সময়ের ভাবনা

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার পরিবেশ কেমন হওয়া উচিত?

স্কুল-কলেজের অধ্যয়ন পর্ব শেষে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হবে বিশ্বমানের নাগরিক, ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে এমন কথা শোনার পর দু চোখে স্বপ্ন আর বিশ্বজয়ের তাগিদ অনুভব হয় কোমল শিক্ষার্থী মনে। তারপর আবাসিক হলে গণরুমের ভোগান্তি, অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে ক্লাসে অংশগ্রহণ। ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, টিউশনি, পার্টটাইম জব শেষে রিডিং রুমে পড়ার জন্য

স্কুল-কলেজের অধ্যয়ন পর্ব শেষে শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা হবে বিশ্বমানের নাগরিক, ওরিয়েন্টেশন ক্লাসে এমন কথা শোনার পর দু চোখে স্বপ্ন আর বিশ্বজয়ের তাগিদ অনুভব হয় কোমল শিক্ষার্থী মনে। তারপর আবাসিক হলে গণরুমের ভোগান্তি, অপুষ্টিকর খাবার খেয়ে ক্লাসে অংশগ্রহণ। ক্লাস শেষে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, টিউশনি, পার্টটাইম জব শেষে রিডিং রুমে পড়ার জন্য সিট পাওয়ার লড়াই—এভাবেই দিন কেটে যায়। পরীক্ষার সময় এলে গাইড বই আর অনেক আগের শিক্ষার্থীদের রেখে যাওয়া নোট ফটোকপি করেই প্রস্তুতি চলতে থাকে।

সোনালি তারুণ্যের অমূল্য সময়গুলো এভাবেই শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি সনদ পাওয়ার জন্য ব্যয় হয়। এজন্য একাডেমিক পড়াশোনার যে পরিবেশ সেটি কেন শিক্ষার্থীদের জন্য তৈরি করা যাচ্ছে না, সে বিষয়টি নিয়ে ভাববার প্রয়োজন কি এখনো আসেনি? এটা সত্য, সরকারি চাকরি পাওয়ার জন্য যে তুমুল প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হতে হয় তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে চাকরির প্রস্তুতি না নিলে পিছিয়ে থাকতে হবে। এজন্য যারা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতার ইচ্ছে পোষণ করে তাদেরই শুধু একাডেমিক পড়াশোনায় অগ্রগামী দেখা যায়। আর বাকি সবাই স্রোতে গা ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়াশোনাকে যদি চাকরি অর্জনের আগে শুধু ‘ট্রানজিট’ হিসেবে দেখা হয়, তাহলে কি এ পড়াশোনার কোনো সার্থকতা থাকে? বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে হাজার বছর ধরে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চার যে সমৃদ্ধ ধারাবাহিকতা সেটি কি ক্রমাগত হ্রাস পাবে? বস্তুত বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা ও গবেষণার পরিবেশ নেই, আজ এ অভিযোগ নিয়েই আলোকপাতের চেষ্টা করব।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কেমন হওয়া উচিত? বর্তমান সময়ে সেমিস্টার সিস্টেমে পড়াশোনায় ‍নির্দিষ্ট সময়ের ভেতর কারিকুলাম শেষ করে জব সেক্টরের পরীক্ষায় যত দ্রুত ঝাঁপিয়ে পড়া যায়, সেক্ষেত্রেই যেন সবার মনোযোগ। এটি একদিক থেকে ইতিবাচক, কারণ সেশনজটে না পড়ে সময়মতো পড়াশোনা শেষ করা একসময় লাখো তরুণের স্বপ্ন ছিল। সেদিক থেকে উত্তরণ হয়েছে বটে, কিন্তু পড়াশোনার মান কি বেড়েছে? বস্তুত সার্বিকভাবে যেটি দৃশ্যমান হচ্ছে, পাশ্চাত্য থেকে সেমিস্টার সিস্টেম নিয়ে আসা হয়েছে, কিন্তু পাশ্চাত্যের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের দেশে প্রচলিত হয়নি।

উন্নত দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর দিকে তাকালে দেখা যায়, শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক নিয়োগ দেয়া হয়। এতে ২০ শিক্ষার্থীর বিপরীতে একজন শিক্ষক পাঠদান করেন। যুক্তরাষ্ট্রের হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এভাবেই পাঠদান করা হয়। দেশটির আরেক জগৎখ্যাত প্রতিষ্ঠান ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব আইটিতে (এমআইটি) গবেষণা, উদ্ভাবন ও প্রযুক্তির ব্যবহারিক জ্ঞানে শিক্ষার্থীরা দক্ষ হয়ে ওঠেন। স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় বিজ্ঞান গবেষণার জন্য বিখ্যাত। ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া সাহিত্য, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির জন্য বিশ্বব্যাপী সমাদৃত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা উদ্রেক করে এমন কারিকুলাম অনুযায়ী পড়ানো হয়। গৎবাঁধা পড়াশোনায় শিক্ষার্থীরা সেখানে শুধু সিজিপিএ অর্জনের বৃত্তে আটকে থাকে না। মেধার সর্বোচ্চ ব্যবহার করে কীভাবে অর্জিত জ্ঞানকে কাজে লাগানো যায়, সেটির প্রায়োগিক জ্ঞান তারা লাভ করে।

প্রতিবেশী দেশ ভারতের পশ্চিমবঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রতিষ্ঠিত বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের প্রকৃতির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করার শিক্ষা দেয়া হয়। বৈচিত্র্যময় শিক্ষাদান পদ্ধতির কারণে বিশ্ববিদ্যালয়টি দেশ-বিদেশের শিক্ষার্থীদের কাছে পড়ার জন্য অভীষ্ট স্থান হিসেবে গণ্য। 

অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠদান পদ্ধতি আমলে নিয়ে ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হলেও এ বিশ্ববিদ্যালয় অতীত গৌরব ধরে রাখতে পারেনি। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসিক হলের ভিত্তিতে শিক্ষা পদ্ধতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও হলভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থার সূচনা হয়। গৌরবময় অতীতে বিশ্ববিদ্যালয়টির শিক্ষার্থীরা উন্নত আবাসন ব্যবস্থা পেলেও সময়ের ফেরে এখন তা অধরা হয়ে গেছে। নিকটবর্তী সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন একটি হলে শিক্ষার্থীদের মানসম্মত আবাসনের ব্যবস্থা করা হলেও পরবর্তী সময়ে সেটি আর প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে থাকেনি। অন্যান্য হলের মতো নতুন হলটিতেও গণরুম প্রথা শুরু হয়েছে।

১৯৭১ সালে দেশের একমাত্র আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হলেও বিশ্ববিদ্যালয়টি এ স্বাতন্ত্র্য ধরে রাখতে পারেনি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের অন্যান্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও প্রকট আবাসন সংকট রয়েছে। 

এবার আসা যাক পাঠদান পদ্ধতি নিয়ে, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা নির্দিষ্ট সিলেবাসের আলোকে কোর্স শেষ করতে পারলেই দায়িত্ব শেষ বলে মনে করেন। কিন্তু শিক্ষার্থীদের মনে পঠিত বিষয়ের প্রতি আগ্রহ জাগল কিনা সেটি ভাবার প্রয়োজন আদৌ মনে করেন কি? খুব অল্পসংখ্যক শিক্ষককেই দেখা যায় শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে সৃজনশীল উত্তর খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে। মূলত পরীক্ষার খাতায় হাজার বছরের পুরনো তত্ত্বের সঙ্গে শিক্ষার্থীদের সমকালীন চিন্তার যে মিথস্ক্রিয়া ফুটে উঠুক, তা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক চান না। এমনকি শ্রেণীকক্ষে পাঠদানের সময়ও শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন করা পছন্দ করেন না এমন শিক্ষকও রয়েছেন।

তাহলে বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণীকক্ষ কেমন হবে? একজন শিক্ষক গৎবাঁধা লেকচার দিয়ে যাবেন। আর শিক্ষার্থীরা সেটি খাতায় টুকে নিয়ে মুখস্থ করে পরীক্ষার খাতায় উগড়ে দেবে বিষয়টি কি এ রকম? আবার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলার আগে স্কুল-কলেজের শিক্ষার প্রসঙ্গ কি উঠবে না? কারণ বিশ্ববিদ্যালয় তো দেশের সার্বিক শিক্ষা ব্যবস্থারই অংশ। স্কুল-কলেজের পাঠদানে যদি মানসম্মত শিক্ষা পদ্ধতি অনুসরণ না করা হয়, এর ধারাবাহিকতা বিশ্ববিদ্যালয়ে উপনীত হওয়াটা অস্বাভাবিক কিছু না। এজন্য সার্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা নিয়ে প্রশ্ন তোলার আগে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার দিকেও মনোযোগী হওয়া উচিত। তবে এটা সত্য, বিশ্ববিদ্যালয়ে অবশ্যই স্কুল-কলেজের তুলনায় উচ্চ স্তরের পড়াশোনা হবে সেটিই প্রত্যাশিত। এজন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ব্যবস্থায় গবেষণার ছাপ পড়বে, সেটি আশা করা হয়। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য যে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে কাঙ্ক্ষিত পর্যায়ে গবেষণা হয় না। সম্প্রতি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকদের গবেষণা ভাতা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। অথচ বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজই শিক্ষা নিয়ে গবেষণা করা। এভাবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে গবেষণা হ্রাস পেলে তা আখেরে দেশের উন্নতির জন্য ভালো ফল বয়ে আনবে না।

আমরা চাই আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হবে বিশ্বমানের জ্ঞানের সূতিকাগার। এখানে শুধু আমলা আর শিক্ষক তৈরি না হয়ে বিশ্ববরেণ্য মনীষী, বিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদ, যুগশ্রেষ্ঠ সমাজচিন্তক তৈরি হবে এটিই প্রত্যাশা। এজন্য সময়োপযোগী কারিকুলাম প্রয়োজন, শিক্ষকদের উন্নত মানের প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষার্থীদের জন্য উপযুক্ত থাকার জায়গা ও মানসম্মত খাবার নিশ্চিত করে পাঠাভ্যাসে মনোযোগী করে তুলতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে জনসাধারণের বিনোদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করার চেয়ে এর অবকাঠামোগুলোকে কীভাবে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শিক্ষা ও গবেষণার প্রাণকেন্দ্রে পরিণত করা যায়, সেদিকে মনোনিবেশ করা উচিত। এক্ষেত্রে অবশ্য সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বেশ সুবিধা পেতে পারে, কিন্তু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেও শিক্ষার পরিবেশ তৈরিতে মনোযোগী হতে হবে।

বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের (ইউজিসি) তথ্য অনুযায়ী, দেশে এখন সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা ৫৩ এবং বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ১১২টি। এদিকে প্রতিটি জেলায় সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছে, অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে আরো একাধিক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়। এত বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিড়ে উচ্চশিক্ষার মানে যেন অবনতি না হয়, সেটি শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কঠোরভাবে মনিটরিং করতে হবে। পরিশেষে বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলোর যথাযথ ব্যবহার হোক সে কামনা করে আজকের লেখা শেষ করব। কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরিগুলো এখন শুধু রিডিং রুমে পরিণত হয়ে গেছে। আর ধুলো জমে মলিন হয়ে থাকে শতবর্ষের পুরনো মৌলিক জ্ঞান সঞ্চিত বইগুলো। বইগুলো গবেষণার উদ্দেশ্যে পড়তে আসা শিক্ষক-শিক্ষার্থীর স্পর্শে প্রাণ ফিরে পাক সেটিই সবার কাম্য। শ্রেণীকক্ষ, সেমিনার আর সিম্পোজিয়ামগুলোতে এর রেশ পড়ুক আর আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হয়ে উঠুক জাতি গড়ার কাঙ্ক্ষিত প্রতিষ্ঠান।

তৌফিকুল ইসলাম: সাংবাদিক

আরও