শিক্ষা ভাবনা

বিশ্ববিদ্যালয় রেটিংয়ের সাতকাহন

শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক। গরমের ছুটি, পাঠ্যবই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বিতর্কে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। কারণ তর্কের খাতিরে তর্ক করার কোনো যুক্তি নেই। আমাদের প্রধান অসুবিধা হলো যে, আমরা সবাই কুতর্ক করতে ভালোবাসি। বেশকিছু দিন আগের কথা। ব্যাংককের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আমি একটি ওয়ার্কশপে ছিলাম। এক বক্তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর প্রশ্নোত্তরের পালা।

শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে প্রচুর বিতর্ক। গরমের ছুটি, পাঠ্যবই, ইত্যাদি ইত্যাদি। এ বিতর্কে যাওয়ার ইচ্ছা আমার নেই। কারণ তর্কের খাতিরে তর্ক করার কোনো যুক্তি নেই। আমাদের প্রধান অসুবিধা হলো যে, আমরা সবাই কুতর্ক করতে ভালোবাসি। বেশকিছু দিন আগের কথা। ব্যাংককের এশিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে আমি একটি ওয়ার্কশপে ছিলাম। এক বক্তার বক্তব্য শেষ হওয়ার পর প্রশ্নোত্তরের পালা। অনেকগুলো হাত উঠল। তারা প্রশ্ন করলেন। কিছু প্রশ্ন ছিল শ্রোতাদের চিন্তার ফসল। কিন্তু কিছু প্রশ্ন ছিল নিতান্ত অবান্তর। অনেকটা আমাকেও কিছু একটা বলতে হবে এ রকম ধরনের প্রশ্ন। প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন সংশ্লিষ্ট বক্তা অত্যন্ত বিনীতভাবে। আমি উদ্যোক্তাদের জিজ্ঞাস করলাম। ওই যে, লাল শার্ট পরা ব্যক্তি (যিনি অবান্তর প্রশ্ন করছিলেন) তিনি কি বাঙালি? হুম। পরে জানলাম তিনি ভারতীয় বাঙালি, যা ভেবেছিলাম তা-ই। অর্থাৎ অবান্তর বিষয়ের অবতারণা করে গোলমাল বাধানোর নায়ক আর কেউ নন আমরাই। তবে এটাও সত্য, এ উপমহাদেশে বাঙালিরাই আগে বুঝতে পারে। তাই তো সেই হান্টার বলেছিলেন – What Bengal [Bangla] thinks today India thinks tomorrow. যা-ই হোক। এজন্য হয়তো আমাদের দেশে এত জ্যোতিষী। আমার আজকের বিষয়বস্তু বিশ্ববিদ্যালয় র‍্যাংকিং কিংবা বলতে পারেন বিশ্ববিদ্যালয়ের মান যাচাই। 

ইদানীং দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো র‍্যাংকিং নিয়ে মেতেছে। কারো র‍্যাংকিং ৫ তারকা, কেউ চারতারকা। কেউ বিশ্বের ১০০০তম। ইত্যাদি। প্রায় সবাই এ নিয়ে সোচ্চার। এসব রেটিং দেখলে একটি বিষয় লক্ষ করবেন প্রথম ১০-২০টা ছাড়া বাকি রেটিংগুলোর মাঝে কোনো সম্পর্ক নেই। একজন যাকে ৭০০ বলছে, অন্যজন তাকে ১৫০০ বলছে। অথচ সবাই তাদের ভাষ্য অনুযায়ী সঠিক মান প্রদর্শন করছে তাদের ফলাফল দিয়ে। এ ফলাফল দিয়ে কি হয় তা আমার বোধগম্য নয়, তবে কেউ কেউ মনে করেন তা বাজারে ক্রেতা বা অভিভাবককে একটি দিকনির্দেশনা নাকি দেয়। যদিও আমার তা মনে হয় না। কেউ কেউ বলেন, এর ফলে নাকি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো জাতে উঠে যাবে। পশ্চিমারা বলছে আমাদের এ বিশ্ববিদ্যালয় ভালো। অতএব...।

দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই র‍্যাংকিং খেলায় না নামলেও নাম না জানা বহু বিশ্ববিদ্যালয় তা নিয়ে বেশ জোরেসোরে সবাইকে মাতিয়ে নিচ্ছে। বিষয়টি নিয়ে আমরা যারা শিক্ষক তারা বেশ চিন্তিত কিন্তু কী করা যায় তা বুঝতে পারছিলাম না। চিন্তার কারণ হলো, বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই রেটিং নিয়ে যে পরিমাণ সম্পদ খরচ করে তার চেয়ে বেশি ভালো হতো যদি তারা শিক্ষার মানোন্নয়নে এ খরচগুলো করত। তাই র‍্যাংকিং বিষয়ে আমার জানার আগ্রহ বাড়ল।

আরো একটি কথা, তারা দেশে না এসে কোনো তথ্য-উপাত্ত যাচাই না করে কীভাবে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান বলে দিতে পারে এমন জ্যোতিষবিজ্ঞান জেনে রাখা ভালো। কি করে তারা এমন অসম্ভব কাজটি করে? যেখানে তারা সঠিকভাবে বাংলাদেশ উচ্চারণই করতে পারে না কিংবা রোহিঙ্গাকে রোহিঞ্জ্যা বলে—তারাই কি অদ্ভুতভাবে বলে দেয় কোন দেশের সেরা বিশ্ববিদ্যালয় কোনটি! কী এমন আলাদিনে প্রদীপ রয়েছে তাদের কাছে যা আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) পারে না কিংবা আমাদের অ্যাক্রিডাইটেশন কাউন্সিল এখনো তৈরি করতে পারেনি।

বলা বাহুল্য, বহুদিন আগে আমাদের ইউজিসি এমন একটি বিশাল উদ্যোগ নিয়েছিলেন। দেশের সেরা ১০টি ‘বেসরকারি’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকাও প্রকাশ করেছিলেন। তবে যখন তা প্রকাশ হয়েছিল তখন আমাদের সবার আক্কেল গুড়ুম। গরু-ছাগল অধ্যুষিত এক অজানা বিশ্ববিদ্যালয় সেরা দশে স্থান পেয়েছিল। আমরা বোকা বনে গিয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম, সেরা বিশ্ববিদ্যালয় খুঁজে দেয়ার ক্ষমতা কমিশনের নেই। এরপর এ বিষয়ে তারা আর পা বাড়ায়নি। তবে তারাই প্রকারান্তরে সব বিশ্ববিদ্যালয়কে এসব র‍্যাংকিং বিষয়ে উৎসাহিত করছে। এ রকম কনফারেন্সে যোগ দেয়াও এখন আমাদের শখানেক বিশ্ববিদ্যালয়ের বার্ষিক কর্মকাণ্ডের অংশ। ফলে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় ফি বছর এসব র‍্যাংকিংয়ের পেছনে অর্থ ব্যয় করছে। 

যেসব র‍্যাংকিং আমাদের দেশে বেশ সচল সেগুলোর মধ্যে রয়েছে ১. টাইমস হাইয়ার এডুকেশন র‍্যাংকিং, ২. কিউএস র‍্যাংকিং অন্যতম। সব র‍্যাংকিংই তথাকথিত প্রথম বিশ্বে ‘উৎপাদিত’ এবং এর মধ্যে পৃথিবীর সব বিশ্ববিদ্যালয় থাকে না। এমনকি অনেক ক্ষেত্রে কোনো কোনো দেশও এখানে নেই। যেমন এখানে পাবেন না—রাশিয়ায় কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে কিনা। রাশিয়ানরা পাশ্চাত্যের এ তথ্যে আস্থা রাখে না। তাদের ধারণা, এসব র‍্যাংকিং পাশ্চাত্যকে উচ্চতর স্তরে পৌঁছে দেয়া এবং তৃতীয় বিশ্বের দেশ হতে ছাত্র আকৃষ্ট করার নিমিত্তে তৈরি। 

তবে বিশ্বে র‍্যাংকিং তৈরির প্রায় ৯৬টি ‘কোম্পানি’ [লক্ষ করবেন আমি কোম্পানি বলছি প্রতিষ্ঠান বলছি না] রয়েছে যারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে র‍্যাংকিং করে। এগুলো সবই ব্যবসায়িক কোম্পানি। তাদের মূল লক্ষ্য এর মাধ্যমে তারা আয় করে। বহুল পরিচিত কিউএস র‍্যাংকিংয়ের নিট বার্ষিক আয় প্রায় ৭৫ মিলিয়ন ডলার। আর টাইমস হাইয়ার এডুকেশনের নিট আয় প্রায় ২৫ মিলিয়ন। র‍্যাংকিং সর্বস্ব এসব কোম্পানির আয়-ব্যয় নিয়ে আমার খুব একটা আগ্রহ নেই। আমার আগ্রহ তাদের জোতির্বিদ্যায়। কী করে তারা এমন অসম্ভব কাজ করে? দেখতে চাই কিছু পর্যবেক্ষণ না করে, কোনো ধরনের পরিদর্শন না করে কীভাবে তারা পারে! জানার আগ্রহ বেড়ে গেল।

ভাবলাম র‍্যাংকিংয়ের আদ্যোপান্ত একটু জেনে নিই। টাইম হাইয়ার এডুকেশনের নিয়ম অনুযায়ী তারা বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান যাচাই করে দুটি বিষয় লক্ষ করে। শিক্ষার মান ও গবেষণার মান। ৩০ শতাংশ প্রতিমান থাকে শিক্ষার মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার অর্থ, সংখ্যা ও মানে, ৩০ শতাংশ থাকে গবেষণার প্রভাবে, ৭ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে বিদেশী শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও বিদেশে গবেষণায় আর ২ দশমিক ৫ শতাংশ থাকে দেশের গবেষণা অনুদান নিয়ে। কিউএস বা কুয়াককুয়ারলি সিমন্ডস সাহেবের কোম্পানির নিয়ম অনুযায়ী ৪০ শতাংশ পয়েন্ট থাকে শিক্ষার মানে, ১০ শতাংশ থাকে নিয়োগদাতাদের মতামতে, ২০ শতাংশ থাকে শিক্ষক-শিক্ষার্থীর অনুপাতে, ২০ শতাংশ থাকে গবেষণার সাইটেশনে [প্রভাবে], ৫ শতাংশ থাকে বিদেশী শিক্ষকে এবং ৫ শতাংশ থকে বিদেশী শিক্ষার্থীতে। 

বুঝতে পারছেন, এর মধ্যে বিদেশী শিক্ষক/শিক্ষার্থীতে আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সুযোগ খুব একটা নেই, কারণ আমাদের ইমিগ্রেশন নিয়ম কিংবা বৈদেশিক মুদ্রার নিয়ন্ত্রণের কারণে তাদের এখানে আনার সুযোগ কম কিংবা এখানে যা আছে তাদের অধিকাংশই থাকে নামকাওয়াস্তে কিংবা বলা চলে অনুপযুক্তদের নিয়োগ দিয়ে। বিদেশী শিক্ষার্থীর ক্ষেত্রেও তাই। আমাদের কূটনৈতিক মিশনগুলো এ বিষয়ে খুব একটা সচল নয় আর বিদেশী ছাত্র আগ্রহ করতে গেলে যে পরিমাণ অর্থ বিদেশে খরচ করতে হবে তাও নিতান্ত কম হবে না। তাছাড়া গরিব দেশে কেইবা আসবে! এখানেই প্রায় ১০ শতাংশ মান নির্ভরশীল। তাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মান তৈরি হয় বাকি ৯০ শতাংশ ওপর।

কারা এসব পয়েন্ট দিয়ে থাকে? এ প্রসঙ্গে পরে আসছি। তবে নিয়ম অনুযায়ী প্রায় ৫০ শতাংশ পয়েন্ট থাকে শিক্ষার মানে। কীভাবে তা যাচাই করে? বিষয়টি নিয়ে ধোঁয়াশা ছিল। কেটে গেল সম্প্রতি এক অভিজ্ঞতার ফলে। এখানে নিয়ম হলো, অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আপনার বিশ্ববিদ্যালয়কে কীভাবে উপলব্ধি করে তার ওপর। অর্থাৎ ভালো-মন্দ নির্ভর করে আমার শিক্ষক বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো কার্যক্রম নয় বরং অন্যরা এ বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে কী মনে করছে তার ওপর। তাদের ভোটে। প্রথমে ভাবলাম বিষয়টি বেশ ভালো। কারণ নিজের ঢোল নিজে বাজাই কী করে? তার চেয়ে ছেড়ে দিই অন্যদের ওপর। প্রশ্ন হলো, বিশ্বজুড়ে হাজার হাজার বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে কোনটি ভালো তার ভার যদি আমার মতো শিক্ষকের হাতে ছেড়ে দেয়া হয় তাহলে আমি কাকে ভোট দেব? স্বভাবতই যাদের নাম আমার মাথায় রয়েছে। হার্ভার্ড, অক্সফোর্ড, ইত্যাদি। কিংবা দেশের মধ্যে ঢাকা, বুয়েট প্রভৃতি। অর্থাৎ নতুনদের নাম আসার সম্ভাবনা নেই এক্ষেত্রে। তাহলে উপায়? নামের ভোট দুভাবে দেয়া হয়। একটি বিশ্বজুড়ে। অন্যটি আঞ্চলিক। তবে অঞ্চলগুলোর মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার নাম এলে ভারতে ভোট বেশি হবে এবং সেক্ষেত্রে তাদের বিশ্ববিদ্যালয় কিংবা পূর্ব এশিয়ায় চীনের বিশ্ববিদ্যালয় বেশি ভোট পাবে। তাই তাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এখানে চলে আসবে। কিছু ছোট দেশের নামও আসবে যারা বহুদিন ধরে বিদেশী ছাত্র বা গবেষক অধ্যুষিত। এটাই স্বাভাবিক। তাহলে! বাংলাদেশের কী হবে? আমাদের নাম কোথায় থাকতে পারে বুঝতেই পারেন। তবে ভুল ভাঙল আমার ভোট দেয়ার সময়। আমার নাম একটি বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয় দিয়েছিল ভোট দেয়ার জন্য। বলা হল, আমরা এ তারিখে সবাই মিলে একসঙ্গে ভোট দেব। আপনার সময় না থাকলে পাসওয়ার্ড আমাদের পাঠিয়ে দিন। আমরা ভোট দিয়ে দেব। অবাক হওয়ার পালা এখানে। আমার ভোট ওরাই দেবে! বললাম, না ওইদিন আমি জুমে উপস্থিত থাকব। নির্দিষ্ট দিনে জুমে কয়েকশ ভোটার একসঙ্গে ভোট দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক কর্মকর্তা আমাদের বললেন। দুটো ভোটেই তার বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম দিতে। বুঝতেই পারছেন। এ কেরামতি! অথচ এ লিস্টে নাম লেখানোর জন্য আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কী পরিমাণ পরিশ্রম ও অর্থ ব্যয় করছে? তাও বিদেশী মুদ্রায়! শুধু তা-ই নয়, বাকি ৫০ শতাংশ পূরণের ক্ষেত্রেও রয়েছে কারসাজি। 

একসময় গবেষণার মান নির্ধারণ করত গুটিকয়েক জার্নাল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় জার্নালের সংখ্যা বেড়েছে। বিখ্যাত সব জার্নালে গবেষণা ছাপাতে অপেক্ষার পালা বেশি। আবার সময়মতো প্রকাশ না হলে আবিষ্কারক হিসেবে পরিচিত হওয়া যায় না। একই বিষয়ে শত শত গবেষক কাজ করছেন। তাই জার্নালের সংখ্যাও বেড়েছে। জার্নালের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ায় গবেষণাপত্র প্রকাশনাও বাড়ছে। বড় বড় পশ্চিমা জার্নালে অপেক্ষার সময় বেড়ে যাওয়ায় অনেকে স্থানীয় বা আঞ্চলিক জার্নালে প্রকাশ করছিলেন তাদের গবেষণা। তাতে ক্ষতি হয়ে গেল বড় প্রকাশকদের। তাদের ব্যবসায় বাধা এসব নতুন প্রকাশনা বন্ধে উদ্যোগ প্রয়োজন। তাই তারা এক্ষেত্রেও র‍্যাংকিং করল। কিছু কিছু প্রকাশক একত্র হয়ে তাদের ও বন্ধুদের সব প্রকাশনাকে আসল আর নকল দুই ভাগে ভাগ করল। ফলে এশিয়ার প্রকাশনাগুলোর অধিকাংশকে নকল আখ্যায়িত করা হলো। অতএব মানসম্মত প্রকাশনা করতে গেলে আপনাকে যেতে হবে পশ্চিমা দেশের প্রকাশনায়। উপনিবেশবাদের নতুন সংস্করণ! ফলাফল কী হলো! আমাদের দেশের গবেষণাগুলো কালো তালিকায় ফেলা হলো। 

তবে হ্যাঁ, পৃথিবীতে বাজার ব্যবস্থা বলে একটি বিষয় আছে। প্রকাশকদের ক্ষেত্রে নতুন অসুবিধা দেখা দিল। পশ্চিমা প্রকাশকরা দেখল তাদের প্রকাশনার খরচ বেশি। কী করা যায়? ছাপার সুবিধার্থে তারা তা ভারত, মালয়েশিয়া, হংকং, সিংগাপুর এসব দেশ থেকে প্রকাশ করতে লাগল। ক্রমে অনেক এশীয় প্রতিষ্ঠান এখন এগুলোর মালিক। প্রকাশনায় মালিকানা বদল হতে লাগল। অনেকে হয়তো জানে না যে, এখন বহু পশ্চিমা প্রকাশনার মালিকানা বদল হয়েছে। এসেছে এশিয়ায়। এক অর্থে এটি একটি ভালো সংবাদ তবে বাজার দখলের ব্যাপারে এরা সবাই একমত নতুন কাউকে সহজে ঢুকতে দেয়া যাবে না।

তবে আমাদের দেশের ক্ষেত্রে মূল বাধা এখানে নয়। যেখানে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ই যথাযথ বা মানসম্মত পিএইচডি প্রোগ্রাম চালাচ্ছে না বা তাদের মূল বিষয় পিএইচডি পড়ানো নয় সেখানে গবেষণায় আমাদের দেশে খুব বেশি পয়েন্ট পাবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় তো এ ধরনের প্রোগ্রামের অনুমোদনই নেই। অতএব এখানে বাংলাদেশ বেশি দূর এগোতে পারবে না। 

তাহলে দেখা যায় যে, আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর আন্তর্জাতিক র‍্যাংকিংয়ের ওপরের দিকে স্থান পাওয়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তারা কি এতই খারাপ? নিশ্চয়ই নয়। র‍্যাংকিং কি খুব বেশি দিকনির্দেশনা দেয়? তাহলে কী করে আমরা আমাদের গুণগত মান জানতে পারব? হার্ভার্ড কি র‍্যাংকিংয়ের মাধ্যমে প্রথম হয়েছে নাকি ভালো ছিল বলেই তাদের বাদ দিয়ে র‍্যাংকিং হয় না! মূলত প্রয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো শিক্ষক ও গবেষক। কেবল শিক্ষক দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় হয় না। হয় স্নাতক কলেজ। কেবল গবেষক দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয় হয় না হয় গবেষণা প্রতিষ্ঠান। খেলার মাঠ দিয়ে পড়াশোনা হয় না। এয়ারকন্ডিশন দিয়েও বিশ্ববিদ্যালয়ের মান তৈরি হয় না। প্রয়োজন ভালো শিক্ষক ও ভালো গবেষক। এগুলো দূরদূরান্ত থেকে নির্ণয় করা যায় না। এজন্যই এমআইটির মতো বিশ্ববিদ্যালয় এখনো সপ্তাহে প্রতি বৃহস্পতিবার পালন করে অভিভাবক দিবস (ওপেন হাউজ), যেখানে যে কেউ বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো অনুষ্ঠানে আসে (পূর্ব আমন্ত্রণ নিয়ে বা রেজিস্ট্রেশন করে), জানতে পারে কী হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে। যোগ দেয় ক্লাসে বা কোনো অনুষ্ঠানে। ভাবে আমার ছেলে বা মেয়েকে এখানেই ভর্তি করাতে চাই। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের গেস্ট হাউজে থাকতেও পারে একরাত। অভিভাবদের শিক্ষকদের সঙ্গে কথা বলা কিংবা আলোচনার সুযোগ করে দেয়। এর মাধ্যমে শিক্ষার্থী কিংবা অভিভাবকের মনে জন্ম নেয় এক স্বপ্নের। এখানেই পড়তে চাই। দেখুন, তারা তো বলতে পারত রেটিং দেখে ভর্তি হোন! রেটিং একটি মুহুরীগিরি জাতীয় কর্ম, এখানে মুনশিয়ানা হয়তোবা আছে তবে নেই যথাযথ তথ্য। এখানে বিশ্বাস রাখা অর্বাচীনের কর্ম। ঘুরে দেখুন বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। জানুন শিক্ষকদের। প্রয়োজনে কথা বলুন। তবেই বুঝতে পারবেন কোন বিশ্ববিদ্যালয় কেমন! বহুদিন আগের একটি ঘটনা বলেই শেষ করি। আমার ছেলের ভর্তির জন্য একটি স্কুলে (নামকরা স্কুল) গেছি। দারোয়ান জিজ্ঞাসা করল কেন এসেছি। বললাম অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। কী কারণ? বললাম ভর্তির ব্যাপারে। আমাকে বলুন। আমি অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে চাই। না তা হবে না। আমাকে বলতে হবে। আমার স্ত্রীকে বললাম চল ফেরত যাই। কেন? এটাকে স্কুল মনে হচ্ছে না জেলখানা মনে হচ্ছে। আমার ছেলেকে আমি জেলে ঢুকাতে আসিনি। বলা বাহুল্য, আমি সেখানে আর ভর্তি করাইনি। আমার সন্তানকে ভর্তি করতে চাচ্ছি কিন্তু আমি দারোয়ানের সাথে কথা বলব, আর কারো সঙ্গে বলা যাবে না। এখানে আর যা-ই হোক আর শিক্ষা নেই। শেষ পর্যন্ত আমি তাকে অন্য এক স্কুলে ভর্তি করিয়েছিলাম, যেখানে আমি অধ্যক্ষের সঙ্গে কথা বলতে পেরেছিলাম। আমার সেই ছেলে এখন ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসেটসে পিএইচডি করছে। নামকরা সেই স্কুলে ভর্তি না করাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। আপনারাও তাই করবেন। রেটিংয়ের কথা ভাববেন না। ভাবুন কার হাতে আমি আমার সন্তানকে তুলে দিয়ে এলাম। তাকে ভরসা করা যায় কিনা। 

ড. এ কে এনামুল হক: ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক ও ব্যবসা ও অর্থনীতি অনুষদের ডিন

আরও