আরো বেড়েছে ডিমের দাম

বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ডিমের দাম কমানো হোক

দীর্ঘদিন ধরেই ডিমের বাজারদর ঊর্ধ্বমুখী। স্বস্তি নেই মাংস-সবজি ও চালের বাজারেও। দাম নিয়ন্ত্রণে সরকার এরই মধ্যে কতিপয় পণ্যের, বিশেষ করে ডিম ও মুরগির মূল্যও বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু দাম বেঁধে দিয়ে যে বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করা যায় না সে দৃষ্টান্ত বিদায়ী সরকার রেখে গেছে। এমনকি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বাজারে নামিয়ে অভিযান চালিয়েও বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। বাজার সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে না পারলে দাম কমানো একটা প্রহসন মাত্র। এছাড়া এ অবস্থায় ডিমসহ অন্য নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে সরকারের বাজার ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। এর জন্য তদারকিসহ প্রয়োজনীয় সব উদ্যোগ নিতে হবে।

বণিক বার্তার প্রতিবেদন জানাচ্ছে, বাজার নিয়ন্ত্রণে সপ্তাহ দুয়েক আগে ফার্মের মুরগির ডিম এবং ব্রয়লার ও সোনালি মুরগির দাম নির্ধারণ করে দেয় সরকার। সে অনুযায়ী প্রতি ডজন ডিম ১৪২ টাকায় বিক্রি করার কথা থাকলেও বিক্রি হচ্ছে ১৭৫-১৮০ টাকায়। ডিমসহ মাংস-সবজি ও চাল বিক্রির ক্ষেত্রে ক্রেতাদের গুনতে হয়েছে বাড়তি দাম।

বাংলাদেশ পোলট্রি অ্যাসোসিয়েশনের (বিপিএ) প্রকাশিত সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, বাজারে প্রতিটি ডিমে ২ টাকা করে বেশি নেয়া হচ্ছে। ফলে প্রতিদিন ৪ কোটি ডিমে ৮ কোটি টাকা বেশি লাভ করা হচ্ছে। এভাবে গত ২০ দিনে ১৬০ কোটি টাকা ভোক্তার পকেট থেকে হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ উঠেছে। সরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশের (টিসিবি) প্রতিবেদনও বলছে, খুচরা বাজারে অনেকটাই বেশি দামে কিনতে হচ্ছে ডিম। টিসিবির তথ্যানুসারে, গত এক বছরে ডিমের দাম ১৩ শতাংশের বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতো, বাজার সিন্ডিকেটের কারণেই ডিমের দাম নাগালে আসছে না। এদিকে ব্যবসায়ীদের দাবি, মূল্য নির্ধারণ সরকারের একতরফা প্রক্রিয়া। সরকার যখন কোনো ভোগ্যপণ্যের মূল্য নির্ধারণ করে দেয় তখন কোনো ব্যবসায়ীর সঙ্গে আলোচনা করে না। সে কারণেই সরকারের বাজারবিষয়ক কোনো সিদ্ধান্ত সফলতার মুখ দেখেনি। বাজার নিয়ন্ত্রণে তাই পাইকার ও উৎপাদকদের নীতিমালার অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। পাশাপাশি তদারকি বাড়াতে হবে।

বিপিএর ওই প্রতিবেদনে মুরগির বাচ্চার দাম বাড়ানো নিয়েও অভিযোগ প্রকাশ করা হয়। সংগঠনটির মতে, প্রতিটি মুরগির বাচ্চার গত ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত দাম ছিল ৩০-৩৫ টাকা, যা পরদিন থেকে হয়ে যায় ৪০-৫৬ টাকা। প্রতিদিন সব ধরনের ৩০ লাখ মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হয়। সে হিসাবে প্রতি বাচ্চায় যদি ২০ টাকা বাড়তি দাম রাখা হয়, তাহলে প্রতিদিন ৬ কোটি টাকা বেশি আয় হয়। অর্থাৎ ২০ দিনে প্রান্তিক খামারিদের সঙ্গে প্রতারণা করে ১২০ কোটি টাকা অতিরিক্ত মুনাফা করা হয়েছে। ডিম আর মুরগির বাচ্চা সব মিলিয়ে ২৮০ কোটি টাকা লুট করা হয়েছে গত ২০ দিনে।

সাধারণভাবেই প্রান্তিক খামারিরা ডিম ও মুরগি উৎপাদন করলেও দাম নির্ধারণী পর্যায়ে তাদের হাত থাকে না। বিশেষত ডিমের দাম নির্ধারণ করা হয় সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ী গ্রুপ ও করপোরেট প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। বিপিএরও অভিযোগ, দাম নির্ধারণসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান ও অ্যাসোসিয়েশনগুলোর সিন্ডিকেট শক্তিশালী হওয়ার কারণে ডিমের বাজার স্থিতিশীল করা যাচ্ছে না।

তবে করপোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো এসব অভিযোগ নাকচ করে দিয়েছে। তাদের মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে বন্যা হওয়ায় ডিমের সরবরাহ কমে গেছে। সে কারণেই বেড়েছে ডিমের দাম।

গত আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে দেশের পূর্বাঞ্চল ভয়াবহ বন্যার কবলে পড়ে। এতে ১১ জেলা প্লাবিত হয়। তলিয়ে যায় ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা ও লক্ষ্মীপুরের কয়েক হাজার মুরগির খামার। মারা গেছে লাখ লাখ মুরগি। বিপিএর তথ্যমতে, এ চার জেলায় আগে যেখানে গড়ে প্রতিদিন ডিমের উৎপাদন ছিল প্রায় ৪০ লাখ পিস। এখন তা অর্ধেকে নেমে এসেছে। বন্যাকবলিত অন্য জেলায় কমেছে আরো দেড়-দুই লাখ পিস ডিম উৎপাদন। বাজারে এর বড় ধরনের প্রভাব পড়েছিল। এক সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে মুরগির দাম বেড়েছিল ১০ টাকা পর্যন্ত। সে সময় থেকে অনেক স্থানে ডিমের দামও বাড়তে শুরু করে।

সাধারণ মানুষের আমিষের চাহিদা পূরণের বড় উৎস ডিম ও মুরগির মাংস। দেশে প্রতিদিন ডিমের গড় চাহিদা চার থেকে সাড়ে চার কোটি পিস এবং মুরগির মাংসের চাহিদা ৫ হাজার ২০০ টন। বন্যাদুর্গতসহ সর্বসাধারণের আমিষের চাহিদা পূরণে ও ডিমের দাম নাগালের মধ্যে রাখতে প্রয়োজন পর্যাপ্ত মজুদ। এর জন্য সরবরাহ ঘাটতি দূর করা জরুরি হয়ে পড়ে। এ পরিস্থিতিতে আলু, পেঁয়াজ ও ডিম আমদানির শুল্ক কমানোর বিষয়ে গত ২৯ আগস্ট জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে চিঠি পাঠায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন (বিটিটিসি)। এর পরিপ্রেক্ষিতে ডিম ও আলু বর্তমানে শর্ত সাপেক্ষে আমদানির অনুমতি দেয়া হয়। এর পরও আমদানি না করে ডিমের সরবারহ বিঘ্ন ও ঘাটতির অজুহাত দেখিয়ে ডিমের দাম বাড়ানো কোনোভাবেই কাম্য নয়।

তাছাড়া দেশে ডিম মজুদের ঘটনাও দেখা গেছে। গত মে মাসে এক সপ্তাহের ব্যবধানে ডিমের দাম ডজনপ্রতি ২৫-৩০ টাকা বৃদ্ধি পায়। সে সময় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর অভিযান চালিয়ে ডিম মজুদ করার দুটি বড় চালান পায়। এমন অভিযান বর্তমানে আরো চালানো উচিত। এতে হয়তো ডিমের অবৈধ মজুদ খুঁজে পাওয়া যাবে।

ডিমের দাম বাড়তির পেছনে ডিম উৎপাদন ব্যয়বহুল বলেও অভিযোগ রয়েছে। ডিমের উৎপাদন ব্যয় যেখানে প্রতিবেশী দেশ ভারতে ৫ টাকা, দেশে তা প্রায় সাড়ে ১০ টাকা। মুরগির বাচ্চা, মেডিসিন, ফিডসহ যাবতীয় বিষয়ে সিন্ডিকেট করে কয়েক গুণ বেশি দাম আদায় করা হয়। এর প্রভাব পড়ে ডিমের বাজারদরে।

মুক্তবাজার অর্থনীতিতে দাম বেঁধে বাজার নিয়ন্ত্রণ করা বেশ কঠিন। বাজারে শৃঙ্খলা এক্ষেত্রে জরুরি। শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত না হলে সিন্ডিকেট, অসাধু ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য বন্ধ করা যাবে না। বারবার নিত্যপণ্যের বাজার অস্থিতিশীল হয়ে পড়বে। আর বাড়তি দাম মেটাতে গিয়ে অর্থকষ্টে দিনাতিপাত করবে নিম্ন আয়ের মানুষ, যা কখনই কাম্য নয়। সরকারের এ বিষয়ে মনোযোগী হতে হবে।

আরও