সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে একটা কথা বারবার উঠে আসছে—‘রাষ্ট্র মেরামত’। একই সঙ্গে আরেকটি কথাও শোনা যাচ্ছে ‘রাষ্ট্র সংস্কার’। বর্তমান চালচিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে এ ধারণা দুটো সম্পর্কে প্রথমেই তিনটি কথা বলা প্রয়োজন। প্রথমত, মেরামত ও সংস্কার—এ শব্দদ্বয়ের পরিধি, ব্যঞ্জনা এক নয়। মেরামত যেখানে কোনো ক্ষতি-বিক্ষতির আপাত সমাধান বোঝায়, সংস্কার সেখানে সমস্যার মৌলিক কাঠামোগত পরিবর্তন বোঝায়। দ্বিতীয়ত, মেরামত ব্যাপারটি তাৎক্ষণিক বা স্বল্পমেয়াদের; সংস্কার ব্যাপারটি মধ্য কিংবা দীর্ঘমেয়াদের। তৃতীয়ত, সময়সীমার বিবেচনায় মেরামত হবে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কর্মপরিধির অংশ, সংস্কার হবে নির্বাচিত সরকারের কর্মপরিধির অংশ।
তাৎক্ষণিকভাবে প্রথম যে রাষ্ট্রীয় মেরামতটি দরকার তা হচ্ছে দেশে শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং আইন-শৃঙ্খলা নিশ্চিত করা। পাশাপাশি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা। সেই প্রসঙ্গে সামাজিক সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির নিশ্চিতকরণ অত্যন্ত জরুরি। সামাজিক সৌহার্দ্যের ক্ষেত্রে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সমাজে সবাই সবার বিরুদ্ধে এবং প্রত্যেকে প্রত্যেকের প্রতিপক্ষ। একই সঙ্গে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নিয়ে বর্তমানে আশঙ্কার অবকাশ রয়েছে। হিন্দু নাগরিকের জানমাল, বাড়িঘর ও উপাসনালয় বিনষ্ট করার প্রচেষ্টা বিদ্যমান। আশ্বাসের কথা, ছাত্র-জনতা সেই সব প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে সদা জাগ্রত এবং সে ব্যাপারে যেকোনো অপচেষ্টাকে তারা প্রতিহত করছে। ক্ষয়িষ্ণু সামাজিক সম্প্রীতি এবং আশঙ্কিত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিকে অবিলম্বে মেরামত করতে হবে।
দ্বিতীয়ত মেরামতটি হতে হবে সম্প্রতি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী পুলিশ প্রশাসনের ভেঙে পড়া প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর অবিলম্বে পুনর্গঠন। গত কয়েক দিনে একাধিক পুলিশ সদস্যকে হত্যা করা হয়েছে, বহু পুলিশ কেন্দ্র পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে এবং অন্যান্য কেন্দ্র তালাবদ্ধ। পুলিশ প্রশাসনের অনুপস্থিতি দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি এবং নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তাকে বিঘ্নিত করেছে। পুলিশ প্রশাসনের আশু পুনঃস্থাপন অত্যন্ত জরুরি।
তৃতীয়ত রাষ্ট্রীয় মেরামত করতে হবে ধ্বংসপ্রাপ্ত রাষ্ট্রীয় সম্পত্তির পুনঃস্থাপন ও পুনর্গঠন প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে। রাষ্ট্রীয় স্থাপনার যে বিনষ্টীকরণ কয়েক সপ্তাহ ধরে চলেছে এবং গত কয়েক দিনে রাষ্ট্রীয় সম্পদের যে ধ্বংসযজ্ঞ চলেছে তা অতি বিশাল। এগুলোর মেরামতে অজস্র সম্পদ এবং বিরাট প্রচেষ্টার প্রয়োজন হবে। কিন্তু প্রক্রিয়াটি দ্রুতই করতে হবে। সেই সঙ্গে যেসব ইতিহাস-প্রতীকী চিত্র, শিল্পকর্ম, ভাস্কর্য, জাদুঘর বিনষ্ট করা হয়েছে সেগুলোরও আশু মেরামত প্রয়োজন। এর মধ্যে রয়েছে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, ৩২ নম্বরের ঐতিহাসিক ভবন, জাতির পিতার ভাস্কর্য, ইতিহাসের মাইলফলকভিত্তিক ভাস্কর্য, সাত বীরশ্রেষ্ঠের আবক্ষ ভাস্কর্য প্রভৃতি। আমাদের জাতিসত্তার জন্য এগুলো ক্ষমাহীন অপরাধ, যার যোগ্য শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।
স্বল্পমেয়াদে প্রথমেই যে রাষ্ট্রীয় মেরামতটি প্রয়োজন হবে সেটি হচ্ছে নানা বিষয়ে একটি গণতান্ত্রিক, দৃশ্যমান, সর্বজনীন অংশগ্রহণমূলক আলাপ-আলোচনার ক্ষেত্র তৈরি করা। কণ্ঠস্বরের স্বাধীনতা, মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা সেই মেরামতের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ। দ্বিতীয় যে রাষ্ট্রীয় মেরামতটি করতে হবে, তা করতে হবে নির্বাচন কমিশনের কাঠামোকে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ করে দেয়ার মাধ্যমে। তৃতীয় মেরামত উদ্যোগটি হবে একটি মুক্ত, দৃশ্যমান, নিরপেক্ষ ও সর্বজনীন অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন সংগঠন। বলা চলে, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের সেটাই মুখ্য কাজ।
মধ্যমেয়াদ হবে রাষ্ট্র মেরামতের নয়, রাষ্ট্র সংস্কারের। প্রথম সংস্কারটি হতে হবে নির্বাচন কাঠামো এবং সাংবিধানিক কাঠামো প্রসঙ্গে। নির্বাচন কাঠামো প্রসঙ্গে নিম্নোক্ত প্রশ্নগুলো উত্থাপিত এবং আলোচিত হতে পারে—আমাদের জাতীয় সংসদ দ্বিকক্ষবিশিষ্ট হবে কিনা; সমানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব থাকবে কিনা; সরকার ও সরকারপ্রধানের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হবে কিনা। সংবিধান সম্পর্কেও নিম্নোক্ত বিষয়গুলো সংস্কার-আলোচনার অংশ হতে পারে—’৭২-এর সংবিধানে ফিরে যাওয়া, বর্তমান সংবিধানের সংস্কার কিংবা নতুন প্রজন্মের আশা-আকাঙ্ক্ষা মনে রেখে নতুন এক সংবিধান। শেষোক্ত বিষয়টির জন্য অবশ্য একটি গণপরিষদ এবং গণপরিষদ নির্বাচন প্রয়োজন হবে।
দ্বিতীয় রাষ্ট্র সংস্কারের ক্ষেত্রটি হবে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কাঠামো সংস্কারের। মধ্যমেয়াদে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে বহুমাত্রিক সংস্কারের। আমরা সবাই জানি, আমাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলোর গভীর কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে এবং দীর্ঘদিনের অবহেলা ও রাজনীতিকরণের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরো অকার্যকর করে ফেলা হয়েছে। সব সংস্কারের মূল কথা হবে অঙ্গীকার, দায়িত্ববোধ, জনমুখিতা, দৃশ্যমানতা ও দায়বদ্ধতা।
রাষ্ট্রীয় সংস্কার প্রয়োজন হবে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, আইনের শাসন, জনপ্রশাসনের নানা দিক যথা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর ক্ষেত্রে। সংস্কার লাগবে পুলিশ প্রশাসনে যাতে একটি জনসেবামুখী, অরাজনৈতিক পুলিশ বাহিনী গড়ে তোলা যায়। নির্বাচন কমিশনের সংস্কার করে তাকে স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতার উচ্চ পর্যায়ে নিয়ে যেতে হবে, যাতে নির্বাচন কমিশন নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য তার ওপর অর্পিত দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করতে পারে। দুর্নীতি দমন কমিশনের মতো প্রতিষ্ঠানকে মুক্ত ও নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলতে পারে। প্রাতিষ্ঠানিক সংস্কার করতে হবে সরকারি কর্মকমিশন, বাংলাদেশ ব্যাংকেরও আশু পরিবর্তন প্রয়োজন। এসব ক্ষেত্রে দৃশ্যমানতা ও জবাবদিহির একটি মজবুত কাঠামো গড়ে তোলা অপরিহার্য। এর ফলে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির মতো অপকর্মগুলোকে বাগ মানানো যাবে।
তৃতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্কার করতে হবে আর্থিক ও সামাজিক খাতে। আর্থিক খাতে ব্যাংক ব্যবস্থার আমূল সংস্কার দরকার। কর নীতি, মুদ্রা নীতি, বাণিজ্য নীতিসহ সব রকমের সামষ্টিক নীতির সংস্কার প্রয়োজন। আর্থিক খাতে স্বল্পমেয়াদে অর্থ পাচার নিরোধে সংস্কারকাজ শুরু করা য়েতে পারে, যাতে দেশের সম্পদভিত্তি বৃদ্ধি পায়।
তরুণদের আন্দোলনের একটি বড় দিক হচ্ছে বৈষম্যহীন বাংলাদেশ। আমাদের সমাজে বৈষম্যের নানা মাত্রিকতা আছে। বৈষম্য আছে নানা আর্থসামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যে, বৈষম্য আছে নানা অঞ্চলে এবং সবচেয়ে বড় কথা বৈষম্য আছে শুধু ফলাফলেই নয়, বৈষম্য আছে মূলত সুযোগেও। শিক্ষা, স্বাস্থ্য খাতে সুযোগের বৈষম্য বিশাল। কর্মনিয়োজনের সুযোগে আকাশচুম্বী বৈষম্য তরুণ সমাজের অন্যতম ক্ষোভের কারণ ছিল। সামাজিক খাতে শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার। সামাজিক বৈষম্য হ্রাসে দারিদ্র্য, বঞ্চনা ও প্রান্তিকতা বিষয়গুলোর ওপর জোর দিতে হবে।
আগামীতে নতুন বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদি একটি রূপরেখা প্রণয়ন করতে হবে। সে রূপরেখা চিহ্নিত করবে আগামী দিনের বাংলাদেশের পথযাত্রা। এ রূপরেখার মূল কারিগর হবে আজকের তরুণরা এবং তাদের দিকদর্শনই চালিত করবে ভবিষ্যতের বাংলাদেশকে। আজকের বাংলাদেশে তরুণরা আর ‘দেশের ভবিষ্যৎ’ হয়ে থাকবে না, তারা হবে ‘দেশের বর্তমান’।
সেলিম জাহান: ভূতপূর্ব পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র