সময়ের ভাবনা

বাংলাদেশে সোনালি আঁশের বর্তমান চিত্র

পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। কিন্তু বর্তমানে পাটের সে সোনালি দিন আর নেই। বাংলাদেশে এ খাতের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। উন্নত জাতের বীজের অভাব, সারের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, চাষের উপযুক্ত জমির অপ্রতুলতা, উচ্চমজুরি, সেচ দেয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, মজুদ করার অসুবিধা ইত্যাদি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় খাতটি। পাটের চাষাবাদ ও

পাটকে বলা হয় সোনালি আঁশ। কিন্তু বর্তমানে পাটের সে সোনালি দিন আর নেই। বাংলাদেশে এ খাতের বৃদ্ধি ও সমৃদ্ধি ঝুঁকির মধ্যে আছে। এর পেছনে কয়েকটি কারণ আছে। উন্নত জাতের বীজের অভাব, সারের অপর্যাপ্ত সরবরাহ, চাষের উপযুক্ত জমির অপ্রতুলতা, উচ্চমজুরি, সেচ দেয়ার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা না থাকা, মজুদ করার অসুবিধা ইত্যাদি কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সম্ভাবনাময় খাতটি। পাটের চাষাবাদ ও বিপণনের মাধ্যমে প্রচুর লোকের কর্মসংস্থান হওয়ার সুযোগ আছে। কিন্তু স্বাধীনতার পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে অনেকগুলো উল্লেখযোগ্য পাটকল বন্ধ হয়ে গেছে। ফলে অসংখ্য শ্রমিক বেকার হয়ে গেছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে তা নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। পাটের বাজার সম্পর্কে পাটচাষীদের কোনো সম্যক জ্ঞান নেই। ফলে পাটের চাহিদা ও প্রকৃত বিক্রয়মূল্য সম্পর্কে তাদের কোনো ধারণা নেই। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে সাধারণত পাটের চাষ হয়। এসব এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা ততটা ভালো নয়। ফলে পাট পরিবহনে বেশি টাকা গুনতে হয়। 

বাংলাদেশে পাটের গৌরবময় অতীত আছে। ভবিষ্যতেও তার সমৃদ্ধির সম্ভাবনা আছে। ’৬০ ও ’৭০-এর দশকে এ দেশের জাতীয় আয়ের একটি বড় অংশ আসত পাট ও পাটজাত দ্রব্য থেকে। এ খাতের সঙ্গে অনেক মানুষের রুজি জড়িত ছিল। ষাটের দশকে তৎকালীন পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম উৎস ছিল পাট ও পাটজাত দ্রব্য। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। পশ্চিম পাকিস্তানি পাট ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ ছেড়ে চলে গেল। তাদের পাট কারখানাগুলো বাংলাদেশেই রয়ে গেল। ১৯৭২ সালে সব পাটকল জাতীয়করণ হলো। এসব জাতীয় পাটকল বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের অধীনে চলে এল। বাংলাদেশে পাটের মূল্য নির্ধারণ, বিক্রয় ও ক্রয়নীতি নির্ধারণের ভার এ সংস্থার ওপর বর্তাল। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ সরকার পাট বিভাগ স্থাপন করে। এ বিভাগকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন করা হয়। ১৯৭৬ সালে পাট বিভাগ স্বতন্ত্র পাট মন্ত্রণালয়ে রূপান্তরিত হয়। ১৯৭৯ সালে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে একটি প্যানেল গঠন করা হয়। সে প্যানেল জুট মিলগুলো বেসরকারীকরণের জন্য সরকারের কাছে সুপারিশ করে। ’৮০-এর দশকজুড়ে সরকার পাট খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা দেয়। এর মাধ্যমে পাটের সুদিন ফেরানোর চেষ্টা করা হয়েছিল। ১৯৮২ সালে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ৭২টি জুট মিল চালু ছিল। ১৯৮২ সাল থেকে সরকার জুট মিল বেসরকারীকরণের উদ্যোগ নেয়। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশ সরকার ৩৪টি জুট মিল বেসরকারীকরণ করে। 

তবে এতকিছু করেও সোনালি আঁশের সুদিন আর ফেরানো গেল না। ২০০৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট রফতানিতে পাটের অবদান ৪ শতাংশের নিচে নেমে আসে। ’৭০-এর দশকের তুলনায় তা অনেক কম। ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশের মোট রফতানিতে পাটের অবদান ছিল ৮৯ দশমিক ৯ শতাংশ।

বর্তমানে বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের অধীনে ১৯টি পাটকল চালু আছে। বাংলাদেশ জুট মিলস অ্যাসোসিয়েশনের অধীনে বেসরকারিভাবে চালু আছে আরো ৪২টি পাটকল। তবে এগুলোর মধ্যে মাত্র সাত থেকে ১০টি কার্যকরভাবে চালু আছে। পাঁচ থেকে সাতটি কোনো রকমে টিকে আছে। বাকিগুলো বন্ধ হয়ে গেছে। এসব প্রতিষ্ঠান প্রচুর দেনার ভারে জর্জরিত। ব্যাংকগুলোও তাদের আর আর্থিক সাহায্য দিচ্ছে না। বর্তমানে বাংলাদেশে পাটজাত পণ্য উৎপাদন করে এমন পাটকলের সংখ্যা ৩০। এগুলো বাংলাদেশ জুট মিল অ্যাসোসিয়েশনের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হচ্ছে। জুট স্পিনিং মিল আছে ৫০টি। বেসরকারি এই স্পিনিং মিলগুলো বাংলাদেশ জুট স্পিনার্স অ্যাসোসিয়েশনের আওতাধীন। এ মিলগুলোয় পাটের সুতা উৎপাদিত হয়। জুট স্পিনিং খাতের অধীনে থাকা মিলগুলো প্রতি বছর ২ দশমিক ৯০ লাখ টন পাটের সুতা উৎপাদন করে। তা থেকে ২ দশমিক ৬১ লাখ টন সুতা রফতানি হয়। এর মাধ্যমে প্রতি বছর ১ কোটি ২০ লাখ টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়। আর এ পরিমাণ সুতা উৎপাদনে ১৯ লাখ পাটের গাঁট ব্যবহার হয়। 

বাংলাদেশ জুট মিলস করপোরেশনের সূত্রে জানা যায়, ২০০৬-০৭ অর্থবছরে বাংলাদেশে চালু থাকা জুট মিলের সংখ্যা ছিল ১৯। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে তা কমে ১৮তে পরিণত হয়। ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে পাটকলের সংখ্যা আরো কমে যায়। এ দুই অর্থবছরে পাটকলের সংখ্যা ছিল ১৬। তবে এরপর আবার পাটকলের সংখ্যা বেড়ে যায়। ২০১০-১১ ও ২০১১-১২ অর্থবছরে ১৮টি পাটকল চালু ছিল। ২০১২-১৩ অর্থবছর থেকে ২০১৭-১৮ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশে চালু থাকা পাটকলের সংখ্যা ২২-এ স্থির ছিল। বাংলাদেশের পাট বিভাগের প্রকাশিত তথ্য থেকে প্রতি বছর এ দেশে পাট উৎপাদনের চিত্র পাওয়া যায়। তথ্য অনুসারে, ২০০৫-০৬ অর্থবছরে বাংলাদেশে ৫০ লাখ গাঁট পাট উৎপাদন হয়। ২০০৬-০৭ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছিল ৬৫ দশমিক ৯১ লাখ গাঁট পাট। ২০০৭-০৮ অর্থবছরে উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ৬৮ দশমিক ৭১ লাখ গাঁটে উন্নীত হয়। এ পর্যন্ত উৎপাদন ঊর্ধ্বমুখী ছিল। তবে ২০০৮-০৯ ও ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা কিছুটা কমে যায়। এ দুই অর্থবছরে উৎপাদিত পাটের পরিমাণ ছিল যথাক্রমে ৫১ দশমিক ৭২ ও ৫৯ দশমিক ৪৫ লাখ গাঁট। ২০১০-১১ অর্থবছরে পাটের উৎপাদন আবার বেড়ে যায়। সে সময় বাংলাদেশে ৭৮ দশমিক শূন্য ২ লাখ গাঁট পাট উৎপাদন হয়েছিল। ২০১১-১২ অর্থবছর থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছর পর্যন্ত বাংলাদেশে যথাক্রমে ৭৮ দশমিক শূন্য ৫, ৭৫ দশমিক ৭২, ৬৭ দশমিক ৮৫, ৭৫ দশমিক শূন্য ১, ৮৭ দশমিক ৬৪, ৮৮ দশমিক ৯৯, ৯৩ দশমিক ১০ ও ৭৩ দশমিক ১৫ লাখ গাঁট পাট উৎপন্ন হয়। 

বাংলাদেশ প্রতি বছর পাট ও পাটজাত দ্রব্য রফতানি করে। বাংলাদেশের পাট অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, বিগত দশকে সবচেয়ে বেশি পাট রফতানি হয়েছে ২০১০-১১ অর্থবছরে। সে সময় প্রায় ১ হাজার ৯০৭ কোটি টাকার পাট রফতানি হয়েছিল। ২০১১-১২ ও ২০১২-১৩ অর্থবছরেও পাট রফতানির পরিমাণ ভালো ছিল। এ দুই অর্থবছরে যথাক্রমে ১ হাজার ৫৪১ ও ১ হাজার ৪৩৭ কোটি টাকার পাট রফতানি হয়। বিগত দশকে সবচেয়ে কম পাট রফতানি হয়েছিল ২০১৩-১৪ অর্থবছরে। সে সময় মাত্র ৭০৬ কোটি টাকার পাট রফতানি হয়েছিল। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮৫৯ কোটি টাকার পাট রফতানি হয়। বিগত দশকে পাটজাত দ্রব্য সবচেয়ে বেশি রফতানি হয়েছিল ২০১৭-১৮ অর্থবছরে। সে সময় ৬ হাজার ৮০১ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য রফতানি করে বাংলাদেশ। ২০১৮-১৯ অর্থবছরে এ দেশ থেকে ৫ হাজার ২২১ কোটি টাকার পাটজাত পণ্য রফতানি হয়।

বাংলাদেশে পাট একটি সম্ভাবনাময়ী খাত। কিন্তু নানা সমস্যা ও যথাযথ পরিকল্পনার অভাবে এ খাত দিন দিন পিছিয়ে পড়ছে।

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও