আলোকপাত

বৈশ্বিক দুর্নীতির ধারণা সূচকে দেশের উন্নতি হচ্ছে না কেন?

বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সম্প্রতি দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২২ প্রকাশ করেছে। ১০০ ভিত্তিতে এ সূচকে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সর্বোচ্চ স্কোর নিয়ে

বিশ্বের ১৮০টি দেশ ও অঞ্চলের দুর্নীতির পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে বার্লিনভিত্তিক দুর্নীতিবিরোধী সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) সম্প্রতি দুর্নীতির ধারণা সূচক (সিপিআই) ২০২২ প্রকাশ করেছে। ১০০ ভিত্তিতে এ সূচকে শূন্য স্কোরকে দুর্নীতির ব্যাপকতার ধারণায় সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত এবং ১০০ স্কোরকে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত বা সর্বোচ্চ সুশাসনের দেশ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সর্বোচ্চ স্কোর নিয়ে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর তালিকায় রয়েছে ডেনমার্ক। এর পরের চারটি অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে ফিনল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে ও সিঙ্গাপুর। তালিকায় বিশ্বের সবচেয়ে বেশি দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ সোমালিয়া। এর পরের চারটি অবস্থানে রয়েছে যথাক্রমে দক্ষিণ সুদান, সিরিয়া, ভেনিজুয়েলা, ইয়েমেন। দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের তালিকায় ১৮০টি দেশের মধ্যে এবার বাংলাদেশের অবস্থান ১২তম, যা গতবার ছিল ১৩তম। গত বছরের তুলনায় বাংলাদেশের এক ধাপ অবনমন হয়েছে। ১০০ স্কোরের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৫, যা গতবারের চেয়ে ১ পয়েন্ট কম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নিচে রয়েছে শুধু আফগানিস্তান। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) মতে, গত এক দশকে দুর্নীতির অবস্থানে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি ঘটেনি, বরং খারাপ হয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৭ ও পরে ২০২২ পর্যন্ত বাংলাদেশের অবস্থান স্থবির জায়গায় আছে। এটা হতাশাব্যঞ্জক। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ প্রথমবারের মতো দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয় ২০০১ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের প্রথম মেয়াদের শেষ বছরে। পরবর্তী টানা চার বছর (২০০২-০৫) খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি সরকারের সময়কালে বাংলাদেশ দুর্নীতিতে বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ছিল। বর্তমানে দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন না হলেও বাংলাদেশ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশগুলোর সারিতে রয়েছে। দুর্নীতির অবস্থানে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি ঘটছে না কেন, তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য। 

বিশ্লেষকদের মতে, দুর্নীতির অবস্থানে বাংলাদেশের কোনো উন্নতি না ঘটার প্রধান কারণ হলো দুর্নীতি দমনে রাজনৈতিক সদিচ্ছার অভাব। দেশে দুর্নীতি দমনের উদ্দেশ্য নিয়ে বিএনপি সরকার ২০০৪ সালে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) প্রতিষ্ঠা করলেও তারা সংস্থাটিকে পুরোপুরি কার্যকর করতে তেমন উৎসাহী ছিল না। তাছাড়া দলীয় স্বার্থরক্ষার জন্য এমনসব ব্যক্তিকে চেয়ারম্যান ও কমিশনার হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়, যারা বিএনপির আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী ছিলেন। ক্ষমতাসীন দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে চুপ করে থাকাকেই তারা শ্রেয় মনে করেন। চেয়ারম্যান ও একজন কমিশনারের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণে দুদকের কার্যক্রম অনেকটা মুখ থুবড়ে পড়েছিল।

নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনী ইশতেহারে আওয়ামী লীগ দুর্নীতি দমনে যেসব প্রতিশ্রুতি দেয়, সেগুলোর মধ্যে ছিল—ক. দুদকের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে শক্তিশালীকরণ; খ. দুর্নীতির বিরুদ্ধে যুদ্ধে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন; গ. ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ জমা প্রদান; ঘ. রাষ্ট্র ও সমাজের সব স্তরে ঘুস-দুর্নীতি উচ্ছেদ; অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, কালো টাকা ও পেশিশক্তি প্রতিরোধ ও নির্মূলে ব্যবস্থা গ্রহণ। দেখা যাক, এসব প্রতিশ্রুতি কতটা বাস্তবায়ন হয়েছে। 

২০০৯ সালের ১৪ অক্টোবর তৎকালীন দুদক চেয়ারম্যান কমিশনের প্রধান কার্যালয়ে তার নিজ প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে এক সংবাদ সম্মেলনে দুদককে দন্তহীন বাঘের সঙ্গে তুলনা করে বলেন, এখন থাবা থেকে নখগুলো কেটে দেয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ২০১৮ সালের সরকারি চাকরি আইনের ৪১(১) ধারায় বিধান করা হয়, কোনো সরকারি কর্মচারীর দায়িত্ব পালনের সঙ্গে সম্পর্কিত অভিযোগে দায়েরকৃত ফৌজদারি মামলায় আদালত কর্তৃক অভিযোগপত্র গৃহীত হওয়ার আগে তাকে গ্রেফতার করতে হলে সরকার বা নিয়োগকারী কর্তৃপক্ষের পূর্বানুমতি গ্রহণ করতে হবে। সরকারি চাকরি আইনের উপর্যুক্ত ধারাটি ‘সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান’-সংবিধানের ২৭ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় হাইকোর্ট তা বাতিল করে দেন। যতদূর জানা যায়, সরকার হাইকোর্টের এ বাতিল আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করেছে। দুদককে দুর্বল করার এটি আরেকটি চেষ্টা।

ক্ষমতাধরদের বার্ষিক সম্পদ বিবরণ জমা প্রদান সম্পর্কে উল্লেখ্য যে ২০০৯ সালের ৬ জুলাই তৎকালীন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের জানান, নবম সংসদ নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণের লক্ষ্যে মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সম্পদের বিবরণ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে জমা দেয়ার একটি খসড়া মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য পেশ করা হবে। পরের বছর এটি মন্ত্রিসভার অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হলে মন্ত্রীদের আপত্তির মুখে সম্পদের বিবরণী মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে দাখিলের দায় থেকে মন্ত্রীদের অব্যাহতি দেয়া হয় বলে সে সময় পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশ হয়।

অনুপার্জিত আয়, ঋণখেলাপি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি এখন কতটা বেড়েছে, গণমাধ্যমের খবর থেকে সহজে অনুধাবন করা যায়। নির্বাচনে, তা জাতীয় বা স্থানীয় সরকার যে পর্যায়েই হোক, চলছে কালো টাকার খেলা। রাজনৈতিক দলগুলোর, বিশেষ করে বড় দলগুলোর লক্ষ্য হলো যেকোনো উপায়ে, তা অগণতান্ত্রিকভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলকারী শক্তির সঙ্গে আঁতাত করে হোক বা নির্বাচনে কালো টাকা ও পেশিশক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভোট জালিয়াতি করে হোক, নির্বাচনে জয়লাভের মাধ্যমে সরকার গঠন করা। নির্বাচন কমিশন সময়ে সময়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীর জন্য যে ব্যয়সীমা নির্ধারণ করে দেয় তা না মেনে চলাই নিয়মে পরিণত হয়েছে। টিআইবি পরিচালিত এক জরিপ মতে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী প্রার্থীরা গড়ে কমিশন নির্ধারিত ব্যয়ের অধিক ৩০ লাখ টাকা ব্যয় করেন। জরিপ মোতাবেক এরূপ অতিরিক্ত ব্যয়ের সর্বোচ্চ পরিমাণ ছিল ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা। ৪০টি নিবন্ধিত দলের মধ্যে তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপিসহ ২৮টি দল দশম সংসদ নির্বাচন বর্জন করায় এবং শাসক দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থক গুটিকয়েক দলের অংশগ্রহণে অনুষ্ঠিত এ নির্বাচনে জাতীয় সংসদের মোট ৩০০ আসনে ১৫৪টি আসনে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। অবশিষ্ট আসনগুলো ভাগাভাগি করে সেগুলোয় ক্ষমতাসীন দল ও তাদের সমর্থক কয়েকটি দলের প্রার্থীদের মনোনয়ন দেয়া হয়। ফলে তাদের কালোটাকা ব্যবহারের দরকার হয়নি। ২০১৮ সালের একাদশ সংসদ নির্বাচনে মাঠের প্রধান বিরোধী দল বিএনপিসহ সব নিবন্ধিত দল অংশগ্রহণ করলেও ওই নির্বাচনেও তেমন কালো টাকার ব্যবহার প্রয়োজন হয়নি। তবে এ সময়কালে স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর নির্বাচনে কালোটাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেলে। একাদশ সংসদ নির্বাচনের পর যেসব স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানে নির্বাচন হচ্ছে, সেসব নির্বাচনেও কালো টাকা ও পেশিশক্তির ব্যবহার চলছে। কমিশন এ পর্যন্ত নির্বাচনে কালো টাকার ব্যবহার বন্ধে তেমন কার্যকর ব্যবস্থা নিতে পারেনি। 

বাংলাদেশের দুর্নীতি চক্রে সরকারি কর্মচারীদের ভূমিকা অত্যন্ত শক্তিশালী। এখানে সরকারি কর্মচারী বলতে প্রজাতন্ত্রের কর্মে বা কোনো করপোরেশন বা তার অধীন সেবা প্রদানকারী বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কর্মে নিযুক্ত ব্যক্তিকে বোঝাবে। প্রশ্ন হলো, সরকার সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা অনেক গুণ বাড়িয়ে দিলেও তারা সরকারি কর্মচারী বিধিমালার প্রতি অবজ্ঞা প্রদর্শন করে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়ছে কেন? এর অন্যতম কারণ সরকারি কর্মচারীদের দলীয়করণ। গত এক যুগে সরকারি কর্মচারীদের, বিশেষ করে প্রশাসনের সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মচারীদের বেশির ভাগ সরকারি আনুকূল্যে অপ্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা পেয়ে শাসক দলের অনুরক্ত হয়ে পড়েছেন। দলবাজ এসব সরকারি কর্মচারী হয়ে উঠেছেন দুর্নীতিবাজ। 

বেসরকারি খাত, বিশেষ করে ব্যবসায়ীরা দুর্নীতির জন্য কম দায়ী নয়। বেসরকারি খাত বিভিন্নভাবে দুর্নীতি করে। কর ফাঁকি দিতে অনেক ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান তাদের প্রকৃত সম্পদ ও লাভের পরিমাণ কর কর্মকর্তাদের দেখায় না। আমদানি-রফতানিতে আন্ডার ইনভয়েসিং ও ওভার ইনভয়েসিংয়ের মাধ্যমে কর ফাঁকি দেয়া একটি মামুলি ব্যাপার। 

রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং কর্মরত ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারীদের দুর্নীতির খবর মিডিয়ায় অহরহ প্রকাশ হচ্ছে। দুদক আইন বলে এসব অভিযোগ অনুসন্ধান ও তদন্তে দুদক ক্ষমতাপ্রাপ্ত (ধারা ১৭)। কানাডা ও দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের অবৈধভাবে বাড়ি কেনাসহ সম্পদ গড়ে তোলার খবর মিডিয়ায় গুরুত্বসহ প্রকাশ হচ্ছে। সম্প্রতি খবর প্রকাশিত হয়েছে, একজন সংসদ সদস্য যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে ৪০ লাখ ডলার ব্যয়ে একাধিক বাড়ি কিনেছেন। এসব অভিযোগের তদন্ত হবে কি? তারা মূলত রাজনীতিক, ব্যবসায়ী এবং ক্ষমতাসীন দলের আদর্শ ও ভাবধারায় বিশ্বাসী কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী। এরা রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত শক্তিশালী। দুদকের বিরুদ্ধে একটি অভিযোগ হলো, সংস্থাটি ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ায় নমনীয়। কিছুদিন আগে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) পরিচালিত এক গবেষণাপত্রে অভিযোগ করা হয়েছে, দুদক বিরোধী দলের রাজনীতিকদের হয়রানি এবং ক্ষমতাসীন দল ও জোটের রাজনীতিকদের প্রতি নমনীয়তা প্রদর্শনের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। গবেষণাপত্রে আরো উল্লেখ করা হয়েছে, দুদকের কার্যক্রম ও ক্ষমতার অপব্যবহারের কারণে এর স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।

উল্লিখিত বর্ণনার মাধ্যমে যা বলতে চাওয়া হয়েছে তা হলো, দুর্নীতি হ্রাসে সরকারকে কঠোর ভূমিকায় নিতে হবে। দুর্নীতিবাজ, তিনি যে পেশার বা যে রাজনৈতিক দলেরই হোন, তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পিছপা হওয়া যাবে না। দুর্নীতি হ্রাসের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ দেশগুলোর সারি থেকে বের হয়ে আসতে পারলে বিশ্বদরবারে বাংলাদেশের সম্মান অনেক গুণ বৃদ্ধি পাবে। জনগণ দেশের এমন সম্মানজনক অবস্থান দেখতে আগ্রহী। 

মো. আবদুল লতিফ মন্ডল: সাবেক সচিব

আরও