পরিবেশকে অবহেলা করে যতই মেট্রোরেল এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ হোক, ঢাকা নিশ্চলই থাকবে

অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নিল, আমরা অনেকগুলো কমিশন দেখেছি। সংবিধান সংস্কার কমিশন, অর্থনীতি সংস্কার কমিশনসহ অনেক ধরনের কমিশন সরকার করেছে।

ড. আদিল মুহাম্মদ খান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের সভাপতি এবং ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিডি) নির্বাহী পরিচালক। রাজধানীর বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা ২০১৬-৩৫ (ড্যাপ) সংশোধন ও অন্তর্বর্তী সরকারের নগর ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন বণিক বার্তার সঙ্গে। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন আল ফাতাহ মামুন

অন্তর্বর্তী সরকার অনেক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করছে। অনেক সংস্কারও করা হচ্ছে। নগর সংস্কারে সরকার কতটুকু গুরুত্ব দিচ্ছে, বিশেষ করে ঢাকার বাসযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে কী পলিসিতে এগোচ্ছে বলে মনে হয়?

অন্তর্বর্তী সরকার যখন দায়িত্ব নিল, আমরা অনেকগুলো কমিশন দেখেছি। সংবিধান সংস্কার কমিশন, অর্থনীতি সংস্কার কমিশনসহ অনেক ধরনের কমিশন সরকার করেছে। বাংলাদেশে গত কয়েক দশকে নগরায়ণে যে মাত্রায় দূষণ যোগ হয়েছে, পানি, মাটি, বায়ু সবই দূষিত হয়ে পড়েছে। এক কথায় নগরগুলো বসবাসের যোগ্যতা হারিয়েছে। আগামীর নতুন বাংলাদেশ গড়ার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসম্মত নগরায়ণ ও নগর পরিকল্পনা প্রাধান্য পাওয়ারই কথা। কিন্তু দুঃখজনক বাস্তবতা হলো, নগর পরিকল্পনা, নগরায়ণ বা অসম উন্নয়ন নিয়ে যে তামাশা বিগত সময়গুলোয় হয়েছে, সেটা নিয়ে কোনো ধরনের সংস্কার কমিশন সরকার করেনি। পাশাপাশি নগরায়ণের সঙ্গে সম্পর্কিত আরেকটা বিষয় হলো পরিবেশ; নগর ও পরিবেশ দুটো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কিন্তু পরিবেশ নিয়েও কোনো কমিশন হয়নি। একটি দেশের মূল বিষয় হলো নগরায়ণ-পরিবেশ, যার সঙ্গে অবকাঠামো ও উন্নয়ন সরাসরি সম্পৃক্ত। অথচ সরকারের ফ্রেমে আমরা দেখিনি যে নগর-পরিবেশ নিয়ে সরকার আলাদা কোনো চিন্তা করেছে। যদিও অর্থনীতি সংস্কার কমিশন, তাদের রিপোর্টে নগরায়ণের বিষয়ে কিছু নীতিমালা বা কিছু প্রস্তাব রেখেছে। কিন্তু সেটা তাদের মূল কাজ ছিল না। সরকার যদি সত্যিকার অর্থে আন্তরিক হতো, নগরায়ণসংক্রান্ত একটা কমিশন খুবই জরুরি ছিল।

তার মানে অন্তর্বর্তী সরকারের পলিসিতে নগরায়ণ ও পরিবেশ সেভাবে গুরুত্ব পাচ্ছে না...

এটা দুঃখজনক বাস্তবতা যে সরকার যেভাবে অর্থনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশকে দেখে, বিশ্বের আর কোথাও এভাবে দেখা হয় না। সারা পৃথিবীতেই পরিকল্পনা, পরিবেশ ও অর্থনীতি এক দৃষ্টিতে দেখা হয়। কেবল অর্থনীতিকে প্রাধান্য দিয়ে একটা দেশ ঘুরে দাঁড়াতে পারে না। সেখানে পরিবেশ, পরিকল্পনা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সরকার সে অর্থে নগরের পরিকল্পনা নিয়ে যেমন কোনো কমিশন করেনি, কিংবা পরিকল্পনাবিদদের জ্ঞান কাজে লাগানোর খুব বেশি প্রচেষ্টা নেই। বরং আমরা দেখছি উল্টো চিত্র। পরিকল্পনাবিদদের যেসব সুপারিশ রয়েছে, যেগুলো আগেও আমরা বিভিন্ন সরকারের সময় দেয়া হয়েছে, এ সরকারের কাছেও দিয়েছি। কিন্তু বাংলাদেশের মতো বিকাশমান অর্থনীতির দেশে পরিকল্পনাবিদদের সুপারিশ যেভাবে বাস্তবায়ন হওয়া উচিত, তাদের সঙ্গে নিয়ে কাজ করা, তাদের কথা শোনার মানসিকতা আগের সরকারগুলোর মধ্যে ছিল না। বর্তমান সরকারও পরিকল্পনাবিদদের প্রেসক্রিপশন নিতে চায়নি। পরিকল্পনাবিদরা ব্যবস্থাপনার কথা বলেন। ব্যবস্থাপনার কথা বললেই ব্যবসায়ীরা মানতে চান না। ব্যবসায়ীরা যত্রতত্র অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে চান। পরিকল্পনা হলো এক ধরনের রেগুলেশন ও নিয়ন্ত্রণ। ব্যবসায়ীরা নিয়ন্ত্রণ চান না। এ সরকার যদি পরিকল্পনাকে সেভাবে গুরুত্ব দিত, তাহলে বাংলাদেশকে আমরা যে জায়গায় নিতে চাই, সে জায়গায় যাওয়ার মতো পথরেখা তৈরি হতো। কিন্তু এখন পর্যন্ত সুষম পরিকল্পনা নিয়ে সরকারের কোনো উদ্যোগ আমরা দেখিনি।

ড্যাপ সংস্কার হচ্ছে। বিদ্যমান ড্যাপের কারণে আবাসন ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে ভবনের উচ্চতা বাড়ানো জরুরি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। এক্ষেত্রে বাদ সাধছেন পরিকল্পনাবিদরা।

অন্তর্বর্তী সরকার গঠন হওয়ার পর আবাসন ব্যবসায়ীদের একটা গোষ্ঠী সরকারের কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। এ গোষ্ঠী বিগত সরকারের সময়ই সরকারের খুব কাছে যাওয়ার চেষ্টা করেছে। আর যেহেতু তারা ব্যবসায়ী, তাই তারা বিগত সরকারের সান্নিধ্যও পেয়েছে। বিগত সরকারের অবৈধ শাসন যে মহলগুলো টিকিয়ে রেখেছিল, তাদের মধ্যে এ ব্যবসায়ী মহল অন্যতম। বিগত সময় যখন ড্যাপ তৈরি হচ্ছিল, তখন এ মহলই বলেছিল, বিশেষ করে জনঘনত্ব প্রসঙ্গে যে এভাবে ড্যাপ হলে বিগত সরকারের ভোট ব্যাংক সাংঘাতিকভাবে বিপর্যস্ত হবে। তারা ড্যাপ নিয়ে এক ধরনের রাজনীতির চেষ্টা করেছে। তার পরও বাসযোগ্যতা একদম তলানির দিকে, এমন একটি শহরে অবশ্যই ড্যাপের জনঘনত্ব পরিকল্পনা ছিল বলেই বিগত সরকার তা উপক্ষো করতে পারেনি। এ ব্যবসায়ীদের তীব্র আপত্তির মুখেই তা চূড়ান্ত করা হয়েছিল।

জুলাই অভ্যুত্থানের সরকার বাংলাদেশ সংস্কারের জন্য গঠন করা হয়েছে। বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, যখন নতুন সরকার গঠন হলো, ওই ব্যবসায়ীরাই ড্যাপকে বৈষম্যমূলক বলে তা বদলে ফেলতে চাচ্ছেন। যেহেতু তারা ব্যবসায়ী, বর্তমান সরকারের নীতিনির্ধারকদের কাছেও তারা সহজেই পৌঁছে গেছেন। সরকারের বুঝতে হবে, বসবাসের অযোগ্য ঢাকায় আরো বেশি ভবন, আরো বেশি কংক্রিট; নিশ্চিতভাবেই ঢাকার বাসযোগ্যতাকে আরো অনেক খারাপ দিকে নিয়ে যাবে। আমাদের কাছে বিস্ময় এটা না যে ব্যবসায়ীরা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে এসেছেন। এর আগে যখন ড্যাপ হলো, বছরখানেকের মধ্যে সে সরকারকে তারা চাপ দিয়ে বাধ্য করেছে ড্যাপের সংস্কার করতে। যে সংস্কার বা সংশোধনীর সঙ্গে আমরা পেশাজীবীরা অবগত ছিলাম না। আমরা বিস্মিত হয়েছি, এ সরকারের একজন উপদেষ্টা ব্যবসায়ীদের অন্যায্য দাবি আমলে নিয়েছেন। তিনিই প্রথম বলেছেন যে আবাসন ব্যবসায়ীদের কথা শুনেই ড্যাপ সংশোধন করতে হবে। এ কথা আমাদের অবাক করেছে। কারণ উপদেষ্টা একজন আইনজীবী হয়ে জানেন, যিনি ব্যবসা করেন, তিনি চাইবেন তার ব্যবসার ম্যাক্সিমাইজেশন। সারা পৃথিবীতেই ব্যবসার মূল স্পিরিট এটা। এ কারণে যারা ব্যবসায়ী, তারা কখনই আইন বা নীতি প্রণয়নে ভূমিকা রাখতে পারেন না। এ কথা জানা সত্ত্বেও উপদেষ্টা ব্যবসায়ী গ্রুপকে ড্যাপ সংশোধনের টেকনিক্যাল কমিটিতে সরাসরি সম্পৃক্ত করেছেন। যেটা অতীতে কখনো হয়নি। ড্যাপের মতো পরিকল্পনার আইনি দলিলে আবাসন ব্যবসায়ীরা সরাসরি সম্পৃক্ত হয়েছেন। এবার এটা প্রথম হলো। উপদেষ্টার সঙ্গে সচিব ও রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) চেয়ারম্যানও ব্যবসায়ীদের স্বার্থ রক্ষার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। অথচ বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব নিল, তারা কিন্তু পরিকল্পনাবিদদের একবারও ডাকেনি শহরকে বাসযোগ্য করতে হলে এখন কী করণীয় তা জানতে। নতুন বাংলাদেশে কী ধরনের পরিকল্পনা হলে অতীতের ভুলগুলো থেকে আমরা বেরিয়ে আসতে পারব। সেটা না করে বরং তারা ব্যবসায়ীদেরই প্রমোট করেছে এবং শেষ পর্যন্ত তাদের দাবির মুখেই ড্যাপ সংশোধনের চূড়ান্ত আয়োজন করেছে। আমরা বারবার বলেছি, এটা নগরীর সঙ্গে ভয়াবহ অন্যায়। আমাদের কথা সরকার শোনেনি।

আবাসন ব্যবসা স্থবির হয়ে আছে। ব্যবসা টিকিয়ে রাখাও অর্থনীতির জন্য জরুরি। এক্ষেত্রে আপনার কী মত?

ড্যাপ অনুমোদনের পর আদৌ কি আমাদের ভবন নির্মাণ কমেছে? আমরা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) থেকে যে তথ্য পাই, সেখানে দেখা গেছে, অন্যান্য বছর যে পরিমাণ ভবন অনুমোদন হয়, ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর ২০ শতাংশ কমেছে। বাকি ৮০ শতাংশ কিন্তু হচ্ছেই। ড্যাপের অনেক সুপারিশের একটা হলো উন্নয়ন নিয়ন্ত্রণ। সে বিবেচনায় ডেভেলপমেন্ট কিছুটা কমবেই। সেটা লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গেই প্রাসঙ্গিক এবং সেটাই হওয়ার কথা। তাই এটা সত্য যে ড্যাপের কারণে ভবন নির্মাণ কিছুটা নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। কিন্তু তাই বলে যে আবাসন ব্যবসায় মন্দা নেমে এসেছে এটা পুরোপুরি সঠিক নয়। ৮০ শতাংশ ডেভেলপমেন্ট তো হচ্ছেই। এখানে আরেকটা বিষয় আছে। ড্যাপ গেজেট হওয়ার পর আবাসন ব্যবসায়ীরা চারদিকে গুজব ছড়িয়েছে যে এ ড্যাপ অচিরেই বাদ দেয়া হবে। শুধু আবাসন ব্যবসায়ী নয়, রাজউকের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী, যারা বিভিন্নভাবে আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে অনৈতিক যোগসাজশে লিপ্ত থাকেন, তারাও এ গুজব ছড়ানোয় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ যদি প্ল্যান পাস করতে যেতেন, তারা বলত কয়দিন পরে আসেন, ড্যাপ বাতিল হয়ে যাবে। এ ধরনের নেতিবাচক বার্তা সবসময়ই দিয়ে এসেছেন। কিন্তু সব ধরনের গুজবের পরও ভবন নির্মাণ বন্ধ হয়নি। মাত্র ২০ শতাংশ কমেছে। এক্ষেত্রে রিয়েল এস্টেট ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে যে প্রজেক্টগুলো হয়, সেগুলো সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ থাকতে পারে, কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে যারা ডেভেলপ করেন, কারো যদি হাউজিং ডিমান্ড থাকে, তিনি তার ডিমান্ডের কারণে বিল্ডিং বানাচ্ছেনই। তিনি ব্যবসায়ীদের কাছে যাচ্ছেন না। সুতরাং ব্যবসায়ীদের দাবি সঠিক বলা যায় না। তারাই এ ধরনের গুজব মার্কেটে ছড়িয়ে দিয়েছেন। সরকার পর্যন্ত পৌঁছে দিয়েছেন। বিপরীতে ড্যাপ অনুমোদনের আগে প্রচুর ভবন অনুমোদন হয়েছে এই বলে যে ড্যাপে ফ্লোর এরিয়া রেশিও (এফএআর) অনেক কমে যাবে। ফলে তারা ড্যাপের আগে-পরে সবসময়ই গুজব ছড়িয়ে সুবিধা নিয়েছেন। এ ধরনের মিস ইনফরমেশন দিয়ে সুবিধা নেয়া আবার এর সঙ্গে রাজউকের কর্মকর্তাদের জড়িত থাকার ব্যাপারটি দুঃখজনক।

একটা কথা জোর দিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশ ছোট। ঢাকায় জমি কম। এখানে সুউচ্চ ভবনই জনভারে নুয়ে পড়া ঢাকার জন্য আদর্শ সমাধান। সিঙ্গাপুরের উদাহরণ দেয়া হয়।

সিঙ্গাপুর হলো সিটি স্টেট। আর বাংলাদেশ বিশাল বিস্তীর্ণ একটা দেশ। সিঙ্গাপুর বা হংকংয়ের উদাহরণ বাংলাদেশে সরলভাবে খাটে না। এক্ষেত্রে যেটা বলা হয়, আপনি যদি মানুষকে একোমোডেট করতে চান, জনঘনত্ব বাড়াতে চান, এজন্য সুউচ্চ ভবনই একমাত্র সমাধান, সেটি পুরোপুরি ভুল তথ্য। আমরা সারা পৃথিবীর নগরায়ণ বিশ্লেষণ করি। কড়াইল বস্তি, সেখানে জনঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, সেখানে কিন্তু লো রাইজ। আপনি যদি আবাসনের সমস্যা সমাধানের জন্য অপটিমাম ডেনসিটি পেতে চান, তাহলে মিড রাইজই টেকসই সমাধান। সারা পৃথিবীতেই এ ফর্মুলাই ফলো করা হয়। নগর এলাকার ভবন চারতলা থেকে আটতলা—এটা হলো মিড রাইজের সংজ্ঞা। সুতরাং পরিকল্পনামাফিক নগর গড়লে মিড রাইজের মাধ্যমের অপটিমাম ডেনসিটি পাওয়া সম্ভব। হাইরাইজের সঙ্গে ডেনসিটির কোনো সম্পর্ক নেই। হাইরাইজ ভবন বানাতে হলে প্রচুর জায়গা ছাড়তে হবে। সিঙ্গাপুর ছেড়েছে। তারা যেহেতু সিটি স্টেট, তাদের ল্যান্ড কম। হংকংয়ের ক্ষেত্রেও তাই। সিঙ্গাপুর অনেক হাইরাইজ বানানোর পরও তাদের ফ্লোর এরিয়া রেশিও আড়াই-পৌনে তিনের মধ্যে আছে। অর্থাৎ তারা হাইরাইজের শর্ত কঠোরভাবে মেনেছে। কিন্তু আমাদের দেশে প্লটের চরিত্র হলো, ছোট ছোট প্লট। এসব ছোট ছোট প্লটে আপনি কখনই হাইরাইজ ভবন বানাতে পারেন না। এটা করলে সুপার ডেনসিটি তৈরি হবে। যেটা ঢাকায় এরই মধ্যে তৈরি হয়েছে। যে কারণে শহর অবাসযোগ্য হয়েছে। তার পরও কেউ যদি আবাসিক এলাকায় হাইরাইজ ভবন বানাতে চায় তাহলে তাকে ব্লক ডেভেলপমেন্টে যেতে হবে। সেটা আরেক প্রসঙ্গ। হাইডেনিসিটি এলাকায় যদি চাহিদা থাকে তাহলে ব্লকভিত্তিক ডেভেলপমেন্টের মাধ্যমে হাইরাইজ ভবন বানানো যাবে। আর বাণিজ্যিক এলাকায় হাইরাইজ ভবন বানানো যাবে। আমরা শুধু ব্যক্তি মালিকানাধীন ছোট প্লটে হাইরাইজ ভবন বানানোর অযৌক্তিতা নিয়ে বলছি। পরিকল্পনাবিদরা হাইরাইজ বিল্ডিংয়ের বিরুদ্ধে—এটা একটা ভুল বার্তা। যেখানে প্ল্যান হাইরাইজ করতে বলে সেখানে হাইরাইজ করবেন, যেখানে ছোট প্লট সেখানে হাইরাইজ করতে দিতে পারেন না। এটাই নগরায়ণের সূত্র। আমাদের স্পষ্ট কথাও এটাই। এমনকি সিঙ্গাপুরেও ১০ কাঠার নিচে জমি হলে সেখানে দুই তলার বেশি ভবন বানানোর অনুমোদন নেই।

আবাসন ব্যবসার সঙ্গে স্থপতিদের ব্যবসা জড়িত, আর জমির ব্যবসার সঙ্গে পরিকল্পনাবিদদের ব্যবসায়িক স্বার্থ রয়েছে?

জমির ব্যবসার সঙ্গে পরিকল্পনার কোনো সম্পর্ক নেই। আমি আবারো বলছি, আপনি হাইরাইজ বানাতে চাইলে যে পরিমাণ জমি লাগবে, মিড রাইজেও একই পরিমাণ জমি লাগবে। ভবন যত উঁচু হবে চারপাশে তত জায়গা ছাড়তে হবে। হাইরাইজে জমি কম লাগবে আর মিড রাইজে জমি বেশি লাগবে ব্যাপারটা এ রকম নয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১০ শতাংশ জমিতে আপনি ৮ তলা করে দুটি ভবন অথবা ১৬ তলার একটি ভবন বানাতে পারেন। আবার ইচ্ছা করলে একই পরিমাণ জমিতে একবারে ১৬ তলা ভবন বানাতে পারেন। ১৬ তলা বানালে আশপাশের জমি ছেড়ে বানাতে হবে। সমসংখ্যক মানুষকে হাইরাইজে জায়গা করে দেয়া হবে, না মিড রাইজে জায়গা করে দেয়া হবে সেটা হলো প্ল্যানিংয়ের বিষয়। কিন্তু আমাদের দেশে মনে করা হয়, হাইরাইজ বানাব কিন্তু জায়গা ছাড়ব না। এমন অদ্ভুত বেআইনি কাজ বিশ্বের কোনো সভ্য শহরে পাবেন না। ১০ শতাংশ জায়গায় কেউ যদি ২০ তলা দুটি করে ভবন বানায় আর বলে এখানে বেশি মানুষ বসবাসের সুযোগ হয়েছে, সেটা ভুল হবে।

এভাবে অপরিকল্পিত নগরায়ণ চলতে থাকলে ২০৪০ বা ২০৫০ সালের ঢাকার চেহারা কেমন হবে?

নগরায়ণের দৃষ্টিতে বললে, ঢাকার ভবিষ্যৎ খুবই অন্ধকার। কোনো দেশের সরকার যখন ব্যবসায়ী মহলের সঙ্গে সমঝোতা করে রাজধানীর পরিবেশ ও বাসযোগ্যতাকে বৃদ্ধাঙ্গুল দেখায়, তখন সে শহরে সুস্থতা বলে কিছু থাকে না। এখানে যত বেশি আবাসন ইউনিট বাড়বে, শহরটা তত বেশি ভাড়াক্রান্ত হবে। তেমনিভাবে কৃষিজমিতে যত বেশি শিল্পায়ন হবে, তত বেশি পরিবেশ ধ্বংস হবে। আরো বেশি মানুষ কাজের সন্ধানে আসবে। আরো বেশি ট্রাফিক বাড়বে। জনপরিষেবার ওপর চাপ পড়বে। এখন সরকার ঢাকায় এফএআর বাড়ানোর জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। ব্যাপারটা এমন হওয়ার কথা ছিল না। এখন আলাপ হওয়া জরুরি ছিল, ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণের জন্য কী করণীয় কিংবা কীভাবে ঢাকায় মানুষের স্রোত বন্ধ করা যায় তা নিয়ে। ঢাকায় মানুষের স্রোত বন্ধ করতে চাইলে কোনো পলিসি করে বলা যাবে না যে এখন থেকে নতুন মানুষ ঢাকায় আসা বন্ধ। এজন্য ভিন্ন ধরনের পরিকল্পনা কৌশল নির্ধারণ করতে হবে। যেমন ঢাকায় নতুন করে কোনো শিল্প এলাকা ও বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান হবে না। যেমন আমরা কোস্টগার্ডের সদর দপ্তর ঢাকা থেকে সরাতে পারতাম। এটা ঢাকায় হওয়ার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। খাদ্য, কৃষি ও মৎস্য এ-সংক্রান্ত অধিদপ্তরগুলো আমরা ঢাকার বাইরে করতে পারতাম। কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার বাইরে তৈরি করা যেত। এগুলো করতে পারলে ঢাকায় আবাসনের চাহিদা স্বয়ংক্রিয়ভাবে কমত। পাশাপাশি ঢাকায় যে অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড আছে যেমন হকার, অবৈধ অটো রিকশা—এগুলোর সংখ্যা একটা যৌক্তিক মাত্রায় নিয়ে আসা যেত। সরকার সে পথে হাঁটছে না। বরং ঢাকায় এখনো শিল্পায়ন, বাণিজ্যিক কর্মকাণ্ড, নতুন নতুন সরকারি দপ্তরের কার্যালয় নির্মাণ, অপ্রাতিষ্ঠানিক অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ঢাকার দুয়ার পুরোপুরি খুলে দেয়া—এ চক্রের কারণেই ঢাকায় আবাসনের চাহিদা বাড়ছে। এগুলো যত বাড়বে, তত কৃষিজমি ভরাট করে শিল্পায়নের চাহিদা তত বাড়বে।

এরই মধ্যে স্থবির শহরে আপনি যত মেট্রোরেল, এক্সপ্রেসওয়ে করেন, ঢাকা নিশ্চলই থাকবে। ঢাকার বাসযোগ্যতার কোনো উন্নতি হবে না। বায়ুদূষণ ঢাকার এমন পর্যায়ে চলে গেছে, এটা জনস্বাস্থ্যের জন্য সাংঘাতিক হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর সঙ্গে আমাদের উন্নয়ন নীতি জড়িত। জনস্বাস্থ্য আর নগর পরিকল্পনা যে ওতপ্রোতভাবে জড়িত সরকার সে বিষয়টি এখনো ধরতে পারছে না। এ কারণেই সরকার নগরীর পরিকল্পনা নীতিতে ব্যবসায়ীদের অংশীজন করে নগরীকে মারাত্মক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।

ঢাকা একটা বড় ফ্যাক্টর। ঢাকা যদি পরিকল্পনায় ভুল করে, সারা বাংলাদেশের পরিকল্পনায় এর প্রভাব পড়বে। ভুল হবে। ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এর প্রভাব দেখা গেছে ঢাকার বাইরেও। বাংলাদেশের পৌর এলাকার অলিগলিতে ১০ ফুট রাস্তার পাশে ১০-১২ তলা ভবন উঠে গেছে। এটা ঢাকার ভুলের ফসল। ঢাকা যদি ঘুরে দাঁড়াতে পারত, তাহলে অন্য এলাকার নগর পরিকল্পনাও ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ ছিল। কিন্তু বিস্ময়কর ব্যাপার হলো, সরকার পরিকল্পনাবিদদের বাদ দিয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে ইমারত নির্মাণ বিধিমালা ২০২৫ ও ড্যাপ সংশোধনের যে নীল নকশা করেছে, এটা আমাদের জুলাই অভ্যুত্থানের সঙ্গে সরাসরি প্রতারণা। জুলাই অভ্যুত্থানে শহীদরা এ কারণে রক্ত দেননি যে তাদের রক্তের ওপর দাঁড়িয়ে যারা উপদেষ্টা হয়েছেন, তারা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আঁতাত করে বাসযোগ্যতার তলানিতে থাকা ঢাকার বাসযোগ্যতা আরো নামিয়ে আনবেন।

আরও