সময়ের ভাবনা

অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও বিভীষিকাময় নাগরিক জীবন

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের গ্রামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙন শুরু হয়। শুরু হয় ব্যাপক নগরায়ণ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রধান নগরগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে থাকে। নগরকেন্দ্রিক শিল্পায়নের কারণে প্রচুর মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। ধীরে ধীরে গ্রামগুলো পরিত্যক্ত হয়। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পুল ফ্যাক্টর’। অর্থাৎ নগরগুলো তাদের যাবতীয় সুযোগ-

সত্তরের দশকের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশের গ্রামভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থায় ভাঙন শুরু হয়। শুরু হয় ব্যাপক নগরায়ণ। উন্নয়ন কর্মকাণ্ড প্রধান নগরগুলোকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হতে থাকে। নগরকেন্দ্রিক শিল্পায়নের কারণে প্রচুর মানুষ গ্রাম থেকে শহরে চলে আসে। ধীরে ধীরে গ্রামগুলো পরিত্যক্ত হয়। সমাজবিজ্ঞানের ভাষায় একে বলা হয় ‘পুল ফ্যাক্টর’। অর্থাৎ নগরগুলো তাদের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা এবং কর্মসংস্থান দিয়ে আকৃষ্ট করতে থাকে মানুষকে। 

২০১৫ সালে প্রকাশিত বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর এক প্রতিবেদন অনুসারে, ১৯৭৪ সাল থেকে বাংলাদেশে প্রতি বছর গড়ে ৫ দশমিক ৩৪ শতাংশ হারে নগরায়ণ হচ্ছে (রেট অব আরবানাইজেশন)। যদিও বিগত কয়েক দশকে এ হার কিছুটা কমতির দিকে, কিন্তু নগরায়ণের মাত্রা (লেভেল অব আরবানাইজেশন) এখনো আশঙ্কাজনক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১৯৭৪ সালে নগরায়ণের মাত্রা ছিল মাত্র ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ (পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৩)। ২০১১ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ২৩ দশমিক ৩০ শতাংশে উন্নীত হয় (পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৩, বিবিএস, ২০১৪)। আরেকটি হিসাব অনুসারে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে নগরায়ণের মাত্রা ছিল ২৫ থেকে ২৮ শতাংশের মধ্যে (বিবিএস, ২০১৪, পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৫)। ২০১৭ সালে তা ছিল ৩৫ দশমিক ৮ শতাংশ (ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, ২০১৮)। এ ধারাবাহিকতা অনুসারে ধারণা করা হচ্ছে যে ২০২৫ সালের মধ্যে এ দেশে নগরায়ণের মাত্রা ৫০ শতাংশে পৌঁছবে (বাংলাদেশ আরবান ফোরাম, ২০১২)। ২০৫০ সালের মধ্যে শহরে বসবাসরত জনগণের সংখ্যা ৫৬ শতাংশে উন্নীত হবে (ইউএন, ২০১৪)। উল্লেখ্য, একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি দেশের নগরগুলোয় বসবাসরত জনগণের সংখ্যার গড় পরিবর্তনকে বলা হয় নগরায়ণের হার (রেট অব আরবানাইজেশন)। অন্যদিকে একটি দেশের মোট জনসংখ্যা এবং নগরগুলোয় বসবাসরত নাগরিকদের অনুপাতকে নগরায়ণের মাত্রা (লেভেল অব আরবানাইজেশন) বলা হয়।

২০১১ সালে মোট শহুরে জনসংখ্যার প্রায় ৬৪ 

শতাংশ বাংলাদেশের তিনটি বড় শহর ঢাকা, চট্টগ্রাম ও খুলনায় বাস করত (পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৫)। সে বছর কেবল ঢাকা সিটি করপোরেশন এলাকাতেই মোট জনসংখ্যা ছিল ১ কোটি ৮৯ লাখ। এ সংখ্যা সে সময় মোট শহুরে জনসংখ্যার ৪৪ দশমিক ২৬ শতাংশ (পরিকল্পনা কমিশন, ২০১৫)।

বাংলাদেশে নগরায়ণের এ হার ও মাত্রা টেকসই উন্নয়নের পথে বড় অন্তরায়। মানুষ নগরমুখী। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ এবং সুচিন্তিত পদক্ষেপহীনতার কারণে তারা যথাযথ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বাংলাদেশ জনবহুল দেশ। এ বিশাল জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ কয়েকটি প্রধান নগরে কেন্দ্রীভূত হয়ে আছে। ঢাকা শহরে তা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তার একটি ভয়াবহ চিত্র ২০১৬ সালে প্রকাশিত রাজউকের একটি প্রতিবেদনে উঠে আসে। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে সময় ঢাকা শহরের প্রায় ৪০ শতাংশ আবাসিক এলাকায় প্রতি বর্গকিলোমিটারে গড়ে ৯৯ হাজারের অধিক লোক বাস করত! বর্তমানে তা আরো বেড়েছে নিঃসন্দেহে। নগরে জনসংখ্যার এ অধিক ঘনত্বের কারণে প্রতিনিয়ত নানা জটিল সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে নাগরিকরা। এ বিপুল জনসংখ্যার জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে গিয়ে কমে যাচ্ছে উন্মুক্ত স্থান, খেলার মাঠ ও সবুজ বাগান। তীব্র যানজটের কথা তো বলাই বাহুল্য। কোনো সুনির্দিষ্ট বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নেই। বর্ষাকালে অধিকাংশ এলাকা চলে যায় পানির নিচে। পরিবেশ দূষণ এবং অপর্যাপ্ত গণপরিবহন ব্যবস্থা নাগরিকদের জীবনকে করে তুলেছে দুর্বিষহ। একটি স্বাস্থ্যকর নাগরিক জীবন কাটানোকে একান্ত অসম্ভব করে তুলেছে এ সমস্যাগুলো। পাশাপাশি গায়ে গা লাগিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে বহুতল ভবনগুলো। কিন্তু অধিকাংশ ভবনেই কোনো নিরাপত্তা কাঠামো নেই। আগুন, বিদ্যুৎ কিংবা গ্যাসের কারণে সৃষ্ট দুর্ঘটনা থেকে মানুষকে বাঁচানোর কোনো ধরনের ব্যবস্থা নেই। এমনকি এসব ভবনে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসও প্রবেশ করে না। ফলে সারা দিন বাতি জ্বালিয়ে রাখতে হয়। পাখা কিংবা শীতাতপ নিয়ন্ত্রক যন্ত্র চালু রাখতে হয়। এতে জ্বালানি খাতের ওপর ব্যাপক চাপ পড়ে। তারই দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল হিসেবে বিদ্যুৎবিভ্রাট এবং গ্যাস সংকট এরই মধ্যে চরম আকার ধারণ করেছে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণের আরেকটি প্রধান সমস্যা হলো দারিদ্র্য ও বেকারত্ব। এর ফলে বাড়ছে যত্রতত্র বস্তির সংখ্যা। এলজিইডির ২০১১ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন অনুসারে, সে সময় মোট শহুরে জনসংখ্যার ২১ শতাংশ ছিল দরিদ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদন অনুসারে, ক্রমবর্ধমান দরিদ্র জনসংখ্যার চাপ সামলাতে ১৯৯৭ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে শহর এলাকায় প্রায় ১১ হাজার বস্তি তৈরি হয়। সবচেয়ে বেশি বস্তি আছে ঢাকা শহরে। তারপর যথাক্রমে চট্টগ্রাম, খুলনা ও রাজশাহীর অবস্থান। ঘিঞ্জি ও অস্বাস্থ্যকর এসব বস্তিতে অমানবিক জীবন কাটাচ্ছে অসংখ্য মানুষ। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ২০১৫ সালের এক প্রতিবেদনে জানা যায়, এসব বস্তির মাত্র ২৬ শতাংশ বাসায় স্যানিটারি ল্যাট্রিনের ব্যবস্থা আছে। আর ৭ শতাংশ বাসায় আছে ঝুলন্ত পায়খানা। বাকি বাসাগুলোয় টয়লেটের কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই।

জনসংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বেড়েছে যানবাহনের সংখ্যা। সে তুলনায় রাস্তার পরিধি বাড়েনি। তাই যানজট পরিণত হয়েছে নিত্যদিনের বিভীষিকায়। রাস্তাগুলোয় মানুষের হাঁটা কিংবা সাইকেল চালানোর জন্য আলাদা কোনো লেন নেই। পথচারীদের তাই গাড়ির পাশঘেঁষে, এমনকি দুই গাড়ির মাঝখান দিয়েও হেঁটে যেতে হয়। এগুলো খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। এসব কারণে অহরহ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে অসংখ্য মানুষ। এখানেই শেষ নয়। রাস্তা দিয়ে যেতে না পেরে প্রায় ফুটপাতে মোটর সাইকেল তুলে দেয় চালকরা। এমনিতেই ফুটপাতগুলোর অধিকাংশই থাকে হকারদের দখলে (অপরিকল্পিত নগরায়ণের এটিও একটি বড় সমস্যা)। তারপর সামান্য যে অংশটুকু থাকে, সেদিক দিয়ে চলাচল করে মোটর বাইক। ফলে ফুটপাথেও নিরাপদে হাঁটার নিশ্চয়তাটুকু থাকল না পথচারীদের। রাস্তায় নেই কোনো ট্রাফিক বাতি। অতিরিক্ত গাড়ির কারণে ট্রাফিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশরাও যে খুব সচেতনভাবে দায়িত্ব পালন করছেন তা বলা যাবে না। প্রায় দেখা যায়, মানুষ সিগন্যাল দেখে রাস্তা পার হওয়া শুরু করেছেন। তাদের রাস্তার মাঝখানে থাকতেই দেখা যায়, ট্রাফিক পুলিশ সিগন্যাল ছেড়ে দিচ্ছেন। আর সিগন্যাল ছাড়লেই তো গাড়িগুলো পাগলের মতো ছুটতে থাকে। ফলে নাগরিকদের সবসময় প্রাণ হাতে নিয়ে চলাফেরা করতে হয়। এতে তাদের শারীরিক এবং মানসিক উভয় ধরনের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রধান নগরগুলো, বিশেষত ঢাকা শহর এর মধ্যেই বসবাসের অযোগ্য হয়ে গেছে। চলতি পথে অনেকের মুখেই শোনা যায়, তারা এ শহর ছেড়ে চলে যেতে পারলে হাঁফ ছেড়ে বাঁচেন। কিন্তু নিজ এলাকায় কোনো কাজের সুযোগ না পেয়ে তারা ঢাকা শহরে থাকতে বাধ্য হচ্ছেন। চট্টগ্রাম শহরের অবস্থাও নাজুক। বাংলাদেশের সব প্রধান নগরই কমবেশি অপরিকল্পিত সিদ্ধান্ত ও অব্যবস্থাপনার শিকার। এ থেকে অন্তত চারটি বিষয় ধারণা করতে পারে সাধারণ মানুষ—১. বাংলাদেশে কোনো নগর পরিকল্পনাবিদ নেই, ২. নগর পরিকল্পনাবিদ আছেন, কিন্তু তারা দায়িত্ব সচেতন নন, ৩. নগর পরিকল্পনাবিদ আছেন, তারা দায়িত্বও পালন করতে চান, কিন্তু সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ তাদের কথা আমলে নেন না এবং ৪. নগর উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে কোনো সমন্বয় নেই। তারা স্বেচ্ছাচারভাবে কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। এর মধ্যে যেটিই সত্য হোক না কেন, পরিণামে দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সে ক্ষতির ভার বহন করতে হচ্ছে জনগণকে।

অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করার জন্য সরকারের উচিত সুচিন্তিত পদক্ষেপ নেয়া। এক্ষেত্রে বিকেন্দ্রীকরণের কোনো বিকল্প নেই। জনগণ যেন নিজ এলাকায় থাকতে উৎসাহী হয়, তার জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে। নগরগুলোকে পুনর্গঠনের ব্যবস্থা করতে হবে। ফ্লাইওভার, মেট্রোরেল ইত্যাদি নিঃসন্দেহে ভালো ব্যাপার। কিন্তু অপরিকল্পিত নগরায়ণ বন্ধ করা না গেলে এর কোনোটিরই সুফল মিলবে না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও নাগরিক সমস্যা রোধে সরকারের কর্তব্য হলো সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এবং নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যৌথ আলাপের মাধ্যমে একটি সুচিন্তিত নীতিমালা প্রণয়ন ও তার যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা।

নিজাম আশ শামস: সাংবাদিক

আরও