দেশব্যাপী বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্যের জন্য এমন ত্রাহি অবস্থা দেশের ইতিহাসে কখনো হয়েছে কিনা জানা নেই। বিশ্ববিদ্যালয় রয়ে গেছে কিন্তু তার অভিভাবকের দায়িত্ব পালন করা উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষ যে যেখানে ছিলেন পলায়নপর পদত্যাগ করেছেন। কেন পদত্যাগ করেছেন সে নিয়ে পত্রপত্রিকায় অনেক খবর, খবরের বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, তাই আর কেঁচে গণ্ডূষ করে লাভ নেই। বাংলাদেশে এত বিশ্ববিদ্যালয় ছিল না এবং দেড় দশকে গড়ে ওঠা বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এভাবে কাছাকাছি সময়ে অভিভাবকশূন্য হয়ে পড়ায় অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে অভিভাবক নিয়োগের চাপ সামলানো হয়তো কঠিনও হয়ে পড়েছে।
বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশনের তথ্যমতে, বাংলাদেশে এখন ৫৫টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে, যার মধ্যে চারটি পরিচালিত হয় ১৯৭৩ সালের অধ্যাদেশ মোতাবেক। গত দেড় দশকে দেশে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিস্ফোরণ ঘটেছে। জেলায় জেলায় বিশ্ববিদ্যালয় গড়ে তোলা হয়েছে, যার মধ্যে বেশকিছু রয়েছে ভূমিহীন হয়ে। আর অনেকগুলো রয়েছে ভবনহীন অন্যের ওপর আশ্রিত হয়ে। নতুন অনেক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ‘ভূমিহীন, গৃহহীন’। গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্যমতে, ১৮টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় চলছে কলেজের শ্রেণীকক্ষে, বিদ্যালয়ের ভবনে ও ভাড়া করা জায়গায়। আমরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় নামের সংখ্যা বাড়িয়েছি, সঙ্গে এর মর্যাদাকে কবর দিয়েছি। এসব ভূমিহীন, ভবনহীন বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলোয় উপাচার্য নিয়োগ দেয়াও হয়েছিল এবং তারা কার্যত ভূমি অধিগ্রহণ, ভবন নির্মাণ, লোকবল নিয়োগ নামক বিষয়ে ব্যস্ত থেকে নিজেদের নানা দুর্নীতির সঙ্গে জড়িয়ে ফেলে নিজেকে এবং শিক্ষক সমাজকে কলঙ্কিত করেছেন।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থান-পরবর্তী সময়ে বেশকিছু বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ করা হয়েছে। নবনিযুক্ত উপাচার্যরা তাদের নতুন কর্মক্ষেত্রে ভালো নজির স্থাপনের চেষ্টাও করছেন এবং সেগুলো গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের কল্যাণে সাধারণ জনতার কাছে পৌঁছেও যাচ্ছে। কোনো কোনো উপাচার্য নিজের যাতায়াতের জন্য সংরক্ষিত বাহন ব্যবহার না করে হেঁটে অফিসে যাচ্ছেন, কেউবা নিজের জন্য সংরক্ষিত গাড়ি ব্যবহার না করে শিক্ষকদের যাতায়াতের জন্য সংরক্ষিত গাড়িতে অফিসে যাচ্ছেন—সবই ভালো দৃষ্টান্ত। আমরা এর আগে রাজনৈতিক সরকারের কোনো মন্ত্রীকে দেখেছি প্রথম দিন অফিসে গিয়ে অফিস কক্ষে ঝাড়ু দিচ্ছেন এবং সে ছবি সংবাদমাধ্যম ও যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ায় অনেকের বাহবা পেয়েছেন, আবার অনেকে বিষয়টি নিয়ে হাসি-তামাশাও করেছেন। অতি সাধারণ জীবনের প্রতি মোহ কিংবা কোনো অহমিকা নেই এমন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রকাশ ঘটাতে গিয়ে এমন করাই যেতে পারে এবং আমজনতার মাঝে ব্যক্তি সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা আনার চেষ্টা করাও যেতে পারে। কিন্তু সমস্যা হলো ‘ঘর পোড়া গরু সিঁদূরে মেঘ দেখলেও ভয় পায়’। যে মন্ত্রী তার সাধারণ জীবনের প্রতিচ্ছবি দেখাতে অফিস ঝাড়ু পর্যন্ত দিয়েছেন সংবাদমাধ্যমে জানা গেল তিনিই অতি সাধারণ (?) উপাচার্য নিয়োগে মোটা অংকের উৎকোচ নিতেন। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ মানুষ যেমন আতঙ্কিত হবেন, তেমনি বিশ্বাস হারাবেন—এটাই স্বাভাবিক; সঙ্গে সঙ্গে তার নিযুক্ত উপাচার্য, উপ-উপাচার্য, কোষাধ্যক্ষরা কেমন তারও একটি প্রতিচ্ছবি প্রকাশিত হবে। রাষ্ট্র উপাচার্যদের ব্যবহারের জন্য গাড়ি এবং চালকের ব্যবস্থা করেছে, যাতে তিনি নির্বিঘ্নে যাতায়াতের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়ে তার কাজগুলো স্বাচ্ছন্দ্যে করতে পারেন। তেমনি মন্ত্রীর অফিসে পরিচ্ছন্নতাকর্মী রেখেছেন যাতে সুন্দর পরিবেশে দেশ ও জনগণের জন্য তিনি কাজ করতে পারেন, শুধু তার জন্য রক্ষিত সুযোগ-সুবিধাগুলোর অপব্যবহার না করলেই হলো। হেঁটে অফিসে যাওয়া কিংবা নিজের অফিস নিজেই পরিচ্ছন্ন রাখাও ভালো কাজ যদি সেটা লোক দেখানো কিংবা দুর্নীতিকে আড়াল করার জন্য না হয়।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে পরিবর্তন এসেছে সেখানে বিভিন্ন সেক্টরে সংস্কারের বিষয়টি এসেছে বহুবার এবং সেক্ষেত্রে উচ্চ শিক্ষায় দলীয়করণ, লেজুড়বৃত্তিক রাজনীতির বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণের কথা বলা হয়েছে গুরুত্ব দিয়ে। উচ্চ শিক্ষায় সংস্কারে সবকিছু বিবেচনায় অন্তর্বর্তী সরকার যোগ্য, নির্মোহ ও নিরপেক্ষ ব্যক্তিকে উপাচার্য, উপ-উপাচার্য কিংবা কোষাধ্যক্ষ পদে নিয়োগ দিতে গিয়ে হয়তো সময় নিয়েছে, যা আদতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর জন্য মঙ্গল ডেকে আনতে পারে। আমরা আশা করছি নবনিযুক্ত উপাচার্যরা দলীয় প্রভাবের বাইরে থেকে নিরপেক্ষ, নির্মোহভাবে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজে নয়া বিপ্লব সাধন করবেন। তা না হলে পরিবর্তনের জন্য এত আত্মাহুতি, বিসর্জন বৃথা যাবে, শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। আমরা দেখেছি রাউফুন বসুনিয়া, নূর হোসেনের আত্মাহুতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান দেখিয়ে তেমন কোনো পরিবর্তন আসেনি এবং দেশে গণতন্ত্র, সুবিচার যেমন প্রতিষ্ঠিত হয়নি তেমনি শিক্ষা ক্ষেত্রে বাড়েনি বরাদ্দ; সাধিত হয়নি গুণগত পরিবর্তন।
ঢাকার বাইরে অপেক্ষাকৃত নবীন, ক্ষেত্রবিশেষে প্রবীণ বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় উপাচার্য পদে নিয়োগ দিতে গিয়ে দেখা গেছে, দেশের প্রাচীনতম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেছে নেয়া হয়েছে। এটাও একটা সুন্দর উদ্যোগ মনে করা যেতে পারে, কারণ দেশের সব মেধাবী, গুণী ব্যক্তিদের উদ্ভব এবং বিকাশ তো এখানেই হওয়ার কথা। কিন্তু আদতে তেমন হয়েছে কিনা জানা নেই। যদি হতো তাহলে উপাচার্যদের এত দুর্নীতির খবর যেমন শুনতে হতো না, তেমনি প্রতিষ্ঠানটি দেশের উচ্চ শিক্ষার মডেল হয়ে দাঁড়াতে পারত, শুধু উপাচার্য তৈরির কেন্দ্র নয়। দেশব্যাপী উপাচার্যের এ আকালের সময়ে এত উপাচার্য খুঁজে পাওয়া কঠিন কাজ, যেখানে অনেক অধ্যাপক পূর্বসূরিদের রেখে যাওয়া বদনামের ভয়ে এ পদে আসতে অনাগ্রহ প্রকাশ করছেন। সেক্ষেত্রে যারা সরকারের অনুরোধে কিংবা স্বেচ্ছায় এ পদে আসতে রাজি হয়েছেন তাদের সাধুবাদ জানাতেই হবে। অন্তত তিন দশকের তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অধিকাংশ উপাচার্য দায়িত্ব, কর্তব্য এবং সমাজে তাদের অবস্থান সবকিছুকে ভুলে দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়েছেন এবং তার প্রতিষ্ঠানের ঐতিহ্য কিংবা মর্যাদা কোনোটার প্রতিই তেমন সুবিচার করতে পারেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে সরকার হয়তো একাডেমিক সফলতা, গবেষণা ইত্যাদি গুণ দেখে উপাচার্যের দায়িত্ব দিয়েছেন কোনো ব্যক্তিকে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত পত্রপত্রিকায় এমন খবর এসেছে যে ওই ব্যক্তি তার কর্মকালে প্রতিষ্ঠানের ইট নিয়ে নিজের বাড়ি তৈরি করেছেন যেন ‘মুখ মে শেখ ফরিদ বগল মে ইটা হ্যায়’। এমন লজ্জাকর খবর আমরা শুনতে ও দেখতে চাই না। মনে রাখতে হবে একজন আমলা কিংবা প্রশাসকের অর্থ পাচার করে ‘বেগমপাড়ায়’ বাড়ি নির্মাণের খবর আর একজন উপাচার্যের দুর্নীতির খবর জনগণ সমানভাবে নেয় না এবং প্রত্যাশাও করে না। ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের মতো উপাচার্য নিয়োগের সিন্ডিকেটও আছে বলে আমরা খবর শুনেছি। আমরা আশা করতে চাই সেটি এখন নেই এবং তেমন কোনো মাধ্যমে উপাচার্য নিয়োগ হচ্ছে না। তবে উপাচার্য নিয়োগে নিরপেক্ষ, নির্মোহ ‘সার্চ কমিটি’ থাকতে পারে, যারা উপাচার্যের প্যানেল তৈরি করে রাখবেন এবং সেখান থেকে নিয়োগ দেয়া হবে।
অপেক্ষাকৃত নবীন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে দেখা যায় উপাচার্যজনিত নানা সমস্যায় ভুগতে। ভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নিযুক্ত উপাচার্যরা নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে এসে অনেকটা অন্ধকারে পড়ে যাওয়ার মতো ঘটনা ঘটে। প্রথমত স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের তদবির এবং চাপ, সঙ্গে নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীর বলয়ে আটকে যাওয়া একজন উপাচার্যকে তার মূল লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত করে। অনেক ক্ষেত্রে উপাচার্য অতি উৎসাহী হয়ে নিজেই একটা বলয় তৈরি করেন। সেক্ষেত্রে এমনও ঘটে, উপাচার্য যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসেছেন সেখানকার যেসব গ্র্যাজুয়েট নতুন কর্মস্থলে শিক্ষকতা করছেন কিংবা কর্মরত আছেন তাদের নিয়ে একটি বাহিনী গড়ে তোলেন, সঙ্গে যুক্ত করেন তার রাজনৈতিক মতাদর্শের ছাত্রসংগঠন, শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারী সংগঠনকে। এরপর হয়ে ওঠেন দুর্বিনীত স্বেচ্ছাচারী, জড়িয়ে পড়েন নানা দুর্নীতিতে। বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিকীকরণ, বলয় প্রতিষ্ঠা হবে না এমন আশা করা যেতে পারে। তবে বাস্তবে জাতির সে আশা কতটা পূরণ হবে তা নির্ভর করে নিযুক্ত ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের ওপর।
আমরা দীর্ঘ সময় ধরে দেখেছি, উপাচার্যরা যতটা না শিক্ষা ও গবেষণার জন্য সময়, শ্রম ও অর্থ বরাদ্দ রাখেন তার চেয়ে বেশি ব্যয় করেন অপ্রাসঙ্গিক কাজে। বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন প্রজ্ঞাবান উপাচার্য দেখবেন তার প্রতিষ্ঠানের যে লক্ষ্য অর্থাৎ শিক্ষা, গবেষণা, জ্ঞানের সৃষ্টি, নতুন উদ্ভাবন ও শিক্ষার্থীদের মননের বিকাশের জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো এবং সুবিধা কীভাবে বৃদ্ধি করা যায়; যাতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে দর্শন সেটিকে ধারণ করে লক্ষ্যে পৌঁছতে পারেন। অনেক উপাচার্যকে দেখা গেছে গণভোজ আয়োজনে কত হাজার মানুষকে খাইয়ে কতটা খুশি করতে পারবেন সে নিয়ে ব্যস্ত থাকতে। ক্যাফেটেরিয়ায় চা, শিঙাড়া, পেঁয়াজুর মাননিয়ন্ত্রণ নিয়ে উপাচার্যকে ব্যস্ত থাকার চেয়ে শিক্ষাসংশ্লিষ্ট অনেক বিষয়ে মনোযোগী হওয়া উচিত। সে কাজের জন্য নির্দিষ্ট লোক নিশ্চয়ই আছেন। একজন উপাচার্যকে নিশ্চয়ই কত কেজি গোশতে কতখানি মরিচ গুঁড়া, ধনিয়া গুঁড়া দিয়ে রান্না করলে তা সবচেয়ে সুস্বাদু হবে এবং খরচ কম হবে তা নিয়ে ব্যস্ত থাকার কথা না, সেটি দেখার জন্য রাষ্ট্রের অর্থে পাচক নিয়োজিত আছে। বরং তার দায়িত্ব হতে পারে রাষ্ট্রের নাগরিকের টাকায় যে অবকাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে তার সুবিধা শিক্ষার্থী ও শিক্ষকরা পাচ্ছেন কিনা এবং প্রতিষ্ঠান নতুন জ্ঞান সৃষ্টিতে কী অবদান রাখল কিংবা ভবিষ্যতে রাখতে পারে তার মূল্যায়ন ও পরিকল্পনা করা। একই সঙ্গে জনগণের টাকায় পরিচালিত প্রতিষ্ঠান থেকে রাষ্ট্র ও জনতা উপকৃত হচ্ছে কিনা সেদিকে নজর রাখা। কিন্তু প্রায়ই গণমাধ্যমে যেসব খবর দেখি এবং কর্মক্ষেত্রে যেসব অভিজ্ঞতা হয় তা হতাশাজনক।
অনেক উপাচার্যকে দেখা যায় প্রতিষ্ঠানে একটি স্তাবক বাহিনী তৈরি করেন এবং তাদের দ্বারা এক সময় পরিবেষ্টিত হয়ে নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অসাধু কর্মে জড়িয়ে পড়েন। ধীরে ধীরে উপাচার্যের অফিসটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক ভবনের চেয়ে তার বাসভবনে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে এবং পর্যায়ক্রমে আহমদ ছফা রচিত ‘গাভী বিত্তান্ত’র আলোচিত চরিত্র ‘আবু জুনায়েদ’-এর গোয়ালঘরের মতো অনেক গোশালা গড়ে ওঠে। এসব গোশালা শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণকারী অফিসে পরিণত হয়। সেখানে কেবল স্তাবকদের স্তুতি চর্চা চলে, আত্মসমালোচনার কোনো জায়গা থাকে না। ফলে মহোদয় যা বলেন, যা করেন তাই ঠিক—এ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত হয়।
কিন্তু আমরা তো অনেক প্রজ্ঞাবান, সৎ, সবার পূজনীয় ব্যক্তিত্বকেও উপাচার্য হিসেবে পেয়েছি এবং এখনো অনেকে বেঁচে আছেন, যারা রাষ্ট্রের ‘থিংক ট্যাংক’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এবং আছেন। স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য। তার প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতা ছিল সর্বজনবিদিত, যা এখনো মুখে মুখে ঘুরে বেড়ায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম উপাচার্য পি জে হার্টগ এক অনন্য উপমা। এক সময় রীতি ছিল বিশ্ববিদ্যালয় কোর্টের মাধ্যমে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ। হার্টগ প্রচলিত পদ্ধতিকে গণতান্ত্রিক রূপ দান করেন। সমাজের নানা স্তর থেকে মনোনীত সদস্যদের তিনি স্বাধীন মত প্রকাশের সুযোগ দিতেন, কোনো মত নিজের বিরুদ্ধে গেলেও গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন। এখন তো অনেক সময় সিনেট, সিন্ডিকেটে ভিন্নমত সহ্য করা হয় না। এমনকি হট্টগোল থেকে হাতাহাতিতে পর্যন্ত গড়ায়। নবীন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিজেন্ট বোর্ডগুলোয় বেছে বেছে এমন লোক বসানো হয় যারা উপাচার্যের কিংবা তার রাজনৈতিক মতের বিরুদ্ধে কিছু বলবেন না। পি জে হার্টগের যুগে ছাত্র-শিক্ষক সম্পর্কও ছিল শ্রদ্ধা ও দায়িত্বের মিশেলে ভরপুর। উপাচার্য শিক্ষার্থীদের সুবিধা-অসুবিধা দেখতেন, সমস্যার সমাধান করতেন। স্নাতক-মাস্টার্স শেষ করে শিক্ষার্থীরা কে কোথায় চাকরি পাচ্ছেন, সে খবরও রাখতেন। ছাত্ররা ঠিকমতো ক্লাস করছেন কিনা, সে খোঁজ নিতেন। শিক্ষার মানের প্রশ্নে তিনি কখনই নমনীয় হননি। অধুনাকালের উপাচার্যদের দেখেছি সমমনা রাজনৈতিক মতাদর্শের শিক্ষার্থীদের দ্বারা বেষ্টিত থাকতেন। অনেক সময় উপাচর্যের দায়িত্ব পাওয়া কিংবা টিকে থাকাও নির্ভর করে রাজনৈতিক নেতাদের ওপর। আশির দশকেও আমরা অনেক উপাচার্য পেয়েছি যারা জ্ঞান, প্রজ্ঞা ও ব্যক্তিত্বে অতুলনীয় ছিলেন, যারা সাদাকে সাদা আর কালোকে কালো বলার সাহস রাখতেন। তবে রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণের কারণে স্পষ্টবাদীদের যেমন উপাচার্য করাও হয় না, তেমনি নিযুক্ত উপাচার্যদের সত্যটি বলার সাহসও থাকে না। আমাদের উপাচার্যদের গর্ব করার মতো অতীত ঐতিহ্যের একটি ঘটনা দিয়ে শেষ করব। ষাটের দশকের কথা। তৎকালীন প্রাদেশিক গভর্নর আবদুল মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মাহমুদ হুসেইনকে বললেন গভর্নর হাউজে দেখা করার জন্য। উপাচার্য জানতে চাইলেন, এক. বিষয়টি কি শিক্ষাসংক্রান্ত? যদি শিক্ষাবিষয়ক বা বিশ্ববিদ্যালয়সংক্রান্ত হয় তবে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই আলোচনা হবে গভর্নর হাউজে নয়। দুই. বিষয়টি কি রাজনীতিবিষয়ক? যদি রাজনীতিবিষয়ক হয় তবে গভর্নর হাউজে যাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব নয়, কারণ আমি রাজনীতি করি না। এমন সাহসী ব্যক্তিত্ববান উপাচার্য কি ফিরে আসবেন? হাজারো ছাত্র-জনতা যে সুন্দর বাংলাদেশের আশায় জীবন দিয়েছেন সেটি পূরণে উপাচার্যরা তাদের হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে সচেষ্ট হবেন কিনা সেটা তাদের বিবেচ্য বিষয়।
ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়