অভিমত

দেশব্যাপী ভয়াবহ রূপ নিয়েছে ডেঙ্গু

ডেঙ্গু এখন শহরের রোগ নয়। ডেঙ্গু এখন দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে ডেঙ্গু এখন শুধুই ঋতুনির্ভর রোগ নয়। সারা বছরের রোগ। এ থেকে সুস্পষ্ট, দেশময় সারা বছর আমাদের প্রাণ ঝরাতে যে রোগটি বিস্তার লাভ করছে তা দমনে কতটা সচেতনতা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোয় ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ দিয়ে ডেঙ্গু দমনের চেষ্টা করার ফলাফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। কথায় আছে, ডেঙ্গু

ডেঙ্গু এখন শহরের রোগ নয়। ডেঙ্গু এখন দেশময় ছড়িয়ে পড়েছে। একইভাবে ডেঙ্গু এখন শুধুই ঋতুনির্ভর রোগ নয়। সারা বছরের রোগ। এ থেকে সুস্পষ্ট, দেশময় সারা বছর আমাদের প্রাণ ঝরাতে যে রোগটি বিস্তার লাভ করছে তা দমনে কতটা সচেতনতা প্রয়োজন। বিগত বছরগুলোয় ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’ দিয়ে ডেঙ্গু দমনের চেষ্টা করার ফলাফল এখন হাড়ে হাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। কথায় আছে, ডেঙ্গু একবার যখন কোনো রাজ্যে বা রাষ্ট্রে প্রবেশ করে তখন তাকে আর বের করা যায় না, দমন করে রাখতে হয়। কিন্তু দমন পদ্ধতি যদি যথাযথ না হয়, দমনের নামে যদি শুধুই পিলো পাস খেলা হয় তাহলে দমনের সুযোগে বর্ধন ত্বরান্বিত হয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন ও ডেঙ্গুর চিকিৎসা দুটি বিষয় ভিন্ন। তবে দুটি বিষয়কে একসূত্রে গেঁথে কাজ না করে দোষারোপের আড়ালে নিজের পিঠ বাঁচানোর তালে কখন যে ডেঙ্গু দেশব্যাপী বিস্তার লাভ করেছে এবং সব শ্রেণী-পেশার মানুষের আশঙ্কার কারণে রূপান্তর হয়েছে তা এখন ক্রমেই স্পষ্ট হচ্ছে। বিগত স্বৈরশাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট হয়ে সাধারণ মানুষ যেমন দিশেহারা ছিল। বিপরীতে মানুষের প্রাণঘাতী শত্রু এডিস মশা তার বংশ বিস্তার করে মানেুষর শরীরে ডেঙ্গুর ভাইরাস ছড়িয়ে চলেছে। ২০২৩ সাল ছিল এ ভয়াবহতার চরম অবস্থা, যার রেশ ২০২৪ সালের মে মাস পর্যন্ত বীভৎস আকারে ছিল। গত মে-জুনে একটু স্বস্তি থাকলেও জুলাইয়ে আবার তাণ্ডবলীলা শুরু হয়েছে। মোট আক্রান্ত ২৫ হাজার ৭০১ জনের মধ্যে শুধু ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত আক্রান্ত ১২ হাজার ৮৬০ জন। মোট ১৩৬ জন মৃত্যুর মধ্যে ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মৃত্যু ৫৩ জন। আক্রান্ত ও মৃতের সংখ্যা বিশ্লেষণে দেখা যায়, সর্বোচ্চ আক্রান্ত ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন এবং এর পরিমাণ ২৪ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৬ হাজার ১৫০ জন। একইভাবে সর্বোচ্চ মৃত্যুহারও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে, যা মোট মৃত্যুর ৫২ শতাংশ। এ পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে, স্বৈরাচারী ফ্যাসিজম শুধুই প্রশাসনে নয়, মশক উৎপাদনে কত ভয়ংকর পরিণতি বয়ে আনতে পারে। আমি অনেকবার চেষ্টা করেছি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মশক দমনে সব কার্যক্রম পরিচালনার পরার্মশ প্রদানের। কিন্তু সবসময়ই ব্যর্থতার গ্লানি নিয়ে ভগ্ন মনোরথ হয়ে ফিরতে হয়েছে। মশক দমন পদ্ধতি কখনই যেমন একক কোনো পদ্ধতি নয়, তেমনি কখনই একক কোনো মানুষের সিদ্ধান্ত জোর করে প্রয়োগের ব্যাপার নয়। এ দমন পদ্ধতি হলো বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে সব অংশীজনের সমন্বিত পরামর্শের প্রায়োগিক ব্যাপার। বিশ্বের সব দেশে মশাবাহিত রোগগুলো সফলভাবে দমনে সক্ষম দেশগুলোর প্রায়োগিক দিক বিশ্লেষণে আমাদের দেশের পারিপার্শ্বিক উপাদানের ভিত্তিতে কতটা ফিজিবল তা অবশ্যই বিশেষজ্ঞ দল কর্তৃক অনুমোদন সাপেক্ষে প্রয়োগ করা প্রয়োজন। এর ব্যত্যয় হলে অবশ্যই বিপরীত ফল দেবে। যেকোনো জনগুরুত্বপূর্ণ রোগের ক্ষেত্রে এপিডেমিওলজিক্যাল স্টাডির যথাযথ বিশ্লেষণেই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। সেক্ষেত্রে অবশ্যই সঠিক পরিসংখ্যানভিত্তিক তথ্য উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার ঘনত্ব এবং এর সঙ্গে ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাবের সঠিক সম্পর্ক নিরূপণ নিশ্চিত করতে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সহায়তা প্রয়োজন। পাশাপাশি মশক দমন পদ্ধতির কার্যকারিতা, ডেঙ্গু চিকিৎসার উন্নয়ন প্রভৃতি বিষয়ে যখন সঠিক গবেষণাভিত্তিক তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করা সম্ভব হবে, তখনই একটি সঠিক প্রায়োগিক পদ্ধতি নির্বাচন সম্ভব হবে। একই সঙ্গে যুক্ত হতে হবে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সদিচ্ছা। আমাদের নগরপিতার কাউন্সিলররা সাধারণ জনগণের প্রতিনিধি। সাধারণ মানুষের কিসে মঙ্গল তা-ই হবে তাদের মূল আরাধ্য বিষয়। ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশা দমন করে প্রাণঘাতী ডেঙ্গু থেকে সাধারণ মানুষকে রক্ষা করার ব্রত নিয়েই তারা জনসেবায় নামেন। কিন্তু বাস্তবতা বড়ই নির্মম। আমাদের দেশে সরকারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক যতগুলো প্রতিষ্ঠান কাজ করে, যেমন বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা, ইউনিসেফ, ইউএনডিপি, ইউনেস্কো, ফুড অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল অর্গানাইজেশন, ইউএসএআইডি প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানেরও একটি নিজস্ব পলিসি রয়েছে। সেই পলিসির সঙ্গে আমাদের পলিসির সমন্বয় ঘটাতে হলে অবশ্যই গবেষণালব্ধ ফলাফলের ব্যাপকতা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। দেশের যতগুলো গবেষণা ও শিক্ষাসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান আছে, বিশেষ করে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক শিক্ষা ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠান যেমন জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসাপ্রতিষ্ঠান নিপসম, এমন জনগুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হওয়া প্রয়োজন। এর মাধ্যমে একদিকে যেমন গুণগত মানসম্পন্ন জনস্বাস্থ্যবিদ তৈরি হবে, তেমনি গ্লোবালাইজড বিশ্বে প্রগতিশীল উদ্ভাবনের যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিত সম্ভব। একইভাবে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণাপ্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে আন্তঃসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এতে জ্ঞান-বিজ্ঞানচর্চা ও গবেষণার বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির মাধ্যমে সঠিক সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে। এছাড়া গবেষণার পরিধি ও বাজেটও বাড়াতে হবে। আমাদের দেশের স্বাস্থ্য খাতে যে বাজেট তৈরি হয় তার সঠিক ও সফল ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। আজ জনস্বাস্থ্য উপেক্ষিত হয়েছে সঠিকভাবে জ্ঞানচর্চার মাধ্যমে গবেষণালদ্ধ ফলাফলের সঠিক বিস্তার ও প্রয়োগের অভাবে। জনস্বাস্থ্য শুধু চিকিৎসাশাস্ত্রের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি একটি কমপ্রিহেনসিভ কনসেপ্ট, যা সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার স্বাস্থ্যকে সুস্থ রাখার সব শাখা-প্রশাখার সমন্বিত একটি বিষয়। এর সঙ্গে জড়িত মানুষের বসতবাড়ির অবস্থা। অর্থাৎ সমাজবিজ্ঞান থেকে শুরু করে পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবেশবিজ্ঞান পরিবেশের মধ্যে অবস্থিত বিভিন্ন রোগ-জীবাণুর বাহকের উপস্থিতি ও ঘনত্ব তথা এন্টোমোলজি এবং সেই বাহক কর্তৃক বাহিত রোগ সৃষ্টিকারী জীবাণু—ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া, প্যারাসাইট প্রভৃতিসংবলিত বিজ্ঞান বা মাইক্রোবায়োলজি, মাইক্রোলজি, প্যারাসাইটোলজি, পপুলেশন ডায়নামিকস, অ্যানথ্রোপোলজি, বায়োস্ট্যাটিসটিকস প্রভৃতি। তাই চিকিৎসাশাস্ত্রের সঙ্গে এতগুলো বিষয়ের চমৎকার সমন্বয়ই জনস্বাস্থ্য, যা জনগণের সুস্বাস্থ্যের নিশ্চয়তা দেয়। জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নের সঙ্গে সুচিকিৎসার জন্য জনবল ও অবকাঠামোর উন্নয়নই হলো স্বাস্থ্যের উন্নয়ন। এ ধারাবাহিকতা সুসংহত করাই স্বাস্থ্য খাতের মূল উদ্দেশ্য। একজন পুষ্টিহীন মানুষ কখনই সঠিক ইমিউনিটির অধিকারী হতে পারে না। একজন মানুষ দূষিত ও অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে থেকে যত ওষুধই সেবন করুক, অ্যাজমা বা নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত রোগী সুস্থ থাকতে পারে না। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে ডেঙ্গুর বাহক এডিস মশার প্রজননস্থল বাড়িয়ে কখনই একজন মানুষ ডেঙ্গুর হাত থেকে রক্ষা পেতে পারে না। তাই দেশময় এ ভয়াবহ পরিস্থিতিতে সবাইকে একসঙ্গে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। আসুন পরিবেশ পরিচ্ছন্ন রেখে, এডিস মশার প্রজননস্থল ধ্বংস করে নির্মল পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের সংরক্ষণ করি।

ড. মো. গোলাম ছারোয়ার: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, কীটতত্ত্ব বিভাগ, জাতীয় প্রতিষেধক ও সামাজিক চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান (নিপসম)

আরও