একটি নতুন বিশ্বের সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে আমরা। যেখানে প্রাচ্যের মাটি ও পশ্চিমের আকাশে জেগে উঠছে এক অদৃশ্য যুদ্ধের ছায়া। এ যুদ্ধ তলোয়ার বা ট্যাঙ্কের নয়, এ যুদ্ধের অস্ত্র হলো—ডাটা, অ্যালগরিদম ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই)। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের লড়াইয়ের পাশাপাশি এটা নবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের এক মহাযজ্ঞও বটে! প্রযুক্তির বলয়ে বিশ্ব আজ দুভাগে বিভক্ত—একপাশে আমেরিকা, অন্যপাশে চীন। এ বিভাজন শুধু মানচিত্রের নয়, এ বিভাজন ডিজিটাল, এ বিভাজন চিন্তার, এ বিভাজন ভবিষ্যতের। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এ নতুন যুগের প্রধান হাতিয়ার। এটি শুধু প্রযুক্তি নয়, এটি হলো এক নতুন শক্তি, যা সমাজ, অর্থনীতি, এমনকি মানবচিন্তাকেও নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ক্ষমতা ‘অসীম’, বিপদও কম নয়। এটি যেমন উন্নতির নতুন দিগন্ত খুলে দিচ্ছে, তেমনই তৈরি করছে নতুন আতঙ্ক।
এ নতুন যুদ্ধে চীন ও আমেরিকার প্রতিযোগিতা শুধু প্রযুক্তিগত নয়, এটি আদর্শিকও। চীন তার সমাজতান্ত্রিক মডেলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যাচ্ছে, আর আমেরিকা চিরাচরিত উদারনৈতিক গণতন্ত্রের ছায়ায় এগোচ্ছে। কিন্তু এ লড়াইয়ে হারজিত শুধু এ দুই দেশের নয়, এটি গোটা মানবতার ভাগ্য নির্ধারণ করবে।
১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবরে সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন প্রথম কৃত্রিম উপগ্রহ ‘স্পুটনিক’ উৎক্ষেপণ করে, তখন সারা বিশ্ব স্তম্ভিত হয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে মস্কোর কমিউনিস্ট শাসন কিছু সময়ের জন্য হলেও এগিয়ে যায়। যা রীতিমতো সূচনা করেছিল স্নায়যুদ্ধের। এখন চীনা কোম্পানি ‘ডিপসিক’ কি সেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটাতে যাচ্ছে? প্রযুক্তিগত দৌড়ে কি চীন যুক্তরাষ্ট্রকে নতুনভাবে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে?
১৯৫৭ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্পুটনিক-১ উৎক্ষেপণের মাধ্যমে প্রথম মহাকাশে মানবনির্মিত স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিশ্বকে তাক লাগিয়ে দেয়। ১৯৬১ সালে ইউরি গ্যাগারিনকে প্রথম মানুষ হিসেবে মহাকাশে পাঠিয়ে সোভিয়েতরা তাদের প্রযুক্তিগত সক্ষমতায় এগিয়ে যায় আরো এক ধাপ। যুক্তরাষ্ট্র এ প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়লেও ১৯৬৯ সালে অ্যাপোলো-১১ মিশনে চাঁদে মানুষ পাঠিয়ে তাদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠা করে। এ মহাকাশ প্রতিযোগিতা কেবল বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির বিষয় ছিল না, বরং এটি ছিল দুই পরাশক্তির মধ্যকার জাতীয়তাবাদ তথা রাজনৈতিক লড়াইয়ের একটি মঞ্চও।
চীনা কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তা ‘ডিপসিক’-এর আগমন জন্ম দিয়েছে একই পরিস্থিতির। বছর দুয়েক ধরেই প্রযুক্তিতে আলোচিত নাম ‘চ্যাটজিপিটি’ তথা ওপেনএআই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মডেলগুলো যেন পশ্চিমা বিশ্বের প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্বের প্রতীক হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল। সে যুদ্ধে খানিকটা যেন চুপচাপই ছিল চীন। সেখানে ডিপসিক যেন ‘বিনা মেঘে বজ্রপ্রাত’। পশ্চিমাদের চেয়ে প্রায় ৩০ গুণেরও কম খরচে এটি নির্মাণ করা হয়েছে। ডিপসিকের শক্তিশালী প্রসেসিং ক্ষমতা, উন্নত কনটেক্সট বোঝার দক্ষতা ও স্থানীয় ভাষাগুলোর প্রতি অধিক গ্রহণযোগ্যতা একে চীনা প্রযুক্তির বড় বিজয় হিসেবে তুলে ধরেছে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এতদিন পর্যন্ত কেবল মার্কিন প্রযুক্তি সংস্থাগুলোর বিনিয়োগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল, যেখানে শত শত বিলিয়ন ডলার ব্যয় করা হয়েছে। ধারণা করা হচ্ছিল, এ শীর্ষস্থান আগামী কয়েক দশক ধরে সিলিকন ভ্যালির দখলে থাকবে। কিন্তু ‘ডিপসিকের’ চমকপ্রদ উত্থান সেই পূর্বানুমানকে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। পশ্চিমা বিশ্বের সবচেয়ে সুস্পষ্ট কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বী এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মতো গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে সমতুল্য প্রতিযোগী হয়ে উঠেছে—তাও প্রায় ৩০ গুণ কম খরচ করেই।
চ্যাটজিপিটির তুলনায় ডিপসিক শুধু দ্রুতগামী নয়, এটি ৩০ গুণ কম ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিদ্বন্দ্বী সংস্থাগুলোর চেয়ে সহজেই বাজারে প্রবেশযোগ্য। চ্যাটজিপিটির অপারেশন খরচ যেখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল, ডিপসিক তার কার্যক্ষমতার অনুপাতে বহুগুণ সাশ্রয়ী। এটি চীনের লক্ষ্যবদ্ধ কৌশলের সফল বাস্তবায়ন। চীন তার নিজস্ব ইন্টারনেট ইকোসিস্টেম তৈরি করায় ডিপসিকের জন্য প্রচুর পরিমাণে স্থানীয় তথ্য সহজলভ্য। অন্যদিকে চ্যাটজিপিটি পশ্চিমা খোলা ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীল।
চীনের এআই নীতিমালা কখনই শুধু বাণিজ্যিক বা প্রযুক্তিগত কৌশলের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। এটি ছিল একটি দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় কৌশলের অংশ, যা ‘মেইড ইন চায়না ২০২৫’ পরিকল্পনার অধীনে গঠিত হয়েছে। ডিপসিকের প্রতিষ্ঠাতা লিয়াং ওয়েনফেং স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, ‘তাদের সংস্থা মূলত মুনাফার জন্য নয়, বরং চীনা জাতীয় কৌশলের অংশ হিসেবে কাজ করছে’। তার বক্তব্য যেন চীনের ঐতিহ্যবাহী ‘প্রতিযোগীদের দাম কমিয়ে বাজারে আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার’ মডেলেরই প্রতিফলন।
ডিপসিকের উত্থান পশ্চিমাদের জন্য শুধু প্রযুক্তিগত নয়, বরং নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকেও চিন্তার কারণ হয়ে উঠেছে। যদি পশ্চিমা প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো সস্তা চীনা এআই মডেল গ্রহণ করে, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের চীনা প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীলতা আরো বেড়ে যাবে। ডিপসিকের ঘোষণার পরই গুগল, মাইক্রোসফট এবং ওপেনএআইয়ের শেয়ারমূল্য নিম্নমুখী হতে শুরু করে। এ ঘটনা প্রযুক্তি বিনিয়োগকারীদের জন্য এক নতুন বাস্তবতা তৈরি করেছে—যেখানে চীন শুধু উৎপাদনের ক্ষেত্রে নয়, বরং গবেষণা ও উদ্ভাবনের ক্ষেত্রেও এখন বিশ্বব্যাপী প্রতিযোগিতার প্রধান খেলোয়াড়। বাজার বিশ্লেষকদের মতে, চীনের প্রযুক্তিগত বিকাশ অব্যাহত থাকলে ভবিষ্যতে আরো পশ্চিমা সংস্থাগুলোর বাজারমূল্য ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
ডিপসিকের সাফল্য এমন এক সময়ে এসেছে যখন ওয়াশিংটন চীনের ওপর উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন চিপ প্রযুক্তি রফতানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। অথচ এ প্রতিরোধ উপেক্ষা করেই চীনা প্রতিষ্ঠানটি নতুন উচ্চতায় পৌঁছেছে। ট্রাম্প প্রশাসনের ‘প্রজেক্ট স্টারগেট’ নামে ঘোষিত ৫০০ বিলিয়ন ডলারের এআই বিনিয়োগ পরিকল্পনা এতদিন ধরে গর্বের বিষয় ছিল। কিন্তু সোমবার চীনের প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সামনে এ প্রকল্প যেন অনেকটাই ম্লান হয়ে গেছে।
সত্তরের দশকের মহাকাশ প্রতিযোগিতা যেমন স্নায়ুযুদ্ধের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল, তেমনি আজকের এআই প্রযুক্তির লড়াইও বৈশ্বিক রাজনীতিতে নতুন করে সে আবহ ফিরিয়ে আনছে। উভয় ক্ষেত্রেই প্রযুক্তিগত শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে বৈশ্বিক রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চলছে। এ লড়াইয়ের ফলাফল ভবিষ্যতের বিশ্বকে কী দিকে নিয়ে যাবে, তা এখনো অনিশ্চিত।
আশির দশকে শেষ পর্যন্ত স্নায়ুযুদ্ধের চূড়ান্ত অধ্যায়ও মহাকাশ সম্পর্কিত বিষয়ের মাধ্যমে নির্ধারিত হয়। প্রেসিডেন্ট রোনাল্ড রিগ্যান তার ‘স্টার ওয়ার্স’ প্রকল্পের মাধ্যমে মহাকাশভিত্তিক ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ ব্যবস্থা তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এটির মূল নাম ছিল এসডিআই প্রকল্প। এটি মূলত একটি প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছিল। যার অন্যতম লক্ষ্য ছিল লেজার ও স্যাটেলাইট ব্যবহার করে শত্রুর ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করা, মহাকাশভিত্তিক প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা, একই সঙ্গে নিউক্লিয়ার প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তোলা। ১৯৮৫ সালে মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নের নেতা হন। তিনি দেখলেন এ প্রকল্প শুধু সামরিক প্রতিযোগিতাই বাড়াবে না, বরং রুগ্ণ সোভিয়েত অর্থনীতির আরো চাপ সৃষ্টি করবে। ফলে তিনি অনেকটাই প্রতিযোগিতার পথে না হেঁটে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সামরিক আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা করার অভিযোগ তোলেন। এরপরই শুরু হয় অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তির আলোচনা। গর্বাচেভ প্রস্তাব দেন, সোভিয়েত ইউনিয়ন পারমাণবিক অস্ত্র হ্রাস করতে রাজি, যদি যুক্তরাষ্ট্র এসডিআই প্রকল্প বাতিল করে। সে যাত্রায় আলোচনা ব্যর্থ হলেও ১৯৮৭ সালে ইন্টারমিডিয়েট-রেঞ্জ নিউক্লিয়ার ফোর্সেস চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এতে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপে মধ্যম পাল্লার নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্র কমাতে রাজি হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত রিগ্যানের এসডিআই প্রকল্পের কারণে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতিরক্ষা বাজেট আরো বেড়ে যায়। সোভিয়েত অর্থনীতি দুর্বল হয়ে পড়ে। অনেকেই মনে করেন সোভিয়েত পতনের অন্যতম কারণ ছিল এ প্রকল্প।
যুক্তরাষ্ট্র মহাকাশ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হয়েছিল তাদের বিজ্ঞানীদের উদ্ভাবনী শক্তি ও নভোচারীদের অসাধারণ সাহসের মাধ্যমে। তবে এর পেছনে বিশাল অর্থনৈতিক শক্তিরও অবদান ছিল। ১৯৬০-৭৩ সাল পর্যন্ত চাঁদে পৌঁছানোর অ্যাপোলো প্রকল্পে বর্তমান মূল্যে ৩০০ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি খরচ হয়েছিল। কিন্তু তখনকার যুক্তরাষ্ট্র এতটাই অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী ছিল যে এ বিশাল ব্যয় প্রতিরক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষা খরচের তুলনায় তেমন বড় কিছু মনে হয়নি। সোভিয়েত অর্থনীতি সেই প্রতিযোগিতায় টিকতে পারেনি। এখনকার পরিস্থিতি যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক অতটা অনুকূলে নেই। ২০০৮ সালের আর্থিক সংকটের পর থেকে মার্কিন জনগণের মধ্যে এক ধরনের রাজনৈতিক ক্ষোভও দৃশ্যমান।
এ প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন জাগে আমরা কোন দিকে যাচ্ছি? এআইয়ের যুগে কি আমরা নতুন এক মানবসভ্যতার দিকে এগোচ্ছি, নাকি ধ্বংসের পথে পা বাড়াচ্ছি? এ প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের ভাবতে হবে সহযোগিতা ও সংহতির ভাষায়। এ নতুন যুদ্ধে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতা যেমন প্রগতির চালিকাশক্তি, তেমনই সহযোগিতা হলো টিকে থাকার মূলমন্ত্র। এ নতুন যুদ্ধে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে প্রযুক্তির নৈতিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে মানবকল্যাণে, ধ্বংসে নয়। এ লক্ষ্যে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে একত্র হয়ে কাজ করতে হবে। কারণ প্রযুক্তির এ প্রতিযোগিতা শুধু রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার লড়াই নয়, এটি মানবতার সংগ্রাম। আমরা এক কঠিন সময়ের মুখোমুখি। এ সময়ে আমাদের পথ দেখাবে সহমর্মিতা, সহযোগিতা ও মানবিক মূল্যবোধ। কারণ প্রযুক্তি যতই উন্নত হোক, মানুষের হৃদয়ই হলো সবচেয়ে বড় অস্ত্র। এ অস্ত্রের জোরে আমরা জয়ী হব—নতুন এক বিশ্ব গড়ে তুলব, যেখানে প্রযুক্তি মানবতার প্রতিযোগী নয় বরং সহযোগী হবে। যেখানে প্রযুক্তি মানবতার সেবক হবে, শাসক নয়।
মাহফুজ রাহমান: জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক, বণিক বার্তা