অভিমত

পেঁয়াজের চারা না গজানো, বাজার পরিদর্শন ও শুল্কমুক্ত আমদানি

গত ৫৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে যারাই যখন এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন, ব্যতিক্রমহীনভাবে তাদের সবাই বাংলাদেশকে চিন্তা করেছেন ঢাকা শহরের মাপকাঠিতে। ফলে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত

গত ৫৪ বছরের বিভিন্ন সময়ে যারাই যখন এ দেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন এবং আছেন, ব্যতিক্রমহীনভাবে তাদের সবাই বাংলাদেশকে চিন্তা করেছেন ঢাকা শহরের মাপকাঠিতে। ফলে ঢাকার রাস্তায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চলাচল নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হলে সঙ্গে সঙ্গেই তা উচ্চ আদালত পর্যন্ত চলে যেতে পারলেও সাধারণ গ্রামীণ মানুষ এর চেয়ে অনেক বড় সমস্যাতেও রাষ্ট্রের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হন না (রিকশার সমস্যাকে ছোট করে দেখা হচ্ছে না)। খালের ওপর সাধারণ বাঁশের সাঁকো না থাকায় যখন এই ২০২৪ সালে এসেও কোনো কোনো গ্রামের বিদ্যালয়গামী শিক্ষার্থীকে জামাকাপড় ভিজিয়ে ক্লাসে যেতে হয় অথবা সেখানে তার যাওয়াই হয় না কিংবা গ্রামে ঢোকার রাস্তা না থাকায় যখন সেখানকার মেয়েদের বিয়ে আটকে যায়, তখনো এ রাষ্ট্রের কাছে এগুলো খুবই তুচ্ছ ব্যাপার। এমনকি গণমাধ্যমেও এগুলো নিছকই ‘মফস্বল সংবাদ’। 

এমনি রাষ্ট্র ব্যবস্থার আওতায় পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মফস্বলের খবর’: পাবনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর, গোপালগঞ্জ, মাদারীপুর প্রভৃতি জেলার চাষীদের মধ্যে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) কর্তৃক সরবরাহকৃত পেঁয়াজবীজ রোপণের পর সেগুলোর ৯৫ শতাংশই গজায়নি। প্রকাশিত খবরে কতিপয় জেলার নাম উল্লেখ করা হলেও ধারণা করা যায়, দেশের অন্যত্রও এমনটিই ঘটে থাকবে। কারণ বিএডিসি এ বীজ একযোগে সারা দেশেই বিতরণ করেছে। আর তেমনটি ঘটে থাকলে বোঝাই যাচ্ছে, চলতি আবাদ মৌসুমে পেঁয়াজ উৎপাদনের ক্ষেত্রে দেশ অনিবার্যভাবেই বড় ধরনের ঘাটতির মুখে পড়তে যাচ্ছে। তাহলে স্বভাবতই প্রশ্ন দাঁড়ায়, পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখা ও মূল্য কমিয়ে আনার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিতভাবে বাজার পরিদর্শন করছে বলে খবর দিয়ে তারা যে পত্রপত্রিকা ও বেতার-টেলিভিশনগুলোকে সয়লাব করে ফেলছে, সেসবের ভিত্তি কী? নিয়মিত বাজার পরিদর্শন করলে তো সর্বাগ্রে তাদেরই এটি জানার কথা ছিল যে বিএডিসি কর্তৃক চাষীদের মধ্যে নষ্ট পেঁয়াজবীজ সরবরাহের কারণে এর উৎপাদন ও সরবরাহ চেইন আরো একদফা বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে। কিন্তু তারা সেটি জানাতে পারেনি। বরং তারা এটি জানতে পেরেছে এ বিষয়ে গণমাধ্যমে চাষীদের প্রতিবাদ-বিক্ষোভের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর সেগুলো পড়ে ও দেখে।

এ অবস্থায় এটাও জিজ্ঞাস্য যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় তাহলে বাজার পরিদর্শন বলতে কী বোঝে? বাজার পরিদর্শন মানে কি শুধুই কতিপয় দোকানদারকে জরিমানা করা? নষ্ট পেঁয়াজবীজ সরবরাহের কারণে পেঁয়াজের উৎপাদন যে নিশ্চিতভাবেই বিঘ্নিত হতে যাচ্ছে, সে খবর কৃষি মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় আগে থেকে জানতে পারল না কেন? তাহলে কেমন তাদের পরিদর্শন ব্যবস্থা? আসলে পরিধারণের অর্থটিই বোধকরি তাদের কাছে স্পষ্ট নয়। তারা সম্ভবত মনে করে যে পরিদর্শন মানে হচ্ছে চোখের সামনে যা ঘটছে তার ওপর হামলে পড়া। কিন্তু চোখের আড়ালে যা ঘটছে, সেটি বিবেচনায় নেয়া কিংবা সেসব বিষয়ে খোঁজখবর রাখা এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে সংশোধনমূলক ব্যবস্থা নেয়াটা যে পরিধারণের সবচেয়ে মৌলিক শর্ত, সেটি তাদের চিন্তায় আছে বলে তো একেবারেই প্রতীয়মান হচ্ছে না। যদি তাদের চিন্তায় সেটি থাকত, তাহলে নষ্ট বীজ থেকে পেঁয়াজের চারা না গজানোর বিষয়টি তারাই সবচেয়ে আগে জানতে পারত এবং সেক্ষেত্রে বীজ প্রতিস্থাপনের মাধ্যমে পেঁয়াজের উৎপাদন স্বাভাবিক রাখার ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে, সেটি তাদের জানাতে নিয়মিত তাগিদ দিত। কিন্তু বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ক্ষীণ দৃষ্টিসম্পন্ন চোখের আলো ওই পর্যন্ত পৌঁছে না। বাজারে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার বাইরে বড়জোর পেঁয়াজের আমদানি শুল্ক আংশিক বা পুরোপুরি মাফ করে দেয়া পর্যন্তই তাদের চিন্তার পরিধি।

আমদানি শুল্ক মাফ করে দিয়ে বাংলাদেশের বাজারে কখনো কোনো পণ্যের মূল্য হ্রাস করা গেছে—এরূপ দৃষ্টান্ত একান্তই বিরল। বরং এটি করার মাধ্যমে একদিকে যেমন সংশ্লিষ্ট আমদানিকারককে পক্ষপাতমূলকভাবে একচেটিয়া ও অতিরিক্ত মুনাফা সুবিধা এগিয়ে দেয়া হয়েছে, অন্যদিকে তেমনি রাষ্ট্রকেও বঞ্চিত করা হয়েছে মূল্যবান রাজস্ব আহরণ থেকে। অথচ চরম রাজস্ব ঘাটতির এ দেশে এ ধরনের শুল্কের প্রতিটি পয়সাই অত্যন্ত মূল্যবান। ফলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) কাছে অনুরোধ থাকবে, তারা যেন বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের শুল্ক হ্রাসের প্রস্তাব পাওয়ার পর এ ধরনের সুবিধাদানের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে এসবের অতীত ফলাফল ও কথিত ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে যাচাই-বাছাই করে দেখে। আর এ বক্তব্য শুধু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে নয়—সব পণ্য আমদানির ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। এ সূত্রে আরো একটি প্রস্তাব করি, ১৯৯০-উত্তর রাজনৈতিক সরকারগুলোর গত ৩৪ বছরের কার্যকালে এভাবে মোট কত কোটি টাকার শুল্ক থেকে রাষ্ট্রকে বঞ্চিত করা হয়েছে, তারও একটি হিসাব যেন এনবিআর ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য কমিটির শ্বেতপত্রের মতো করে সহসাই প্রকাশ করে।

বিএডিসি এরই মধ্যে পেঁয়াজের যে নষ্ট বীজ কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেছে, সে ব্যাপারে কৃষি মন্ত্রণালয় তাদের কৈফিয়তে উল্লেখ করেছে যে ওই নষ্ট বীজের পরিবর্তে নতুন ভালো বীজ তারা শিগগিরই কৃষকদের সরবরাহ করবে। তাদের এ বক্তব্য শুধু হাস্যকরই নয়, কৃষি ও ফসলের আবাদ সম্পর্কে তাদের চরম অজ্ঞতা অথবা অবিমৃশ্যকারিতার নামান্তর। পেঁয়াজের যে বীজ কৃষক গেল কার্তিকে বুনেছেন, সে বীজের প্রতিস্থাপন অগ্রহায়ণের শেষে এসে করাটা এক ধরনের ঠাট্টা-মশকরারই শামিল বৈকি! তো কৃষি মন্ত্রণালয় এ ব্যাপারে যে ব্যাখ্যা, কৈফিয়ত বা প্রস্তাবই দিক না কেন, এ মৌসুমের পেঁয়াজ উৎপাদন যে স্বাভাবিক থাকছে না, এটি প্রায় নিশ্চিত করেই বলা যাচ্ছে। সেক্ষেত্রে বাজারে পেঁয়াজের সরবরাহ স্বাভাবিক রাখার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় কী ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং তাদের চিন্তানুগ সে ব্যবস্থা আসলেই কতটা ফলদায়ক হবে, সে বিষয়টি সাধারণ্যে স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। আর এটি শুধু পেঁয়াজের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য নিত্য প্রয়োজনীয় ভোগ্যপণ্যের ক্ষেত্রেও সমান গুরুত্বের সঙ্গে ভাবা দরকার।

এদিকে বিএডিসি কেন কৃষকদের কাছে নষ্ট পেঁয়াজবীজ সরবরাহ করল এবং এর জন্য কারা দায়ী, যথাযথ তদন্তের মাধ্যমে সেটি নিশ্চিত হওয়া ও দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা খুবই জরুরি বলে মনে করি। এক্ষেত্রে আরেকটি বিষয় দৃষ্টিতে আনতে চাই, এ ধরনের তদন্তের আওতায় সাধারণত কনিষ্ঠ কর্মীদের ওপর দায় চাপানোর একটি ঐতিহ্য ও প্রবণতা বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর চর্চায় যথেষ্টই রয়েছে। আশা করব, প্রস্তাবিত এ নতুন তদন্ত উল্লিখিত পুরনো ঐতিহ্য থেকে বেরিয়ে এসে নীতিনির্ধারক পর্যায়ের দায়ীদেরও চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে এবং তেমনটি করা সম্ভব হলেই কেবল ভবিষ্যতে নষ্ট পেঁয়াজবীজ বিতরণের মতো দায়িত্বহীন আচরণ থেকে জনগণের কিছুটা হলেও পরিত্রাণ মিলবে বলে আশা করা যায়। এ প্রসঙ্গে আরো একটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই, পাট ও অন্যান্য বীজ সংরক্ষণের মতো কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সামর্থ্য ও ব্যবস্থা কি বিএডিসির সত্যি সত্যি রয়েছে? যদি থেকে থাকে তাহলে ওই বীজ নষ্ট হলো কেমন করে, কার দোষে? আর তা না থাকলে প্রশ্ন হচ্ছে, সেটি নেই কেন?

সব মিলিয়ে সারাংশ হিসেবে যা বলতে চাই তা হচ্ছে: এক. রাজধানীর বাইরের গ্রামীণ বা আধা গ্রামীণ পর্যায়ের সাধারণ মানুষ নিত্যদিনই এমন নানা বঞ্চনা, বৈষম্য ও কষ্টের শিকার হচ্ছে, যা রাজধানীর নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি ও মনোযোগকে একেবারেই টানতে পারছে না। দুই. শুধু নষ্ট পাটবীজ বিতরণ নয়, এমন আরো অনেক দায়িত্বহীন আচরণই দেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলো অহরহ করে যাচ্ছে, যার মূল ভুক্তভোগী গ্রামীণ মানুষ বিধায় এ নিয়ে কারোরই তেমন কোনো উদ্বেগ বা মাথাব্যথা নেই। তিন. বাজার পরিধারণের মতো কাজের ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর ধারণা যেমন অগভীর, তেমনি তাদের এ-সংক্রান্ত কাজগুলো এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে তাদের উদ্যোগের ধরনও একেবারেই দায়সারা। ফলে এ ধরনের পরিদর্শন ব্যবস্থা বাস্তবে তেমন কাজেই আসছে না। চার. আমদানি শুল্ক ছাড় দিয়ে বাজারে পণ্যমূল্য হ্রাসের চেষ্টা বস্তুতই একটি ভ্রান্ত কৌশল। এ প্রক্রিয়ায় আমদানিকারকের একচেটিয়া মুনাফাই শুধু বাড়ে না, রাষ্ট্রও বিপুল অংকের রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়, যা দেশের নাজুক অর্থনীতির জন্য বড় ধরনের ক্ষতির কারণ। অতএব পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের জন্য শুল্ক ছাড়ের পথে না গিয়ে সামগ্রিক পরিদর্শন ও তত্ত্বাবধান ব্যবস্থাকে জোরদার করাই উত্তম। সংশ্লিষ্ট রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ এখানে উপস্থাপিত পর্যবেক্ষণ ও প্রস্তাবগুলো বিবেচনায় নিলে এসব ক্ষেত্রে কিছুটা হলেও সুফল মিলতে পারে বলে আশা করা যায়।

আবু তাহের খান: সাবেক পরিচালক, বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক), শিল্প মন্ত্রণালয়

আরও