এ অনুষ্ঠানের (বণিক বার্তা আয়োজিত পলিসি কনক্লেভ) বিষয়বস্তুর দুটি দিক রয়েছে। একটি হলো উৎপাদকরা যেন তাদের উৎপাদিত দ্রব্যের যথাযথ দাম পান। আরেকটি দিক হলো ভোক্তারা যেন যৌক্তিক দাম দিয়ে বাজার থেকে তাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনতে পারেন।
এ দুই দিকই এখন অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে। কারণ পণ্যের উৎপাদকরা যেমন যৌক্তিক দাম পাচ্ছেন না তেমনি ভোক্তারাও যৌক্তিক মূল্যে পণ্য ক্রয় করতে পারছেন না। একই সঙ্গে আরো একটি দিক বিবেচনা করা দরকার যে আমদানীকৃত খাদ্যপণ্য কতটা নিরাপদ বা দেশেই উৎপাদিত খাদ্যপণ্য কতটা নিরাপদ সেটি নির্ধারণ করা। কারণ ক্যান্সার হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের বড় একটি অংশ কৃষক। এর অর্থ হলো উৎপাদন প্রক্রিয়ায় এমন সব রাসায়নিক উপাদান ব্যবহার হচ্ছে যেগুলোর সবচেয়ে বড় ভুক্তভোগী কৃষক। যারা আবার তাদের উৎপাদিত পণ্যের সঠিক দামও পাচ্ছেন না। এদিকে ভোক্তারা এসব খাদ্যপণ্য অতিরিক্ত দামে কিনছেন এবং ভোক্তাদের জন্যও এসব খাদ্যপণ্য নিরাপদ নয়। সব মিলিয়ে আমরা খুবই জটিল পরিস্থিতিতে আছি, যেটা আরো অনুসন্ধান ও গবেষণার দাবি রাখে।
বাংলাদেশে একসময় কৃষি ও খাদ্য সম্পর্কিত বিষয়গুলো গবেষণার ক্ষেত্রে এবং সরকারি নীতিমালা আলোচনার ক্ষেত্রে বেশি গুরুত্ব পেত। কিন্তু আশির দশকের পর থেকে, বিশেষত নব্বই দশক থেকে কৃষি আর তেমন গুরুত্ব পায় না গবেষণা কিংবা নীতিমালা প্রণয়নের ক্ষেত্রে। কারণ এটার পেছনে প্রয়োজনীয় বাজেট দেয়া হয় না। সেজন্য নিরাপদ খাদ্য ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে এ বিষয়গুলো নিয়ে আরো বেশি কাজ করতে হবে।
মুক্তবাজার অর্থনীতির সাধারণ ধরন হচ্ছে, এখানে অনেক প্রতিযোগী এবং ক্রেতা-বিক্রেতার সমাহার থাকে। পাশাপাশি সব তথ্য সবার কাছে উন্মুক্ত ও স্পষ্ট থাকবে। এছাড়া বাজার অর্থনীতির হিসাব অনুযায়ী, এখানে চাহিদা ও জোগানের হিসাব করা হয়। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, মুক্তবাজার অর্থনীতি একটি কল্পকথা হয়ে দাঁড়িয়েছে যার কোনো বাস্তব অস্তিত্ব নেই। মূলত যেটার অস্তিত্ব আছে, সেটাকে অর্থনীতির ভাষায় বলে অলিগোপলি, অর্থাৎ কতিপয় সমবৈশিষ্ট্যসম্পন্ন বাজার। যেখানে বেশির ভাগ বাজার, পণ্যের উৎপাদন ও আমদানি এবং সর্বোপরি বাণিজ্য কতিপয় গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। সুতরাং এ রকম বাজার বিদ্যমান থাকলে সেখানে মুক্তবাজার অর্থনীতির মূল ধারণাগুলো কাজ করবে না। এমনকি সুদহারসহ অন্য বাজার অর্থনীতির উপকরণগুলো অকেজো হয়ে পড়বে। সুতরাং এসব ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনয়নের জন্য প্রতিযোগিতা কমিশন ও সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভূমিকা আছে।
কিন্তু গত কয়েক দশকে, বিশেষত গত দেড় দশকে সবচেয়ে ভয়ংকর রকম অবনতি হয়েছে এ দেশের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায়। প্রতিষ্ঠানগুলো ঠিকমতো কাজ করে না। তথ্য-উপাত্তে গরমিল রয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) যথাযথভাবে কাজ করে না। তথ্য-উপাত্তকে নিয়ন্ত্রণ করে গরমিলের সৃষ্টি করা হয়েছে। আবার মন্ত্রণালয়গুলো তাদের নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করতে পারে না। সব প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম নির্ভরশীল ছিল ওপরের আদেশের ওপর। কোনো সংগঠনের নিজস্ব প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া, নিজস্ব শক্তি-উদ্যোগ একেবারেই ব্যর্থ হয়ে পড়ে যদি সবকিছু ওপরের আদেশের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে বা একক ব্যক্তিকেন্দ্রিক অবস্থায় চলে। এমনকি আমাদের আদালতও ওপরের আদেশ অনুযায়ী চলে। আর সেটার চর্চা গত দেড় দশকে সবচেয়ে ভয়ংকর আকার ধারণ করেছিল। সেজন্য এ পরিস্থিতি থেকে বের হওয়াটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ। কারণ অলিগোপলিকে রোধ করতে গেলে যে ধরনের প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়ায় কাজ করতে হবে সেখানে যদি ওপরের আদেশের নির্ভরশীলতার মতো একই চর্চার ওপর নির্ভরশীল থাকে তাহলে বাজারের করুণ অবস্থা ও সামগ্রিক প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থার মধ্যে কোনো পরিবর্তন আসবে না।
আমরা সবাই বুঝেছি যে বিগত সরকারের আমলে প্রত্যেক পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির ক্ষেত্রে চাঁদাবাজি একটা বড় ভূমিকা রেখেছে। এটা স্বীকৃতই ছিল যে কৃষকের থেকে পণ্য সংগ্রহের পর বাজার পর্যন্ত পৌঁছানোর প্রতিটি স্তরে চাঁদাবাজির সংখ্যা ক্রমাগত বেড়েছে। এ স্তরগুলোয় লুটপাট ও চাঁদাবাজি অনির্দিষ্ট ও অনিয়ন্ত্রিত হারে বেড়েছে। এর কারণ হলো কোথাও কোনো ধরনের জবাবদিহিতা ছিল না, স্বচ্ছতা ছিল না। যে কারণে বিগত সরকার পতনের পর স্বাভাবিকভাবেই প্রত্যাশা ছিল যে জিনিসপত্রের দাম কমে আসবে, চাঁদাবাজি থাকবে না। অথচ দৃশ্যপটের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। পণ্যের দাম কমছে না।
বরং কিছুদিনের মধ্যে দেখা গেল, চাঁদাবাজির নতুন নতুন ধরন ও কুশীলব এসেছে। একই সঙ্গে মুক্তবাজারের পরিবর্তে এখনো এখানে কতিপয় গোষ্ঠীর হাতে বাজারের নিয়ন্ত্রণ থাকায় দাম বাড়ার কৌশলটা অব্যাহত রয়েছে। দাম বাড়ার আরো কিছু বাস্তব কারণ আমরা জানি, যেমন বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার ও ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য উৎপাদন খরচ কিংবা আমদানি খরচ বেড়ে যাচ্ছে। এছাড়া উৎপাদন খরচ বাড়ার পেছনে অন্যতম কারণ হলো গ্যাস ও বিদ্যুতের দাম বাড়া।
এমন পরিস্থিতিতে দাম কমিয়ে আনতে হলে কিছু সমস্যার সমাধানে সরকারের স্বল্পমেয়াদে মনোযোগ দেয়া প্রয়োজন। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘমেয়াদে মৌলিক নীতিমালা পরিবর্তনের জায়গাগুলোর সন্ধান করা জরুরি। এছাড়া কিছু ক্ষেত্রে মধ্যমমেয়াদি উদ্যোগ নিতে হবে। অর্থাৎ দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে সব ধরনের কাজই করতে হবে। যেমন গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়ার পেছনে পুরো জ্বালানি খাতে সরকারের বিতর্কিত ও ভুল নীতিমালার ভূমিকা রয়েছে। ব্যবসায়ী মহলের নির্দিষ্ট কিছু গোষ্ঠীকে সুবিধা দিতে গিয়ে এমন পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে যে কিছুদিন পর পরই গ্যাস-বিদ্যুতের দাম বাড়াতে হয়। এভাবে বিগত সরকার পুরো অর্থনীতির অধিকাংশ ব্যবসায়ী ও অন্যান্য উৎপাদনশীল খাতকে আঘাত করেছে। এ ঘটনা অন্যান্য ক্ষেত্রেও পুনরাবৃত্তি হয়েছে। যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) শর্তের কারণে যে ভ্যাট বাড়ানো হলো তার ফলে জিনিসপত্রের দাম বাড়ল। এর ফলে সেটা ব্যবসা থেকে শুরু করে উৎপাদনশীলতা—সবক্ষেত্রেই প্রভাব ফেলেছে। এখানে সরকারের যুক্তি হলো আইএমএফ থেকে ঋণ না নিলে অর্থনীতির ঘাটতি মেটানো যাবে না। কিন্তু সাধারণ পরিসংখ্যান খেয়াল করলেও দেখা যায়, আইএমএফ থেকে তিন বছরে সরকার যে ৪ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ নিচ্ছে, সে একই পরিমাণ অর্থ রেমিট্যান্স থেকে আমরা দুই মাসে পাই। প্রতি বছরে আমাদের রফতানি আয় প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলার। সেখানে তিন বছরে আইএমএফের কাছ থেকে ৪ বিলিয়ন ডলার নেয়ার জন্য যেসব শর্ত পূরণ করতে হচ্ছে, সেটার পেছনে কোনো যুক্তি নেই। বরং এসব শর্ত পূরণ করতে গিয়ে আমাদের উৎপাদনশীলতা আঘাতপ্রাপ্ত হচ্ছে এবং অর্থনীতি ব্যয়বহুল হচ্ছে। ফলে মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় বহুগুণে বেড়ে যাচ্ছে, মানুষের ওপরে চাপ তৈরি হচ্ছে। কিন্তু বিচার করলে দেখা যায় এসব নীতির কোনো যুক্তি নেই।
কিন্তু সরকারি নীতিমালার এমন অযৌক্তিক সিদ্ধান্তগুলো অর্থনীতিতে জনসাধারণের ব্যয়বৃদ্ধির চাপ তৈরি করে। চিনিসহ বেশ কয়েকটি পণ্যের দাম আন্তর্জাতিক বাজারের চেয়ে বাংলাদেশে বেশি, কারণ চিনি একচেটিয়াভাবে আমদানিনির্ভর হয়ে পড়েছে এবং বিপরীতে আমাদের চিনিকলগুলো বন্ধ হয়ে পড়ে রয়েছে। অথচ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এগুলো বন্ধ করার কোনো কার্যকর কারণ ছিল না। এগুলো যদি বন্ধ না হতো তাহলে চিনির বাজারে প্রতিযোগিতা থাকত। ফলে আমাদের আমদানিনির্ভরতা কমত এবং কম দামে আমরা তুলনামূলক আরো ভালো ও গুণগত মানের চিনি পেতাম। সর্বোপরি আমদানিনির্ভরতা থেকে বাংলাদেশের অর্থনীতি কিছুটা হলেও বাঁচতে পারত।
আবার আইএমএফ কিংবা বিশ্বব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের যেসব শর্ত পূরণ করতে হবে সেসবের মধ্যে বেসরকারীকরণ এবং পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির নীতি উল্লেখযোগ্য। এ ধরনের পুরনো নীতির কারণে গত সরকারের আমলে যে হারে লুণ্ঠনকারী, ঋণখেলাপি ও দখলদারদের আধিপত্য তৈরি হয়েছিল, সেই একই ধরনের নীতিমালা এখনো যদি অব্যাহত থাকে এ সরকারের আমলেও, তাহলে কিছুই পরিবর্তন হবে না। বরং জিনিসপত্রের যৌক্তিক মূল্যমান থেকে কৃষক ও ভোক্তা উভয়ে বঞ্চিত হতেই থাকবেন।
যেহেতু অন্তর্বর্তী সরকার খুব বেশি দিন ক্ষমতায় থাকবে না, সেজন্য তাদের পক্ষে মৌলিক নীতি পরিবর্তন করার ব্যাপারে নানা সীমাবদ্ধতা আছে। কিন্তু তারা অন্তত পরিবর্তনের কিছু ভিত্তি স্থাপন, নমুনা তৈরি বা দৃশ্যমান লক্ষণ তৈরি করতে পারে। সর্বোপরি মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারে যে সরকার চেষ্টা করছে, কিছু উদ্যোগ নিচ্ছে পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য। কিন্তু আমাদের এসব প্রত্যাশা অনুযায়ী সরকারের তেমন কোনো কার্যক্রম দেখতে পাচ্ছি না। সেজন্য সরকারের দিক থেকে কথা, পরিকল্পনা ও আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি অর্থনীতি, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক কার্যকারিতা ও বাজারে প্রভাব রাখার মতো জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কিছু উদ্যোগ জরুরিভিত্তিতে নেয়া দরকার। এজন্য সরকারকে সুনির্দিষ্ট প্রভাবগুলোকে মাথায় রেখে সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ও মেয়াদকে লক্ষ্য রেখে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কার্যকর করতে হবে। এটাই আমাদের প্রত্যাশা। পাশাপাশি কৃষিখাদ্য নিয়ে দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ, গবেষণা কিংবা কমিশন গঠন করার ব্যাপারেও সরকার উদ্যোগী হবে বলে প্রত্যাশা করি।
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক
[বণিক বার্তা আয়োজিত ‘খাদ্যপণ্যের যৌক্তিক দাম: বাজার তত্ত্বাবধানের কৌশল অনুসন্ধান’ শীর্ষক পলিসি কনক্লেভে সম্মানিত অতিথির বক্তব্যে]