অর্থনীতির নিরাময়

আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের ব্যাংক খাতের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যাবে

আমাদের ব্যাংক খাত একটা কঠিন চড়াই-উতরাই পার হচ্ছে। ১০-১৫ বছর ধরে এ সেক্টরে অনিয়ম, অরাজকতা আর দুর্নীতির জোয়ার চলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সেই জোয়ার সুনামিতে পরিণত

আমাদের ব্যাংক খাত একটা কঠিন চড়াই-উতরাই পার হচ্ছে। ১০-১৫ বছর ধরে এ সেক্টরে অনিয়ম, অরাজকতা আর দুর্নীতির জোয়ার চলেছে। বিশেষ করে গত কয়েক বছরে সেই জোয়ার সুনামিতে পরিণত হয়েছিল। সেজন্য আজকে আমাদের ব্যাংক সেক্টর অনেক নাজুক এবং অনেক দুর্বল। আর ব্যাংক সেক্টরটা আমাদের দেশের জন্য কতটুকু গুরুত্বপূর্ণ সেটা আপনারা সবাই জানেন। আমার পূর্ববর্তী বক্তা যেটা বললেন যে যেহেতু আমাদের পুঁজিবাজার অনেকটা অকার্যকর অবস্থায় আছে সেজন্য আমাদের ব্যাংক সেক্টর আরো গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কেননা এটা ছাড়া এ দেশে কোনো অর্থায়নই হয় না। তো আশার কথা হলো, এ সুনামি প্রতিরোধ করা হয়েছে, থামানো হয়েছে। আমি মনে করি যে আমরা খুব দক্ষ, নিরপেক্ষ ও সৎ একজন গভর্নর পেয়েছি। এতে আস্তে আস্তে এখানে অনেকটা স্বস্তি ফিরে আসছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে যেসব সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করা হয়েছে যেমন সুদহার, বিনিময় হার সম্পর্কিত নীতিমালা প্রভৃতি গ্রহণ করা হয়েছে তা আশা জাগাচ্ছে। আবার এটাও সত্য এতে অনেকেই খুশি না। কারণ আমাদের দেশে সবাই স্বীয় স্বার্থ উদ্ধার করতে চায়। এজন্য তারা এসবের ওপর নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চায়। এজন্য প্রথমেই আমাদের এ স্বার্থগোষ্ঠী দ্বারা নিয়ন্ত্রিত অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে, অর্থনীতিকে বাজারভিত্তিক অর্থনীতি হতে হবে। এরই মধ্যে আমাদের বিনিময় হারে, ব্যালান্স অব পেমেন্ট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্থিতিশীলতা এসেছে সেটা কিন্তু এই দুই-তিন মাসের মধ্যেই এসেছে। এখন আমাদের রেমিট্যান্স যে এত বাড়ছে এবং প্রায় ৩৫-৪০ শতাংশ বার্ষিক প্রবৃদ্ধি হয়েছে এগুলো সঠিক সামষ্টিক অর্থনীতির নীতিমালা যথাযথ সময়ে প্রণয়নের জন্য।

বিভিন্ন আলোচকদের থেকে যেটা শুনেছি গত ১৫ বছরে যে প্রবৃদ্ধি হয়েছে তা ছিল অত্যন্ত অসামঞ্জস্যপূর্ণ ও বৈষম্যমূলক। সম্পদ পুঞ্জীভূত ছিল মুষ্টিমেয় কিছু মানুষের হাতে—এরা ছিল কিছু ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, আমলা, আইন রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য। গত ১৫ বছরে দেশের অর্থনীতি ও সম্পদের অধিকাংশই সঠিক পদ্ধতিতে বণ্টিত হয়নি, যে কারণে দিনে দিনে বৈষম্য প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ কারণেই বাংলাদেশে অনেক বিলিয়নেয়ার আছে, কিন্তু জনগণ এত দরিদ্র। এসব বৈষম্য, পুঞ্জীভূত ক্ষোভ থেকে মানুষ এ রকম আন্দোলন করেছে।

এই যে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল, তা হয়েছিল অনেকটা সম্প্রসারণমূলক আর্থিক ও মুদ্রানীতির কারণে। আমরা আমাদের ডলারের বিনিময় হার ৮৫ তে অনেকদিন বেঁধে রাখলাম। যেখানে প্রতি বছর ৫-৬ শতাংশ করে তা অবমূল্যায়ন করা উচিত ছিল। যে কারণে হঠাৎ করেই ১২ থেকে ১৮ মাসের মধ্যে প্রায় ৪০ শতাংশ অবমূল্যায়ন হয়ে গেছে। আজ যদি দেখি তাহলে ডলারের বিনিময় মূল্য ১২০-১২১ টাকায় দাঁড়িয়েছে। দুই বছর আগেও তা ৮৫ ছিল। স্পষ্টত সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় ভুল নীতি গ্রহণ করা হয়েছিল। আপনাদের হয়তো মনে থাকবে, এক জ্যেষ্ঠ সরকারি কর্মকর্তা বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বিশ্বে অনন্য, তাই তার পলিসিও অনন্য। এ রকম পলিসি বাংলাদেশের জন্যই বিশেষভাবে প্রণীত হয়েছে।’ কিন্তু আসলে কি তাই? পৃথিবীর সব দেশ, সব অর্থনীতিকেই মৌলিক কিছু নীতি অনুসরণ করতে হয়। কোনো দেশের জন্য আলাদা করে পলিসি প্রণয়ন করা যায় না।

এখন অনেকেই অভিযোগ করছেন, বিশেষ করে আমাদের ব্যবসায়ীরা যে এখন সুদহার বেড়ে গেছে। তারা মনে করছেন যে সুদহারটা নামিয়ে রাখা দরকার, যাতে তারা তাদের ব্যবসাটা বাড়াতে পারে। শ্রীলংকার দিকে তাকান, তাহলে দেখবেন গত দুই বছরে তারা সুদহার কীভাবে নিয়ন্ত্রণে রেখে মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরেছে। সুতরাং মূল্যস্ফীতিকে কমানোর জন্য কিছুটা সময় তো লাগবেই।

আমি মনে করি আমাদের সামনে সব দারুণ সুযোগ রয়েছে। একটু আগেই আমাদের ডিএসইর চেয়ারম্যান যেটা বললেন একটা সুযোগ এসেছে আমাদের, আর ভবিষ্যৎ নিয়ে আমি ব্যক্তিগতভাবে খুব আশাবাদী। আমি মনে করি যে এই যে আমরা আমাদের দেশে পুঁজিবাদের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে থাকা দুরারোগ্য দুর্নীতিকে বন্ধ করেছি, আগামীতে সুশাসনের ঢেউ আসবে বাংলাদেশে। এরই মধ্যে এসেছে এবং তাতে ভালো মানুষ, ভালো প্রতিষ্ঠান উঠে আসবে। আগামী চার-পাঁচ বছরের মধ্যে আমাদের ব্যাংক খাতের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যাবে। আমি বিশ্বাস করি, ৬০টি ব্যাংক বাংলাদেশে থাকার কোনো প্রয়োজন নেই এবং থাকবেও না। এতগুলো ব্যাংক চালু রাখার মতো লোকবল, কারিগরি জ্ঞান ও সক্ষমতা যেমন আমাদের নেই, তেমনি সেই পুঁজিও আমাদের নেই। কাজেই আমরা যেটা মনে করি যে আমাদের ব্যাংক সেক্টরে আগামীতে যে সংস্কারগুলো আসছে তার মাধ্যমে অনেক দূর এগিয়ে যাবে। অবশ্য প্রথম যে কাজটা সেটা হলো আমাদের দশ-বারোটা ব্যাংকের যে তারল্য সংকট এবং যে চ্যালেঞ্জগুলো রয়েছে সেগুলোকে ঠেকিয়ে রাখা দরকার।

আমি মনে করি যে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংক মাননীয় গভর্নর জাদু করেছেন যে কীভাবে এটা এখনো ম্যানেজ করে রেখেছেন। আমরা ব্যাংকার কিন্তু আমরা নিজেরাই বুঝতে পারি না যে কীভাবে উনি মানুষের আস্থা টিকিয়ে রেখেছেন। আমাদের দেশে এখনো যে ব্যাংক সেক্টর টিকে আছে এবং সব গ্রাহককে সাপোর্ট করছি, আমি মনে করি যে এটার অসাধারণ কৃতিত্ব আমাদের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের। সুতরাং প্রথম অভীষ্ট হলো এ তারল্যকে ধরে রাখা, যাতে কোনো ব্যাংক উল্টে না পড়ে যায়। কারণ আমরা কোনো পশ্চিমা বিশ্বের উন্নত দেশ নই যে ব্যাংকগুলোকে আমরা দেউলিয়া হিসেবে ছেড়ে দিতে পারব। এটা আমাদের দেশে সম্ভব নয়, কারণ আমাদের সামাজিক প্রেক্ষাপটও আলাদা। দ্বিতীয়টা হলো ব্যাংক খাতের ক্ষতটা বা সমস্যাটা আসলে কত বড় আমাদের সেটা উদঘাটন করতে হবে। সম্পূর্ণটা বা বিস্তারিত না জানলেও আমরা শুনেছি যে বাংলাদেশ ব্যাংক সংস্কারের জন্য কিছু কিছু টাস্কফোর্স তৈরি করে কাজ করে যাচ্ছে। যার ফলাফল আশা করি আমরা দুই-তিন মাস বা চার মাসের মধ্যে তখন আমরা বুঝতে পারব যে এ গ্যাপের গভীরতা কত বড়। এটা যে বিশাল বড় হবে সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। একই সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশ ব্যাংকের যে নিয়ন্ত্রণ/ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি ও সক্ষমতা আছে এটা বদলাতে হবে, কারণ যা আছে তা খুবই অপ্রতুল ও অকার্যকর। আমরা মনে করি যে বাংলাদেশ ব্যাংককে সম্পূর্ণ স্বাধীন করতে হবে এবং এটিকে যেকোনো সরকারি ও রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের বাইরে রাখার বিধান করতে হবে। এটা হলো অত্যাবশ্যকীয় শর্ত।

আমরা অনেকেই, বিশেষ করে ব্যাংক সেক্টরে আমরা যারা আছি তারা বিশ্বাস করি যে গভর্নরের পদকে সাংবিধানিক হতে হবে। আরেকটা অভীষ্ট হওয়া উচিত আমরা কীভাবে বিগত ১৫ বছরে পাচারকৃত ১০০ থেকে ১৫০ বিলিয়ন ডলার ফেরত আনতে পারি, যা আমাদের ব্যাংক সেক্টরকে সর্বোপরি দেশকে লুণ্ঠন করে দেশের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এটাকে ফেরত আনা খুবই কঠিন কাজ। বহু দেশ ও কর্তৃপক্ষের সঙ্গে মিলে সমন্বয় করে কাজটি করতে হবে। এটা কোনো সহজ কিছু না। আমরা আশা করি সেখানেও তারা কাজ করবে। শেষে আমি একটা কথা শুধু বলব, ব্যাংক খাত সংস্কারে টাস্কফোর্স গঠন করে যে গুরুদায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক হাতে নিয়েছে তাতে যেন এ খাতের যারা সরাসরি যুক্ত আছেন তাদেরও সম্পৃক্ত করা হয়। আমাদের অনুরোধ ও সুপারিশ থাকবে গভর্নর মহোদয়ের কাছে যে আমাদের সঙ্গে রেখে কাজটি তিনি করবেন। এতে আমি মনে করি আমরা অনেক প্রায়োগিক ও মূল্যবান প্রতিক্রিয়া, পরামর্শ দিতে পারব। কারণ আমরা এ খাতে কাজ করছি এবং এখানকার বাস্তবতা সম্পর্কে আমরা সবচেয়ে ভালো ধারণা রাখি। যেমন আপনারা দেখছেন বাংলাদেশে ১০-১২টা ব্যাংক খুব খারাপ করছে, তেমনি আমাদের অনেক ব্যাংক কিন্তু ভালো করছে। এটা মনে রাখা দরকার যে অনেক ভালো ব্যাংকারও বাংলাদেশে আছেন। আমরা আশা করব বাংলাদেশ ব্যাংকের সংস্কার উদ্যোগের সঙ্গে তাদের রেখে তাদের সক্ষমতা, অভিজ্ঞতাকে কাজে নিয়ে পুরো ব্যাংক সেক্টরকে সংস্কার করা হবে তাহলেই সামনে এগিয়ে নিয়ে যাওয়াটা অনেক সহজ হবে।

সেলিম আর এফ হোসেন: চেয়ারম্যান, এবিবি; এমডি ও সিইও ব্র্যাক ব্যাংক

[১১ নভেম্বর বণিক বার্তা আয়োজিত ‘বৈষম্য, আর্থিক অপরাধ ও বাংলাদেশের অর্থনীতির নিরাময়’ শীর্ষক তৃতীয় বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সম্মেলন ২০২৪-এ প্যানেল আলোচকের বক্তব্য]

আরও