অভিমত

অর্থনীতিতে ট্রেড ইউনিয়নের ভালো-মন্দ

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ট্রেড ইউনিয়নের কী প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে বেন গিটিস ও সারা রিজিক ‘Union Membership And Economic Growth’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সালে ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে। এ সময় দেশটিতে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে, রিয়েল ইকোনমিক আউটপুটে যোগ হয় অতিরিক্ত ১১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। দ্রুত

যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতিতে ট্রেড ইউনিয়নের কী প্রভাব পড়ে সে বিষয়ে বেন গিটিস ও সারা রিজিক ‘Union Membership And Economic Growth’ শীর্ষক এক গবেষণায় দেখিয়েছেন, ২০০৪ থেকে ২০১৩ সালে ইউনিয়নের সদস্য সংখ্যা হ্রাস পাওয়ায় যুক্তরাষ্ট্র লাভবান হয়েছে। এ সময় দেশটিতে বৃহত্তর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটে, রিয়েল ইকোনমিক আউটপুটে যোগ হয় অতিরিক্ত ১১৫ দশমিক ৯ বিলিয়ন ডলার। দ্রুত চাকরিপ্রাপ্তি সহজ হওয়ায় ৩ লাখ ৯৩ হাজার ১৮৯ অতিরিক্ত চাকরির ব্যবস্থা হয়। কর্মীদের সাপ্তাহিক গড় আয়ে অতিরিক্ত ৬ দশমিক শূন্য ৮ ডলার যোগ হয় এবং মোট উপার্জনে যুক্ত হয় অতিরিক্ত ৩৫ দশমিক ১ ডলার।

আবার দ্য সেঞ্চুরি ফাউন্ডেশনের সিনিয়র ফেলো স্টিভেন গ্রিনহাউজের মতে, অর্থনীতিতে ট্রেড ইউনিয়ন ভূমিকা রাখে। কীভাবে ভূমিকা রাখে এ প্রশ্নের ক্ষেত্রে আমরা অর্থনীতি বলতে কী বুঝি তা গুরুত্বপূর্ণ। যখন কিছু মানুষ অর্থনীতি নিয়ে আলোচনা করে, তখন সাধারণত করপোরেট লভ্যাংশ বাড়ানোর বিষয়টি তুলে ধরে। কিন্তু অর্থনীতি শুধু ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও এর সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের নিয়ে আলোচনা নয়। এবং এটি পণ্য ও সেবা সরবরাহ, উপার্জন ও সম্পদ, এমনকি মানুষের জীবনমান উন্নত করা নিয়ে আলোচনা করে না। কিন্তু ইউনিয়ন বৃহৎ আকারে মানুষের জীবন উন্নত করতে সহযোগিতা করে।

ইউনিয়নগুলো সমৃদ্ধির ডালপালার বিস্তার ঘটায়। শ্রমিকদের প্রাপ্য মজুরির বৃদ্ধি ঘটে, ধনী-গরিবের মধ্যে বৈষম্য কমে, কর্মীদের চাকরির নিরাপত্তা দেয় এবং স্বাস্থ্য সহায়তা ও অবসরকালীন নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়। কর্মজীবনে ভারসাম্য বজায় রেখে পরিবারকে সময় দেয়ার ব্যবস্থাও করে। এর মাধ্যমে ইউনিয়নগুলো অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখে। 

যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে একটি স্টিকারের দেখা মেলে—ইউনিয়ন আপনার জন্য সাপ্তাহিক ছুটি এনে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান নাগরিকরা প্রায়ই উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হন অতীতে কী ভয়াবহ দিনগুলো ছিল! কীভাবে মার্কিনদের প্রায়ই সপ্তাহে ছয়দিন অথবা সাতদিন কাজ করতে হতো। শতবর্ষ আগে প্রতি বছর দুই হাজারেরও বেশি কয়লা শ্রমিক কর্মক্ষেত্রেই মারা যেতেন। বর্তমানে বছরে ১০ জনের মতো শ্রমিক কর্মক্ষেত্রে মারা যান। এ পরিস্থিতির উন্নতির জন্য ইউনিয়নের ভূমিকা রয়েছে।

গত শতাব্দীর শুরুর দিকে নিউইয়র্ক শহরের গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকরা সপ্তাহে ছয়দিন অথবা সাতদিনও কাজ করতেন। প্রায়ই তাদের ভোর ৭টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত কাজ করতে হতো। স্টিভেন গ্রিনহাউজ লিখিত ‘Beaten Down, Worked Up’ বইয়ে ক্লারা লেমলিখ নামে এক শ্রমিক অভিযোগ করে জানান, অনেক সপ্তাহ সে সূর্য দেখেনি। সূর্য ওঠার আগে কর্মস্থলের উদ্দেশে বের হতেন, কাজ শেষ হতে হতে সূর্য ডুবে যেত।

গার্মেন্টস শ্রমিকদের প্রায়ই ঠকানো হতো, তাদের কর্মঘণ্টা ও কাজের পরিমাণ অনুযায়ী মজুরি দেয়া হতো না। একটি গার্মেন্টসের মালিক ঘড়ির কাঁটা ১ ঘণ্টা এগিয়ে রাখত, এতে সন্ধ্যা ৬টার সময় ঘড়িতে ৫টা দেখাত। কিছু গার্মেন্টসে বের হওয়ার দরজা বন্ধ করে রাখত। এটি শ্রমিকদের নিরাপত্তার জন্য হুমকি ছিল।

১৯১১ সালের মার্চে এক গার্মেন্টসে বন্ধ দরজার কারণে ১১৬ জন কর্মী পুড়ে মারা যান। এর মধ্যে অধিকাংশই ছিল নারী ও কিশোর-কিশোরী। এ ঘটনা গার্মেন্টস শিল্পের শ্রমিকদের ইউনিয়ন গড়ে তোলাকে উদ্দীপ্ত করে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের শিল্প-কারখানাগুলো বহুগুণে নিরাপদ হয়ে ওঠে। 

১৯৪০ সালের শেষে দেশটিতে শক্তিশালী ইউনিয়ন গড়ে ওঠে, যারা উচ্চমজুরি আদায় করতে সক্ষম হয়। এতে খুব অল্প সময়ে সে দেশে বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও ধনী মধ্যবিত্ত শ্রেণী গড়ে ওঠে। শ্রমিকরা সংগঠিত থাকায় লাখো কর্মী প্রথমবার বাড়ি ও গাড়ি কেনার সুযোগ পান। সর্বোপরি ইউনিয়নের ফলে ভোক্তার চাহিদা বৃদ্ধি পায় এবং দেশের অর্থনীতিতে বড় মাত্রায় ভূমিকা রাখে। এটিও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ইউনিয়নগুলো তাদের সদস্য নয় এমন কর্মীদের মজুরি বৃদ্ধিতেও ভূমিকা রেখেছে। ফলে ইউনিয়নের সদস্য নয় এমন কর্মীরা ইউনিয়ন করতে উৎসাহিত হননি।

ইউনিয়ন হওয়ার আগে কর্মক্ষেত্রে নানা ধরনের অন্যায় সংঘটিত হতো। এমনও হয়েছে যে কর্মীরা প্রাকৃতিক কর্ম সারার জন্যও সময় পেতেন না। সে অধ্যায় তারা পার হয়ে এসেছেন, এখন তারা মানুষ হিসেবে গণ্য হন। 

অনেক পরিসংখ্যানেই উঠে এসেছে, ইউনিয়ন অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। এতে শুধু কর্মীদের মজুরিই বাড়ে না, জাতি অর্থনৈতিক ও সামাজিকভাবে ভারসাম্যপূর্ণ হয়। 

বাংলাদেশ শ্রম আইন, ২০০৬-এর ১৭৬ ধারা অনুযায়ী সব শ্রমিকের ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করার এবং সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র সাপেক্ষে নিজস্ব পছন্দের ট্রেড ইউনিয়নে যোগদানের অধিকার থাকার বিষয়টি স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। কিন্তু মালিক পক্ষ ট্রেড ইউনিয়নের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা তৈরি করে। এমনকি কাগুজে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ায় ভূমিকা রাখে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সম্প্রতি বেলজিয়ামের ব্রাসেলসভিত্তিক সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশনের (আইটিইউসি) বৈশ্বিক অধিকার সূচক ২০২৩-এ শ্রমজীবী মানুষের জন্য বিশ্বের ‘সবচেয়ে বাজে’ ১০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ১৪৯টি দেশকে অন্তর্ভুক্ত করে আইটিইউসির দশম এ সূচক গত ৩০ জুন প্রকাশ করা হয়। তালিকায় বাংলাদেশের সঙ্গে থাকা বাকি নয়টি দেশ হলো বেলারুশ, ইকুয়েডর, মিসর, এসওয়াতিনি, গুয়াতেমালা, মিয়ানমার, তিউনিসিয়া, ফিলিপাইন ও তুরস্ক।

মূলত ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল রানা প্লাজা ধসের ঘটনার পর ট্রেড ইউনিয়নের বিষয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং শ্রমিক অধিকার নিয়ে কাজ করা বৈশ্বিক জোট নতুন করে চাপ তৈরি করে। এর ফলে সরকার ইউনিয়ন নিবন্ধনের নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু এ নিবন্ধন প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে মালিক পক্ষ নিজেদের পছন্দের শ্রমিক দিয়ে নিবন্ধন করায়। যার ফলে এসব ট্রেড ইউনিয়নের কারণে শ্রমিকদের কোনো উপকারই হচ্ছে না তা সহজভাবে বলে দেয়া যায়।

অনেক প্রতিষ্ঠানে এখনো শ্রমিকরা মাস শেষে বেতন পান না। এভাবে শ্রমিকের শ্রম-ঘামে ব্যবসা পরিচালনা করে প্রাপ্য বেতন বুঝিয়ে না দেয়া হলে এর ফলে যে অস্থিরতা পুঞ্জীভূত হয়, তার সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব বেশ সুদূরপ্রসারী। একটি সমাজে উৎপাদনে জড়িত মেহনতি মানুষকে বঞ্চিত করে সে সমাজের কাঙ্ক্ষিত অর্থনৈতিক উন্নয়ন সাধন করা সম্ভব নয়। তাই ট্রেড ইউনিয়ন যে উদ্দেশ্য নিয়ে করা হয়, সেটির দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব হিসেবে শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তির বিষয়টিই প্রাধান্য পেয়ে থাকে। নাহলে যেকোনো সময় চাকরি চলে যাওয়া, ওভারটাইমের মজুরির ব্যবস্থা না থাকা এবং প্রয়োজনীয় ছুটি থেকে বঞ্চিত করা এসব হয়ে থাকে কার্যকর শ্রমিক ইউনিয়নের অভাবে, যার প্রভাব বহুমুখীভাবে সমাজের ওপর পড়ে।

তবে দেশে এত ট্রেড ইউনিয়ন থাকার পরও শ্রমিকদের ভাগ্য কতটা পরিবর্তন হচ্ছে তা দেখার বিষয়। অনেক ট্রেড ইউনিয়ন শ্রমিকদের অযৌক্তিক দাবিতে ইন্ধন দিয়ে গার্মেন্টস বন্ধ করে দেয় এমন অভিযোগও রয়েছে। তবে দুর্মূল্যের এ বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির সঙ্গে শ্রমিকদের বেতন যে বাড়েনি, এটিও অস্বীকার করা যাবে না। মূলত ট্রেড ইউনিয়নের যে উদ্দেশ্য, তাতে মালিক-শ্রমিক দ্বন্দ্ব নয়, বরং উভয়ের মধ্যে যৌক্তিক সম্পর্কের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠান যেন অগ্রসর হয় সেটিই চাওয়া। কারণ শ্রমিক অসন্তোষ জিইয়ে রেখে কোনো প্রতিষ্ঠান স্বাভাবিক গতিতে চলতে পারবে না। কর্মীরা যেন মনোযোগ দিয়ে যথাযথ শ্রমের মাধ্যমে উৎপাদন করতে পারেন এবং প্রতিষ্ঠান যেন লাভবান হয়, ট্রেড ইউনিয়ন এ উদ্দেশ্যে চলতে পারলে তা প্রতিষ্ঠানের অগ্রগামিতায় ভূমিকা রাখতে পারে।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও