আজকের মূল প্রবন্ধ উপস্থাপক ড. মোয়াজ্জেম সাহেবের পেপারটা পড়েছি। সেখানে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক তুলে ধরা হয়েছে, যেগুলোর সঙ্গে আমি একমত। তবে কিছু বিষয়ে ভিন্নমতও রয়েছে, যা আমি এখানে ব্যাখ্যা করতে চাই।
প্রথমত, কিছু ডাটা প্যাটার্নের মাধ্যমে ড. মোয়াজ্জেম দেখিয়েছেন, আন্তর্জাতিক বাজারের দামের প্রবণতা এবং দেশের বাজারে দামের ওঠানামার মধ্যে সাধারণত সামঞ্জস্য থাকে। কিন্তু আপনারা খেয়াল করলে দেখবেন প্যাটার্ন একই রকম হলেও বেশ ব্যবধান রয়েছে আন্তর্জাতিক বাজার ও স্থানীয় বাজারের মধ্যে। এ ফারাকটা কিছুটা বিস্তৃত হয়েছে; বিশেষ করে ২০২০ সালের পর থেকে। সেটা আমরা যেকোনো পণ্যের বেলাতেই দেখতে পাচ্ছি। হোক সেটা ভোজ্যতেল, সয়াবিন কিংবা ভুট্টা। এ ফারাকটা বাড়ার কারণের মধ্যে রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট, মুদ্রার অবমূল্যায়ন, বিনিময় হারের পরিবর্তন। মূল্যস্ফীতি কেন হচ্ছে এটা সবার প্রশ্ন। মনে রাখতে হবে, মূল্যস্ফীতি কিন্তু কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ড্যাশবোর্ডের বিষয় হতে পারে না। এর সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব রয়েছে। আমরা দেখছি, মূল্যস্ফীতির ফলে মাথাপিছু পুষ্টিহার কমেছে।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, মধ্যবিত্তের ৮ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের ৩৬ শতাংশ পুষ্টিহীনতার কারণে খর্বাকায় হচ্ছে। আমরা এ বিষয়গুলো আমলে নিয়ে কাজ করতে চাই।
বর্তমানে মুদ্রানীতি নিয়ন্ত্রণে সুদের হার বাড়ানো হয়েছে, কিন্তু এতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসেনি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভও বাড়েনি। আমাদের পর্যবেক্ষণ বলছে, সুদ হার বাড়লেও বাজারে পণ্যমূল্য স্থিতিশীল হয়নি, বরং বিনিয়োগের গতি কমে গেছে। ফলে এটি কার্যকর নীতি কিনা তা পুনর্মূল্যায়ন করা প্রয়োজন।
সরবরাহ ব্যবস্থাপনায় কর বৃদ্ধির পরিকল্পনা করা হচ্ছে, যা বাজারে আরো সংকট তৈরি করতে পারে। করের হার না বাড়িয়ে কর ব্যবস্থার আওতা বাড়ানো উচিত। বিশেষ করে পণ্য ও পরিষেবার ওপর কর কাঠামো পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন, যাতে এটি ব্যবসায়ীদের জন্য সহনীয় হয় এবং ভোক্তাদের ওপর অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি না করে।
মোয়াজ্জেম ভাই যে প্রস্তাব দিয়েছেন—মূল্যশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে বাজারের তথ্য ডিজিটাল পদ্ধতিতে সংরক্ষণ ও বিশ্লেষণ করা উচিত—এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে হলে প্রতিটি স্তরের তথ্য যথাযথভাবে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করতে হবে।
মূল্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি না করে বাস্তবসম্মত নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। বাজারের প্রতিটি পর্যায়ে পণ্যের প্রকৃত ব্যয় কত, মুনাফা কত, তা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ অযৌক্তিকভাবে মূল্য বাড়াতে না পারে।
আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে, কৃষি খাতে উৎপাদন খরচ কমানো গেলে বাজারে ন্যায্যমূল্য বজায় রাখা সম্ভব। ধান উৎপাদনে প্রতি বছর উল্লেখযোগ্য ব্যয় শুধু ফসল সংগ্রহ ও সংরক্ষণে ব্যয় হয়, যা আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের মাধ্যমে কমানো যেতে পারে।
দেশে খাদ্যশস্য আমদানির পরিমাণ বিশাল, যা সঠিক ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে বাজারে ভারসাম্য রাখতে পারে। তবে বাস্তবে দেখা যায়, বাজারে কিছু অংশের নিয়ন্ত্রণ একশ্রেণীর ব্যবসায়ীর হাতে রয়ে গেছে, যারা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে অধিক মুনাফা নিচ্ছে। খুচরা পর্যায়ে এ ধরনের অনিয়ম নিয়ন্ত্রণে আনতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।
সরকার যদি মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা আনতে চায়, তাহলে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যকে উৎসাহিত করতে হবে। বিশ্বব্যাপী অনেক দেশে আনুষ্ঠানিক খাতের গুরুত্ব বাড়ানো হয়েছে, যেখানে আমাদের দেশে এখনো অনানুষ্ঠানিক বাণিজ্যের আধিক্য রয়েছে।
বর্তমানে আনুষ্ঠানিক বাণিজ্যে যে পরিমাণ কর আরোপ করা হয়েছে, তা ব্যবসায়ীদের জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করছে। বাজার ব্যবস্থায় স্থিতিশীলতা আনতে হলে কর ব্যবস্থাপনা সহজ করতে হবে, বাণিজ্যের ডিজিটাল পদ্ধতি উন্নত করতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে হবে।
আমরা যদি এ নীতিগুলো বাস্তবায়ন করতে পারি, তাহলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে, বাজারে স্বচ্ছতা আসবে এবং অর্থনীতি কাঙ্ক্ষিত গতিতে এগিয়ে যাবে।
সাব্বির হাসান নাসির: ব্যবস্থাপনা পরিচালক এসিআই লজিস্টিকস লি. (স্বপ্ন)
[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে প্যানেল আলোচকের বক্তব্যে]