অভিমত

তত্ত্বাবধায়ক সরকার ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা

দুটি প্রধান দলই তাদের এক দফা ঘোষণা করেছে। একটি দল ক্ষমতায়, অন্য দল ক্ষমতার বাইরে। ঘোষণা দেখে মনে হয়েছে, দুটি দলই আগে থেকে একে অন্যের ঘোষণার বিষয়ে অবগত ছিল। কথা হলো বিরোধীদের অথবা সরকারপক্ষের এক দফার দাবিতে নতুনত্ব কিছুই নেই। বিএনপি এক দফায় যা ঘোষণা করেছে তা দলটি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে। অন্যদিকে সরকারি দল যারা একটানা প্রায় ১৪

দুটি প্রধান দলই তাদের এক দফা ঘোষণা করেছে। একটি দল ক্ষমতায়, অন্য দল ক্ষমতার বাইরে। ঘোষণা দেখে মনে হয়েছে, দুটি দলই আগে থেকে একে অন্যের ঘোষণার বিষয়ে অবগত ছিল। 

কথা হলো বিরোধীদের অথবা সরকারপক্ষের এক দফার দাবিতে নতুনত্ব কিছুই নেই। বিএনপি এক দফায় যা ঘোষণা করেছে তা দলটি দীর্ঘদিন ধরেই বলে আসছে। অন্যদিকে সরকারি দল যারা একটানা প্রায় ১৪ বছর ক্ষমতায় রয়েছে তারাও এ দাবিকে অগ্রাহ্য করছে। 

প্রশ্ন হলো এত পুরনো একটি ইস্যু নিয়ে বিএনপি কতদূর এগোতে পারবে। এর উত্তর খোঁজা প্রয়োজন, কারণ নির্বাচন আসন্ন। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে এই এক দফার তাৎপর্য জাতি বুঝতে চায়। তারও কারণ রয়েছে। সেটি হলো ২০০৮ থেকে ২০২৩। এর মধ্যে দুটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার অনুষঙ্গটি ছাড়াই। 

পুরো বিষয়টি স্পষ্ট করতে ঘটনার গভীরে যাওয়া যেতে পারে। সংসদ ভেঙে দিয়ে সরকারের পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি বিএনপি ও তার সমমনারা ২০০৮ সাল থেকেই করে আসছে। সে সময় থেকেই দলটি বলে আসছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গঠিত সরকারটি ছিল ওই সময়ের ‘বিশেষ সরকারের’ পরিকল্পনা। যেহেতু সে সরকার ছিল বিশেষ একটি সরকার। একটি এজেন্ডা বাস্তবায়নের সরকার। দলটির ভাষায় যেহেতু সেটি পরিপূর্ণভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল না, সুতরাং সেই সরকারের আমলে সংসদ গঠন করে ক্ষমতায় বসা সরকারও অবৈধ। বিএনপি এ দাবি থেকে এখনো সরে আসেনি। 

এদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার সংবিধান থেকেই বাতিল করে দেয়। এ বাতিলের প্রক্রিয়াও ছিল অন্য রকম, যেটি খুবই নিয়মতান্ত্রিকভাবে করা হয়। প্রক্রিয়াটি ছিল এমন, বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে সংবিধানের যে সংশোধনীর মাধ্যমে এ সরকার ব্যবস্থা চালু হয়েছিল, সেই ত্রয়োদশ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে রিটের ফলে ২০০৪ সালে হাইকোর্ট তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বৈধ ঘোষণা করে। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল বিভাগে রিট ও শুনানি শেষে ২০১১ সালের ১০ মে আপিল বিভাগ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থাকে অসাংবিধানিক ঘোষণা করে। এরপর ওই বছরের ৩০ জুন জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোটের বিধান রেখে সংবিধান সংশোধন বিল পাস হয়। এরপর অনুষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালের নির্বাচন। একই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের সংসদ নির্বাচন হয়েছে। ক্ষমতায় রয়ে গেছে আওয়ামী লীগ। 

বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, সংবিধানের দৃষ্টিকোণ থেকে এ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এখন অসাংবিধানিক এবং এ ইস্যুতে অতীতের মতোই বিপরীতমুখী অবস্থানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি। সরকার বলছে, ভোট হবে সাংবিধানিক বিধানমতেই। যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যু বহুদূরে চলে গেছে, তা ফিরে আসবে না কোনোভাবে। সরকারের বক্তব্য হলো দেশের সর্বশেষ রায়দাতা সুপ্রিম কোর্টের রায়ের পর বাতিল হয়েছে এ ব্যবস্থা এবং আইন প্রণয়নের সুপ্রিম প্রতিষ্ঠান জাতীয় সংসদও সেই রায়ের আলোকে এটি বাতিল করে দিয়েছে। এখন কোনো সুযোগই নেই তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফেরার।

প্রশ্ন হলো উচ্চ আদালত বাতিল করেছেন, এ মর্মে সংবিধান সংশোধন করা হয়েছে সেই ধরনের ইস্যুর এখন কোনো নিরপেক্ষ বাস্তবতা আছে কিনা। সরকারি দলের কথা শুনলে মনে হয় এ ধরনের সরকারের কোনো প্রয়োজনীয়তা একেবারেই নেই। আবার বিরোধী দলের মতে, এ সরকারের বাস্তবতা দেশে পরিপূর্ণভাবে বিরাজমান। যদি অনেক কিছু বিবেচনা করেও বলতে হয় তাহলে বলতে হবে, বাংলাদেশের মতো দেশে তত্ত্বাবধায়ক সরকার কাঠামোর ইস্যুর নিরপেক্ষ বাস্তবতা সবসময়ই থাকে। কারণ এসব দেশে এখনো গণতন্ত্র মধ্যম পর্যায়ের বিকাশও লাভ করেনি। এখনো নির্বাচনই ক্ষমতা বদলের কৌশল ধরা হয়। অথচ অধিকতর গণতন্ত্রে নির্বাচন হচ্ছে উন্নয়নের নতুনতর কৌশল। নতুন নির্বাচন মানেই নতুন প্রত্যাশার জন্ম। নতুন নতুন উন্নয়ন কৌশলে জনগণকে প্রলুব্ধ করে ক্ষমতাসীন হওয়ার পদ্ধতি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো দেশে নির্বাচনকেই মনে করা হয় গণতন্ত্র। কিন্তু গণতন্ত্রের গভীরতর হিসাব তা নয়। 

বক্তব্য খুবই পরিষ্কার। সেটি হলো বর্তমান বাস্তবতায় তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুই কেন একমাত্র সমাধান ভাবা হচ্ছে সেটা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব পুরোটাই রয়েছে। কারণ তত্ত্বাবধায়ক সরকার এসে নির্বাচন করে দিয়ে চলে গেলেই কি সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে? শুধু নির্বাচন করে ক্ষমতার পালাবদল ঘটিয়ে একবার এক দল অন্যবার আরেক দলকে ক্ষমতার স্বাদ বুঝতে দেয়াই কি একমাত্র নিরপেক্ষ বাস্তবতা? 

একটু পেছনে যাওয়া যাক। ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এরপর ১৯৯৬, ২০০১, ২০০৮—এ নিবার্চনগুলোয় দুটি দলই তাদের শরিকদের নিয়ে ক্ষমতাসীন হয়েছে। কিন্তু তাতে বিশেষ কী হয়েছে? রাজনীতি থেকে অস্থিরতা, বিরোধ ও সংঘাত শেষ হয়ে গেছে? নির্বাচনের মধ্য দিয়ে গঠিত সংসদ সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠুভাবে চলেছে? দলাদলি, খুনোখুনি, লুটপাট বন্ধ হয়েছে? সর্বক্ষেত্রে সরকারের দায়বদ্ধতা, জবাবদিহিতার দেখা মিলেছে? দুর্নীতি শেষ হয়ে গেছে? এ অবস্থায় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ফিরিয়ে আনলে পরিস্থিতির গুণগত উন্নতি হওয়ার কোনো নিশ্চয়তা আছে?

দেশের রাজনীতি যে পরিস্থিতি, জ্ঞান-প্রজ্ঞা ও দক্ষতা নিয়ে আবর্তিত হচ্ছে সেখানে রাজনীতি এখনো দলীয় ইস্যু। রাজনীতিকে দলগত সুবিধা আদায়ে, পেশিশক্তি সৃষ্টিতে কাজে লাগানো হয়, যেখানে দলীয় ছাত্রছাত্রী, দলীয় কৃষক-কামার-কুমোর, জেলে-তাঁতি, দলীয় বুদ্ধিজীবী রয়েছেন। যেখানে মেধার বিকাশও হচ্ছে দলীয় কায়দায়, সেখানে নিরপেক্ষতা বলে কিছু থাকার কথা নয়। বরং এসব বিষয়কে কেন্দ্র করে ইস্যুবাজি এখন একধরনের গোঁড়ামিতে পরিণত হয়েছে। যা দল-মত নির্বিশেষে সব মানুষের মধ্যেই অসংখ্য ভ্রান্ত প্রত্যাশার জন্ম দিচ্ছে, যেটি সমাজ ও জাতির জটিল ইস্যুগুলোর কোনো সরল সমাধানের পথ রুদ্ধ করে দিচ্ছে, সেখানে নিরপেক্ষতা একটি ভান বা বাহুল্য ছাড়া কিছুই নয়। 

এ অবস্থায় যা দাঁড়াতে পারে সেটা আসলে কী? মার্কিন মুলুকের দুই মহারথী উড়োজাহাজে চেপে রথের দেশে এসেছেন। তারা ছোটাছুটি করছেন। হুড়োহুড়ি কতটুকু হবে সেটা বোঝা যাচ্ছে না। তাদের আগে ইউরোপীয় ইউনিয়নের টিম কাজ করে গেছে। তারা ঠাণ্ডা মাথায় বাস্তবতা বুঝে গেছেন। তারা কোথাও কোথাও বলেছেন, কেয়ারটেকার সরকার নিয়ে তাদের আগ্রহ নেই। এরই মধ্যে দুটি সিটি করনপোরেশনের নির্বাচন হয়ে গেছে। আরেকটি সংসদ উপনির্বাচন সমাগত। বছর ঘুরতেই পুরো সংসদ নির্বাচন। এখানেই সূত্রগুলো একসঙ্গে মেলানোর তাগিদ সবারই। কারণ সাংবিধানিক বিধি অনুযায়ী নির্বাচন হতে না দিলে তার পরিণামও ভালো হয় না, এটা দুই দলই জানে। 

প্রশ্ন হলো এই মুহূর্তে সংবিধানের একটি বিধানকে পাশ কাটিয়ে কারোই কিছু বলার আছে কিনা? সংসদ যে অবস্থায় রয়েছে তাতে ক্ষমতাসীন দলকে কীভাবে বাধ্য করা যায় যে সংসদে বসে আইন পরিবর্তন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারে ফিরতে? আদালতের কী হবে তাহলে? আদালত বলে কিছু থাকবে? সুতরাং, মার্কিন মোগল যারা তত্ত্বাবধায়ক ইস্যুকে পালিশ করে এগোতে চেষ্টা করছেন তাদের আরো বারবার ভাবতে হবে। যাদের নিজের দেশেই এ ধরনের ব্যবস্থা নেই তারা এটার স্বপক্ষে বলবে কীভাবে। বরং তারা যেটা করতে পারে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের জন্য সরকারকে চাপ প্রয়োগ করতে পারে। সরকারকে পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলতে পারে। লেভেল সমান করার কথা বলতে পারে। 

সমস্যার সমাধান এখানেই। যদি কেয়ারটেকার ফেরানো না-ই যায়, তাহলে যাতে সরকারের অধীনেই কীভাবে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠান করা যায় সেটা ভাবতে হবে। বিরোধী পক্ষ যদি সেই ইস্যুতে কাজ করে একটি লেভেল তৈরির চেষ্টা করত সেটাই তাদের জন্য বেশি ভালো হতো। কারণ ভোট তো দেবে জনগণ। সেটা কি বগুড়ায়, গাজীপুরে দেখা যায়নি? বিভিন্ন সংসদীয় আসনে ক্ষমতাসীন দলের অনেক এমপির অবস্থা ভালো নয় এমন সংবাদ অহরহ চোখে পড়ে। নির্বাচনী গণতন্ত্রে এটার অসীম গুরুত্ব রয়েছে। কারণ অনেক জায়গায় ক্ষমতাসীনদের নেতিবাচক ভোট তৈরি হয়। সেই ভোট ধরতে হয়। বিরোধী দল বিশেষ করে বিএনপি যদি মনে করে, কেউ এসে তাদের ক্ষমতায় বসার বন্দোবস্ত করে দেবে সেটা আকাশকুসুম ভাবনা হবে। সেই ইউটোপিয়া থেকে সরে আসতে হবে। 

ব্যাপকাশ্রয়ী চিন্তা থেকে পুরো জাতিকে সরিয়ে আনা দরকার। শুধু ভোটে পেট ভরবে না। ভোটের সঙ্গে ভাতের রাজনীতি করতে হবে। ভাতের রাজনীতির সঙ্গে উন্নয়নের রাজনীতি এক করতে হবে। জনগণকে যারা গণতন্ত্র বলতে শুধু নির্বাচন সামনে এনে বোঝানোর চেষ্টা করে চলেছেন তারা জনগণকে ঠকাচ্ছেন। কারণ গণতন্ত্র যতটা নির্বাচনমুখী তার থেকেও বেশি উন্নয়নমুখী। নির্বাচন কোনো উন্নয়ন প্রক্রিয়া নয়, এটি একটি বৃহৎ সিস্টেমের অনেকগুলো প্রবণতা ও প্রক্রিয়ার একটি অংশমাত্র। শুধু ক্ষমতা পরিবর্তনের রাজনৈতিক নির্বাচন সবসময় প্রত্যাশিত পথে নাও আসতে পারে। বাংলাদেশের রাজনীতি অধিক ব্যক্তি ও দলাশ্রয়ী। এখানে দলের সিদ্ধান্তেও আবার ব্যক্তির প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত। এ অবস্থায় স্রেফ গণতন্ত্রে কোনো মুক্তি নেই। ভাবনা পরিবর্তন করতে হবে। রাজনীতি থেকে ব্যক্তিনির্ভরতা পরিহার করতে হবে। এটি আমাদের রাজনীতির যে ক্ষতি করেছে তা থেকে শান্তিপূর্ণ একটি উত্তরণ ঘটাতে হবে। যৌথ প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতির কথা ভাবতে হবে। যেখানে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার সুযোগ কম থাকার কারণে ক্ষমতার অপব্যবহারেরও সুযোগও কম। 

রাজনীতিতে চড়াই-উতরাই, টানাপড়েন অনিবার্য। এটি আরো অবশ্যম্ভাবী যখন ক্ষমতা দখলই রাজনৈতিক দলের প্রধান লক্ষ্য থাকে। সুতরাং, সমস্যা সেখানে একটি সাধারণ বিষয়। রাজনৈতিক এ ধরনের সমস্যার সবচেয়ে বড় সমাধান হলো সংলাপ। আর এটি কার্যকরের বড় জায়গা হলো যৌথ প্রতিনিধিত্বশীল রাজনীতি, ব্যক্তিকেন্দ্রিক রাজনীতি নয়। 

ড. আমানুর আমান: লেখক ও গবেষক 

আরও