মানবসভ্যতায় আগুনের আবিষ্কার যেমন প্রযুক্তির উন্নয়নে এক বিশাল মাইলফলক তেমনি পরিবেশের পরিবর্তনেও বিরাট ভূমিকা রেখেছে। তবে সাম্প্রতিক দশকগুলোয় পরিবেশে যে নেতিবাচক পরিবর্তন পরিলক্ষিত হচ্ছে, তা লম্বা সময় ধরে পরিবেশ দূষণ এবং গত শতক থেকে দ্রুত উন্নয়নের নামে পরিবেশের ওপর জুলুমের ফল। প্রযুক্তির উন্নয়ন নিঃসন্দেহে পৃথিবীতে মানুষের বসবাসকে অনেক আরামপ্রদ করেছে কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে এটি পরিবেশের দূষণকে তীব্রতর করেছে এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এখনো মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করছে।
প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার বছর আগে মানুষ শিখেছিল কীভাবে আগুন ব্যবহার করতে হয়। মূলত বন্যপ্রাণীর আক্রমণ এবং ঠাণ্ডা থেকে রক্ষা পাওয়ার কাজে প্রথম দিকে আগুনের বহুল ব্যবহার শুরু হয়। ধারণা করা হয়, মানুষ যখন প্রথম পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মাধ্যমে আগুন জ্বালাল তখন যে ধোঁয়ার সৃষ্টি হলো সেটাই ছিল মানবসৃষ্ট প্রথম বায়ুদূষণ। অর্থাৎ এখান থেকেই বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সংযোজন হতে থাকে এবং ক্রমে তা বাড়তে থাকলে বায়ুমণ্ডলে ব্যাপক দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এছাড়া প্রায় ১১ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে মানুষের মাধ্যমে বনে আগুন লেগেছিল এমন প্রমাণ মিলেছে কাঠের পোড়া কয়লা, জ্বালানি কাঠের পোড়া রেণুর অস্তিত্ব থেকে। এ সময় থেকেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে বাঁচার পরিবর্তে প্রকৃতিকে নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে বেঁচে থাকার কৌশল পরিবর্তন শুরু করে।
বলা চলে ১০ হাজার খ্রিস্টপূর্বাব্দে মধ্যপ্রাচ্যের ‘ফার্টাইল ক্রিসেন্ট’ অঞ্চলে বসতি স্থাপন করার জন্য মানুষ কাদা-মাটি, বন পরিষ্কার করে ভূমির পরিবর্তন করে এবং এভাবে প্রকৃতি বিনাশ ছড়িয়ে পড়তে থাকে। বসতি স্থাপনের পর মানুষ ভেড়া, ছাগল, কুকুরসহ নানা প্রাণী পোষ মানাতে এবং পালন করা শুরু করে। মানুষের মধ্যে গৃহে প্রাণী পোষ মানানো এবং লালন-পালনের সঙ্গে সঙ্গে উন্নয়ন এবং সম্পদ বৃদ্ধির চিন্তা বিস্তার লাভ করে। প্রকৃতিকে নিজের অনুকূলে ব্যবহারের সাফল্য সভ্যতার উন্নয়নে মানুষকে আরো উদ্বুদ্ধ করে, যা পরে তাদের নগরজীবন গড়ার পথ দেখায়। এভাবে নাগরিক সভ্যতার উদ্ভব হলে যেমন নগরের বিস্তার হতে থাকে তেমনি বিস্তার হতে থাকে শহুরে জীবনের।
মেসোপটেমীয় সভ্যতা যেটি বর্তমানে ইরাক একসময় ছিল পলল সমভূমি। মূলত মেসোপটেমীয় সভ্যতাকে প্রথম নগর সভ্যতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং এখানকার ঘন বনভূমি পরিষ্কার করে ব্যাবিলন শহর প্রতিষ্ঠা করা হয়। মেসোপটেমিয়ান অধিবাসীরা খাল কেটে প্রথম সেখানে সঠিকভাবে পানি সেচের ব্যবস্থা শুরু করে বলে ধারণা করা হয়। তবে দুঃখের বিষয় হলো সেচ প্রক্রিয়া শুরু করলেও সঠিক পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা না থাকায় নদীর ভাঙন এবং গভীরতা কমে যাওয়ায় বন্যা ছড়িয়ে পড়ে, যা ক্রমে এ সভ্যতার বিলুপ্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
আধিপত্যবাদী রোমান সভ্যতার আধিপত্যের একটি বিরাট প্রভাব রয়েছে প্রকৃতির ওপর। রোমান সভ্যতায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বনভূমি এবং বন্যপ্রাণী। রোমানরা বন্যপ্রাণীর নানামুখী ব্যবহার করত। রোমানরা সঠিক নিষ্কাশন ব্যবস্থা তৈরি করতে গিয়ে জলাভূমি ধ্বংস করেছে। এছাড়া বিভিন্ন প্রাণী উৎসর্গ এবং পশুর নানাবিধ ব্যবহারের রেওয়াজ ছিল তাদের। বন্যপ্রাণী শিকারের পর এর চামড়া দিয়ে বিভিন্ন পোশাক ও আসবাবপত্র তৈরি করত রোমানরা। এর বাইরে শিল্প খাতকে সমৃদ্ধ করতে, বিনোদন খাতের উন্নয়নেও তারা পশু এবং পশুর চামড়া ব্যবহার করত। ফলে অনেক বন্যপ্রাণী তাদের হাতে বিলুপ্ত হয়েছে। বর্ধিত চাহিদা মেটাতে রোমানরা ইউরোপ, আফ্রিকা এমনকি এশিয়ার থাইল্যান্ড থেকে স্তন্যপায়ী প্রাণী, সরীসৃপ এবং পাখি আমদানি করত। রোমানদের এ প্রাণী সংগ্রহ আফ্রিকার উত্তরাঞ্চল, নীল নদের নিম্ন অববাহিকা, সিরিয়ার কিছু অংশ পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে এবং প্রাণী শিকারকে বিস্তৃত করে, যার ফলে বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী আশঙ্কাজনকভাবে কমতে শুরু করে।
শিল্প-কারখানা থেকে শুরু করে নির্মাণসামগ্রীর ভারী ধাতুর ব্যবহার মূলত রোমান সভ্যতায় বিকশিত হয়। বিশেষ করে রোমানরা স্থাপত্য, জাহাজ নির্মাণ, স্টেশনারি তৈরিসহ নানা কাজে সিসার ব্যাপক ব্যবহার শুরু করে। রোমানদের অ্যালকোহলের প্রতি বিশেষ আসক্তি ছিল এবং এসব অ্যালকোহল সংরক্ষণের কাজে বিশেষ করে এর গাজনকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্য সিসা ব্যবহার করা হতো। বলা হয়ে থাকে অ্যালকোহলের মাধ্যমে সিসা গ্রহণ করায় রোমানরা মরণঘাতী রোগে আক্রান্ত হতে থাকে এবং এ সভ্যতায় বিপর্যয় নেমে আসে। সিসার অতিরিক্ত ব্যবহার এবং এর সংস্পর্শের কারণে রোমান সাম্রাজ্য এবং তখনকার অভিজাতদের মধ্যে ‘প্লাম্বিজম’ এবং ‘স্যাচুরিন গাউটে’ আক্রান্ত হওয়ার কথা প্রায়ই শোনা যেত। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে এবং এভাবে রোমান সভ্যতার সমাপ্তি ঘটে। প্রাচীনকাল থেকে সিসার ব্যবহার বাড়তে থাকায় রোম সাম্রাজ্যের পতন পর্যন্ত এর পরিমাণ প্রায় ৪০ মিলিয়ন টনে পৌঁছায় বলে অনুমান করা হয়। রোমানদের দ্বারা ভারী ধাতু সিসা ব্যাপক ব্যবহারের কারণে সিসাকে ‘রোমান মেটাল’ হিসেবেও আখ্যায়িত করা হয়।
প্রাক-শিল্প যুগে সমসাময়িক পরিপ্রেক্ষিতে মানুষের সংস্কৃতি, ধর্মীয় বিশ্বাসও পরিবেশের পরিবর্তনে ভূমিকা রেখেছে বলে মনে করা হয়। মানুষের এমন বিশ্বাস গড়ে ওঠে যে সমুদ্রের মাছের ওপর এবং আকাশের পাখির ওপর এবং পৃথিবীতে চলাচলকারী সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর ওপর কর্তৃত্ব রয়েছে তাদের। এটিকে আধিপত্যের সুযোগ হিসেবে কাজে লাগিয়ে প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের মতো করে ব্যবহার করেছে মানুষ এবং এতে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সূচনা হয়েছে। তবে বিশ্বের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা ঘটে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে, তখন ব্রিটেনে দ্বিতীয় রিচার্ডের শাসনামলে বায়ূদূষণ রোধে প্রথম আইন প্রণয়ন হয়।
মিসরবিদ জ্য ব্যাপ্টিস্ট জোসেফ ফুরিয়ার (১৭৬৮-১৮৩০) সে সময় তাপ সঞ্চালন তত্ত্বের কথা বলেছিলেন যেটি হট হাউজ ইফেক্ট নামে পরিচিত ছিল, যা পরে উদ্ভূত ‘গ্রিন হাউজ ইফেক্টে’র সঙ্গে মিলে যায়। ফ্রেডরিখ এঙ্গেল তার ‘দ্য কন্ডিশন অব দ্য ওয়ার্কিং ক্লাস অব ইংল্যান্ড’ বইয়ে ইঙ্গিত দিয়েছেন যে শিল্প বিপ্লবের সঙ্গে দূষণ সমস্যা অনেক গুণ বেড়েছে।
১৮৬৩ সালে ব্রিটেন ‘অ্যালকালি অ্যাক্ট’ (ক্ষার আইন) প্রবর্তন করে, যেটি দূষণের ইতিহাসে একটি নতুন সংযোজন, যেটি পরে ১৮৭৪ সালে সংশোধন করা হয়েছিল। সুইডিশ বিজ্ঞানী আরহেনিয়াস (১৮৫৯-১৯২৭) অনেক আগেই বলেছিলেন কয়লা খনি থেকে কয়লা উত্তোলন যেন কয়লা খনিগুলোকে বাষ্পায়িত করে বাতাসে ছেড়ে দিচ্ছে, এর ফলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ দ্বিগুণ হলে বিশ্বব্যাপী বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেড়ে যেতে পারে এবং তাপমাত্রা বৃদ্ধির ফলে বরফ গলে যেতে পারে এবং সমুদ্রের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। আমরা ‘গ্রিন হাউজ ইফেক্ট’ নামে যে বিষয়টি এখনো আলোচনা করছি, যার প্রতিকারের জন্য নানা দেন-দরবার করছি তার পূর্বাভাস অনেক আগেই এসেছিল। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে খরার কারণে সেখানকার চাষযোগ্য জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি ধুলায় পরিণত হয়, যা বাতাসের মাধ্যমে উড়ে গিয়ে বায়ুমণ্ডলে ধূলিকণার মেঘ তৈরি করে এবং সূর্যের আলো প্রবেশে বাধা দিয়ে চারদিক অন্ধকারাচ্ছন্ন করে ফেলে। ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার’ নামে আমরা আজও বাতাসের অবস্থা নিরূপণে এর পরিমাপ করে থাকি। ঢাকা, দিল্লির বাতাসে এ ‘পার্টিকুলেট ম্যাটার’ বা সূক্ষ্ম ধূলিকণার পরিমাণ বরাবরই বেশি পাওয়া যায়। সভ্যতার বিকাশে ১৯৩০ সালের এক ডিসেম্বরে বেলজিয়ামের মিউজ উপত্যকার একটি ভারি শিল্পোন্নত এলাকা ঘন কুয়াশায় ছেয়ে যায় এবং তিনদিন পর্যন্ত স্থায়ী হয়, যার কারণে ৬ জন মৃত্যুবরণ করে এবং শতাধিক মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। এমনি ঘন ধোঁয়াশাচ্ছন্ন অবস্থার কবলে পড়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ১৯৪৮ সালে ফলে পেনসিলভানিয়ার ডোনোরোর শহরের ১২ হাজার ৩০০ বাসিন্দার অর্ধেক অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং ২০ জন প্রাণ হারায়।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সেই বিপর্যয়ের পরে ১৯৫২ সালে লন্ডন আচ্ছাদিত হয়ে পড়ে ঘন কালো কুয়াশায়, যার ফলে ৪ হাজার মানুষ মৃত্যুবরণ করে। অধুনা উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে পরিচিত দেশগুলো তাদের এ ‘উন্নত’ অভিধা লাভের পেছনে যে বিশাল দূষণের পাহাড় গড়েছে তা বিভিন্ন সময়ে পরিবেশ ও আবহাওয়া বিপর্যয়ের ঘটনা থেকে পরিষ্কার হয়। বায়ুদূষণের পর বড় দুর্যোগের খবর আসে জাপান থেকে। ১৯৫০-এর দশকে জাপানের মিনামাটা উপসাগরের আশপাশে বসবাসকারী জেলেরা রহস্যজনকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ে এবং পরে দেখা যায় যে এদের সবাই পারদের বিষক্রিয়ায় ভুগছিল। লেদের এ অসুস্থতাকে নাম দেয়া হয় ‘মিনামাটা ডিজিজ’। মিনামাটা উপসাগরের কাছাকাছি শিল্প-কারখানা থেকে নিঃসরিত পারদ উপসাগরের পানিতে এসে মিশতে থাকে এবং পারদ দূষণের সূত্রপাত হয়, মিনামাটা রোগে ২ হাজার মানুষ আক্রান্ত হয় এবং ৪৩ জন মারা যায়। পারদের বিষক্রিয়া থেকে সাধারণত বিভিন্ন শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ অবশ হয়ে যেতে পারে, নার্ভাস সিস্টেম বিকল হয়ে যেতে পারে, এ ধরনের সমস্যায় ৭০০ জন স্থায়ীভাবে আক্রান্ত হয়।
আধুনিক বিজ্ঞানের বিশাল সাফল্য পারমাণবিক শক্তিকে নিজের করায়ত্ত করা। পারমাণবিক জ্বালানি ইউরেনিয়াম ব্যবহার করে শক্তি উৎপাদন এখন অনেক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে, যদিও এর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা রয়েছে। ১৯৮৬ সালে রাশিয়ার চেরনোবিল পারমাণবিক পাওয়ার প্লান্টে বিস্ফোরণ থেকে ভয়াবহ তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে। এর ফলে ১ লক্ষাধিক মানুষকে তাদের বাড়িঘর থেকে সরিয়ে নিতে হয়েছিল এবং তেজস্ক্রিয়া ছড়িয়ে পড়ে ইউরোপের বিশাল অঞ্চলে।
স্থল এবং অন্তরিক্ষকে দূষণের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ জলভাগের দূষণও ঘটাতে থাকে। বিশ্বব্যাপী পণ্য পরিবহনের বহুল ব্যবহৃত পথ হচ্ছে সমুদ্র এবং পরিবহনের জন্য অতি প্রয়োজন জ্বালানি তেল এবং জাহাজ। ১৯৮৯ সালের ২৪ মার্চ আলাস্কার প্রিন্স উইলিয়াম সাউন্ডে ‘এক্সন ভাল্ডেজ’ নামের তেল ট্যাংকার দুর্ঘটনায় ৪২ মিলিয়ন লিটার অপরিশোধিত তেল নিঃসরণ করে এবং এ কারণে বিপুলসংখ্যক মাছ ও সামুদ্রিক পাখি মারা যায়। এভাবে জল, স্থল, অন্তরিক্ষ সর্বত্র দূষণ ছড়িয়ে পড়ে।
যান্ত্রিক যানবাহনের সংখ্যা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বায়ুদূষণও বাড়তে শুরু করে। জীবাশ্ম জ্বালানিচালিত যানবাহনের সংখ্যা বাড়ার ফলে রাস্তাঘাটে দীর্ঘ ট্রাফিক জ্যামের সৃষ্টি হতে থাকে এবং বাতাসে মিশতে থাকে প্রচুর পরিমাণ কার্বন ডাই-অক্সাইড, কার্বন মনোঅক্সাইড, জ্বালানিতে থাকা ভারী ধাতু যেমন সিসা। শুধু উন্মুক্ত বায়ুমণ্ডলের দূষণই নয়, এর সঙ্গে আমাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়ায় অভ্যন্তরীণ বায়ুদূষণ এবং ‘সিক বিল্ডিং সিনড্রোম’।
সময়ের সঙ্গে জীবনের প্রতি ক্রমবর্ধমান হুমকি হয়ে দাঁড়াতে থাকে নানা আধুনিক বর্জ্য। মাইক্রোওয়েভ ওভেন এবং সেল ফোন, খেলাধুলার সামগ্রী, যানবাহন এবং ডিজেল ট্রাক, ডিক্যাফিনেটেড কফি এবং খাদ্য রং, সার এবং হার্বিসাইডস, সিসা পেইন্ট এবং অ্যাসবেস্টস আবরণ, অটোমোবাইল ব্যাটারি এবং ব্যবহৃত মোটর তেল, ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী গৃহস্থালি, ডিটারজেন্ট, অ্যান্টিবায়োটিক, প্লাস্টিক, খাবার প্যাকিং, ড্রাই ক্লিনিংয়ের রাসায়নিক এবং বিকল্প কীটনাশক, বিকিরণ এবং জেনেটিক পরিবর্তন জনস্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়ায়।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে যোগাযোগমাধ্যমের ব্যাপক বিকাশ ঘটে, বিশেষ করে একুশ শতকের দ্বিতীয় দশকের মাঝামাঝি এসে মোবাইল ফোনের দ্রুত উন্নয়ন সারা বিশ্বকে হাতের মুঠোয় এনে দেয়। যোগাযোগের এ দারুণ সুযোগকে মানুষ সহজেই লুফে নেয় এবং খুব দ্রুত বাড়তে থাকে মোবাইল ফোনের ব্যবহার। ২০১৭ সালের সমীক্ষা বলছে, সে সময় বিশ্বে ২ বিলিয়নেরও বেশি স্মার্টফোন ছিল এবং ২০২০ সালে সেটি বেড়ে ৬ বিলিয়নের বেশি হবে বলে অনুমান করা হয়েছিল। শুধু যুক্তরাষ্ট্রে ২০০ মিলিয়ন স্মার্টফোন ছিল সে সময় এবং প্রাপ্তবয়স্কদের ৭০ শতাংশের কাছে এ ধরনের অন্তত একটি ফোন ছিল। পরিসংখ্যান বলছে ২০১৪ সালে সারা বিশ্বে ১ দশমিক ৪ বিলিয়ন স্মার্টফোন বেচাকেনা হয়েছে, যা এর আগের বছর অর্থাৎ ২০১৪ সালের চেয়ে ২০০ মিলিয়ন বেশি। স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা সহসাই এর মডেল পরিবর্তন করেন।
আমাদের নিত্যদিনের ব্যবহার করা স্মার্টফোনে ৭০টিরও বেশি বিভিন্ন উপাদান রয়েছে, যার মাঝে ৬২টি ধাতু এবং ১৬টি বিরল উপাদান। এসব উপাদান সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নানা উৎস হতে সংগ্রহ করা হয়। এদের মধ্যে কিছু কিছু উপাদান আছে যা মারাত্মক দূষণ সৃষ্টি করে এবং এর মাধ্যমে ভয়ংকর স্বাস্থ্যঝুঁকির সম্মুখীন হয় স্বল্প পারিশ্রমিক পাওয়া দরিদ্র শ্রমিক। একটি স্মার্টফোনের জীবনচক্র পর্যালোচনা করলে দেখা যায় তিন বছর ব্যবহৃত স্মার্টফোনটির বিশ্ব উষ্ণায়ন ক্ষমতা ৫০ কিলোগ্রাম কার্বন ডাই-অক্সাইডের সমতুল্য। এ পরিমাণকে যদি মোট ব্যবহৃত ফোনের সংখ্যা (ধরা যাক ২ বিলিয়ন) গুণ করা হয় এবং ৩ বছর দ্বারা ভাগ করা হয় বার্ষিক অবদান হিসাব করার জন্য তাহলে হয়তো দেখা যাবে ১ লাখ টন গ্রিন হাউজ গ্যাস নির্গমন হচ্ছে এ উৎস থেকে।
বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর কোটি কোটি পুরনো ফোন ব্যবহারের পরে ফেলে দেয়া হয় এবং এগুলো পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের হুমকি সৃষ্টি করে। পুরনো রিকন্ডিশন্ড গাড়ি যেমন ব্যবহার করা হয় তেমনি এসব ফোনও পুনর্ব্যবহার করা হয় না কেন—সেটি একটি প্রশ্ন। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ব্যবহারের পরে ফেলে দেয়া ফোনগুলোর একটি অংশের শেষ গন্তব্য আবর্জনার ভাগাড়, কখনো প্রয়োজনীয় অংশ সংগ্রহ করা হয় পুনঃচক্রায়নের জন্য। তবে আরেকটি বড় অংশ উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোয় পাঠানো হয় যেখানে ব্যবহারোপযোগী থাকলে এগুলো কিছুদিন ব্যবহারের পরে কিংবা অকেজোগুলোকে রিসাইকেল করা হয়। এসব থেকে ছড়িয়ে পড়া বিষাক্ত পদার্থে সেসব দেশের মানুষ বিশেষ করে শিশুরা বিষক্রিয়ায় আক্রান্ত হচ্ছে, দূষিত হচ্ছে মাটি, পানি ও বায়ু।
মানুষ কিংবা আধুনিক বিশ্বের রাষ্ট্রগুলো তার নিজের স্বার্থসিদ্ধির জন্য নিজের সীমানার বাইরের সম্পদ যা সবার, সেটিও নির্দ্বিধায় যাচ্ছে তাই ব্যবহার করে চলছে কোনো ধরনের বিচার বিবেচনা ছাড়াই। যেহেতু সম্পদের মালিকানা সবার তাই ব্যবহারের ক্ষেত্রে এর সংরক্ষণের দায়িত্ব কোনো রাষ্ট্র বা ব্যক্তি নেয় না, ফলে সম্পদের অবক্ষয়, দূষণ সীমা অতিক্রম করে ভয়াবহ রূপ ধারণ না করা পর্যন্ত এ বিষয়ে কারো ন্যূনতম অনুতাপ যেমন সৃষ্টি হয় না তেমনি রক্ষণাবেক্ষণের তাগাদাও অনুভূত হয় না।
ড. এ এস এম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়