পৃথিবী নামক গ্রহের প্রায় ৯৯ শতাংশ জায়গাকে জড়িয়ে রেখেছে সমুদ্র। বলা চলে সমুদ্র মানবজাতির জন্য একক বৃহত্তম প্রাকৃতিক সম্পদের আধার। আমাদের প্রতিটি শ্বাস-প্রশ্বাসে অক্সিজেনের জন্য সমুদ্র বিরাট এক উৎস। বিশ্বব্যাপী মানবজাতির আমিষের চাহিদার ১৫ শতাংশ সরবরাহ করে সমুদ্র। বিভিন্ন উৎস থেকে নির্গত ৩০ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড শোষিত হয় সমুদ্রে। এছাড়া গ্রিনহাউজ গ্যাস দিয়ে সৃষ্ট অতিরিক্ত তাপের ৯০ শতাংশ শোষণ করে সমুদ্র এবং জলবায়ু পরিবর্তনকে ধীর করতে সাহায্য করে।
বিজ্ঞানের উৎকর্ষের শুরুর দিকের সময় বিশ্লেষণ করলেও দেখা যায়, বিশ্বব্যাপী যোগাযোগের বড় পথ হিসেবে সমুদ্র ব্যবহৃত হয়ে আসছে। শিপিং সেক্টরের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে বাণিজ্য করা পণ্যের প্রায় ৯০ শতাংশের পরিবহনের হাইওয়ে হচ্ছে সমুদ্রপথ। আমরা যদি কোনো মহাসাগরকে দেশ হিসেবে চিন্তা করি তাহলে এটি অর্থনীতিতে অবদান রাখে কয়েক ট্রিলিয়ন ডলার, যা জিডিপি হিসেবে সারা পৃথিবীর দেশগুলোর তালিকায় সপ্তম স্থানে থাকতে পারে।
উন্নত দেশগুলো সমুদ্রকে নানামুখী সম্পদের উৎস হিসেবে ব্যবহার করলেও অনুন্নত দেশগুলো সমুদ্রকে কেবল মৎস্যসম্পদ আহরণের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করছে। ফলে সামনে মূল্যবান সম্পদ থাকা সত্ত্বেও তা সম্পর্কে জ্ঞানের অভাব কিংবা আহরণের কলাকৌশল না জানা থাকার কারণে সম্পদ হিসেবে ব্যবহার করতে পারছে না। অথচ সমুদ্র এবং এর সম্পদ সম্পর্কে জ্ঞানের সমৃদ্ধির মাধ্যমে মৎস্য ও অন্যান্য জলজ সম্পদ, শিপিং, খনিজ ও পর্যটনসহ নানা খাতে লাখ লাখ কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি সম্ভব। বিশ্বের তেল ও গ্যাস সম্পদের প্রায় ৩০ শতাংশের উৎসও সমুদ্র। উন্নত দেশগুলো ভূ-ভাগ থেকে খনিজ পেট্রোলিয়ামজাত সম্পদ আহরণের পর এখন হাত বাড়িয়েছে সমুদ্রের দিকে এবং সফলও হচ্ছে।
বর্তমানে যেসব দেশ সামুদ্রিক সম্পদ আহরণের সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি সেসব দেশসহ বিশ্বের লাখ লাখ দরিদ্র মানুষও তাদের ভরণপোষণ এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য সমুদ্র এবং উপকূলীয় সম্পদের ওপর ব্যাপকভাবে নির্ভর করে। এমনকি ক্ষুদ্র আকারে যেসব সামুদ্রিক মৎস্য শিকারি আছে তাদের মাধ্যমে বিশ্বের সামুদ্রিক খাবারের প্রায় অর্ধেক জোগান এসে থাকে। জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) মতে, সুনীল অর্থনীতি হলো মানব উন্নয়নের একটি টেকসই ব্যবস্থা। সাধারণভাবে বলতে গেলে মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নে সমুদ্রসম্পদ একটি মজবুত এবং টেকসই ভিত্তি হিসেবে কাজ করতে পারে।
বিশ্বব্যাপী জনসংখ্যা বৃদ্ধি এবং সঙ্গে সঙ্গে ভোগবাদী সভ্যতার বিকাশের কারণে ভূমিজ সম্পদ দিন দিন ফুরিয়ে যাচ্ছে। তাই প্রয়োজনের তাগিদে বিশাল সমুদ্রসম্পদের দিকে হাত না বাড়িয়ে উপায় নেই। এখন কৃষির ভূমিভিত্তিক কর্মকাণ্ড তার গণ্ডি পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমুদ্রে। ভূমিভিত্তিক চাষাবাদের সঙ্গে এখন সামুদ্রিক চাষাবাদ বেশ জনপ্রিয় সম্ভাবনাময় খাত হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী অ্যাকুয়াকালচার বিষয়টি ১৯৮০ সাল থেকে প্রায় ৯ শতাংশ যৌগিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। এখান থেকে বিশ্বের ব্যবহৃত মাছের আমিষের প্রায় অর্ধেক সরবরাহ হয় বলে মনে করা হয়। যদিও ব্যাপক দূষণের কারণে এখন সামুদ্রিক জীবের প্রজাতিবৈচিত্র্য দিন দিন হ্রাস পাচ্ছে এবং সম্ভাবনাময় খাতটি চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। অথচ দূষণ হ্রাস এবং বিভিন্ন প্রজাতির মৎস্য সমন্বিতভাবে চাষাবাদের মাধ্যমে আর্থিক উন্নয়ন এবং আমিষের উৎস সৃষ্টি সম্ভব।
সাম্প্রতিক সময়ে সুনীল অর্থনীতি বিষয়টি উন্নত বিশ্বের নজর কেড়েছে এবং এ নিয়ে দেশগুলোর পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়নের সঙ্গে সুফল ভোগও শুরু হয়েছে। সুনীল অর্থনীতির দুটি উপাদান রয়েছে। প্রথমটি হলো, বিদ্যমান সমুদ্রসম্পদের ভিত্তি রক্ষা করা ও পুনরুদ্ধার করা, যেটি এরই মধ্যে কোটি কোটি মানুষের খাদ্য এবং জীবিকার উৎস হিসেবে প্রমাণিত হয়ে আছে। দ্বিতীয়ত, হ্রাসপ্রাপ্ত মৎস্যসম্পদের মজুদ যা পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে উচ্চতর, টেকসই মাছের ফলন এবং মজুদ নিশ্চিত করা ও এর মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি করা। সামুদ্রিক সম্পদ আহরণ ও তার ব্যবহারের মাধ্যমে টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সামুদ্রিক বাস্তুসংস্থান সংরক্ষণ এবং পুনরুদ্ধারের মাধ্যমে সম্পদের টেকসই ব্যবহার ও উন্নয়ন কর্মকাণ্ড গ্রহণ করে থাকে। এক্ষেত্রে সামুদ্রিক স্রোত এবং বায়ুপ্রবাহ ব্যবহার করে তা থেকে শক্তি উৎপাদন একটি সম্ভাবনাময় খাত। এছাড়া ম্যানগ্রোভ, সামুদ্রিক শৈবাল বৈশ্বিক কার্বন স্টক হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে এবং এ থেকে অর্থ উপার্জনের সম্ভাবনাও রয়েছে।
২০১৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত ১৭টি টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যের মধ্যে একটি হলো টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৪। এ লক্ষ্যের আনুষ্ঠানিক শব্দ হলো”টেকসই উন্নয়নের জন্য মহাসাগর, সমুদ্র ও সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ এবং টেকসইভাবে ব্যবহার করা। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ১৪-এর লক্ষ্যমাত্রা ১৪ (৭)-এ বলা হয়েছে, ‘২০৩০ সালের মধ্যে মৎস্য, জলজ চাষ ও পর্যটনের টেকসই ব্যবস্থাপনাসহ সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার থেকে ক্ষুদ্র দ্বীপ, উন্নয়নশীল দেশ ও স্বল্পোন্নত দেশগুলোর অর্থনৈতিক সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে’। এটা স্বতঃসিদ্ধ যে দারিদ্র্য, ক্ষুধা, অপুষ্টি এবং অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দূরীকরণে মৎস্য ও জলজ চাষ অবদান রাখতে পারে। বৈশ্বিক জিডিপিতে টেকসই মৎস্য চাষের অবদান প্রতি বছর প্রায় শূন্য দশমিক ১ শতাংশ।
বাংলাদেশের রয়েছে বিশাল উপকূল এবং বঙ্গোপসাগরের জলরাশিতে সমৃদ্ধ সামুদ্রিক সম্পদ। বঙ্গোপসাগরের প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮ ১৩ বর্গকিলোমিটার এলাকার ওপর বাংলাদেশের সার্বভৌম অধিকার রয়েছে। আয়তন হিসেবে যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ৮১ শতাংশ। দেশটির এত বিশাল সামুদ্রিক এলাকা থাকা সত্ত্বেও এর সামুদ্রিক উৎপাদন জাতীয় উৎপাদনের মাত্র ১৫ শতাংশ।
বিশ্ব অর্থনীতির বিশাল এক জায়গা দখল করে আছে সামুদ্রিক সম্পদ। সারা বিশ্বের সমুদ্রনির্ভর অর্থনীতির বার্ষিক মূল্য বলতে গেলে ৩ থেকে ৬ ট্রিলিয়ন ডলার এবং বিশ্বব্যাপী ৩ বিলিয়নেরও অধিক লোকের জীবিকা সমুদ্রের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সমুদ্রসম্পদের বার্ষিক অবদান ৬ বিলিয়ন মার্কিন ডলার এবং ভবিষ্যতে তা আরো বাড়বে বলে আশা করা হচ্ছে। এমনিভাবে উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল অথবা অনুন্নত দেশ আছে, যাদের অর্থনীতির বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে সমুদ্রের অবদান। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চলের অনেক দেশ, যেমন থাইল্যান্ড, ফিলিপাইন, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ায় সামুদ্রিক চাষাবাদ বেশ জনপ্রিয় এবং তাদের অর্থনীতিতে এর অবদান অনেক।
বিশ্বের মৎস্য উৎপাদনের ৬০ শতাংশেরও বেশি আসে সামুদ্রিক খাত থেকে, কিন্তু বাংলাদেশে পরিস্থিতি বিপরীত, যদিও দেশে যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশগুলোয় তাদের সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের পরিমাণ বাড়ালেও বাংলাদেশের পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ২০০২ থেকে ২০২১ সালে এটি কমেছে ব্যাপক হারে।
বিশ্বের বিভিন্ন উপকূলীয় দেশের মতো বাংলাদেশের উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক অঞ্চল বিশ্বের সেরা প্রজাতি বৈচিত্র্যপূর্ণ বাস্তুতন্ত্রের একটি। বাংলাদেশ ইকোনমিক রিভিউ (২০১৬)-এর তথ্যমতে, দেশের জনগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশ আমিষের চাহিদা মিটে থাকে মাছ থেকে এবং অর্থনীতিতেও মৎস্যসম্পদের রয়েছে বিশাল অবদান। ২০২০-২১ অর্থবছরে বাংলাদেশের মৎস্য উৎপাদন ছিল ৪৬ লাখ মেট্রিক টন। এর মধ্যে সামুদ্রিক মৎস্য উৎপাদন ছিল মাত্র শূন্য দশমিক ৭ মেট্রিক টন, শতকরা হিসাবে অভ্যন্তরীণ মৎস্য ৮৫ দশমিক ৩ শতাংশ এবং সামুদ্রিক মৎস্য ১৪ দশমিক ৭ শতাংশ। সামুদ্রিক মৎস্য আহরণের এমন চিত্র আমাদের অক্ষমতাকেও প্রকাশ করে।
মৎস্যসম্পদের গুরুত্ব অনুধাবন করে বাংলাদেশ সরকার ১৯৭৩ সালে মেরিন ফিশারিজ একাডেমি প্রতিষ্ঠা করে। এ প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য ছিল মাছ আহরণের উন্নতি সাধন, বাণিজ্যিক জাহাজ উন্নয়ন, মাছ প্রক্রিয়াকরণ প্লান্ট স্থাপন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হলেও সামুদ্রিক সম্পদ আহরণে বাংলাদেশ এখনো তেমন একটা সক্ষমতা অর্জন করতে পারেনি। যদিও সাম্প্রতিক বছরগুলোয় নানা কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং অধুনা প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সমুদ্র গবেষণা ইনস্টিটিউট বিশাল উপকূলীয় এবং সামুদ্রিক মৎস্য ও অন্যান্য সম্পদ আহরণে তাৎপর্যপূর্ণ অবদান রাখতে পারে। এজন্য প্রয়োজন প্রতিষ্ঠানগুলোকে যথাযথ এবং জ্ঞানসম্পন্ন লোকবলের মাধ্যমে শক্তিশালী করে তোলা, তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। একটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, গবেষণার মাধ্যমে নিত্যনতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানে প্রশাসনিক দক্ষতার চেয়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনের জ্ঞান ও দক্ষতা প্রয়োজন। টেকসই লক্ষ্যমাত্রার ১৪ নম্বর লক্ষ্যটি অর্জনের জন্য অর্থাৎ সুনীল অর্থনীতির সুবিধা ভোগের জন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি। প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার চেয়েও বেশি জরুরি প্রতিষ্ঠানের মান ও সক্ষমতা বৃদ্ধি। লক্ষ্য অর্জনের জন্য সুনীল অর্থনীতির যে দুটি উপাদানের কথা আলোচনায় বলা হয়েছে সে দুটিকে প্রাধান্য দিতে হবে। এর মাধ্যমে যেমন সম্ভব হবে সামুদ্রিক সম্পদ সংরক্ষণ, মৎস্যবৈচিত্র্য পুনরুদ্ধার এবং টেকসই নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন।
ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বিশ্ববিদ্যালয়