জ্বালানি ভাবনা

বিদ্যুৎ খাতে কৃষক কেন লুণ্ঠনের শিকার?

২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবরে এক উপানুষ্ঠানিক পত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টাকে বলেছেন, ‘‌পশুপালন ও মৎস্য চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে।

কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) কর্তৃক গঠিত ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটি, ক্যাবের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটি বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেশন কমিশন (বিইআরসি) আইন অনুযায়ী গ্রাহক ক্যাটাগরি ভেদে নির্ধারিত বিদ্যুৎ মূল্যহারের পরিবর্তে সেচ/কৃষি ক্যাটাগরি গ্রাহকের কাছ থেকে শিল্পের রেটে বিদ্যুৎ বিল আদায় করছে। অর্থাৎ কৃষকের কাছ থেকে এখতিয়ার-বহির্ভূতভাবে শিল্পের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করছে।

ঝিনাইদহ পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির (পিবিএস) আওতাভুক্ত কতিপয় সেচ গ্রাহকের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে কমিটি বিষয়টি আমলে নেয় এবং অনুসন্ধানে দেখতে পায়, দেশব্যাপী বিশেষ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) আওতাধীন সেচ/কৃষি গ্রাহকদের কাছ থেকে নিম্নবর্ণিত সেচ নীতিমালা অনুযায়ী শিল্প ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করা হয়:

‘‌সেচ নীতিমালা ৩.৪(ট) অনুযায়ী সেচ ক্যাটাগরির পাশাপাশি অন্য ক্যাটাগরি বা মিশ্র ক্যাটাগরিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করা হলে, সে গ্রাহকের কাছ থেকে সেচের জন্য প্রযোজ্য মূল্যহারে বিল করার পরিবর্তে ব্যবহৃত ক্যাটাগরি পরিবর্তনকরত ব্যবহৃত ক্যাটাগরির মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাটাগরির জন্য প্রযোজ্য বিল করতে হবে।’

ওই নীতিমালা অনুযায়ী কোনো কৃষক ধান ও মাছ চাষে সেচের জন্য একত্রে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে তার কাছ থেকে সেচের পরিবর্তে শিল্পের জন্য প্রযোজ্য মূল্যহারে বিল আদায় করা হয়। বিষয়টি ঝিনাইদহ পিবিএস কর্তৃপক্ষ জনৈক সেচ গ্রাহককে ৫ মে ২০২৩ তারিখে প্রদত্তপত্রে নিশ্চিত করেছে।

পর্যালোচনায় দেখা যায়, ধানের অনুরূপ মাছও কৃষিপণ্য, শিল্পপণ্য নয়। ২৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৪ বাংলাদেশ গেজেটে বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত বিদ্যুতের মূল্যহার বৃদ্ধির আদেশে দেখা যায়, সেচ/কৃষি ক্যাটাগরির জন্য বিদ্যুতের মূল্যহার ৫ দশমিক ২৫ টাকা এবং ক্ষুদ্র শিল্প ক্যাটাগরির জন্য ১০ দশমিক ৭৬ টাকা। সুতরাং মিশ্র ক্যাটাগরি হিসাবে ধান ও মাছ চাষ (সেচ/কৃষি) ক্যাটাগরির জন্য মূল্যহার ৫ দশমিক ২৫ টাকার পরিবর্তে শিল্প ক্যাটাগরির জন্য প্রযোজ্য ১০ দশমিক ৭৬ টাকা মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল করা বেআইনি। অতএব সেচ/কৃষি ক্যাটাগরির জন্য প্রযোজ্য ৫ দশমিক ২৫ টাকা মূল্যহারে মিশ্র ধান ও মাছ ক্যাটাগরির জন্য বিদ্যুৎ বিল করা আইনি বিবেচনায় বাধ্যতামূলক। যেহেতু মাছচাষী কোনো আলাদা ক্যাটাগরির গ্রাহক নন, যেহেতু মাছ ধানের মতোই কৃষিপণ্য এবং যেহেতু মাছ কিংবা ধান আলাদা কোনো ক্যাটাগরি নয়, সেহেতু মিশ্র ধান ও মাছচাষী সেচ/কৃষি ক্যাটাগরি হিসেবে গণ্য হবে। তাই মাছ চাষের সেচে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল সেচ/কৃষির জন্য প্রযোজ্য মূল্যহারেই নির্ধারিত হবে। অর্থাৎ বিদ্যুৎ বিল এ ক্যাটাগরির জন্য প্রযোজ্য ৫ দশমিক ২৫ টাকা রেটেই হবে।

মূল্যহার ও গ্রাহক ক্যাটাগরি নির্ধারণ বা পরিবর্তন অবশ্যই বিআরসি আইন অনুযায়ী হবে, সেচ নীতিমালা অনুযায়ী নয়। তাই মিশ্র ধান ও মাছ চাষ ক্যাটাগরির বিদ্যুৎ গ্রাহকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যহার ৫ দশমিক ২৫ টাকার পরিবর্তে শিল্প ক্যাটাগরির জন্য প্রযোজ্য মূল্যহার ১০ দশমিক ৭৬ টাকা মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করা বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩-এর ৪২ ধারা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন ২০০৯-এর ৪০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ।

বর্তমানে সেচ/কৃষি ও শিল্প ক্যাটাগরির গ্রাহক কর্তৃক ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যহার যথাক্রমে ৫ দশমিক ২২ টাকা ও ১০ দশমিক ৭৬ টাকা। এ মূল্যহার ও গ্রাহক ক্যাটাগরি উভয়ই বিইআরসি আইন অনুযায়ী নির্ধারিত, সেচ নীতিমালা অনুযায়ী নয়। সেচ নীতিমালা অনুযায়ী বিদ্যুতের মূল্যহার ও গ্রাহক ক্যাটাগরি নির্ধারণ করার এখতিয়ার বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটি তথা বিইআরসির লাইসেন্সির নয়। ফলে বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটিগুলো তা করে বিইআরসি আইনের ৪২ ধারা ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইনের ৪০ ধারা অনুযায়ী শাস্তিযোগ্য অপরাধ করেছে।

সারে ভর্তুকি প্রত্যাহার করার ব্যাপারে আইএমএফের পরামর্শ ছিল। সে পরামর্শ উপেক্ষা করে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, খাদ্যনিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে সরকার কৃষিতে পর্যাপ্ত ভর্তুকি দেবে। অথচ ইউটিলিটি কর্তৃক মাছ ও ধান চাষের সেচে মিশ্রভাবে ব্যবহারিত বিদ্যুতের বিল ৫ দশমিক ২৫ টাকার পরিবর্তে ১০ দশমিক ৭৬ টাকা মূল্যহারে আদায় করা হচ্ছে, যা বেআইনি ও এখতিয়ার-বহির্ভূত এবং সরকারের খাদ্যনিরাপত্তা সংরক্ষণের লক্ষ্যে কৃষিতে ভর্তুকি প্রদানের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যহীন ও সাংঘর্ষিক।

অতঃপর ২০২৪ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন ও জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছে ক্যাব নিম্নরূপ আবেদন করে: (১) মিশ্র ধান ও মাছ (সেচ/কৃষি) ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য মূল্যহার ৫ দশমিক ২৫ টাকা বলবৎ করার জন্য নির্দেশ প্রদান, (২) উক্ত মিশ্র ক্যাটাগরির কাছ থেকে শিল্প ক্যাটাগরির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য ১০ দশমিক ৭৬ টাকা মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করায় প্রতিটি গ্রাহকের কাছ থেকে এ-যাবৎ বাড়তি যত টাকা আদায় করা হয়েছে, তত টাকা তাদের স্ব-স্ব বিদ্যুৎ বিলের সঙ্গে সমন্বয় করার নির্দেশ প্রদান এবং (৩) ধার্যকৃত মূল্যহার অপেক্ষা অধিক মূল্যহারে বিদ্যুৎ বিল আদায় করার অপরাধে বিদ্যুৎ বিতরণ ইউটিলিটির বিরুদ্ধে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন, ২০০৩-এর ৪২ ধারা এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯-এর ৪০ ধারা মতে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য যথাক্রমে কমিশনের চেয়ারম্যান এবং ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের কাছে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হয়।

কৃষকের কাছ থেকে লুণ্ঠনমূলক বিদ্যুৎ বিল আদায়সংক্রান্ত ক্যাবকর্তৃক ২০২৪ সালের ১৫ মে কমিশনের কাছে আনীত ভোক্তা অভিযোগের বিষয়ে ২০২৪ সালের ৭ জুলাই প্রাপ্ত আরইবির মতামত-সংক্রান্ত প্রতিবেদনের সূত্রে বিআরইবির নিম্নের বক্তব্য কমিশন ২০২৫ সালের ২৮ জুলাই এক পত্রে ক্যাবকে অবহিত করে:

‘‌জাতীয় শিল্পনীতি-২০২২ ও বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক অনুমোদিত ‘‘বিদ্যুতের মূল্যহার ও নিয়মাবলী’’র লোকে মৎস্য চাষকে কৃষিভিত্তিক শিল্প বিবেচনা করা হয়েছে। সে পরিপ্রেক্ষিতে কোনো গ্রাহক সেচ সংযোগ থেকে মাছ চাষে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে অর্থাৎ মিশ্র (ধান ও মাছ) ক্যাটাগরিতে বিদ্যুৎ ব্যবহার করলে আরইবির সেচ নীতিমালা-২০২৪ এর ৩.৪(ঞ) অনুযায়ী সেচ/কৃষি শ্রেণীর পরিবর্তে ব্যবহৃত ক্যাটাগরির মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাটাগরি অর্থাৎ মাছ চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুতের জন্য শিল্পহারে বিল করার বিষয়টি যথাযথ রয়েছে।’

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের কাছ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। তারা নিষ্ক্রিয়।

২০২৪ সালের ১৯ মে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে বিদ্যুৎ বিভাগে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়, মৎস্য খামার ও হ্যাচারি মালিকদের বাণিজ্যিক হারে বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করতে হয়, যা কৃষিকাজে নিয়োজিত খামারিদের বিদ্যুৎ বিলের চেয়ে অনেক বেশি! এর ফলে খামারিদের মৎস্য উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া অনেক ফিড মিল বিদ্যুতের অভাবে ডিজেল জেনারেটর ব্যবহার করে বিধায় ফিড উৎপাদন খরচও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে মৎস্য/মৎস্যজাত পণ্যের দামবৃদ্ধি পাচ্ছে এবং এ খাতের অনেক খামারি/উদ্যোক্তা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) সিদ্ধান্ত অনুযায়ী মাছ চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যহার কৃষির অনুরূপ পুনর্নির্ধারণ করে মৎস্য খাতের প্রতিষ্ঠানগুলোর বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করার অনুরোধ জানানো হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত ২০২৪ সালের ১৯ মে পত্রে বর্ণিত মৎস্য খাতে/মৎস্য চাষে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কৃষি খাতে বিদ্যমান বিদ্যুতের মূল্যহারের অনুরূপ মূল্যহার নির্ধারণ/পুনর্নির্ধারণের বিষয়ে পরবর্তী প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ১৪ জুলাই ২০২৪ পত্রে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনকে (বিইআরসি) অনুরোধ করা হয়। ওই পত্রে বলা হয়, বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন আইন ২০০৩-এর ৩৪ ধারা মোতাবেক মূল্যহার পদ্ধতি ও গ্রাহক শ্রেণী নির্ধারণ করা কমিশনের আওতাভুক্ত। সুতরা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে প্রাপ্ত পত্রটি কমিশন কর্তৃক নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। কমিশন বিষয়টি নিষ্পত্তি করেছে কিনা, এর কোনো তথ্য-প্রমাণ পাওয়া যায়নি।

২০২৪ সালের ২ সেপ্টেম্বর পত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় ২০২৪ সালের ২৮ আগস্ট অনুষ্ঠিত আন্তঃমন্ত্রণালয় সভার নিম্ন সিদ্ধান্তের সূত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের বিদ্যুতের মূল্যহার কৃষির অনুরূপ পুনর্নির্ধারণের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে অনুরোধ করা হয়:

‘‌মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের কৃষির ন্যায় বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ভর্তুকি দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ বিভাগকে পুনরায় অনুরোধ জানাতে হবে।’

ওই পত্রের জবাবে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে ২০২৪ সালের ৩ অক্টোবরের পত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে জানানো হয়: ‘কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, কৃষিপণ্যের রফতানি উৎসাহিত করা এবং কৃষিভিত্তিক শিল্পকে উদ্বুদ্ধ করার লক্ষ্যে কৃষিভিত্তিক শিল্পে ব্যবহারিত বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত রেয়াত (রিবেট) প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে ২০০৩ সালের ২৭ অক্টোবর অর্থ বিভাগ থেকে এক পত্র জারি করা হয়। পরে ২০০৪ সালের ৪ জুলাই অর্থ বিভাগ থেকে কৃষিভিত্তিক শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ক্ষেত্রে প্রদত্ত রেয়াত ১৫-২০ শতাংশে বাড়ানোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পত্র জারি করা হয়। এরপর ১০ জুলাই অর্থ বিভাগ থেকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ন্যায় পোলট্রি শিল্পে বিদ্যুৎ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত প্রদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পত্র জারি করা হয়। ওই পত্রগুলোয় মৎস খাতভুক্ত কোনো শিল্পকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি। অর্থ বিভাগের সিদ্ধান্তের আলোকে শুধু আরইবিকে কৃষিভিত্তিক শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ওপর ২০ শতাংশ রেয়াত (রিবেট) প্রদান করা হচ্ছে। রেয়াতকৃত অর্থ অর্থ বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে কৃষি মন্ত্রণালয়ের “কৃষি ভর্তুকি” খাত থেকে পুনর্ভরণ করা হয়ে থাকে। এ বিবেচনায় উক্ত পত্রে বিদ্যুৎ বিভাগের অভিমত ছিল, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে খামারিদের কৃষির ন্যায় বিদ্যুৎ বিলে ২০ শতাংশ ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনার নিমিত্তে মৎস্য খামারিদের কৃষিভিত্তিক শিল্প ক্যাটাগরিতে অন্তর্ভুক্তপূর্বক তা অর্থ বিভাগের ‌কৃষি ভর্তুকির আওতাভুক্ত করা যেতে পারে। অথবা পৃথক খাত হিসেবে রিবেট বা ভর্তুকির আওতাভুক্ত করা যায়। এজন্য অর্থ বিভাগের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য পরামর্শ দেয়া হয়।’

২০২৪ সালের ২৭ অক্টোবরে এক উপানুষ্ঠানিক পত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টাকে বলেছেন, ‘‌পশুপালন ও মৎস্য চাষের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে ব্যাপক সুযোগ রয়েছে। এটি একটি সম্ভাবনাময় খাত, যা কর্মসংস্থান (২০ শতাংশ স্থায়ী ও ৫০ শতাংশ অস্থায়ী) সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। উল্লেখ্য, বর্তমানে সমগ্র দেশে প্রান্তিক খামারিরা শতকরা ৮০ ভাগ প্রাণিজ পুষ্টি জোগান দিচ্ছে। এর মধ্যে ৮৮ হাজার ৫৭৭টি রেজিস্টার্ড গবাদিপশুর খামার, ৯০ হাজার মুরগির খামার এবং প্রায় ২ লাখ মৎস্য খামার রয়েছে। কিন্তু পরিতাপের বিষয় কৃষির ন্যায় মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতের খামারিরা মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উৎপাদনে ব্যবহৃত বিদ্যুতের ওপর কোনো রেয়াত পায় না। বিদ্যুৎ বিলের উপরে রেয়াত পেলে একদিকে যেমন উৎপাদন ব্যয় কম হতো অন্যদিকে ভোক্তা ও খামারি উভয়েই লাভবান হতো।’ তাই তিনি বিষয়টি বিবেচনাকরত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টার সুদৃষ্টি কামনা করেন।

২০২৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় থেকে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগে পাঠানো এক পত্রে বলা হয়: (১) কর্মসংস্থান সৃষ্টি, দারিদ্র্যবিমোচন, সর্বোপরি ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার নিরাপদ প্রাণিজ আমিষের চাহিদা পূরণের মাধ্যমে স্বাস্থ্যবান ও মেধাবী জাতি গঠনে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাত গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে; (২) অর্থ মন্ত্রণালয়ের ২০০৪ সালের ১৩ জুলাইয়ের পত্রমূলে ২০০৪ সালের ১ জুলাই থেকে কৃষিভিত্তিক শিল্পের ন্যায় পোলট্রি শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ হারে রেয়াত প্রদান করা হয়। সে সময় ভর্তুকির বরাদ্দ অর্থ বিভাগের বাজেটে অন্তর্ভুক্ত থাকায় সেখান থেকেই কৃষিভিত্তিক ও পোলট্রি শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের ২০ শতাংশ রেয়াতের অর্থ ছাড় করা হতো; (৩) পরবর্তীতে, কৃষি ভর্তুকি কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেটভুক্ত করা হয় এবং এরপর থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট হতে কৃষিভিত্তিক ও পোলট্রি শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলের রিবেট প্রদান করা হয়নি; (৪) অর্থ বিভাগের মনিটরিং সেলের মহাপরিচালকের সভাপতিত্বে ২০১৯ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিউবো) কৃষিভিত্তিক ও পোলট্রি শিল্পে জানুয়ারি ২০১৯ পর্যন্ত প্রদত্ত ২০ শতাংশ বিদ্যুৎ বিলের রেয়াত বাবদ ১১ কোটি ৪৮ লাখ ৪৩ হাজার ২৯৭ টাকা কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট খাত থেকে বাবিউবো পেতে পারে মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও ওই অর্থ না পাওয়ায় বিউবোর ২০২০ সালের ৩ নভেম্বরে এক দপ্তরাদেশের মাধ্যমে পোলট্রি শিল্পে বিদ্যুৎ সরবরাহের ক্ষেত্রে ২০ শতাংশ রেয়াত প্রদান স্থগিত করা হয়; (৫) ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবরে এক পত্রে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয় বিউবো ও আরইবিকে অবহিত করে, ‘‌অর্থ ও কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষিভিত্তিক ও পোলট্রি শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুতে ২০ শতাংশ রিবেট প্রদান না করায় বিদ্যুৎ বিলের শতভাগ সংশ্লিষ্ট গ্রাহকের কাছ থেকে আদায় করতে হবে এবং বকেয়া আদায়ের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। বকেয়া আদায়ে ব্যর্থ হলে নিয়মানুযায়ী গ্রাহক সংযোগ বিছিন্ন করতে হবে এবং (৬) তবে মন্ত্রণালয়ের ২০২২ সালের ২০ অক্টোবরের পত্রে বলা হয়, ওপরে বর্ণিত ২০২২ সালের ১৭ অক্টোবরের পত্রটি আরইবির জন্য প্রযোজ্য নয়। বর্ণিত অবস্থায় উক্ত পত্রে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে/চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় কৃষি খাতে বিদ্যমান বিদ্যুৎ মূল্যের অনুরূপ ট্যারিফ নির্ধারণ/পুনর্নির্ধারণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানানো হয়।

মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ উপদেষ্টা গত ২৩ জানুয়ারি এক উপানুষ্ঠানিক পত্রে অর্থ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টাকে জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পাওয়ার পর থেকেই বিগত সরকারের যেকোনো বৈষম্যমূলক নীতি, বিধি-বিধান ও কার্যক্রমের প্রয়োজনীয় সংস্কারের মাধ্যমে সাধারণ জনগণের স্বার্থ সুরক্ষা ও তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষার বাস্তব প্রতিফলনের মাধ্যমে দেশের প্রকৃত উন্নয়ন সাধনে আপনি নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছেন। বর্ণিত প্রেক্ষাপটে, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতকে কৃষির উপখাত হিসেবে বিবেচনা করে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে/চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোয় ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে কৃষি খাতে বিদ্যমান বিদ্যুৎ মূল্যের অনুরূপ ট্যারিফ নির্ধারণ ও পুনর্নির্ধারণের মাধ্যমে সাধারণ খামারি/উদ্যোক্তাগণের অর্থনৈতিক অবস্থা হুমকির সম্মুখীন হওয়া থেকে রক্ষার ক্ষেত্রে উক্ত পত্রে তার ব্যক্তিগত উদ্যোগ ও সহযোগিতা চাওয়া হয়।

গত ২৬ জানুয়ারিতে বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়কে পাঠানো পত্রে জানানো হয় যে, কৃষি মন্ত্রণালয় কর্তৃক ২০১৮ সালের ১ অক্টোবরে বাংলাদেশ গেজেটে প্রকাশিত ‘কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮’ এর ধারা ২(৪) অনুযায়ী তফসিল-১ এ বর্ণিত কৃষিপণ্যগুলোর মধ্যে এখানে উল্লেখযোগ্য:

(ঝ) পশু ও পশুজাত পণ্য: গরু ও গরুর মাংস; মহিষ ও মহিষের মাংস; উট ও উটের মাংস; ছাগল ও ছাগলের মাংস; ভেড়া ও ভেড়ার মাংস; হাঁস-মুরগি; কোয়েল ও কবুতরের মাংস; ডিম; দুধ ও অন্যান্য দুগ্ধজাত দ্রব্য; কাঁচা ও আধা প্রক্রিয়াজাত চামড়া এবং হাড় ও হাড়ের গুঁড়া;

(ঞ) মাছ: সকল প্রকার মাছ (তাজা, শুকনা, লবণজাত ও হিমায়িত), চিংড়ি, কাঁকড়া, কচ্ছপ এবং কুমির ও অন্যান্য জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী।

উল্লিখিত তথ্য-প্রমাণাদিতে বলা যায়: (১) আইন অনুযায়ী মাছ ধানসহ অন্যান্য কৃষিপণ্যের মতোই কৃষিপণ্য। তাই মাছকে শিল্পপণ্য হিসেবে গণ্য করা এবং মাছ চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল কৃষির পরিবর্তে শিল্পের রেটে আদায় করা বেআইনি ও এখতিয়ার-বহির্ভূত; (২) মাছ ও ধান মিশ্র চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিল শিল্প রেটে কেবল আরইবি কর্তৃক আদায় বৈষম্যমূলক এবং সংশ্লিষ্ট চাষীরা লুণ্ঠনের শিকার; (৩) কৃষিভিত্তিক ও পোলট্রি শিল্পে ব্যবহৃত বিদ্যুৎ বিলে রেয়াত প্রদান বন্ধ করা এবং আরইবির জন্য তা বন্ধ না করা—বিদ্যুৎ বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত এমন আদেশ বৈষম্যমূলক ও এখতিয়ার-বহির্ভূত; (৪) মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ খাতে/চাষের সঙ্গে সম্পৃক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো কৃষি খাতে বিদ্যমান বিদ্যুৎ মূল্যহারের অনুরূপ মূল্যহার নির্ধারণ/পুনর্নির্ধারণের প্রস্তাব নিষ্পত্তি না করে সংশ্লিষ্ট ভোক্তাদের জ্বালানি সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে তাদের জ্বালানি অধিকার খর্ব করার অভিযোগে অর্থ বিভাগ, বিদ্যুৎ বিভাগ ও বিইআরসি অভিযুক্ত এবং (৫) ক্যাব কর্তৃক মাছ চাষে ব্যবহৃত বিদ্যুতের মূল্যহার নির্ধারণ প্রস্তাব নিষ্পত্তি না করে মাছচাষীদের সুবিচার থেকে বঞ্চিত করে তাদের জ্বালানি অধিকার খর্ব করার অভিযোগে বিদ্যুৎ বিভাগ, বিইআরসি ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর বিশেষভাবে অভিযুক্ত।

এম শামসুল আলম: জ্বালানি উপদেষ্টা, কনজিউমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)

আরও