অর্থনীতির নিরাময়

শুধু কর ব্যবস্থাই না, আমাদের সব সেবাই অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করিনি। আমাদের কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। দায়িত্বগুলোর মধ্যে কিছু কাজ আছে যেগুলোকে আমি তিন ভাগে বিভক্ত করি।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হিসেবে আমরা ক্ষমতা গ্রহণ করিনি। আমাদের কিছু দায়িত্ব দেয়া হয়েছে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। দায়িত্বগুলোর মধ্যে কিছু কাজ আছে যেগুলোকে আমি তিন ভাগে বিভক্ত করি। এক. স্বল্পমেয়াদি, দুই. মধ্যমেয়াদি এবং তিন. দীর্ঘমেয়াদি। মধ্যমেয়াদি কাজগুলোর কিছু হয়তো আমরা শুরু করতে পারব। দীর্ঘমেয়াদি কাজগুলো নিশ্চিতভাবেই রাজনৈতিক সরকার করতে পারবে। আর স্বল্পমেয়াদি যেসব কাজ রয়েছে সেগুলো করার চেষ্টা করব আমরা। আমাদের মূল ফোকাসের জায়গা হলো আমরা সেসব কাজ কীভাবে করব। সরকার পরিচালনায় আমাদের ব্যক্তিগত এজেন্ডা নেই।

  • বর্তমান সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে আমাদের কোনো ব্যক্তিগত এজেন্ডা বা স্বার্থ নেই। দেশের স্বার্থই হলো আমাদের স্বার্থ। আমরা সে স্বার্থ সংরক্ষণের চেষ্টা করছি। রাজনৈতিক সরকারের ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে দীর্ঘসূত্রতা থাকে। কিন্তু আমাদের সিদ্ধান্তগুলো দ্রুত ও ত্বরিত গতিতে নেয়া হয়। ভাবনা-চিন্তা করি, কিন্তু অতিদ্রুত সিদ্ধান্ত নিই। যেমন জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) চেয়ারম্যান (মো. আবদুর রহমান খান) বললেন যে চিনি, চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় কিছু খাদ্যদ্রব্যের দাম, আমদানি শুল্ক কমানোর চেষ্টা করা হয়। এসব সিদ্ধান্ত নিতে আগে অনেক সময় লাগত। কিছু রাজনৈতিক প্রতিবন্ধকতা থাকে, যে কারণে দ্রুত এসব সিদ্ধান্ত নেয়া ও বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি আগে। তবে আমরা এসব জায়গায় কাজ করছি দেশের স্বার্থে। আগেও বলেছি আমাদের ব্যক্তিগত কোনো এজেন্ডা নেই।
  • এ আয়োজনে অনেক রাজনীতিবিদ উপস্থিত আছেন। তাদের উদ্দেশে এটাই বলতে চাই, আমরা একটা পথনকশা রেখে যেতে চাই। আমরা যে পথনকশা স্বল্প বা মধ্যবর্তী সময়ে রেখে যাব, ভবিষ্যতে যে সরকারই ক্ষমতায় আসুক, তারা যাতে তা বাস্তবায়ন করে। আগের মতো যেন না হয় যে এক রাজনৈতিক সরকার এসে বলবে বিগত রাজনৈতিক সরকারের সব কর্মকাণ্ডই খারাপ। আবার নতুন করে শুরু করতে হবে। এতে বরং ক্ষতির পরিমাণ বাড়ে। অর্থনীতির ভাষায় এটাকে বলে ডেডওয়েট লস। এমনটি যেন না হয়। যে সরকারই আসুক তাকে সচেষ্ট থাকতে হবে খণ্ডিত কাজকে এগিয়ে নিতে এবং প্রয়োজনে অন্য কোনো লক্ষ্য নির্ধারণ করে হলেও কাজটি সম্পন্ন করতে। সেজন্য আমরা একটি পথনকশা রেখে যেতে চাই। তবে কাজটি খুব বেশি সহজ নয়। তবু চেষ্টা থাকবে পথনকশা যেটা রেখে যাব, সেটাতে যাতে জনগণ সন্তুষ্ট হয়। তখন তারাই রাজনৈতিক সরকারকে প্রেশার দেবে, আপনারা এটা করছেন না কেন? আরো সূক্ষ্ম জিনিস নিয়েও তারা কাজ করতে পারবে।
  • এবার মোটাদাগে বৈষম্য নিয়ে কিছু বলা যাক। বাংলাদেশে বৈষম্যের দুটি দিক আছে। একটা গুণগত, অন্যটা সংখ্যাগত। গুণগতগুলো চোখে দেখা যায় না। যেমনটা অমর্ত্য সেন বলেছেন যে গরিব লোককে চিহ্নিত করতে গেলে খুব বেশি গবেষণা করার দরকার নেই। চেহারা, ছেঁড়া কাপড় দেখলেই বোঝা যায়। কিন্তু অনেক গরিব রয়েছেন যাদের মুখ দেখে ভেতরের বঞ্চনা বোঝার উপায় নেই।
  • আমাদের অর্থনীতিতে সংখ্যাগত বৈষম্য দেখতে পাই। বিশেষ করে আমরা আয় ও সম্পদের বৈষম্য দেখতে পাই। আয়ের চেয়ে সম্পদের বৈষম্য আরো প্রকট। জিনিসপত্রের মূল্যবৃদ্ধির চেয়ে সম্পদের বৈষম্য বেশি তীব্র। বৈষম্যের আরেকটি দিক সুযোগের বৈষম্য। সরকারি কী কী সুযোগ-সুবিধা আছে সেটি অনেক দরিদ্র মানুষই জানে না। সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সম্পর্কে তারা অবগত নয়। অর্থাৎ একদিকে দরিদ্রদের সুযোগ সম্পর্কিত জ্ঞান নেই, অন্যদিকে সীমিত সুযোগ রয়েছে। যদিও অন্তর্ভুক্তিমূলক সুযোগের কথা বলা হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় ব্যাংকের কথা। গরিবরা ঋণ নিতে গেলে ব্যাংক কখনই সরাসরি না করবে না। কিন্তু ব্যাংক তাদের ১০ জায়গায় স্বাক্ষর করতে বলবে, নানা কাগজপত্র জমা দেয়ার কথা বলবে। চেয়ারম্যানের স্বাক্ষরিত কাগজ নিয়ে যেতে বলবে। অর্থাৎ সরাসরি বলবে না যে ঋণ দেবে না কিন্তু পরিস্থিতি এমন তৈরি করবে যেন তারা আর ঋণ নিতে না যায়। অনেকেই আমার কাছে নানা সময় জানিয়েছেন যে তারা ব্যাংকে গিয়ে ফেরত আসছেন। তাদের কাছে জমির কাগজ চাওয়া হয়েছে। এভাবে দরিদ্রদের জন্য সুযোগকে সীমিত করা হয়েছে। এছাড়া তাদের সঙ্গে বৈষম্য হয় আয় বা সম্পদে নয়, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায়। কেবল ভিটামিন-এ বা কলেরার টিকা দিয়ে দরিদ্রদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা যায় না। আরো অনেক জটিল রোগে ভুগতে হয় তাদের। কিন্তু সেসব চিকিৎসার জন্য তাদের শহরে আসতে হয়। অবশ্য এটি আবার ধনী ও দরিদ্র উভয়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। উভয়ে এ বৈষম্যের শিকার এবং ব্যয়বহুলও বটে। তবু ধনীরা অসুস্থ হলে চিকিৎসা নিতে পারে, কিন্তু দরিদ্র মানুষকে চিকিৎসার জন্য ঘটিবাটি সব বিক্রি করতে হয়। এ কাজগুলো উদ্দেশ্যপূর্ণভাবে করা হয় এবং এর প্রভাবে মানুষের সৃজনশীল প্রতিভার বিকাশ বাধাগ্রস্ত করা হয়।
  • অন্যদিকে আছে শিক্ষা খাতের বৈষম্য। যদিও আমরা শিক্ষাকে বলি সমতা সৃষ্টিকারী উপাদান। কারণ শিক্ষা মানুষকে উল্লম্ব এবং অনুভূমিক উভয়ভাবেই বেড়ে উঠতে সাহায্য করে। যেমন আমি। আমার দাদা একজন কৃষক ছিলেন। তার সন্তানরাও কৃষিকাজ করেছেন, এখনো গ্রামে বাস করেন। তবে আমার বাবা পড়াশোনা করেছিলেন এবং আমিসহ আমার ভাইবোনদের পড়িয়েছেন। যে পরিবারে আমি বেড়ে উঠেছি, সেখানে আমার বেড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অর্থ বিনিযোগ করা হয়নি। আমাকে এ পর্যন্ত আসতে সাহায্য করেছে মানবসম্পদ এবং শিক্ষা। কিন্তু অনেকেই এ শিক্ষার সুযোগটি পাচ্ছে না। আবার অনেকে মানসম্পন্ন শিক্ষা পাচ্ছে না। এছাড়া সামাজিক সুরক্ষার ক্ষেত্রেও বৈষম্য আছে। যে কারণে আবার আমাদের অধিকাংশ মানুষ কর দেয় না। কিন্তু কর দেয়া ছাড়া এ অবস্থার উন্নয়ন কঠিন। আমরা যদি স্ক্যান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোর দিকে লক্ষ করি তাহলে দেখা যাবে, তাদের ৬০ শতাংশের ওপরে কর দিতে হয়। বিনিময়ে তারা সব নাগরিক সুযোগ-সুবিধা পাচ্ছেন রাষ্ট্রের দেখভালে। রাষ্ট্র সব ক্ষেত্রে তাদের সুযোগ-সুবিধা দিচ্ছে। এমন ব্যবস্থায় আমরা যেতে পারব কিনা জানি না, তবে আমাদেরও সেদিকে যাওয়ার প্রয়োজন আছে। তাই ট্যাক্স দিতে হবে। নয়তো সার্বিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
  • বাংলাদেশের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। একসময় আমাদের তলাবিহীন ঝুড়ি বা টেস্ট কেস ফর ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি বলা হলেও আমরা নানা ক্ষেত্রে নিজেদের প্রমাণ করেছি এবং অগ্রসর হয়েছি। এই সফলতার কৃতিত্ব সব সরকারের। আমাদের প্রত্যাশা আমরা যেন এ ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারি। আরেকটি বিষয় হলো আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক দুর্বল হয়ে পড়েছে। অদক্ষ লোক দ্বারা পরিচালিত হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান মুখ থুবড়ে পড়েছে। এছাড়া আমাদের অনেক জায়গার সিস্টেম অটোমেটেড হয়নি। ফলে স্বেচ্ছাচারিতার অনেক সুযোগ থাকে। আমাদের কর ব্যবস্থা এখনো অটোমেটেড হয়নি। শুধু কর ব্যবস্থাই না, আমাদের সব সেবাই অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। এর মধ্যে এনবিআরের সেবাকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে অটোমেশনের আওতায় আনতে হবে। এনবিআরের কিছু অটোমেশন হয়েছে। তবে তা সব জায়গায় না। অটোমেশনে না গেলে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছে দেয়া যাবে না। আমি যখন বিদেশে ছিলাম, ট্যাক্স অফিসারকে আমার জানার প্রয়োজন হতো না। মাঝে মাঝে ফিরতি মেসেজ আসত, আমি টাকা বেশি দিয়ে দিয়েছি। আমরা স্মার্ট বাংলাদেশ বা ডিজিটাল বাংলাদেশ দাবি করি। আসল বিষয় তো তা নয়। এখানে ব্যান্ডউইডথ কম, ডাটা কম, এভাবে পুরোপুরি অটোমেশন করা কঠিন। আমাদের উন্নয়ন কৌশলকে আবার পুনর্মূল্যায়ন করতে হবে। আমরা কেবল প্রবৃদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি। কিন্তু প্রবৃদ্ধির সুবিধাগুলোর সুষম বণ্টন হচ্ছে কিনা বা তৃণমূলের মানুষ সেই প্রবৃদ্ধির ন্যায্য অংশ পাচ্ছে কিনা তা যাচাই করে দেখা হয়নি। এখন পুনর্গঠনের সময় এসেছে। সে সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে, যাতে অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা যায়। যারা নীতিনির্ধারক হবেন, তাদের নীতি প্রণয়নের পাশাপাশি এর সুবিধার সুষম বণ্টনও নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।

ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ: অর্থ উপদেষ্টা

[১১ নভেম্বর বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪-এ প্রধান অতিথির বক্তব্য]

আরও