প্রযুক্তির ব্যবহার মাছের অর্থনীতিকে বড় করতে পারে

সম্প্রতি প্রযুক্তিগত গবেষণার ফলে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য দেখা দিয়েছে। যে কারণে সবার জন্য ভবিষ্যতে চাষের মাছ সহজলভ্য হবে—এ কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে।

সম্প্রতি প্রযুক্তিগত গবেষণার ফলে মাছ চাষে ব্যাপক সাফল্য দেখা দিয়েছে। যে কারণে সবার জন্য ভবিষ্যতে চাষের মাছ সহজলভ্য হবে—এ কথা জোর দিয়ে বলা যাচ্ছে। 

সাম্প্রতিক পরিসংখ্যান বলছে, মাছ চাষে দেড় দশকে ১৫০ শতাংশেরও বেশি উৎপাদন বেড়েছে। অ্যাকুয়াকালচার বা চাষের মাধ্যমে মাছ উৎপাদনে বাংলাদেশের অবস্থান এখন বিশ্বে পঞ্চম। এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকলে ভবিষ্যতে সুলভে চাষের মাছ মিলবে। এমনকি বাংলাদেশ বিশ্বে মাছ উৎপাদনে প্রথম স্থান অধিকার করার সক্ষমতা রাখে, মৎস্যবিজ্ঞানীদের এ কথাটিও বাস্তব হওয়ার সম্ভাবনা দেখা ‍দিয়েছে। মূলত দেশী মাছের চাষোপযোগী উন্নত জাত উদ্ভাবনের মাধ্যমে মাছ উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর পুরো কৃতিত্ব দেশের বিজ্ঞানীদের। বিশ্ব খাদ্য সংস্থা (এফএও) এবং ইন্টারন্যাশনাল ফুড পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (ইফপ্রি) একাধিক প্রতিবেদনেও দেশে পুকুরে মাছ চাষে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের তথ্যটি উঠে এসেছে।

স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন পর্যবেক্ষক সংস্থার ভাষ্যমতে, কয়েক বছরের মধ্যেই দেশে আমিষের সবচেয়ে সুলভ উৎস হয়ে উঠতে যাচ্ছে মাছ। বিশেষ করে অ্যাকুয়াকালচারে ব্যাপক অগ্রগতির ধারাবাহিকতায় মাছের উৎপাদন ও জোগান চাহিদাকে ছাড়িয়ে যাবে। মূল্যস্ফীতির কারণে বাজারে অন্যান্য পণ্যের দাম বাড়লেও মাছের ওপর এর প্রভাব সামান্য থাকবে। বরং চাষের মাছ এখনকার চেয়েও সুলভে পাওয়া যাবে। দেশের চাহিদা পূরণ করে তখন মাছ রফতানিও সম্ভব হবে।

তবে মাছ চাষের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কিছু নিয়মকানুন মেনে চলতে হবে। তাহলে মাছ চাষের পাশাপাশি এর সংরক্ষণযোগ্যতাও নিশ্চিত হবে। চাষের আগে চাষযোগ্য স্থানের পানির মান, জৈবিক, রাসায়নিক এবং জীবতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট্য যাচাই করা প্রয়োজন। এজন্য প্রজননের সময়টায় সঠিকভাবে লালন-পালন করতে হবে। এছাড়া মাছের পোনা সময়মতো অবমুক্ত করা হলে অনেক কম জায়গায় বেশি মাছ পাওয়া যায়। এ পদ্ধতিতে উন্নত প্রজাতির মাছও মিলবে এবং কম খরচে মাছ উৎপাদন করা যাবে। এজন্য মাছের পোনার সরবরাহ স্বাভাবিক থাকতে হবে। বর্তমানে পাঙাশ, তেলাপিয়া, নাইলোটিকা, রুই, সিলভার কার্প, মৃগেল, কাতলা, শিং, মাগুর চাষে অভূতপূর্ব ফলাফল পাওয়া যাচ্ছে। 

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) ‘দ্য স্টেট অব ওয়ার্ল্ড ফিশারিজ অ্যান্ড অ্যাকুয়াকালচার ২০২২’ বৈশ্বিক প্রতিবেদন অনুযায়ী চাষের মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির দিক থেকে আফ্রিকায় মিসর এবং এশিয়ায় বাংলাদেশ ও ভিয়েতনাম উদাহরণ হয়ে উঠেছে। এ দেশগুলোর মানুষের প্রাণিজ আমিষের চাহিদার ৫০ শতাংশের বেশি মাছ থেকে পূরণ হচ্ছে।

থাইল্যান্ড মাছ চাষের ক্ষেত্রে ঈর্ষণীয় সাফল্য লাভ করেছে, যে কারণে থাইল্যান্ডের মাছের কোয়ালিটি অনেক ভালো। পোল্যান্ডও মাছ চাষের ক্ষেত্রে অগ্রগতি অর্জন করেছে। পক্ষান্তরে মিয়ানমার একটা রিমোট কান্ট্রি হলেও তারা মাছ উৎপাদনে প্রযুক্তির যথেষ্ট ব্যবহার করে এবং তাদের মাছের মান বেশ ভালো ও অনেক কম খরচে মাছ উৎপাদন করতে পারে। এ কারণে মাছের বিশ্ববাজারে মিয়ানমারের একটা ভালো জায়গা হয়ে গেছে।

আমাদের দেশের পরিপ্রেক্ষিতে দুঃখজনক হলেও সত্য, মাছের দেশেই মাছ আমদানি করতে হয়। মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের মতে, দেশে উৎপাদিত মাছ দিয়ে এখনো চাহিদা মিটছে না। সে কারণে প্রতি বছর মাছ আমদানি বাড়ছে। এ পরিস্থিতি পরিবর্তনের জন্য মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকেও পুকুরে দেশী মাছের চাষ বাড়াতে গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এজন্য মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটে দেশী মাছের জাত সংরক্ষণের মাধ্যমে সেগুলোকে পুকুরে চাষের উপযোগী করার ব্যবস্থাপনায় জোর দেয়া হয়। 

ইফপ্রির মতে, এখন পর্যন্ত মাছ চাষে বাংলাদেশের সম্ভাবনার পুরোটাকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়নি। সংস্থাটির ভাষ্যমতে, দেশের অর্ধেক পুকুর-জলাশয়ে নিবিড় ও বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে মাছ চাষ করা যায়। এর মাধ্যমে মাছের উৎপাদন এখনকার তুলনায় কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব। 

বাংলাদেশে প্রতিবেশী দেশগুলো থেকে মাছ আসে। মিয়ানমার থেকে মাছ আসার কারণ হলো দামে অনেক প্রতিযোগিতা হচ্ছে। ঠিক একইভাবে ভারতেও একই অবস্থান তৈরি হয়েছে, যে কারণে তারা মাছ উৎপাদনের সর্বাধুনিক কৌশল রপ্তের পর বাংলাদেশেও রফতানি করছে। বাংলাদেশকে যেন অদূরভবিষ্যতে মাছ আমদানি করতে না হয়, সেজন্য বর্তমানে চাষ মাছের ওপর জোর দেয়ার কোনো বিকল্প নেই। এক্ষেত্রে মাছ চাষে ২০৩০ সালের মধ্যে ৭০ শতাংশের বেশি উৎপাদন বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে। তবে পুকুর-জলাশয় কমে যাচ্ছে, মানুষের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এ সীমাবদ্ধতাকে আমলে নিয়েই মাছের উৎপাদন বাড়াতে হবে। সর্বোপরি মাছের আমদানি বন্ধ হলে দেশের চাষীরা লাভবান হবেন।

এক্ষেত্রে মৎস্যবিজ্ঞানীদের মতে, মাছ চাষের প্রসপেকটিভে কিছু নির্দিষ্ট কৌশল অর্জন করতে হবে। গ্রামের বাড়ির আশপাশে যে ছোট ছোট চৌবাচ্চা বা পুকুর আছে, সেখানে মাছের পোনা ছেড়ে দেয়া যেতে পারে। তারপর সেখানে প্রোটিন ফিড দিতে হবে। এর ফলে পানির যে ফ্লো আছে, তাতে মাছ অক্সিজেন পাবে এবং উন্নত মানের খাবার পাবে। এতে মাছগুলোর গ্রোথ অনেক বেশি হবে, স্বাদও ভালো হবে এবং বেশ মানসম্পন্ন মাছ উৎপাদন হবে। এতে লাভও হবে অনেক।

বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের সূত্রমতে, দেশের বিজ্ঞানীরা এ পর্যন্ত রুই, কাতলা, কৈ, তেলাপিয়া, কালিবাউশ ও সরপুঁটির উন্নত জাত উদ্ভাবন করেছেন। দেশের পুকুরে যত মাছ চাষ হচ্ছে, তার অর্ধেকের বেশি এসব জাতের। তারা দেশের বিলুপ্তপ্রায় ২২ প্রজাতির মাছের চাষ পদ্ধতিও উদ্ভাবন করেছেন। সে তালিকায় টেংরা, পাবদা ও মলার মতো পুষ্টিকর মাছ রয়েছে। ইফপ্রির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের ৫৬ শতাংশ মাছ পুকুর থেকে আসছে। পুকুরে মাছ চাষের কারণে গত তিন দশকে উৎপাদন প্রায় ছয় গুণ বেড়েছে। ১৯৯০ সালে মানুষ বছরে মাথাপিছু সাড়ে সাত কেজি মাছ খেত। এখন সেটা ৩০ কেজিতে পৌঁছেছে। মাছ চাষ ও ব্যবসায় বর্তমানে প্রায় দুই কোটি মানুষ সম্পৃক্ত আছে। 

মাছ চাষের ফলে চাষীরা লাভবান হওয়ার পাশাপাশি বাজারে মাছ সরবরাহ স্বাভাবিক থাকবে। বাজারে সরবরাহ প্রচুর থাকলে মাছের দামও সহনীয় হবে, বিক্রি বেশি হলে মাছ পচে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমবে। এছাড়া দেশীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে বর্তমানে মাছ সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা যায়। মোট কথা, মাছ উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য আধুনিক বিশ্বের প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলতে হবে। এজন্য মাছ চাষে সফলতা ধরে রাখতে হবে। তাতে মাছ চাষী, ব্যবসায়ী, ভোক্তা সব পক্ষই লাভবান হবে।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও