বিশ্ব অর্থনীতি

সংরক্ষণবাদী বিশ্বে অর্থনৈতিক উন্নয়ন

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। তার নতুন প্রশাসন আবারো বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দিতে পারে। এ নিয়ে চীন, ইউরোপ ও জাপানের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নিতে চলেছেন। তার নতুন প্রশাসন আবারো বাণিজ্যযুদ্ধ উসকে দিতে পারে। এ নিয়ে চীন, ইউরোপ ও জাপানের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে। কিন্তু এমন পরিস্থিতিতে উন্নয়নশীল দেশগুলোর কথাও মাথায় রাখা প্রয়োজন। উন্নয়নশীল দেশগুলো কৃষি উৎপাদনের বাইরে এমন রফতানি পণ্য উৎপাদনের দিকে ঝুঁকেছে যেখানে বেশি দক্ষ শ্রমের প্রয়োজন নেই। মূলত মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেতে উন্নয়নশীল দেশগুলো এ পথ বেছে ‍নিয়েছে। কিন্তু বাণিজ্যযুদ্ধ নিয়ে বিদ্যমান এ উদ্বেগকে সঙ্গে করে দেশগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে বাণিজ্য করবে কীভাবে?

যা মনে করা হচ্ছে, তাদের ভবিষ্যৎ হয়তো তার চেয়েও ভালো। বিশেষ করে তারা যদি উন্নয়নের বিকল্প পন্থা বেছে নিতে পারে। এক সময় দরিদ্র দেশগুলো রফতানিমুখী শিল্প উৎপাদনকে কাজে লাগিয়ে উন্নয়নের পথে এগিয়েছে। এক্ষেত্রে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছে আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের চাহিদা। যে কারণে তাদের উৎপাদন বেড়েছে এবং রফতানি বাণিজ্যের সম্প্রসারণ ঘটেছে। এছাড়া কৃষি উৎপাদন কম হওয়ায় কম মজুরিতে স্বল্প দক্ষ শ্রমিকদের কারখানার কাজে নিয়ে আসা সম্ভব হয়েছে। শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতা কম হওয়া সত্ত্বেও ঊর্ধ্বমুখী রফতানি বাণিজ্য ও সস্তা শ্রম—এ দুইয়ে মিলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা সক্ষম করেছে।

পরবর্তী সময়ে এ দেশগুলো রফতানি বাণিজ্য থেকে অর্জিত মুনাফা উন্নত সরঞ্জামে বিনিয়োগ করত। এতে শ্রমিকদের উৎপাদনশীলতাও বেড়ে যায়। অন্যদিকে মজুরি বাড়ায় শ্রমিকদের পাশাপাশি তাদের সন্তানদের জন্য উন্নত শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছিল। পাশাপাশি শিল্প উৎপাদনে জড়িত কোম্পানিগুলো আয়কর প্রদান করত, যা দেশগুলোর অবকাঠামো ও সেবার মান উন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা রেখেছিল। এভাবেই তারা আরো উন্নত ও উচ্চ মূল্য সংযোজন পণ্য তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। একই সঙ্গে একটি নির্বিঘ্ন বাণিজ্য চক্র চালু করতে সফল হয়। এমন দেশের উদাহরণ হিসেবে চীনের নাম প্রণিধানযোগ্য। দেশটি এভাবেই মাত্র চার দশকের মধ্যে যন্ত্রাংশ সংযোজন করে বৈশ্বিক মানের বিদ্যুচ্চালিত যানবাহন (ইভি) উৎপাদনে সফলতা পেয়েছে।

কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি কিছুটা ভিন্ন। কোনো উন্নয়নশীল দেশের মোবাইল ফোন কারখানায় গেলে সাদা চোখে দেখা যায়, যন্ত্রাংশ সংযোজনের কাজ এখন আরো কঠিন হয়ে গেছে। মাইক্রো-সার্কিট অতি সূক্ষ্ম হওয়ায় সারিবদ্ধ শ্রমিকরা হাত দিয়ে আর মাদারবোর্ডের অংশগুলো সংযুক্ত করতে পারছে না। এখন এ কারখানাগুলোয় রয়েছে যন্ত্রপাতির সারি, যেগুলো দক্ষ শ্রমিকদের দ্বারা পরিচালিত হয়। আর অদক্ষ শ্রমিকরা মূলত যন্ত্রাংশ স্থানান্তর করে বা কারখানা পরিষ্কার রাখে। এমনকি এ কাজগুলোও শিগগিরই স্বয়ংক্রিয় হয়ে যাবে। পোশাক বা জুতা তৈরির জন্য সারিবদ্ধ শ্রমিকদের দৃশ্য এখন আরো বিরল হয়ে উঠেছে।

এর বাইরেও অটোমেশনের ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোয় বেশকিছু প্রভাব রয়েছে। প্রথমত, প্রতি ইউনিট উৎপাদনের জন্য এখন তুলনামূলকভাবে কম শ্রমিক লাগছে। বিশেষ করে অদক্ষ শ্রমিকের প্রয়োজন কমে এসেছে। অতীতে উন্নয়নশীল দেশগুলোয়ে ধীরগতিতে শিল্পোন্নয়ন ঘটেছে। এ রূপান্তরের সময় তারা অপেক্ষাকৃত স্বল্প দক্ষতানির্ভর রফতানিমুখী শিল্প উৎপাদন ব্যবস্থা অনুন্নত দেশগুলোয় স্থানান্তর করেছে। কিন্তু এখন চীনের মতো দেশে সব ধরনের শ্রমিকের আধিক্য রয়েছে। ফলে তাদের অভ্যন্তরেই সব ধরনের উৎপাদন কাজ সম্ভব। চীনের কম দক্ষ শ্রমিকরা যেমন টেক্সটাইল খাতে বাংলাদেশী শ্রমিকদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছেন, তেমনি চীনের পিএইচডি ডিগ্রিধারীরা বৈদ্যুতিক যানবাহন (ইভি) খাতে জার্মান পিএইচডি ডিগ্রিধারীদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় লিপ্ত।

এছাড়া উৎপাদনে শ্রমের গুরুত্ব কমে যাওয়ার কারণে শিল্পোন্নত দেশগুলোর বিশ্বাস যে তারা উৎপাদন খাতে প্রতিযোগিতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করতে পারবে। যে কারণে তারা এরই মধ্যে সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতি গ্রহণ করেছে। অবশ্য এক্ষেত্রে আধুনিক যন্ত্রপাতি পরিচালনায় দক্ষ শ্রমিক অন্যতম অনুষঙ্গ হিসেবে কাজ করেছে। এ কারণে তারা পুনরায় নিজের দেশে উৎপাদন ব্যবস্থা ফিরিয়ে নিচ্ছে। যদিও এর প্রধান রাজনৈতিক উদ্দেশ্য, পিছিয়ে পড়া মাধ্যমিক শিক্ষিত শ্রমিকদের জন্য বেশি মজুরির চাকরি তৈরি করা। কিন্তু অটোমেশনের কারণে এটি সম্ভব হওয়া কঠিন।

অটোমেশন, চীনের মতো শিল্পোন্নত দেশের অব্যাহত প্রতিযোগিতা এবং নতুন সংরক্ষণবাদ—সব মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার দরিদ্র দেশগুলোর জন্য রফতানিমুখী শিল্পভিত্তিক প্রবৃদ্ধি অর্জন আরো কঠিন হয়ে উঠছে। এজন্য একটি বাণিজ্যযুদ্ধ তাদের পণ্য রফতানির জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যদিও এটি অতীতের মতো উদ্বেগজনক নয়। বরং এটি উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উন্নয়নের বিকল্প পথ খুঁজতে বাধ্য করার মাধ্যমে ইতিবাচক কিছু বয়ে আনতে পারে।

এমন একটি বিকল্প পথ হতে পারে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন সেবা রফতানি। ২০২৩ সালে বৈশ্বিক সেবা খাতের বাণিজ্য প্রকৃত হিসাবে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে, যেখানে পণ্যভিত্তিক বাণিজ্য ১ দশমিক ২ শতাংশ কমেছে। কভিড-১৯ মহামারীর সময় প্রযুক্তিগত উন্নতির ফলে দূর থেকে কাজ করার সুযোগ আরো বেড়েছে এবং ব্যবসায়িক চর্চা ও শিষ্টাচারের পরিবর্তন সশরীরে উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা কমিয়ে এনেছে।

ফলে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এখন যেকোনো জায়গা থেকে তাদের গ্রাহকদের সেবা প্রদান করতে পারে। ভারতে জেপি মরগান থেকে কোয়ালকম পর্যন্ত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্লোবাল ক্যাপাবিলিটি সেন্টারে (জিসিসি) প্রতিভাবান স্নাতকদের নিয়োগ দিচ্ছে। এখানে প্রকৌশলী, স্থপতি, পরামর্শক এবং আইনজীবীরা আন্তর্জাতিক বাজারে বিক্রি হওয়া পণ্য ও সেবায় অন্তর্ভুক্ত নকশা, চুক্তি, কনটেন্ট ও সফটওয়্যার তৈরি করছেন।

প্রত্যেক উন্নয়নশীল দেশেই কিছুসংখ্যক উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন অভিজাত জনগোষ্ঠী রয়েছে। এ দেশগুলো তুলনামূলকভাবে মজুরির ব্যাপক ব্যবধানের কারণে সেবা রফতানি করে উল্লেখযোগ্য মুনাফা অর্জন করতে পারে। এক্ষেত্রে ইংরেজি (অথবা ফরাসি বা স্প্যানিশ) জানা কর্মীরা বিশেষ সুবিধা পেতে পারেন। যদিও এমন দক্ষতা খুব কম সংখ্যক মানুষের মধ্যে থাকে। কিন্তু এ ধরনের চাকরি স্বল্প দক্ষ শ্রমনির্ভর শিল্পের চেয়ে একটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য অনেক বেশি অভ্যন্তরীণ মূল্য সৃষ্টি করে। এছাড়া বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

তার পরও একজন বেশি মজুরি পাওয়া সেবা কর্মী তার নিজস্ব ভোগের মাধ্যমে স্থানীয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারেন। যখন মধ্য মানের দক্ষতাসম্পন্ন কর্মী যেমন ট্যাক্সিচালক, প্লাম্বার বা ওয়েটার স্থায়ীভাবে চাকরি পান, তখন তারা শুধু মানসম্মত চাহিদা মেটানোর জন্যই কাজ করেন না, বরং একে অন্যের চাহিদাও পূরণ করেন। অন্যদিকে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন সেবা রফতানি শুধু ব্যাপক হারে কর্মসংস্থান প্রবৃদ্ধি ও নগরায়ণের ক্ষেত্রে অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারে।

তবে যেকোনো কর্মসংস্থানের প্রবৃদ্ধি দেশের শ্রমশক্তির গুণগত মান উন্নয়নের দাবি রাখে। গ্র্যাজুয়েটদের শিক্ষাজীবন শেষে ন্যূনতম প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে, যাতে দ্রুত সময়ের মধ্যে দক্ষতা বাড়ানো যায়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, যদি একজন প্রকৌশল স্নাতকের তার পঠিত বিষয়ে মৌলিক জ্ঞান থাকে তাহলে তাকে বহুজাতিক নিয়োগকারীদের চাহিদামাফিক উন্নত মানের সফটওয়্যার ডিজাইন শেখানো যেতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে অধিকাংশ দেশের জন্য পুষ্টি, স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষায় উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগের মাধ্যমে মানবসম্পদ উন্নয়ন করা সবচেয়ে জরুরি।

আশার কথা হলো এ ধরনের বিনিয়োগ কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহায়ক ভূমিকা রাখে। সঠিক উন্নয়ন সহায়ক নীতির মাধ্যমে সরকার দেশব্যাপী শিক্ষার মান ও স্বাস্থ্য খাতে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন করতে পারে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশি সংখ্যক মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষিত মায়েদের ডে-কেয়ারে নিয়োগ দিয়ে শিশুদের প্রাথমিক সাক্ষরতা ও গাণিতিক জ্ঞান শেখানো যেতে পারে। অথবা সাধারণ চিকিৎসকদের প্রশিক্ষণ দেয়া যেতে পারে, যারা সাধারণ অসুস্থতা শনাক্ত করতে, ওষুধ দিতে বা প্রয়োজনে যোগ্য চিকিৎসকদের কাছে রোগীকে পাঠাতে সক্ষম হবেন।

উন্নয়নশীল দেশগুলোর শিল্প খাত পরিত্যাগ করার প্রয়োজন নেই। তবে তাদের অবশ্যই প্রবৃদ্ধির বিকল্প পথ খুঁজতে হবে। নীতিসহায়তার মাধ্যমে কোনো নির্দিষ্ট শিল্প খাতকে বিশেষ সুবিধা দেয়ার পরিবর্তে এ দেশগুলোর এমন দক্ষতায় বিনিয়োগ করা উচিত, যা সব ধরনের চাকরির জন্য আবশ্যকীয়।

বিশেষত যেখানে সেবা খাতের বিকাশের জন্য বিনিয়োগ প্রয়োজন। উন্নত দেশগুলো এ খাতে সংরক্ষণবাদী নীতি গ্রহণ করবে বলে মনে হয় না। কারণ ২০২৩ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় সেবা রফতানিকারক ছিল ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য। তাই এ খাতে কোনো বাণিজ্যযুদ্ধ হলে তারা বিপুল ক্ষতির সম্মুখীন হবে।

যেহেতু বৈশ্বিক সেবা প্রতিযোগিতা একটি দেশের অভ্যন্তরীণ শ্রমশক্তিকে প্রভাবিত করে, তাই এর প্রভাব সবচেয়ে বেশি টের পান ডাক্তার, আইনজীবী, ব্যাংকার, পরামর্শকসহ অন্য উচ্চ আয়ের পেশাজীবীরা। এ প্রতিযোগিতা উন্নত দেশগুলোর ভোক্তাদের জন্য সেবার খরচ কমানোসহ তাদের অভ্যন্তরীণ আয়বৈষম্য কমাতে ভূমিকা রাখতে পারে। এগুলো তাদের জন্য সবচেয়ে ইতিবাচক ফলাফল বয়ে আনবে।

[স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট]

রঘুরাম জি রাজন: ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ও আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের প্রধান অর্থনীতিবিদ। বর্তমানে তিনি ইউনিভার্সিটি অব শিকাগো বুথ স্কুল অব বিজনেসে অর্থনীতির অধ্যাপক এবং Breaking the Mold: India’s Untraveled Path to Prosperity (2024) বইটির সহলেখক।

ভাষান্তর: সাবরিনা স্বর্ণা

আরও