটি জটিল প্রক্রিয়ায় সে দেশ থেকে অর্থ ফেরত আনতে হবে। এর জন্য যে সময় প্রয়োজন সে সময় আমাদের বিনিয়োগ করতে হবে।
বড় অংকের এ অর্থ পাচারের দায় কার ওপর বর্তায়?
দায় সবারই আছে। এখানে সরকারেরও দায় আছে। কারণ দেশ থেকে যখন টাকা বাইরে চলে গেল তখন এর জন্য সরকার যেমন দায়ী, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকও দায়ী, গোয়েন্দা সংস্থাসহ সব পক্ষই দায়ী। কারণ এটি একদিনে ঘটেনি, এ প্রক্রিয়া একটা দীর্ঘ সময় ধরে ঘটেছে। অর্থ সরানোর প্রক্রিয়া একটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ঘটেছে। কাজেই প্রভাবশালী রাজনৈতিক ছত্রছায়ার বাইরে গিয়ে এ বিপুল পাচার ঠেকানোর মতো সৎসাহস খুবই অভাব ছিল তখন। ফলে এসব প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বরতরা আরো সহযোগী হিসেবে কাজ করতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছেন। এসবের ফলেই কিন্তু এ ঘটনা ঘটেছে।
নীতিনির্ধারকদের এ মুহূর্তে করণীয় কী বলে মনে করেন?
আমাদের সঠিক নীতিগুলো গ্রহণ করার পাশাপাশি তা প্রয়োগের ক্ষেত্রে কোনো রকমের ছাড় দেয়া যাবে না। যখনই একটি ছাড় দেয়া শুরু হয় তখনই এ ঘটনাগুলো সিরিজ আকারে ঘটতে থাকে, যা বিভিন্ন সময় দেখা গেছে। এ ধরনের ঘটনার রোধকল্পে অতীত অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেয়া যাবে না। আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে হলে অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য দ্রুত একটি পথে যাওয়া প্রয়োজন। কারণ রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশ কতগুলো লক্ষ্য অর্জন করতে চায়। এসডিজির অভীষ্টগুলো বাংলাদেশ ২০৩০ সালের মধ্যে অর্জন করতে চায়। এছাড়া বাংলাদেশের নিজস্ব অর্থনৈতিক দারিদ্র্য বিমোচনের যে লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে, বৈষম্য দূরীকরণের যে প্রচেষ্টাগুলো আছে, সেগুলোয় সফল হওয়ার মাধ্যমে দেশের মানুষগুলোর জীবনকে উন্নততর করতে হবে। মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন করতে হবে। এখনো প্রচুর মানুষ রয়েছেন যারা কভিডের আঘাতের পর এবং দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণে খুবই দুঃসহ জীবন যাপন করছে। কাজেই এ পরিস্থিতি থেকে বের হয়ে তাদের জন্য যদি একটি সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তুলতে চাই, তাহলে এ ধরনের কর্মকাণ্ডের কোনো স্থান থাকতে পারে না এ দেশে।
খেলাপি ঋণ আমাদের আরেকটি মাথাব্যথার কারণ। খেলাপি ঋণ বন্ধ করার পাশাপাশি ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংক বা অন্য ব্যাংকগুলো কী পদক্ষেপ নিতে পারে?
বাংলাদেশে খেলাপি ঋণের একটি সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। এ সংস্কৃতি আমরাই তৈরি করেছি। যারা নীতিবিশারদ ছিলেন তাদের সাহায্যে রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় খেলাপি ঋণকে লালন-পালন করা হয়েছে।
দিনের পর দিন খেলাপি ঋণকে পরিপুষ্ট করা হয়েছে যাতে এটা বাড়তে থাকে। অর্থাৎ আমরা চেয়েছি আমাদের ঋণগুলো খেলাপি হোক। সেজন্য যেসব সুবিধা দেয়া প্রয়োজন ছিল সেগুলো আমরা দিয়েছি। সরাসরি রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় খেলাপি ঋণের একটি সংস্কৃতি গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশে। দেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিরা সমাজের শীর্ষ স্থানগুলো দখল করেছিলেন, সমাজে সবচেয়ে বেশি তারাই সমাদর পেয়েছেন।
এ সংস্কৃতি বিলোপে নীতিনির্ধারকদের করণীয় কী?
এ সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ করতে প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে বাংলাদেশ ব্যাংককে সচেষ্ট হতে হবে। বর্তমানে দেশের এ পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে একটি ঋণও খেলাপি হতে দেবে না, এ ধরনের অঙ্গীকারবদ্ধ হতে হবে বাংলাদেশ ব্যাংককে। খেলাপি ঋণের সংস্কৃতি ভাঙার জন্য প্রথমেই আমাদের নতুন খেলাপি ঋণ তৈরি বন্ধ করতে হবে যাতে এটা আবার নতুন করে সংখ্যায় বাড়তে না পারে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য ব্যাংকসহ যত আর্থিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে কোথাও আর কেউ নতুন করে খেলাপি ঋণ করতে পারবে না—প্রথমেই সে ধরনের উদ্যোগ নেয়া উচিত। খেলাপি ঋণের একটি বড় অংশই দেশের শীর্ষস্থানীয় কিছু ঋণখেলাপির কাছেই আছে। কাজেই তাদের কাছ থেকে এ অর্থ উদ্ধার করতে হবে। তারা যদি আলোচনার মাধ্যমে খেলাপি ঋণ ফেরত দিতে সম্মত হন তাহলে ব্যাংকগুলো নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সেগুলো পাওনা অনুসারে আদায় করে নেবে। কেননা খেলাপি ঋণ ফেরত দিতে তারা সক্ষম। আর যদি তারা সেগুলো ফেরত দিতে সম্মত না হন তাহলে তাদের অনেক ধরনের সম্পদ রয়েছে, বিশেষ করে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান, বিনিয়োগ রয়েছে, সেখান থেকে খেলাপি ঋণের সমপরিমাণ অর্থ আদায় করে নিতে হবে। আদালতের মাধ্যমে বাজেয়াপ্ত করেই খেলাপি ঋণ আদায় করে নিতে হবে। অর্থাৎ যেভাবেই হোক তাদের কাছ থেকেই ঋণ অবশ্যই আদায় করতে হবে। বাংলাদেশের শীর্ষ ঋণখেলাপিদের ঋণগুলো আদায় করা সম্ভব হলে দেশের মোট খেলাপি ঋণের ৮০-৯০ শতাংশ আদায় হয়ে যাবে। খেলাপি ঋণ তাদের কাছেই পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে। তাদের ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তারা এসব ঋণ পরিশোধ করেননি। কাজেই এখন তাদেরকে ঋণ পরিশোধে বাধ্য করতে হবে। এভাবে খেলাপি ঋণের যে পুঞ্জীভূত আবর্জনা রয়েছে সেগুলো মোটামুটিভাবে পরিষ্কার করা সম্ভব হবে। আর বাকি যেগুলো থাকবে, সেগুলো ধীরে ধীরে আদায় করা যাবে। সুতরাং দুটো জায়গায় এখন দৃষ্টি দেয়া প্রয়োজন। এক. নতুন করে খেলাপি ঋণ সৃষ্টি রোধ করতে হবে এবং এর জন্য যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। দুই. শীর্ষ যেসব ঋণখেলাপি রয়েছেন তাদের কাছ থেকে ঋণগুলো আদায় করা। ঋণখেলাপিদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়, কারণ দেশেই বিভিন্ন খাতে তাদের প্রচুর অর্থবিত্ত ও সম্পদ রয়েছে। সরকার আন্তরিক হলেই তাদের কাছ থেকে ব্যাংকগুলোর পাওনা আদায় করা সম্ভব। আর একটি বিষয় মাথায় রাখা প্রয়োজন যে এখানে কোনো ছাড় দেয়া চলবে না। দ্রুততম সময়ে আমাদের এখন এগুলো আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।