আলোকপাত

ডিজিটাল ইকোনমিতে বাংলাদেশের সম্ভাবনার জায়গা

নতুন বছরে নতুন সরকারের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবশ্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সুসংহত করা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ব্যাংকগুলোকে ঠিক করা। সরকারের ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা আছে, অনেক দিন ধরেই তারা বলে আসছে। এখন তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া হবে। যদি পুরনো পথে আমরা এগোতে চাই তাহলে কিন্তু হবে না। একটা চ্যালেঞ্জ

নতুন বছরে নতুন সরকারের সামনে অনেকগুলো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। অবশ্য প্রথম চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ সুসংহত করা। দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ ব্যাংকগুলোকে ঠিক করা। সরকারের ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনা আছে, অনেক দিন ধরেই তারা বলে আসছে। এখন তাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ কীভাবে পরের ধাপে নিয়ে যাওয়া হবে। যদি পুরনো পথে আমরা এগোতে চাই তাহলে কিন্তু হবে না। একটা চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভবিষ্যৎমুখী পরিকল্পনার আর আরেকটা হচ্ছে সমস্যা কাটানোর; বিদ্যমান চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার।

সরকার বলছে, তারা ডিজিটাল ইকোনমি করবে কিন্তু এর পথে কী কী কাজ করা দরকার তা চিহ্নিত হয়নি। আমরা এর দিকে যদি তাকাই তাহলে দেখব আমাদের ডিজিটাল কানেক্টিভিটি তৈরি হয়েছে কিন্তু ইকোনমি দাঁড়ায়নি। ডিজিটাল ইকোনমি তৈরি করা হবে আমাদের প্রধান কাজ। দেশে এর মাধ্যমে এমন সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে যেন মানুষ ঘরে বসে পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের কাজ সম্পন্ন করতে পারে। এ কারণে আমাদের ডিজিটাল ইকোনমি ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ আগামী ১০ বছরে আমাদের জন্য এখনকার তুলনায় আরো বেশি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হবে। সামনের দিনগুলোয় বিশ্ববাজারে অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা হ্রাস পাবে। ফলে আমাদের রেমিট্যান্সও হুমকিতে পড়বে। এছাড়া রফতানিও হুমকিতে পড়ার সম্ভাবনা রয়েছে বিভিন্ন ভূ-রাজনৈতিক কারণে। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নীতি কীভাবে পরিচালনা করব সেটা ভাবতে হবে। তাই আমার মতামত, ডিজিটাল ইকোনমিতে নিজেদের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে। আমাদের রক্ষণশীল নীতি এক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। আমরা যদি উদার হই তাহলে অ্যামাজন, গুগলের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে বিনিয়োগ করবে। হয়তো তারা তাদের সার্ভার এবং সাবসিডিয়ারি বিভিন্ন ব্যবসা এখানে স্থানান্তর করবে। উন্নত দেশগুলোয় উচ্চ শুল্কহার ও উচ্চ মজুরির কারণে বাংলাদেশের মতো দেশ বিভিন্ন কোম্পানির কাছে আকর্ষণীয় গন্তব্য হতে পারে। 

আমাদের দেশে যে অর্থনৈতিক নীতিমালা রয়েছে তা বেশ কঠিন। চীন ও ভারতের মতো অনেক দেশ এ রকম রক্ষণশীল নীতি অনুসরণ করে। ছোট দেশ হিসেবে আমাদের এ রকম রক্ষণশীল হলে চলবে না। আমরা যদি একটু উদার হই তাহলে সিঙ্গাপুরকেও চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারব। আমরা কিন্তু বারবার সিঙ্গাপুর মডেলকে সামনে আনি। মনে রাখতে হবে আমরা সিঙ্গাপুর মডেলে বড় হতে পারব না, তবে সিঙ্গাপুরের চেয়েও বড় অর্থনীতি হতে পারব। 

বাংলাদেশের সবচেয়ে সুবিধার দিক হলো এটা চীন থেকে ২ ঘণ্টার ফ্লাইটের দূরত্বে, ভারতের দিল্লি ও থাইল্যান্ডের ব্যাংকক থেকেও ২ ঘন্টার দূরত্বে। গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক কেন্দ্রগুলো থেকে এ রকম সুবিধাজনক অবস্থানে থাকা এ রকম দেশ আপনি কোথাও পাবেন না। আগামী কয়েক দশকের কথা চিন্তা করলে আমরা দেখব সবচেয়ে সম্ভাবনাময় অর্থনৈতিক অঞ্চল চীন, ভারত ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। আমরা এ রকম একটি গ্রোথ সেন্টারের মাঝখানে আছি। এ সুবিধা কাজে লাগাতে আমরা কতটুকু আন্তরিক সেটা হচ্ছে বড় চ্যালেঞ্জ। আমরা সহজেই এ অঞ্চলের সার্ভিস সেন্টার হতে পারি। 

এশিয়া, বিশেষত চীন ও ভারতের মতো বিশাল বাজারে সবাই প্রবেশ করতে উন্মুখ। ভারতের রেগুলেটরি কাঠামো অনেক জটিল হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠানই সেখানে কার্যালয় বা হাব বানাতে চাচ্ছে না। আবার চীনে কমিউনিস্ট পার্টি নেতৃত্বাধীন সরকারের কারণে অনেকে সে মুখো হতে চায় না। বাংলাদেশ ইচ্ছা করলে একটা হাব হতে পারত কিন্তু আমাদের বড় সমস্যা নতুন যুগের সেসব উদ্যোগের জন্য আমাদের কোনো রেগুলেশনই নেই। আমরা যদি ডিজিটাল ইকোনমির যথাযথ রেগুলেশন তৈরি করতে পারি তাহলে সব হাব এখানে চলে আসবে। তারা বাংলাদেশে বসেই ভারত ও চীনের বাজারের চাহিদা পূরণ করবে। এটা তৈরিতে বাংলাদেশের অনেক সংস্কার পদক্ষেপ নিতে হবে। আমাদের ইমিগ্রেশন নীতিমালা পাল্টাতে হবে যাতে সহজে বাইরের লোক এসে কাজ করতে পারে। ডিজিটাল ও ফরেন এক্সচেঞ্জ নীতিমালাও পাল্টাতে হবে। আমাদের এখনকার ফরেন এক্সচেঞ্জ নীতিমালা বেশ কঠিন। এখানে বৈদেশিক মুদ্রা আনা যায় কিন্তু নেয়া অনেক কঠিন। এ রকম নীতিমালায় কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হবে না। আমাদের সাধারণ চিন্তাই হচ্ছে, এখানে অর্থ নিয়ে আসা যাবে কিন্তু নিয়ে যাওয়া যাবে না। এমনকি আনার ক্ষেত্রেও অনেক বিধিনিষেধের বেড়াজাল। এ কারণে কেউ বিনিয়োগে আগ্রহী হয় না। 

আমাদের অর্থনীতির আরেকটি বড় সুবিধার জায়গা হলো এর বিশাল স্থানীয় বাজার। এর বাইরেও অন্য সুবিধাগুলো নিতে হবে। ডিজিটাল ইকোনমির কেন্দ্র হয়ে ওঠার জন্য যে চিন্তা-ভাবনা ও নীতিমালা দরকার সেদিকে মনোযোগ দেয়া দরকার বলে মনে করি। আমাদের আর্থিক নীতিমালা, বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় নীতিমালা ও অভিবাসন নীতিমালা ঢেলে সাজানো দরকার। এটা করা হলে আমরা অন্য প্রতিদ্বন্দ্বীদের চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিতে পারব। এজন্য সরকারের উচিত প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে আসা। 

সরকার যখন ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রপঞ্চ হাজির করেছিল তখন কিন্তু প্রথাগত চিন্তা থেকে বেরিয়ে এসেছিল। এখন আরেক ধাপ এগিয়ে না এলে আমরা কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন করতে পারব না। ২০৪১ সালের মধ্যে আমরা মধ্যম আয়ের দেশ হতে চাই। আমাদের এখনকার বার্ষিক প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের কাছাকাছি। হয়তো ৮ শতাংশে সহজে নিয়ে যাওয়া যাবে কিন্তু মধ্যম আয়ের দেশ হতে গেলে আমাদের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ১১ শতাংশ কিংবা তার চেয়ে বেশি রাখতে হবে এবং দুই অংকের এ প্রবৃদ্ধি টানা দুই দশকের মতো ধরে রাখতে হবে, যা সহজ কোনো ব্যাপার নয়। এ প্রবৃদ্ধি অর্জনে আমাদের নতুন চিন্তা করতে হবে এবং অর্থনীতিতে নতুন দরজা খুলতে হবে। নতুন সরকারের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সেসব ভিত্তি তৈরি করা। এটা যে স্রেফ চ্যালেঞ্জ তা নয় বরং সুবিধাও বটে।    

ড. এ কে এনামুল হক:  অধ্যাপক ও ডিন, অর্থনীতি ও ব্যবসা অনুষদ, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটি ও পরিচালক, এশিয়ান সেন্টার ফর ডেভেলপমেন্ট

আরও