বঙ্গবন্ধু ছিলেন মওলানা ভাসানীর প্রথম পছন্দ

উভয়ের অসম বয়সের কারণে বন্ধুত্ব হওয়ার সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক থেকে সম্পর্কটি ছিল শ্রদ্ধার। আর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দিক থেকে তা ছিল স্নেহের। উভয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল তাদের মাধ্যমেই গঠিত হয়েছিল। সে দলটিই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাণ্ডারি। যদিও পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানীর

উভয়ের অসম বয়সের কারণে বন্ধুত্ব হওয়ার সুযোগ ছিল না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দিক থেকে সম্পর্কটি ছিল শ্রদ্ধার। আর মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর দিক থেকে তা ছিল স্নেহের। উভয়ে দীর্ঘদিন একসঙ্গে রাজনীতি করেছেন। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দল তাদের মাধ্যমেই গঠিত হয়েছিল। সে দলটিই হয়ে ওঠে বাংলাদেশের স্বাধীনতার কাণ্ডারি। যদিও পরবর্তী সময়ে মওলানা ভাসানীর রাজনৈতিক গতিপথ পরিবর্তিত হয়েছিল। কিন্তু সবসময় তিনি প্রগতিশীলতা ও ন্যায়নীতির পক্ষেই কথা বলেছিলেন।

বলা বাহুল্য, ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে এক কর্মী সম্মেলনে আত্মপ্রকাশ করা আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। বঙ্গবন্ধু হন যুগ্ম সম্পাদক। তারপর ইতিহাস পরিক্রমায় দীর্ঘকাল মওলানা ভাসানী সভাপতি ও বঙ্গবন্ধু সাধারণ সম্পাদক হিসেবে আপামর বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতীক সংগঠনটিকে একটি শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড় করিয়েছিলেন। পৌঁছে দিয়েছিলেন সাধারণ মানুষের দোরগোড়ায়। ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু উভয়েই দীর্ঘ রাজনৈতিক আন্দোলন-সংগ্রামের ভেতর দিয়ে নেতৃত্বের জায়গায় উঠে এসেছিলেন। উভয়েই ছিলেন সত্যিকার অর্থে গণমানুষের নেতা। জনগণের চাহিদা তারা সহজেই বুঝতে পারতেন। মানুষও তাদের আপন করে নিতে দ্বিধা করেনি। ব্যাপক প্রতিশ্রুতি ও দায়বদ্ধতা নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের যাত্রা হলেও ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের প্রতি অচিরেই জনসাধারণের মোহভঙ্গ ঘটে। মুসলিম লীগ তখন কয়েকজন অভিজাত রাজনীতিবিদের পকেট সংগঠনে পরিণত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একনিষ্ঠ ও ত্যাগী কর্মীরা সংগঠনে ব্রাত্য হয়ে পড়েন। এমন পরিস্থিতিতে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করেন তারা। যে দল প্রকৃত অর্থে গণমানসের প্রতিফলন ঘটাবে। ফলস্বরূপ গঠিত হলো আওয়ামী লীগ। কিন্তু কেবল দল গঠন করলেই তো হবে না। তার জন্য প্রয়োজন সুষ্ঠু পরিচালনা ও যথাযথ নেতৃত্ব। সে গুরুদায়িত্ব পালনে অন্যতম ভূমিকা রেখেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। তাদের ভূমিকার কথা স্মরণ করে এম আর আখতার মুকুল তার ‘ভাসানী-মুজিবের রাজনীতি’ বইয়ে লিখেছেন, ‘নানা রকমের বাধা-বিপত্তি আর শত অত্যাচার সত্ত্বেও মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব অত্যন্ত অল্প সময়ের মধ্যেই পূর্ব বাংলার প্রতিটি জেলায় বিরাট কর্মী-বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। তাঁরা কর্মীদের বুঝালেন কিভাবে পূর্ব বাংলা অত্যন্ত দ্রুত পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশ হতে চলেছে। ... মওলানা ভাসানী প্রতিটি ব্যাপারেই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলেন। ভাসানী-মুজিব উল্কার মতো বাংলার পথেপ্রান্তরে ঘুরে বেড়ালেন। তৎকালীন বাংলাদেশে নতুন যুগের সূচনা হলো।’ এম আর আখতার মুকুলের এ লেখায় রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দায়িত্ব পালনে উভয়ের নিষ্ঠা, ত্যাগ ও একনিষ্ঠ ভূমিকার রূপ সুস্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে ‘ভাসানীচরিত’ বইয়ে প্রয়াত লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ মওলানা ভাসানীর বরাত দিয়ে লেখেন, ‘মওলানা বলেছেন, সারা দিনে দুই আনার মুড়ি খেয়ে মুজিবুর আর আমি ঘুরেছি সারা দেশ। আওয়ামী লীগকে গ্রামগঞ্জে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে গেছি। মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনের ফিরিস্তি মানুষকে বলেছি। মানুষ নতুন দলের উপর আস্থা স্থাপন করেছে।’ ইতিহাস-সচেতন পাঠক একমত হবেন যে মওলানা ভাসানীর এ কথায় কোনো বাহুল্য নেই। বস্তুত দেশ ও রাজনীতির সে ক্রান্তিলগ্নে একটি নির্দিষ্ট সময় সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে এ দুজনই ছিলেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রাণপুরুষ। উভয়ের সাংগঠনিক সম্পর্কের ওপর আলোকপাত করে সৈয়দ আবুল মকসুদ ‘ভাসানীচরিত’ বইয়ে লিখেছেন, ‘প্রথম দিকে বছর দুই সাধারণ সম্পাদক হিসেবে শামসুল হক ভাসানীর সফরসঙ্গী হয়েছেন, কিন্তু একসময় তাঁর মনোজগতে পরিবর্তন ঘটে। ধর্মকর্ম নিয়ে অত্যধিক ব্যস্ত থাকতেন। মওলানা নিজে ছিলেন ধর্মীয় নেতা, কিন্তু নিষ্ঠার সঙ্গে ধর্ম পালন তাঁর রাজনীতিতে কোনো ব্যাঘাত সৃষ্টি করত না। শামসুল হক দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ পড়তেন। জায়নামাজে সেজদায় পড়ে থাকতেন। একসময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তাঁকে চিকিৎসা নিতে হয়। রাজনীতি থেকেই হারিয়ে যান। শেখ মুজিব প্রথমে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক এবং ১৯৫৩ থেকে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পান। মুজিব সম্পর্কে ভাসানীর মূল্যায়ন, “আমার জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সেক্রেটারি”।’ সৈয়দ আবুল মকসুদের এ লেখায় যুগপৎ দুটি বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। এক. ধর্মনিষ্ঠা মওলানার রাজনীতিতে প্রতিবন্ধকতা হতে পারেনি। দুই. মওলানা ভাসানীর মতো প্রাজ্ঞ রাজনীতিবিদের মুখ থেকে বঙ্গবন্ধু-সংক্রান্ত এ মূল্যায়ন বঙ্গবন্ধুর সাংগঠনিক দক্ষতার এক অনন্য স্বীকৃতি। সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে মওলানা ভাসানী এতটাই যোগ্য মনে করতেন যে এ পদে তিনি অন্য কারো কথা ভাবতেই পারতেন না। তিনি বরং নিজের সভাপতির পদটি নিয়ে আপস করতে রাজি ছিলেন। কিন্তু সাধারণ সম্পাদক পদে বঙ্গবন্ধুই ছিলেন তার একমাত্র পছন্দ। বঙ্গবন্ধুর প্রতি মওলানা ভাসানীর এমন মনোভাবের প্রমাণ পাওয়া যায় ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র একটি অংশে। ২৩৭ থেকে ২৩৯ পৃষ্ঠায় বঙ্গবন্ধু লিখেছেন, ‘কাউন্সিল সভার দিন যতই ঘনিয়ে আসছিল আওয়ামী লীগের কয়েকজন প্রবীণ নেতা এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলেন, যাতে আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি না করা হয়। ... মওলানা সাহেব আমাকে জেনারেল সেক্রেটারি করার পক্ষপাতী। তাঁকেও আমি বলেছিলাম, আমি ছাড়া অন্য কাউকে ঠিক করতে, তিনি রাজি হলেন না এবং বললেন, “তোমাকেই হতে হবে।” ... ১৯৫০ সালে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ফলে জনাব আবুল হাশিম পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে পূর্ব বাংলায় চলে আসেন। তাঁর অনেক সহকর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেছেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের পর তাঁকে গ্রেফতারও করা হয়। এই সময় জেলে তিনি অনেক আওয়ামী লীগ নেতা ও কর্মীদের সাথে প্রতিষ্ঠান সম্বন্ধে আলোচনা করতে সুযোগ পান। আমার বিরোধী গ্রুপ অনেক চেষ্টা করেও কোনো প্রার্থী দাঁড় করাতে পারছিলেন না। কেউই সাহস পাচ্ছিল না, আমার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে। কারণ তাঁরা জানেন, কাউন্সিলররা আমাকেই ভোট দিবে। ভদ্রলোকেরা তাই নতুন পন্থা অবলম্বন করলেন। তাঁরা আবুল হাশিম সাহেবের কাছে ধরনা দিলেন এবং তাঁকে আওয়ামী লীগে যোগদান করতে ও সাধারণ সম্পাদক হতে অনুরোধ করলেন। হাশিম সাহেব রাজি হলেন এবং বললেন, তাঁর কোনো আপত্তি নাই তবে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হতে হবে। তিনি মওলানা ভাসানী সাহেবকে খাবার দাওয়াত করলেন। তাঁকে যে কয়েকজন আওয়ামী লীগ নেতা এ ব্যাপারে অনুরোধ করেছেন তাও বললেন এবং মওলানা সাহেবের মতামত জানতে চাইলেন। মওলানা সাহেব তাঁকে বললেন, “সাধারণ সম্পাদক বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় করা যাবে কি না সন্দেহ, কারণ মুজিবের আপনার সম্বন্ধে খুব খারাপ ধারণা। তবে যদি সভাপতি হতে চান, আমি ছেড়ে দিতে রাজি আছি।” মওলানা সাহেব এ কথা আমাকে বলেছিলেন।’ বঙ্গবন্ধুর প্রতি মওলানা ভাসানীর এমন অগাধ আস্থা ছিল যে তিনি আবুল হাশিমের মতো বর্ষীয়ান ও সর্বজনশ্রদ্ধেয় রাজনীতিবিদকেও ফিরিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হননি। 

১৯৫৭ সালের জুলাইয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর রাজনীতি ভিন্নধারায় প্রবাহিত হয়। ‘ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন মওলানা ভাসানী। তবে উভয়ের ব্যক্তিগত সম্পর্কের জায়গাটি সবসময়েই অটুট ছিল। তার একটি দৃষ্টান্ত মেলে ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের সময়। ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ প্রত্যাহার নিয়ে মওলানা ভাসানী সরব ভূমিকা পালন করেছিলেন। সৈয়দ আবুল মকসুদ তার ‘ভাসানীচরিত’ বইয়ে এ প্রসঙ্গে লেখেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে এই ঘৃণ্য মামলা প্রত্যাহারের জন্য মওলানা ভাসানী দাবি জানিয়ে আসছিলেন, তাতে কাজ না হওয়ায় শুরু করেন জ্বালাও-পোড়াও আন্দোলন। নীতিগত বিরোধ থাকা সত্ত্বেও পুত্রতুল্য মুজিবের জন্য ব্যক্তিগত প্রভাবও ব্যবহার করছিলেন ভাসানী। ক্যান্টনমেন্ট কারাগার থেকেই শেখ মুজিব সাংবাদিকদের মাধ্যমে ভাসানীর সঙ্গে যোগাযোগ করেন। যাহোক, ২২ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব ছাড়া পান এবং দেশের মানুষ এক শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে অব্যাহতি পায়। ... মুক্তি পেয়ে ওই দিনই রাতে শেখ মুজিব ভাসানীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং দীর্ঘ সময় তাঁদের মধ্যে আলোচনা হয়। রাজনৈতিক মতপার্থক্য ভুলে গিয়ে সেদিন প্রিয় সন্তানের মতো মুজিবকে জড়িয়ে ধরে ভাসানী কেঁদে ফেললেন। সে ছিল এক স্মরণীয় দৃশ্য।’ 

দেশ যখন স্বাধীন হয়, মওলানা ভাসানী তখন ভারতে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর বিশেষ আগ্রহে তার স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের ১২ দিন পর দেশে ফিরে আসেন মওলানা ভাসানী। 

স্বাধীন বাংলাদেশে মওলানা ভাসানীর করা প্রথম সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, তার বিরুদ্ধে অপপ্রচারে বঙ্গবন্ধুর সায় আছে কিনা। তখন মওলানা ভাসানী যা বলেছিলেন, তা থেকে প্রতীয়মান হয় যে বঙ্গবন্ধুর প্রতি তার স্নেহ ও ভালোবাসায় তখনো এতটুকু ভাটা পড়েনি। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সেই ঐতিহাসিক উক্তির উল্লেখ করে এ নাতিদীর্ঘ লেখার ইতি টানছি—‘মুজিব আমার সঙ্গে কখনো বেয়াদবি করেনি। তবে তাঁর রাজনীতি ভিন্ন, আমার রাজনীতি ভিন্ন। আমি তাঁকে আমার ছেলের মতো ভালোবাসি। সে বড় হয়েছে। আরও বড় হোক দোয়া করি। আমার বিরুদ্ধে এ মিথ্যাচার করতে মুজিব উসকানি দিয়েছে বলে আমি বিশ্বাস করি না।’

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও