করনীতি

ভ্যাট ব্যবস্থায় পেশাদার শ্রেণী গঠন জরুরি

আমাদের দেশের ভ্যাট সিস্টেমে অনেক সমস্যা বিরাজমান। এর মধ্যে বড় সমস্যা হলো আমরা ভ্যাট সিস্টেমকে একটা মানসম্মত সিস্টেম হিসেবে নির্মাণ করতে পারিনি।

আমাদের দেশের ভ্যাট সিস্টেমে অনেক সমস্যা বিরাজমান। এর মধ্যে বড় সমস্যা হলো আমরা ভ্যাট সিস্টেমকে একটা মানসম্মত সিস্টেম হিসেবে নির্মাণ করতে পারিনি। সিস্টেম বলতে আমরা কী বুঝি সেটা প্রথমে আলোচনা করা দরকার। ইংরেজি সিস্টেমকে বাংলায় ব্যবস্থা বলা হয়। যেমন ভ্যাট সিস্টেম অর্থাৎ ভ্যাট ব্যবস্থা। সিস্টেমের একটা সংজ্ঞা হলো, System is a collection of components, those are structrurally and functionally related to each other. অর্থাৎ সিস্টেম বা ব্যবস্থা হলো কতকগুলো উপাদানের সমষ্টি, যা কাঠামোগতভাবে ও কর্মপ্রক্রিয়াগতভাবে একে অপরের সঙ্গে সম্পর্কিত। সিস্টেমের উপাদানগুলো একে অপরের সঙ্গে কাজ করে সিস্টেমকে সচল রাখে এবং সিস্টেমের যে উদ্দেশ্য তা সম্পাদন করে।

  • এখন আসি ভ্যাট সিস্টেমের কথায়। ভ্যাট সিস্টেমে মূলত পাঁচটি উপাদান রয়েছে; যথা: ভ্যাটদাতা শ্রেণী, ভ্যাট আদায়কারী শ্রেণী, ভ্যাটসংক্রান্ত আইন-কানুন, তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো ও ভ্যাট প্রফেশনাল শ্রেণী। ভ্যাট প্রফেশনাল শ্রেণী বলতে আমি বুঝিয়েছি ভ্যাট কনসালট্যান্টদের, যারা ভ্যাটদাতাদের পরামর্শ দেন এবং ভ্যাটদাতাদের পক্ষে কাজ করেন। কোনো সিস্টেম তখনই ভালোভাবে কাজ করে যখন সিস্টেমের প্রত্যেকটা উপাদান ভালোভাবে কাজ করে। সিস্টেমের একটা উপাদান যদি ভালোভাবে কাজ না করে, তাহলে অন্য সব উপাদানের কাজে গতি হারায়। ধরুন একটা চেইনে ১০টা রিং রয়েছে। একটা রিং যদি সঠিকভাবে কাজ না করে, তাহলে চেইনটা ভালোভাবে কাজ করতে পারে না। এটা সিস্টেমের একটা উদাহরণ।
  • আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় প্রফেশনাল শ্রেণী এখনো গড়ে ওঠেনি। এনবিআর প্রদত্ত ভ্যাট কনসালট্যান্ট লাইসেন্সের সংখ্যা এখনো নগণ্য। এ পর্যন্ত মাত্র প্রায় ৫০০ ভ্যাট কনসালট্যান্ট রয়েছেন, যারা এনবিআরের লাইসেন্সধারী। আমাদের অর্থনীতির আকার-আকৃতি অনুসারে, আমার মতে প্রায় ২৫ হাজার ভ্যাট প্রফেশনালস প্রয়োজন রয়েছে। এনবিআরের অধীনে আয়কর আইনের আওতায় আইনজীবী রয়েছেন প্রায় ২৩ হাজার। কাস্টমস আইনের আওতায় সিঅ্যান্ডএফ এজেন্ট লাইসেন্সধারী রয়েছেন প্রায় ১২ হাজার। সে তুলনায় মাত্র ৫০০ ভ্যাট কনসালট্যান্ট অতি নগণ্য।
  • আমাদের ভ্যাট ব্যবস্থার একটা সমস্যা হলো ভ্যাট কনসালট্যান্ট লাইসেন্সধারীর সংখ্যা কম। এর পরের সমস্যা হলো আমি তাদের প্রতি সম্মান রেখে আমার মতামত দিতে চাই যে যারা লাইসেন্সধারী ভ্যাট কনসালট্যান্ট রয়েছেন, তারাও নানা কারণে ভ্যাট কনসালট্যান্সির কাজ মানসম্মতভাবে করতে পারছেন না। তাদের মধ্যে অনেকেই অন্যান্য কাজের সঙ্গে জড়িত। তাই ভ্যাট কনসালট্যান্সির কাজে তেমন সময় দেন না। তাদের গুণগত মান বাড়ানোর জন্য তেমন কোনো দর্শনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ফলে তারা ভ্যাট সিস্টেমে তেমন অবদান রাখতে পারছেন না। তারা শুধু কাজ করেন, উপার্জন করেন। কিন্তু সিস্টেমের উন্নয়নে মনোনিবেশ করার মতো কোনো উদ্যোগ দেখি না।
  • ভ্যাট সিস্টেমে ভ্যাট কনসালট্যান্টদের অবদান কী হতে পারে তা বোঝার জন্য আমি একটা উদাহরণ পেশ করছি। ২০১৬ সালে আমি একটা টিমের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ান ট্যাক্সেশন অফিস (এটিও) পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। অর্থাৎ আমাদের দেশের এনবিআর। এটিও থেকে অস্ট্রেলিয়ান জিএসটি লেজিসলেশনের একটা করে কপি আমাদের সবাইকে গিফট দেয়া হয়। অস্ট্রেলিয়ান জিএসটি লেজিসলেশনের কাভার পাতায় লেখা আছে “Disclaimer: No person should rely on the contents of this publication without first obtaining advice from a qualified professional person.” কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসনের কাছ থেকে পরামর্শ নেয়া ছাড়া কাউকে জিএসটি লেজিসলেশনের ওপর নির্ভর না করতে পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তাহলে বুঝে দেখুন, কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসনের গুরুত্ব কতটুকু। আমাদের দেশের ভ্যাট ব্যবস্থায় এরূপ কোয়ালিফায়েড প্রফেশনাল পারসন আমরা গড়ে তুলতেই পারিনি। এমনকি এরূপ একটা শ্রেণী গড়ে তোলা দরকার আছে এ কথাও আমরা অনেকে বুঝি না বা বিশ্বাস করি না। তাহলে একটা উত্তম ভ্যাট ব্যবস্থা আমরা কীভাবে গড়ে তুলব? ভ্যাট সিস্টেমের সব উপাদান সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। তাহলেই আমরা একটা উত্তম ভ্যাট ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারব।

ড. মো. আব্দুর রউফ: সদস্য (মূসক নীতি), জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এ প্রবন্ধে প্রকাশিত মতামত ব্যক্তিগত)

আরও