বিশ্লেষণ

পরিবেশ রক্ষায় রাজনীতির ভূমিকা অনুসন্ধান

রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে যারা পর্যালোচনা করেন তাদের অনেক সময় লেগেছে পরিবেশ রাজনীতির চ্যালেঞ্জগুলো অনুধাবন করতে। মূলত ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বাস্তুসংস্থান অর্থাৎ পরিবেশগত চিন্তা-চেতনাকে রাজনৈতিক চিন্তা কিংবা দর্শনের উপশাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মজার বিষয় হলো পরিবেশ রাজনীতির উদ্ভব পরিবেশ চিন্তকদের কিংবা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক চিন্তা কিংবা দর্শন থেকে

রাজনৈতিক তত্ত্ব নিয়ে যারা পর্যালোচনা করেন তাদের অনেক সময় লেগেছে পরিবেশ রাজনীতির চ্যালেঞ্জগুলো অনুধাবন করতে। মূলত ১৯৭০-এর দশকের শেষের দিকে বাস্তুসংস্থান অর্থাৎ পরিবেশগত চিন্তা-চেতনাকে রাজনৈতিক চিন্তা কিংবা দর্শনের উপশাখা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয়। মজার বিষয় হলো পরিবেশ রাজনীতির উদ্ভব পরিবেশ চিন্তকদের কিংবা শিক্ষাসংশ্লিষ্টদের রাজনৈতিক চিন্তা কিংবা দর্শন থেকে হয়নি।

১৯৯০-এর দশকে পরিবেশ রাজনীতিকেন্দ্রিক চিন্তাভাবনা পশ্চিম ইউরোপে, বিশেষত যুক্তরাজ্য এবং নেদারল্যান্ডসে প্রসার লাভ করে এবং শিক্ষার বিষয়বস্তুও হয়ে ওঠে। এর মূল উদ্দেশ্য ছিল উদারতাবাদ, নৈরাজ্যবাদ কিংবা সমাজতন্ত্রের মতো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক ধারার পরিবর্তে একটি ভিন্নধারার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত নতুন ধারার রাজনৈতিক তত্ত্ব চালু করা যাকে ‘ইকোলজিজম’ও বলা যেতে পারে। এ নতুন ধারার মূল লক্ষ্য ছিল গভীর বাস্তুতন্ত্র এবং বাস্তুকেন্দ্রিকতা এবং এর শুরু মূলত উত্তর আমেরিকা ও অস্ট্রেলিয়ায়। এ সম্পর্কিত প্রথম লেখা যিনি রচনা করেন তিনি হলেন নরওয়ের নাগরিক আর্নে নাইস। পশ্চিম ইউরোপে বাস্তুকেন্দ্রিক রাজনৈতিক তত্ত্বের প্রধান চ্যালেঞ্জগুলো হলো বিভিন্ন আঙ্গিকে সমাজতন্ত্রের স্বাধীনতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি এবং সংশ্লিষ্ট পদ্ধতি যেমন নৈরাজ্যবাদ কিংবা সাম্প্রতিক উদারতাবাদ। 

মার্ক্সবাদী ধারণা একসময় পরিবেশ আন্দোলনকারী সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। এরই পথ ধরে ১৯৭০-এর দশকে ছাত্র আন্দোলনে মার্ক্সবাদী ধারণায় যে আগ্রহের সৃষ্টি হয় তা শেষ পর্যন্ত পরিবেশকে রাজনৈতিক ধারায় চিন্তার বিষয়বস্তু হিসেবে সংযুক্ত করার সূচনা ঘটায়। আমরা যদি ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখতে পাই ‘ফ্রাংকফুর্ট স্কুল’-এর ধারণা, নৈরাজ্যবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পাশাপাশি আরো ঐতিহ্যবাহী মার্ক্সবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ১৯৭০ ও ১৯৮০-এর দশকে মহাদেশীয় তাত্ত্বিক বিতর্কে আধিপত্য বিস্তার করতে শুরু করে। সর্বোপরি সে সময় মহাদেশীয় তাত্ত্বিক আলোচনায় পরিবেশগত নীতিশাস্ত্রের চেয়ে সমাজতাত্ত্বিক তত্ত্বগুলো বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল।

পরবর্তী সময়ে একটি পরিবেশবান্ধব সবুজ তত্ত্ব প্রণয়ন ছাড়াও বর্তমান রাজনৈতিক অনুশীলনে পরিবেশগত বিষয়টিকে যেমন অনেক ক্ষেত্রে প্রাধান্য দেয়া হচ্ছে তেমনি এটি গবেষণার বিষয়বস্তুও হয়ে উঠেছে। পশ্চিম ইউরোপীয় ইতিহাসবিদ, দার্শনিক, অর্থনীতিবিদ এবং সমাজবিজ্ঞানীরা ‘আধুনিক’ পরিবেশগত চিন্তাভাবনার উদ্ভবের আগে দার্শনিক, বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ, সামাজিক তাত্ত্বিক এবং অন্যান্য লেখকের কাজের পরিবেশগত দিকগুলো নিয়ে অনেক অধ্যয়ন ও বিশ্লেষণ করেছেন বলে মনে করা হয়। 

বিশেষত ‘বিজ্ঞানের সমাজতত্ত্ব’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে বৈজ্ঞানিক বিষয় হিসেবে বাস্তুশাস্ত্রের ইতিহাস অত্যন্ত আগ্রহের কেন্দ্রে চলে আসে এবং এর সঙ্গে রাজনৈতিক এজেন্ডাগুলোর সংজ্ঞায় বৈজ্ঞানিক পরিবেশবিদদের ভূমিকাও জড়িত হয়। তবে ‘বাস্তুশাস্ত্র’ এখন একটি রাজনৈতিক বিষয় হিসেবে অন্যান্য রাজনৈতিক মতাদর্শের মধ্যে যোগসূত্র হিসেবে বিতর্কের আরেকটি প্রধান বিষয়বস্তু হিসেবে আলোচিত হচ্ছে। 

এ প্রেক্ষাপটে আমরা যদি সোভিয়েত ইউনিয়ন সময়কাল এবং এর ভাঙনের পরবর্তী সময় বিশ্লেষণ করি তাহলে সমাজতান্ত্রিক সময়ে সেখানে পরিবেশ ও বাস্তুতান্ত্রিকতাকে যেভাবে গুরুত্ব দেয়া হতো পরবর্তীকালে সেটা ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়তে দেখি। সোভিয়েত ইউনিয়নের ভাঙন-পরবর্তী সময়ে পরিবেশগত বিষয়ে দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন একটি তাৎপর্যপূর্ণ বার্তা দেয়। দেখা যায়, সমাজতন্ত্রের জায়গা পুঁজিবাদের চিন্তাচেতনায় দখল হয়ে যাওয়ায় সেখানে কেবল অর্থকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে, পরিবেশকে নয়। যদিও সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পরে বছরের পর বছর ধরে পরিবেশগত রাজনীতি ও নীতিগুলোকে রূপ দিতে থাকে তার উত্তরাধিকার অংশ নতুন দেশগুলো।

গর্বাচেভের পেরেস্ত্রোইকা সংস্কারের সময় যে পরিবেশগত সক্রিয়তা বিকশিত হয়েছিল তা ১৯৯০-এর দশকে এসে হ্রাস পায়। এর কারণ হিসেবে মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্ব বৃদ্ধিকে দায়ী করা হয়। তখন বাস্তুতন্ত্র রক্ষার চেয়ে জনসাধারণের বেঁচে থাকার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। ফলে বাস্তুতন্ত্রের বিনাশ হবে এটাই স্বাভাবিক।

২০০০ সাল-পরবর্তী সময়ে রাশিয়ায় ভ্লাদিমির পুতিন যে অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার শুরু করেন সেখানে মূলত ধনিক শ্রেণীর উত্থান হয় এবং তাদের স্বার্থকে রক্ষা করতে গিয়ে পরিবেশ-প্রতিবেশের ক্ষতি হয়। একই সঙ্গে পরিবেশ রক্ষার বিষয়টি গৌণ হয়ে পড়ে বলে মনে করা হয়। এখানে পুতিনের কর্তৃত্ববাদী এবং পুঁজিতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থাকে দায়ী করা হয়। এমন প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠন পরিবেশ রক্ষায় নানা কর্মসূচি দিলেও সেটি আদতে তেমন সাফল্যের মুখ দেখেনি। অন্যদিকে এসব পরিবেশবাদী সংগঠনের আর্থিক তহবিলের উৎসগুলো ছিল সীমিত এবং ২০০০ সালে এসে আন্তর্জাতিক তহবিল গ্রহণের বিষয়টি সন্দেহের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হলে এদের কর্মকাণ্ড একেবারেই স্তিমিত হতে থাকে। আমরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশেও দেখে থাকি, কর্তৃত্ববাদী শাসন ব্যবস্থায় শাসকদের মাঝে একটি সন্দেহবাতিক প্রবণতা থাকে। জনগণের যেকোনো কল্যাণকাজেও এদের সন্দেহ গড়ে ওঠে এবং ক্ষমতা হারানোর ভয় কাজ করে। একইভাবে রাশিয়ায় কেন্দ্রীয়ভাবে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণের কারণে সুশীল সমাজের স্বাধীনভাবে পরিচালিত কর্মকাণ্ডগুলো মূলত সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ে। প্রধান মিডিয়া আউটলেটগুলো রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণাধীন কিংবা নিজস্ব সেন্সরশিপে অবরুদ্ধ হয়ে পড়ে। খুব কমসংখ্যক সংবাদমাধ্যম পরিবেশগত সমস্যা সম্পর্কে সংবাদ প্রকাশ করে। ফলে রাশিয়ার নাগরিকদের পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে তেমন শক্তিশালী অবস্থান নিতে দেখা যাচ্ছে না। 

জ্বালানি তেল ও গ্যাস উত্তোলনের জন্য মূলত গ্যাজপ্রম ও রোজনেফটের ওপর নির্ভরশীল সুপারপাওয়ার রাশিয়া। এই করপোরেশনগুলো সাধারণত হাইড্রোকার্বন উৎপাদন করতে গিয়ে পরিবেশগত বিষয় খুব কম গুরুত্বই দিয়ে থাকে। ভ্লাদিমির পুতিন রাশিয়ার অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে যে সম্পদ আহরণের মতো উদ্যোগগুলো নেন তাতে এসব করপোরেশনের অবদান অনেক। রাশিয়ার বেশির ভাগ তেল এবং গ্যাসক্ষেত্র সাইবেরিয়া অঞ্চলে অবস্থিত এবং এসব অঞ্চলে তেল-গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে সবচেয়ে বেশি চাপ সইতে হয়েছে এখানকার প্রান্তিক আদিবাসীদের। 

তবে বিশ্বব্যাপী তেল ও গ্যাস রফতানিতে রাশিয়ার ব্যাপক অবদান এবং এর ওপর ইউরোপের নির্ভরশীলতার কারণে পরিবেশের ওপর বিরূপ প্রভাবের বিষয়টা মুখ্য হয়ে ওঠেনি। মূলত ভোগবাদ এবং স্বার্থ অনেক সময় নৈতিক বোধকে ভোঁতা করে দেয় এবং জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বিষয়টি হরহামেশা দেখা যায়। রাশিয়া ২০০৪ সালে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করে, তবে সেটি অনেকটা আন্তর্জাতিক চাপে নিজ দেশের অভ্যন্তরীণ চাপ কিংবা তাগাদায় নয়। উল্লেখ্য, ১৯৯৭ সালের শেষের দিকে জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত জাতিসংঘ ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (ইউএনএফসিসিসি বা এফসিসিসি) আয়োজনের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণায়নের হুমকি থেকে পৃথিবীকে রক্ষার জন্য ১৫০টিরও বেশি দেশ এবং অঞ্চল জাপানের কিয়োটোয় জড়ো হয়েছিল। জাতিসংঘের সম্মেলনে এ আন্তর্জাতিক পরিবেশগত চুক্তির উদ্দেশ্য ছিল বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্বের স্থিতিশীলতা এমন স্তরে অর্জন করা যা জলবায়ু ব্যবস্থায় বিপজ্জনক মানব হস্তক্ষেপ রোধ করবে।

এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয় যে মস্কো বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থায় তার প্রস্তাবিত সদস্যপদ থেকে অর্থনৈতিক সুবিধার প্রত্যাশা করেছিল এবং এর সঙ্গে কিয়োটো প্রটোকলে স্বাক্ষর এবং আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তির একটা সম্পর্ক ছিল। মজার বিষয় হলো, ২০১২ সালে দোহা সম্মেলনে রাশিয়া ঘোষণা করে যে কিয়োটো তার কার্যকারিতা হারিয়েছে এবং রাষ্ট্রটি চুক্তির দ্বিতীয় প্রতিশ্রুতির মেয়াদে স্বাক্ষর করতে অস্বীকার করে। 

বিশ্ব প্রেক্ষাপটে রাজনীতিতে পরিবেশ বিষয়ের গুরুত্ব পরিবর্তিত হতে দেখা যায় বিভিন্ন সময়ে। আমরা যদি মার্ক্স-উত্তর সময়কে অনুধাবন করি তাহলে বেশ পরিবর্তন দেখতে পাব। এখানে ইকো-মার্ক্সবাদী ভৌগোলিক এবং রাজনৈতিক বাস্তুসংস্থান বিশ্লেষণের দাবি রাখে। 

পরিবেশবিষয়ে রাজনীতির প্রভাব বিশ্লেষণ করলে আমাদের কিছু তাত্ত্বিক অধ্যয়ন জরুরি। এক্ষেত্রে ব্রুনো লাট্যুর তার বহুমাত্রিক বিশ্লেষণে দেখিয়েছেন। রাজনৈতিক বাস্তুশাস্ত্র, বাস্তুতন্ত্রে মানুষ এবং অন্যদের মাঝে সম্পর্ক কেমন। ব্রুনো লাট্যুর তার ‘পলিটিকস অব নেচার’ অর্থাৎ ‘প্রকৃতির রাজনীতি’সহ বিভিন্ন বইয়ে রাজনৈতিক দর্শন এবং রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংযুক্ত রাজনৈতিক নীতিনির্ধারকদের কাকে কী হিসেবে চিন্তা করা উচিত সে প্রেক্ষাপটে প্রচলিত চিন্তাচেতনাকে চ্যালেঞ্জ করেন। তার প্রকৃতি-সমাজ দ্বৈতবাদকে উপেক্ষা করে পরিবেশগত অধ্যয়ন এবং ‘ন্যাচারপলিটিক’ গ্রন্থ জলবায়ু পরিবর্তনসহ নানা বিষয়ে সহজ ধারণা দিতে সহায়তা করে। ব্রুনো লাট্যুর প্রকৃতি, পরিবেশগত রাজনীতি এবং অ্যানথ্রোপোসিনের একটি নতুন ধারণার জন্ম দেন। তিনি নানা বিষয়কে সংযুক্ত করেন এবং এখানে তিনি ভূগোলবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক দার্শনিকদের সঙ্গে কাজ করেছেন। বলে রাখা ভালো, প্রায় ১১ হাজার ৭০০ বছর আগে শুরু হওয়া হলোসিন যুগের পর মানুষ যখন পৃথিবীর পরিবেশকে প্রভাবিত করার শক্তিশালী নিয়ামক হয়ে উঠল তখন থেকে বর্তমান ভূতাত্ত্বিক যুগকে অ্যানথ্রোপোসিন যুগ নামে অভিহিত করা হয়। ২০০০ সালে পল ক্রুটজেন ও ইউজিন স্টর্মার এ শব্দটি উদ্ভাবন করেন। মূলত অধুনা অ্যানথ্রোপোসিন যুগে মানুষ তার ভোগ-বিলাস এবং সীমাহীন লোভ-লালসার কারণে জলবায়ু পরিবর্তনসহ পৃথিবীর ভূতত্ত্ব এবং বাস্তুতন্ত্রের ওপর প্রভাব বিস্তার শুরু করে এবং অবাধ দূষণের মাধ্যমে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে চলছে। 

আরেক দিকে, লাট্যুর তার বিশ্লেষণে প্রকৃতি, পরিবেশগত রাজনীতি এবং অ্যানথ্রোপোসিনের একটি নতুন ধারণার বিশ্লেষণ দেন। এখানে লাট্যুর নানা বিষয়কে সংযুক্ত করেন এবং তিনি ভূগোলবিদ, সমাজবিজ্ঞানী, নৃতাত্ত্বিক এবং রাজনৈতিক দার্শনিকদের মতামত ও জ্ঞানের সম্মিলনকে ব্যাখ্যা করেন। এখান থেকে তিনি পরিবেশগত সমস্যাগুলো মোকাবেলার উপায় হিসেবে রাজনৈতিকভাবে সংগঠিত করা এবং সেখানে কূটনীতিকে সংযুক্ত করার বিষয়ে বিমূর্ত ধারণা বিশ্লেষণ করেন। লাট্যুরের লক্ষ্য ছিল রাজনৈতিক বাস্তুসংস্থানের নতুন রূপের বিকাশ ঘটানো, যেখানে বিজ্ঞানের প্রয়োজনীয় বিকাশের প্রয়োজনীয়তাকে অনুধাবন করা হবে। ভূগোলবিদ এবং অন্যান্য শাখার সামাজিক বিজ্ঞানীরা লাট্যুরের প্রাণী এবং বন্যপ্রাণী, প্রকৃতি সংরক্ষণ এবং জীববৈচিত্র্য, জিনগতভাবে পরিবর্তিত জীব এবং জলবায়ু পরিবর্তন নীতির বহুপ্রাকৃতিক পদ্ধতির যে বর্ণনা করেন সেটিকে গ্রহণ করেন। 

রাজনৈতিক চরিত্রের সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণে সিদ্ধান্ত গ্রহণের একটা সম্পর্ক দেখা যায়। এর ব্যতিক্রমও হতে পারে। যেমনটা আমরা দেখলাম সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন ভেঙে গেল এবং এর পরবর্তী সময়ে যে রাজনৈতিক চেতনার উদ্ভব হলো সেখানে পরিবেশ গৌণ এবং অর্থ এবং উন্নয়নই মুখ্য হয়ে দাঁড়াল। তবে সমাজতন্ত্রের বাইরেও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থায় পরিবেশ বিষয়টি আরো বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। দেখা গেছে, গণতান্ত্রিক দেশগুলোয় যেখানে জনগণের মতামতের গুরুত্ব রয়েছে, জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের নিশ্চয়তা রয়েছে এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রয়েছে সেখানে পরিবেশ সংরক্ষণের গুরুত্ব বেশি। অন্যদিকে যেখানে নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ কিংবা একনায়কতন্ত্রের প্রভাব বেশি সেখানে রাজনীতিতে পরিবেশের অবস্থান তলানিতে। 

তবে অধুনা বিশ্ব পরিমণ্ডলে রাজনৈতিক সম্প্রদায় যে উদারনীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠছে তা বস্তুত একদিকে ব্যক্তিগত স্বাধীনতা এবং পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে অগ্রাধিকার দেয়। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো বিষয়ে প্রতিক্রিয়া প্রদান ও ব্যবস্থা গ্রহণকে নিরুৎসাহিত করে। স্বার্থান্ধ গোষ্ঠী ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে এবং নিজ স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়, সেখানে বাস্তুতন্ত্র নিয়ে চিন্তা-চেতনা অনেকটাই অনুপস্থিত। এখানে লভ্যাংশ ভোগে ব্যস্ত গোষ্ঠী উদারতাবাদের মোড়কে স্বার্থবাদী মানবিক অগ্রাধিকার দিয়ে পরিচালিত হয়।

মূল কথা হলো, উদার গণতন্ত্রের নাগরিকরা যখন পরিবেশগত সমস্যাগুলো তাদের জীবনকে প্রভাবিত করে বলে মনে করে না বা যখন সমস্যার গুরুত্ব মূল্যায়ন করার জন্য তাদের শিক্ষার অভাব হয় তখন পরিবেশগত সংকটগুলো মোকাবেলা করা বাধাগ্রস্ত হতে পারে। তাই রাজনৈতিক চর্চার সঙ্গে পরিবেশ-প্রতিবেশকে যতক্ষণ গুরুত্বের শীর্ষে না রাখা যাবে ততক্ষণ পর্যন্ত ভোগবাদই সব কিছুকে ভোগ করবে এবং বিশ্বকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলবে। 

বিশ্ব প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে হয়তো একটি সর্বজনীন করণীয় নির্ধারণ করা সম্ভব হবে। পরবর্তী আলোচনায় দ্রুত উন্নয়নের পথে চলমান দেশ, তাদের রাজনৈতিক দর্শন এবং দেশ পরিচালনার মূলনীতিতে পরিবেশের অবস্থান পর্যালোচনা করা যাবে। তবে এর আগে প্রয়োজন মন এবং মননে গেঁথে নিতে হবে যে পরিবেশ-প্রতিবেশকে যেকোনো পরিকল্পনা কিংবা সিদ্ধান্তে প্রথম গুরুত্ব দিতে হবে, না হয় সব শেষ হবে আমাদের অস্তিত্ব বিনাশের মাধ্যমে।

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও