বিদ্যুতের মেগা প্রকল্পগুলো খতিয়ে দেখবে না পর্যালোচনা কমিটি

সব প্রকল্পের যাচাই-বাছাই ছাড়া বিদ্যুৎ খাতকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করা যাবে না

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন পাস হয়েছিল তৎকালীন সরকারের আমলে।

দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির ঘাটতি এবং অপর্যাপ্ততা দ্রুত নিরসনের লক্ষ্যে ২০১০ সালে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন পাস হয়েছিল তৎকালীন সরকারের আমলে। দুই বছরের জন্য আইনটি করা হলেও এর মেয়াদ তিন দফা বাড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হয় ২০২৬ সাল পর্যন্ত। শুরু থেকেই আইনটি নিয়ে তীব্র সমালোচনা সৃষ্টি হয়। বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর স্বার্থই এ আইনে প্রাধান্য পায় বলে অভিযোগ রয়েছে। এ আইনের আওতায় দরপত্র ছাড়াই চুক্তি করা যায়। ফলে প্রতিযোগিতা ছাড়াই বিদ্যুৎ, জ্বালানি কেনা ও অবকাঠামো নির্মাণের সুযোগ রয়েছে। আইনটি দায়মুক্তি আইন নামেও পরিচিত, কেননা এর বিরুদ্ধে আদালতে যাওয়ারও কোনো সুযোগ নেই। তাই এটি দায়মুক্তি আইন হিসেবেও পরিচিতি পেয়েছে।

সম্প্রতি এ আইনের আওতায় সম্পাদিত চুক্তিগুলো পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। এ লক্ষ্যে গঠিত হয়েছে জাতীয় চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি। তবে বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, আইনটির অধীনে হওয়া চুক্তিগুলো খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া হলেও এ কমিটির পর্যালোচনার আওতায় থাকছে না মেগা প্রকল্প রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ী, রামপাল ও পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র। যদিও এসব প্রকল্পের চুক্তি ও নির্মাণ নিয়ে নানা অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে।

বিপুল টাকা ব্যয়ে নির্মিত রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটির নিরাপত্তা ও ঝুঁকির বিষয়ে শুরু থেকে প্রশ্ন ছিল। রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সুন্দরবনের কোল ঘেঁষে নির্মিত হওয়ায় মোটা দাগে এ বিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রশ্ন রয়েছে। পাশাপাশি রয়েছে প্রকল্পটির গ্রহণযোগ্যতা ও বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন। মাতারবাড়ী বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি ব্যয়ে বাস্তবায়ন করা প্রকল্প। এর প্রয়োজনীয়তা নিয়ে এরই মধ্যে প্রশ্ন তুলেছেন খাতসংশ্লিষ্টরা। এছাড়া পায়রা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্পটিও অনেক ব্যয়বহুল। এতে ব্যয় হয়েছে ১৯ হাজার ৫৫০ কোটি টাকা।

জানা যায়, বিশেষ আইনের আওতাধীন না হওয়ায় এসব মেগা প্রকল্পের চুক্তির পর্যালোচনার বিষয়টি দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটির ভাবনায়ও নেই। বিশেষজ্ঞদের আশঙ্কা, বিদ্যুতের এ চার প্রকল্প সবচেয়ে আলোচিত। এগুলো খতিয়ে দেখা না হলে এগুলোর ব্যয় ও নির্মাণ ঘিরে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে তা অগোচরেই রয়ে যাবে।

বর্তমানে দেশের বিদ্যুৎ খাতের যে বেহাল দশা এর উন্নতি করতে হলে সরকারের এ খাতের যাবতীয় অনিয়ম ও দুর্নীতি দূর করা প্রয়োজন। এজন্য মেগা প্রকল্পগুলোও যেন পর্যালোচনা করা হয় সেই ব্যবস্থা নিতে হবে। পর্যালোচনা কমিটির বিষয়টি বিবেচনায় রাখা আবশ্যক। বিদ্যুৎ খাত সংস্কারের যে উদ্যোগ, তা তখনই পুরোপুরি সফল হবে যখন এ খাতের সব প্রকল্প সমগুরুত্বের সঙ্গে খতিয়ে দেখা হবে এবং প্রকৃত চিত্র জনসম্মুখে প্রকাশ পাবে। এছাড়া এসব প্রকল্পের অর্থনৈতিক কার্যকারিতা প্রকৃতপক্ষে কতটুকু সেটিও জানা জরুরি। এর জন্যও বিশেষ আইনের আওতায় যেসব প্রকল্প ও চুক্তি নেয়া হয়েছে, সেগুলোসহ বিশেষ ও মেগা প্রকল্পগুলোও খতিয়ে দেখার উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।

তৎকালীন সরকারের আমলে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি ঘটেছে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতের ক্রেতাপ্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক দেনায় মুহ্যমান হয়ে পড়েছে; দেউলিয়া হয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান। এ দায়দেনা তৈরি হওয়ার মূলে রয়েছে সরকারের অনৈতিক সুবিধা ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্ত। বিভিন্ন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী দুই ও পাঁচ বছর মেয়াদি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের মেয়াদ ১০-১৫ বছর পর্যন্ত বাড়িয়ে নিয়েছে। ব্যবসায়িক সুবিধা দেয়ার নিমিত্তে ব্যয়বহুল সব বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মিত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বিশেষ করে ওই বিশেষ আইনের আওতায় অপ্রয়োজনীয় বিদ্যুৎ সক্ষমতা বাড়ানোর মাধ্যমে একদিকে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় হয়েছে, অন্যদিকে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে কেবল একটি বিশেষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠী লুফে নিয়েছে বিপুল মুনাফা। তারা জ্বালানি তেল ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণ করে বিপুল পরিমাণ অর্থ তুলে নিয়েছেন। এছাড়া গত দেড় দশকে বিদ্যুৎ খাতে লাখ লাখ টাকা ক্যাপাসিটি পেমেন্টও দেয়া হয়েছে। যার বেশির ভাগ নিয়ে গেছে গুটিকয়েক কোম্পানি।

আবার আর্থিক লোকসান ও সংকটের কথা বলে দফায় দফায় বাড়ানো হয়েছে বিদ্যুতের দাম। যার চাপ পড়েছে ভোক্তা পর্যায়ে। এর পরও ২০০৮-০৯ অর্থবছর থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছর পর্যন্ত বিদ্যুৎ বিক্রি করে ৭০ হাজার ৫০০ কোটি টাকার বেশি লোকসান করে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (বিপিডিবি)। পাশাপাশি সরকারি কোষাগার থেকে সংস্থাটিকে ভর্তুকি হিসেবে দেয়া হয়েছিল ১ লাখ ৩০ হাজার কোটি টাকা। এমনকি বিদ্যুৎ সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় মেটাতে বিশেষ বন্ড ছাড়তে বাধ্য হয় ওই সরকার।

মূলত দেশের বিদ্যুৎ খাত হয়ে উঠেছে অস্বচ্ছতা ও দুর্নীতির অন্যতম নজির। এ অবস্থায় এর সব প্রকল্পই যাচাই-বাছাই করা জরুরি। তা না হলে এ খাতকে স্বচ্ছ ও দুর্নীতিমুক্ত করা দুঃসাধ্য হবে।

নতুন সরকারের উচিত তৎকালীন সরকারের আমলে যেসব প্রকল্প ও চুক্তি হয়েছে, সবগুলো যাচাই-বাছাইয়ের ভিত্তিতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়া। অপ্রয়োজনীয় চুক্তি বাতিল ও ব্যয় কমিয়ে বিদ্যুতের দাম কমিয়ে আনা। দেশে ২০০৯ সালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র ছিল ২৭টি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ছিল ৪ হাজার ৯৪২ মেগাওয়াট। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা ২৭ হাজার ৭৯১ মেগাওয়াট। দেশে বিদ্যুতের চাহিদা সাড়ে ১৩ হাজার থেকে ১৪ হাজার মেগাওয়াট এবং উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ১২ হাজার থেকে ১৩ হাজার। জ্বালানি সংকটের কারণে যেসব কেন্দ্রে বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রয়েছে সেগুলোর বাস্তবে সম্ভাব্যতা কতখানি তা বিবেচনায় সমাধানের দিকে এগোতে হবে।

বিদ্যুতের ব্যয় জনসাধারণের ওপর বাড়তি ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়েছে। পর্যালোচনার মাধ্যমে বিদ্যুতের প্রকল্পগুলোর বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়া হোক। এর ধারাবাহিকতায় উৎপাদন খরচ এবং ভোক্তা পর্যায়ে দাম কমে আসুক— এটিই প্রত্যাশা।

আরও