নির্মাণকাজে সাত বছরের জনভোগান্তির পর নকশাগত ত্রুটি রেখে গত ১৫ ডিসেম্বর অপ্রস্তুত অবস্থায় বিমানবন্দর-গাজীপুর বাস র্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) করিডোরে শুরু হয়েছে বাস চলাচল। বণিক বার্তায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের তথ্য বলছে, বিআরটি লেন সাধারণ যানবাহনের জন্য উন্মুক্ত রাখায় উদ্বোধনের দিনই ভয়াবহ যানজটে পড়ে চলাচলরত বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন করপোরেশনের (বিআরটিসি) বাস। ৫০ মিনিটে যাতায়াতের জন্য যে করিডোর নির্মাণ করা হয়েছে, সেই করিডোর পার হতে উদ্বোধনের দিন বাসগুলোর সময় লাগে দেড়-দুই ঘণ্টা। আবার বিআরটি করিডোর নির্মাণ করতে গিয়ে সংকুচিত করে ফেলা হয়েছে ঢাকা-গাজীপুরের ব্যস্ততম মহাসড়ক। এ কারণে বিআরটি লেনের বাইরেও যানজট মহাসড়কটির নিত্যসঙ্গীতে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পটি বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোরে জনদুর্ভোগ আরো বাড়িয়ে দেবে বলে মত অবকাঠামো বিশেষজ্ঞদের।
- দেশের অন্যতম শিল্প অধ্যুষিত এলাকা গাজীপুর। মহাসড়কের দুই পাশে রয়েছে অসংখ্য শিল্প কল-কারখানা। শ্রমিকদের দৈনন্দিন যাতায়াতের প্রধান মাধ্যম এ মহাসড়ক। শিল্প-কারখানায় পণ্য আনা-নেয়ার ক্ষেত্রেও একমাত্র ভরসা মহাসড়কটি। একই সঙ্গে ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ প্রবেশদ্বার হিসেবেও ব্যবহৃত হয়ে আসছে বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোর। শ্রমঘন এলাকার এ ধমনি সড়ক ঘিরে দীর্ঘদিন ধরেই পরিকল্পিত উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে। সড়কের প্রশস্ততা বাড়ানো, প্রয়োজনীয় ফুটপাত নির্মাণ ও রক্ষণাবেক্ষণ, ড্রেনেজ ব্যবস্থার উন্নয়ন, দক্ষ ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা আর সুষ্ঠু তদারকিতেই যেখানে করিডোরটি গতিশীল করা সম্ভব ছিল, সেখানে মহাসড়কের মাঝের গুরুত্বপূর্ণ অংশ দখল করে গড়ে তোলা হয়েছে বিআরটি প্রকল্প। যেখানে বিআরটির স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে, সেখানে সড়কের প্রশস্ততা এতটাই কম যে সাধারণ যানবাহন চলতে গিয়ে তীব্র যানজট লেগে যায়। নকশায় অসংগতি তৈরি করা অবকাঠামোটির যৌক্তিকতা নিয়েও উঠেছে প্রশ্ন। যদিও কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেনি।
- সহজ, নির্ভরযোগ্য ও দ্রুতগতির যাতায়াত মাধ্যম হিসেবে বিআরটি বিশ্বজুড়েই বেশ জনপ্রিয়। বিআরটি করিডোর নির্মাণ খুব বেশি ব্যয়বহুলও নয়। সাধারণ সড়কে আলাদা লেন করে দিলেই বিআরটি লেন হয়ে যায়। তবে এ ধরনের পরিবহন ব্যবস্থা শহরের ভেতরেই বেশি কার্যকর। মহাসড়কের জন্য খুব একটা উপযোগী নয়। ঢাকায় বিআরটি করিডোর শুরুতে শহরের ভেতরেই নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়েছে সরকারের সংশোধিত কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায় (আরএসটিপি)। রুট ছিল বিমানবন্দর থেকে পুরান ঢাকা অতিক্রম করে বুড়িগঙ্গা পাড়ের কেরানীগঞ্জ পর্যন্ত। আর বিআরটির বর্ধিত অংশ হিসেবে পরিকল্পনা করা হয় বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটির। যদিও অদৃশ্য কারণে আলোর মুখ দেখেনি বিআরটির বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ অংশ। এর বদলে বর্ধিত অংশের কাজই শুরু হয় আগেভাগে। এক পর্যায়ে বাতিল হয়ে যায় বিমানবন্দর-কেরানীগঞ্জ বিআরটির পরিকল্পনা। পরবর্তী সময়ে নির্মাণাধীন বিআরটি করিডোরটি ঢাকার ভেতরে মহাখালী পর্যন্ত টেনে আনার উদ্যোগ নেয়া হলেও সেটি বাস্তবায়ন হয়নি। যে রুটে নির্মাণ করা হলে বিআরটি সবচেয়ে কার্যকর হতো, সেই রুট বাদ দিয়ে অবকাঠামোটি গড়ে তোলা হয়েছে দেশের একটি ব্যস্ত জাতীয় মহাসড়ক দখল করে।
- ঢাকায় বিআরটি নির্মাণ করতে গিয়ে এখন পর্যন্ত খরচ হচ্ছে ৪ হাজার ২৪৬ কোটি টাকা। বিআরটির মতো প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বের কোথাও এর চেয়ে বেশি ব্যয় হয়েছে কিনা তা নিয়েও রয়েছে প্রশ্ন। বাংলাদেশে অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, অবকাঠামো নির্মাণ প্রকল্পগুলো ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে নির্মাণ ব্যয় বাড়ানো হয়েছে। প্রয়োজন নেই, এমন অনুষঙ্গের পেছনে শত শত কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। যদিও প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের আগে সমীক্ষার ঘাটতি থেকেছে। সঠিক নকশা হয়নি। মাঠ পর্যায়ে কাজ বাস্তবায়ন করতে গিয়ে লেজে-গোবরে পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। তিন বছরের প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে সময় লেগেছে ১২ বছর। সময়ের সঙ্গে বেড়েছে নির্মাণ ব্যয় আর জনদুর্ভোগ। বিমানবন্দর-গাজীপুর বিআরটি এ ধরনের প্রকল্পের একটি উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
- ঢাকার বিআরটি নির্মাণে জনদুর্ভোগ হয়েছে। দুর্ঘটনায় প্রাণহানি হয়েছে। এখন বাস পরিষেবা চালুর পরও জনদুর্ভোগ হচ্ছে। বিপুল ব্যয়ের এ অবকাঠামো ভবিষ্যতে যেন আরো দুর্ভোগের কারণ না হয়, সে লক্ষ্যে এখনই সময় সঠিক পরিকল্পনা প্রণয়নের। কর্তৃপক্ষের উচিত কীভাবে জনদুর্ভোগ কমিয়ে বিমানবন্দর-গাজীপুর করিডোরটি গতিশীল করা যায়, সেদিকে মনোযোগী হওয়া। বিশেষ করে বিআরটি করিডোরের স্টেশনগুলো নিয়ে নতুন করে পরিকল্পনা করতে হবে। প্রয়োজনে স্টেশন এলাকাগুলোয় জমি অধিগ্রহণ করে সংকুচিত হওয়া মহাসড়কের প্রশস্ততা বৃদ্ধি করতে হবে। এটা যদি সম্ভব না হয়, প্রয়োজনে বিআরটি করিডোরকে উন্মুক্ত করে দিয়ে স্টেশনগুলো সংকুচিত করে ফেলা হোক। জনদুর্ভোগ নয়, অবকাঠামোটি জনবান্ধব হিসেবে গড়ে তোলা হোক। একই সঙ্গে ভবিষ্যতে এ ধরনের প্রকল্পের পুনরাবৃত্তি এড়াতে প্রকল্পটির বাস্তবায়নকারী কর্মকর্তাদেরও জবাবদিহিতার আওতায় আনা হোক। সঠিক পরিকল্পনা, যথাযথ সমীক্ষা আর সুষ্ঠু বাস্তবায়নে গড়ে উঠুক দেশের সব অবকাঠামো।