১৯৭১ থেকে ১৯৭৩ সালের কথা। অ্যাবারডিন বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি করার সময় আমি বেশকিছু সংখ্যক শিক্ষার্থীর সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম। তারা স্কুল কিংবা কলেজগামী শিক্ষার্থী ছিলেন। কারণ সে সময় মালয়েশিয়ায় উন্নত মানের স্কুল-কলেজ ছিল না। সে সময় এ দেশ থেকে আমাদের দেশেও শিক্ষার্থী আসত। কিন্তু বর্তমানে আমরা একটি উন্নত মালয়েশিয়া দেখতে পাচ্ছি। এখন আর মালয়েশিয়া থেকে কেউ পড়তে আসে না আমাদের দেশে। বরং পাশ্চাত্যের শিক্ষার্থীরা সেখানে পড়তে যায়। কারণ তাদের বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে স্থান পাওয়া, আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যদি সেখানে প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়, তাহলে আমাদের দেশেও সম্ভব। কারণ আমাদের শিক্ষার্থীরা অনেক বেশি প্রতিভাসম্পন্ন। এর একটা বহিঃপ্রকাশ দেখেছি আমরা জুলাই-আগস্টে। তারা এতটাই নিবেদিত ও সংকল্পবদ্ধ যে প্রতিভাদীপ্তভাবেই তারা বিষয়টিকে (গণ-অভ্যুত্থান) সম্ভব করেছে। স্লোগানকে তারা অস্ত্রে পরিণত করেছে। কী সুন্দর সুন্দর স্লোগান তারা নিয়ে এল, যেগুলো দিয়ে তারা মেশিনগান ও ট্যাংককে প্রতিহত করেছে। এর মাধ্যমে তারা পুরো জাতিকে একত্র করে নিয়ে এসেছে। আমরা কৃতজ্ঞ তাদের প্রতি।
এত মেধাবী শিক্ষার্থী যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে আসে, তখন শুরুতেই আমরা তাদের ভীষণভাবে বঞ্চিত করি। একজন শিক্ষার্থীর প্রথমেই দরকার একটি আবাসিক জায়গা বা হল যেখানে সে বসবাস করবে। সে হলগুলোয় প্রাধ্যক্ষ বা আবাসিক শিক্ষকরা সিট বরাদ্দ করতেন না। গুটিকয়েক নেতা দাস-দাসীর মতো খাটার বিনিময়ে তাদের হলে থাকতে দিত। নেতারা যখন বলবে, তখনই মিছিলে আসতে হবে। যখন বলবে মিটিংয়ে অংশ নিতে হবে। কিন্তু তার পরদিন হয়তো পরীক্ষা। এর পরও তাকে সেখানে যেতে হবে। এ অবস্থা থেকে আমরা ফিরে এসেছি। এখন সিট বরাদ্দ হচ্ছে মেধার ওপর ভিত্তি করে।
একই সঙ্গে এটিও সত্য যে আমাদের শিক্ষার্থীরা যেমন অনেক মেধাবী, তাদের অনেকের পিতা-মাতা অনেক গরিব। তারা গর্ব করে বলে যে আমার বাবা কৃষক, রিকশাচালক, নৈশপ্রহরী ইত্যাদি। এ পরিবারের ছেলেমেয়েরা সরকারি- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসে, বিশেষ করে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রায় ৫০ শতাংশের ওপর মেয়েরা ভর্তি হয়। কিন্তু তাদের পরিবার সহযোগিতা দিতে পারে না। এসব শিক্ষার্থী এটা চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছে। কিন্তু তারা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসার পর থাকার জায়গা পাচ্ছে না। তাদের জন্য কি কিছুই করার নেই আমাদের? অবশ্যই আছে।
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে মেয়েগুলোর থাকার ব্যবস্থা নেই তাদের জন্য একটা বৃত্তির ব্যবস্থা করা হবে। সেটি হতে পারে আবাসিক বৃত্তি। একই সঙ্গে প্রায় বিনাসুদে ঋণ দেয়া হবে। এ বিষয়ে আমরা বিশ্বব্যাংক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলেছি। এখানে আমরা সহযোগিতার হাত অবশ্যই বাড়িয়ে দেব।
শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানানোই শিক্ষকতার সবচেয়ে ভালো দিক বলে আমি মনে করি। সুতরাং শিক্ষকদের অবশ্যই শিক্ষার্থীদের মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাতে হবে। হলগুলোয় ভালো আবাসন ব্যবস্থার সঙ্গে পড়াশোনার ভালো পরিবেশ নিশ্চিত করতে হবে। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে লাইব্রেরি, ল্যাব ও শ্রেণীকক্ষ সুবিধাও ভালোভাবে থাকতে হবে। পাশাপাশি হলগুলোয় ভালো মানের ও স্বাস্থ্যকর খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে শিক্ষার্থীরা উন্নত মানের খাবার খেতে পারে। এগুলো নিশ্চিত করা আমাদের দায়িত্ব। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর এসব ক্ষেত্রে এগিয়ে যাওয়া উচিত। বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও দায়িত্বপ্রাপ্তদের মাঝেমধ্যে হলে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে খাওয়া উচিত এবং সার্বিক পরিবেশ পর্যালোচনা করা প্রয়োজন যাতে এ কাজগুলো আরো ভালোভাবে সম্পন্ন করা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অনুমতি দিলে ইউজিসি থেকে আমরাও এ কাজের জন্য যেতে পারি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় নিয়ে অনেক কথা হয়। সব বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ব্যবসায়িক চিন্তা থেকে প্রতিষ্ঠিত নয়। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আছে যারা সামাজিক দায়বদ্ধতার জায়গা থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। আমি মনে করি, একসময় নিশ্চয় তাদের দেখে অন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এগিয়ে আসবে। আমরা শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে পয়সা নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তুলব, এটা উচিত না। তাদের ওপর যত কম চাপানো যায়, সে চেষ্টা করতে হবে আমাদের। আমাদের শিক্ষার্থীদের আর্থসামাজিক অবস্থান বিবেচনায় রাখতে হবে। সমাজ আমাদের কিছু দিয়েছে, এখন আমাদের সময় এসেছে এর প্রতিদান দেয়ার। সমাজের প্রতি আমাদের অনেক দায়বদ্ধতা আছে। অ্যালামনাইদেরও অনেক দায়িত্ব। তাদেরও অনেক দায়বদ্ধতা আছে। এখন তাদের এগিয়ে আসা উচিত সহযোগিতা করার জন্য।
বেসরকারির চেয়ে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরকারের সঙ্গে বেশি সম্পৃক্ত থাকে। কিন্তু এখন সময় এসেছে কীভাবে সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে আমরা ইউজিসিকে পরিচালিত করতে পারি সেটি বিবেচনা করার। শিক্ষা উপদেষ্টা একটি দারুণ ধারণা দিয়েছেন। ইউজিসিকে ইউনিভার্সিটি গ্রান্ট কমিশন না বলে ইউনিভার্সিটি কমিশন অথবা উচ্চ শিক্ষা কমিশন বলা যায় কিনা সে বিষয়ে আমাদের ভাবতে হবে। এটি একটি অসাধারণ ধারণা। এর মাধ্যমে আমরা সরকারের ওপর নির্ভরশীলতা কমাতে পারব। কমিশন কি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের মতো করে দেখবে, নাকি সহযোগিতা করার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাবে? আমরা অবশ্যই শ্রদ্ধামূলক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে এগিয়ে যাব।
বেশকিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অনেক উন্নত মানের কাজ করছে। তবে সব বিষয়ে নয়। কোনোটি একটি বিষয়ে তো আরেকটি অন্য বিষয়ে ভালো কাজ করছে। গবেষণার মধ্য দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে এগিয়ে যেতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যদি পিএইচডি প্রোগ্রাম চালু করতে চায়, আমরা এটিকে ইতিবাচকভাবে দেখব। আমরা সবাইকে সঙ্গে নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব।
গবেষণা ছাড়া কোনো জাতি উন্নতি লাভ করতে পারে না। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান যদি জাতীয় স্তরের হয়ে থাকে, এদের লক্ষ্য হবে নিজেদের আন্তর্জাতিক স্তরে নিয়ে যাওয়া। সমাজের সমস্যা ও চাহিদাগুলোকে অবশ্যই গবেষণার মাধ্যমে সমাধানের রাস্তা বের করতে হবে। গবেষণা খুবই ব্যয়বহুল। এক্ষেত্রে সরকার ও ইউজিসিকে এগিয়ে আসতে হবে। বিশ্বব্যাংকের যে প্রকল্পের কথা শুরুতে বলেছি, সেখানেও গবেষণার ওপর জোর দেয়া হচ্ছে।
এছাড়া এরই মধ্যে আমরা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থাও করছি। ফেব্রুয়ারিতে উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরু হবে। এরপর কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গেও আমাদের সম্পৃক্ততা আসবে। অবশ্যই আমাদের সব বিশ্ববিদ্যালয় নিয়েই কাজ করা উচিত। ইউজিসি শুধু পাঁচ সদস্য ও এক চেয়ারম্যানের একটা ছোট দল। কিন্তু সরকারি-বেসরকারি সব বিশ্ববিদ্যালয় মিলেই আমাদের বড় দল। আমরা একসঙ্গে এগিয়ে যাব।
ড. এসএমএ ফায়েজ: চেয়ারম্যান, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি)
[‘উচ্চ শিক্ষায় বৈশ্বিক মান: বাংলাদেশের করণীয়’ শীর্ষক শিরোনামে বণিক বার্তা আয়োজিত প্রথম বাংলাদেশ উচ্চ শিক্ষা সম্মেলন ২০২৪ অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য]