গত ৭ এপ্রিল ঢাকায় শুরু হওয়া বাংলাদেশ বিনিয়োগ সম্মেলনের উদ্বোধনী দিনে ‘স্টার্টআপ কানেক্ট’ শীর্ষক অধিবেশনের প্যানেল আলোচক হিসেবে অংশ নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, শিক্ষিত তরুণদের উদ্যোক্তাবৃত্তির প্রতি আকৃষ্ট করার লক্ষ্যে শিগগিরই ৮০০-৯০০ কোটি টাকার একটি নতুন উদ্যোক্তা (স্টার্টআপ) তহবিল গঠন করা হবে। বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অন্য নানাবিধ কারণে দেশের বেকারত্ব পরিস্থিতি যখন ক্রমেই নাজুক থেকে নাজুকতর হয়ে উঠছে, তখন গভর্নর কর্তৃক নতুন উদ্যোক্তা তহবিল গঠনের এ ঘোষণা দেশে নয়া কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও ইতিবাচক ধারা সৃষ্টি করবে বলে আশা করা যায়। আর শিক্ষিত তরুণদের জন্য এটি নিঃসন্দেহে এমন একটি সুযোগ, যা অনেক নিষ্ঠাবান-পরিশ্রমী তরুণের ভাগ্যকেই আমূল বদলে দিতে পারে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর কর্তৃক সদ্যঘোষিত ওই নতুন উদ্যোক্তা কর্মসূচির ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুণগত মান ও কাম্যস্তরের ব্যবহার কীভাবে নিশ্চিত করা যাবে এবং একই ধারায় সম্ভাবনাময় নতুন উদ্যোক্তারা এ থেকে কীভাবে সর্বোচ্চ পরিসরে উপকৃত হতে পারবে, তা নিয়ে এখানে সংক্ষিপ্ত পরিসরে খানিকটা আলোচনা করা হলো।
নতুন উদ্যোক্তা তহবিল গঠনের বিষয়ে গভর্নরের দেয়া বক্তব্যের মধ্যকার যে অংশটি এ কর্মসূচির বিষয়ে সবচেয়ে বেশি ইতিবাচকতার ইঙ্গিত দিচ্ছে তা হলো, তিনি বলেছেন, ‘৯৫ শতাংশ স্টার্টআপ ব্যর্থ হলেও আমরা তাদের পাশে আছি।’ এ বক্তব্য একদিকে যেমন বাস্তবায়িত কর্মসূচির অভিজ্ঞতাকে স্মরণে রেখে ভবিষ্যৎ কর্মসূচির বিষয়ে সতর্ক থাকার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছে, অন্যদিকে তেমনি তা নতুন কর্মসূচির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক তথা রাষ্ট্রের দৃঢ় অঙ্গীকারের কথাও তুলে ধরছে। সম্ভব সংক্ষিপ্ততম শব্দে নতুন উদ্যোক্তা তহবিলের বিষয়ে এটি তার একটি চমৎকার মূল্যায়ন ও দিকনির্দেশনা। আশা করব, ঋণ তহবিলটির বাস্তবায়নকালে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো এ দুটো বিষয়কেই গুরুত্বের সঙ্গে মনে রাখবে। আর তা রাখলে কর্মসূচিটি অতীতের বিভিন্ন ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে নিকট ভবিষ্যতে আরো অধিক দক্ষতা ও গতিশীলতার সঙ্গে বাস্তবায়িত হওয়ার সুযোগ পাবে এবং এটিই বস্তুত যেকোনো কর্মসূচির ক্ষেত্রে সফলতা অর্জনের মূল পূর্বশর্ত।
৯০০ কোটি টাকার নতুন তহবিল গঠনের বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক এখনো কোনো বিজ্ঞপ্তি বা প্রজ্ঞাপন জারি করেনি, যা এক সপ্তাহের মধ্যে করা হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। ফলে ওই প্রজ্ঞাপনে কী কী বিষয় কীভাবে থাকছে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। তবে ধারণা করা যায়, তা অতীত কর্মসূচিগুলোর ধারাবাহিকতা অনুযায়ীই প্রণীত হবে এবং সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু তার পরও অতীতের অভিজ্ঞতার আলোকে এখানে দুটি পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই।
এক. নতুন উদ্যোক্তা বাছাইয়ের মানদণ্ড নির্ধারণের ক্ষেত্রে অতীতে তাদের প্রতি যৌক্তিক সীমার বাইরে গিয়ে এক ধরনের ‘বিশেষ’ সহানুভূতি প্রদর্শনের প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের প্রতি রাষ্ট্রকে অবশ্যই বাড়তি ও মমতাপূর্ণ সহানুভূতি দেখাতে হবে। কিন্তু তাই বলে সেটি কোনো অবস্থাতেই পেশাদারত্বের সীমাকে অতিক্রম করে নয়। সৃজনশীল নতুন প্রকল্প নিয়ে এগিয়ে আসার জন্য তরুণদের নানাভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করতে হবে—এটি ঠিক আছে। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে বিনিয়োগের সঙ্গে উদ্যোক্তার যুক্ততা তৈরি হয়ে যাওয়ার পর বাকি সবটুকুই তাকে পেশাদারত্বপূর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে করতে হবে। কিন্তু অতীতে এ ধরনের অপেশাদারত্বপূর্ণ মানদণ্ডের ব্যাপক চর্চা হয়েছে বলেই অনেক ভুল প্রকল্প ও উদ্যোক্তা সেখানে অবলীলায় অর্থায়ন পেয়ে গেছে এবং তারই জেরে শেষ পর্যন্ত এগুলো সফল হতে পারেনি। কার্যত এ ধরনের অপেশাদারত্বপূর্ণ মানদণ্ড নির্ধারণের কারণেই ৯৫ শতাংশ নতুন উদ্যোগ (স্টার্টআপ) সফল হতে পারেনি, যেমনটি গভর্নর বলেছেন।
দুই. দ্বিতীয় পর্যবেক্ষণের ঘটনাটি বস্তুত প্রথমটি থেকেই উৎসারিত এবং সেটিরই ধারাবাহিকতা ও ফলাফল। আর সেসব দেখেই বলা যে প্রকল্প ও উদ্যোক্তা বাছাইয়ের মানদণ্ড নমনীয়ভাবে নির্ধারণের পর তার চেয়েও অধিক নমনীয়তার সঙ্গে সেগুলো প্রয়োগ করার কারণেই ভুল প্রকল্প ও উদ্যোক্তার কাছে ঋণ যাওয়ার ফলে শেষ পর্যন্ত সেগুলো ব্যর্থ হয়েছে। সত্যি কথা বলতে কি, এসব প্রকল্প ও উদ্যোক্তা বাছাইয়ের ক্ষেত্রে মূল বিবেচনা হিসেবে কাজ করেছে রাজনৈতিক পক্ষপাত ও সংশ্লিষ্টতা এবং কিছু ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পর্যায়ের সম্পর্ক ও যোগাযোগ। কিছু ক্ষেত্রে অনৈতিক চর্চারও অভিযোগ রয়েছে। কিন্তু শিল্প ও ব্যবসায় বিনিয়োগের কাজটি এমনই যে অপেশাদারত্বপূর্ণ সহানুভূতি ও নমনীয়তা দিয়ে তা চলে না। তাই নতুন পর্যায়ের ৯০০ কোটি টাকার তহবিল ব্যবহারের ক্ষেত্রে বিষয়টিকে সর্বোচ্চ সতর্কতার সঙ্গে অনুসরণ করা অত্যন্ত জরুরি বলে মনে করি। একইভাবে প্রকল্প ছাঁটাইয়ের ক্ষেত্রেও যেন কোনোভাবেই এ ধরনের রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ বিবেচনা কাজ না করে—সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এ প্রসঙ্গে স্মরণ করতে চাই, এ ধরনের রাজনৈতিক বিবেচনা থেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক গত বছরের জুলাইতে ‘টেন মিনিট স্কুলে’র এ ধরনের বরাদ্দের অনুমোদন বাতিল করা হয়েছিল।
এবারে আসা যাক নতুন পর্যায়ে ৯০০ কোটি টাকার বরাদ্দ ও বিতরণের পরিসর, পদ্ধতি ও প্রক্রিয়া প্রসঙ্গে। এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখ করা দরকার যে অতীতে নতুন উদ্যোক্তা তহবিলের সিংহভাগই গিয়েছে শহরাঞ্চলের বিভিন্ন প্রকল্পে। কিন্তু আজকের এ নতুন পর্যায়ে এটিকে ব্যাপক পরিসরে গ্রামাঞ্চলেও নিয়ে যেতে হবে। এক্ষেত্রে একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই যে, নানা সমস্যা ও সীমাবদ্ধতার পরও স্বীকার্য যে বহু গ্রামেই এখন বিনিয়োগযোগ্য অবকাঠামোগত সুবিধাদি রয়েছে এবং সেই সুবাদে বহু শিক্ষিত তরুণই এখন গ্রামে বসবাস করে। ফলে নতুন উদ্যোক্তা কর্মসূচির আওতায় গ্রামেও বহু সম্ভাবনাময় প্রকল্প ও উদ্যোক্তা খুঁজে পাওয়া সম্ভব এবং তা খোঁজাটা জরুরি বলেও মনে করি। আর তা করা হলে তরুণ-যুবাদের শহর গমনমুখী প্রবণতা কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে আশা করা যায় এবং একসময় হয়তো তা নিয়মিত চর্চাতেই পরিণত হবে। অতএব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহসাই জারীকৃতব্য প্রজ্ঞাপনে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর প্রতি এ নির্দেশনা অবশ্যই থাকতে হবে যে একটি নির্দিষ্ট পরিমাণ ঋণ অবশ্যই গ্রামীণ উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করতে হবে। তদুপরি গ্রাম-শহর নির্বিশেষে সব ঋণের ক্ষেত্রেই স্বল্প বিনিয়োগধারী ক্ষুদে উদ্যোক্তাদের বিশেষ অগ্রাধিকার দিতে হবে। এতে একই পরিমাণ তহবিলের আওতায় বেশি সংখ্যক উদ্যোক্তাকে সেবা ও সুবিধাদানের পাশাপাশি কর্মসংস্থান সৃষ্টির ক্ষেত্রেও বাড়তি সুফল পাওয়া যাবে বলে আশা করা যায়।
নবঘোষিত ৯০০ কোটি টাকার এ নতুন উদ্যোক্তা কর্মসূচিটিকে সর্বোচ্চ গুণগত মান রক্ষা করে বাস্তবায়ন করতে চাইলে উপরোক্ত মতামত ও পর্যবেক্ষণগুলোকে বিবেচনায় নেয়ার পাশাপাশি এক্ষেত্রে একটি শক্তিশালী ও নিয়মিতভিত্তিক কার্যকর পরিধারণ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে, যেক্ষেত্রে বর্তমানে ব্যাপক মাত্রার ঘাটতি রয়েছে বলে মনে করি। এক্ষেত্রে পরিধারণ বলতে শুধু যেন বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো কর্তৃক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে মাস শেযে ঋণ বিতরণ ও আদায়ের প্রতিবেদন পাঠিয়ে দেয়াকে বোঝানো না হয়। বরং ওই পরিধারণ ব্যবস্থার আওতায় অধিকতর গুরুত্ব দিতে হবে মাঠ পর্যায় পরিদর্শন, প্রকল্পের বাস্তব (ফিসক্যাল) অগ্রগতি নিশ্চিতকরণ, প্রকল্প বাস্তবায়নে ও পণ্য বা সেবা উৎপাদনে সর্বোচ্চ গুণগত মান রক্ষা করা ইত্যাদির ওপর। এ বিষয়গুলোর অধিকাংশই করতে হবে সংশ্লিষ্ট বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোকে। তবে এক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্টতাও বর্তমানের তুলনায় আরো বহুলাংশে বাড়াতে হবে।
বর্তমান পরিধারণ ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় ও বাণিজ্যিক উভয় ব্যাংকেরই একটি বড় দুর্বলতা এই যে বাস্তবায়ন পর্যায়ের ত্রুটি-বিচ্যুতি, দুর্বলতা, অদক্ষতা ইত্যাদি বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তর ও শাখা এবং কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সময়ে সময়ে সতর্ক করা হলেও তাদেরকে যথাসময়ে সংশোধনমূলক পরামর্শ দিয়ে সহায়তা করা হয় না। এক্ষেত্রে মনে রাখা দরকার যে পরিধারণ বলতে শুধু ভুল ধরাকে বোঝায় না। বরং ভুলের সংশোধন ও পরিমার্জন কীভাবে ঘটানো যাবে, সে বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের পরামর্শ, তথ্য ও ধারণা দিয়ে সহায়তা করাও কার্যকর পরিধারণেরই অংশ। কিন্তু বাংলাদেশের দপ্তর-সংস্কৃতিতে এ ক্ষেত্রে ব্যাপক মাত্রার ধারণাগত ও চর্চাগত ঘাটতি রয়েছে। আশা করব যে আলোচ্য এ নতুন উদ্যোক্তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তা বহুলাংশে কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। আর তা তারা কতটা পারবে, তার ওপরই নির্ভর করছে এ কর্মসূচির প্রাকারান্তরিক সাফল্য। আশা করব যে ৯০০ কোটি টাকার এ সম্ভাবনাময় কর্মসূচিটিকে যেকোনো ধরনের রাজনৈতিক ও ক্ষুদ্রস্বার্থ বলয়ের ঊর্ধ্বে রেখে সম্পূর্ণ পেশাদারত্বের ভিত্তিতে কাম্য গুণগত মান রক্ষা করে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে।
আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়