বিশ্লেষণ

বিশ্বব্যাপী পুঁজিবাদের বিপদ নতুন মানবিক মডেলের সন্ধানে

রাউটলেজ থেকে আমার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ মার্কেটস, মোরালস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে আমি বাজার ব্যবস্থার বাড়াবাড়ি রকমের আধিপত্য ও ব্যক্তিগত করপোরেট স্বার্থের শিকার সমসাময়িক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত অসন্তুষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছি। এটা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ ও দারিদ্র্যতাড়িত মানব অভিবাসন ও ব্যাপক

রাউটলেজ থেকে আমার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ মার্কেটস, মোরালস অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টে আমি বাজার ব্যবস্থার বাড়াবাড়ি রকমের আধিপত্য ব্যক্তিগত করপোরেট স্বার্থের শিকার সমসাময়িক বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা সম্পর্কিত অসন্তুষ্টি নিয়ে আলোচনা করেছি। এটা এমন একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা, যার বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে এক ধরনের অস্থিতিশীলতা, যুদ্ধ দারিদ্র্যতাড়িত মানব অভিবাসন ব্যাপক দারিদ্র্যের মধ্যে সম্পদের কেন্দ্রীকরণ ঘটানো; যা আমাদের গ্রহের পরিবেশ প্রতিবেশের স্থায়িত্বের জন্যও হুমকি সৃষ্টি করছে। বিদ্যমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ত্রুটিগুলোর দিকে আঙুল তোলার সময় আমার কয়েকজন শিক্ষাবিদ সহকর্মী অবশ্য দক্ষতার সঙ্গে সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন, যেমন থেকে মুক্তির উপায় কী বা আমাদের সামনে আর কী পথ খোলা আছে, -জাতীয় বিষয় এড়িয়ে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।

কেমব্রিজ অর্থনীতিবিদ পার্থ দাশগুপ্ত যেমনটা বলেছিলেন, কোনো দেশই এতটা দরিদ্র নয় যে সমগ্র জনসংখ্যার মৌলিক চাহিদাটুকু পূরণ করতে পারবে না ধরনের বিষয়ের পাশাপাশি আমার গ্রন্থ পুনর্বণ্টন নীতির অর্থনৈতিক পরিণতি সম্পর্কে স্বাভাবিক বিতর্কের বাইরে আয় পুনর্বণ্টনের নৈতিক বিষয়ের ওপর আলোচনা করে।

এতে আমি যে নৈতিক বিষয়টি উত্থাপন করেছি তা অনেকাংশে সত্যের ওপর নির্ভর করে যে আয় বণ্টনের ক্ষেত্রে নিয়তি গুরুত্বপূর্ণ এক অনুঘটক। যদিও মুক্তবাজারের রক্ষণশীলরা এখানে উদ্যোক্তাদের প্রচেষ্টা গুণাবলির প্রশংসা করেন আর বাম-প্রগতিশীলরা বৈষম্যের দায় সম্পূর্ণরূপে বাজার অর্থনীতির প্রক্রিয়ার ওপর চাপিয়ে দেন। একটি বাজার অর্থনীতিতে দারিদ্র্য কেবল দুর্ভাগ্যের কারণে অর্থনৈতিক ব্যর্থতার ফলে হতে পারে, তাই সমাজের ধরনের ব্যর্থতার বিপরীতে বীমা প্রদানের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে। একইভাবে সম্পদ কেন্দ্রীভূতকরণের বিষয়টিও এককভাবে উদ্যোক্তার প্রচেষ্টা নয়, অনেকটা সৌভাগ্যের সঙ্গে সংযুক্ত আয়ের মাধ্যমে হতে পারে। অসমতার বিষয়টি শুধু আয় নয়, বরং আয়বর্ধনকারী সম্পদের পুনর্বণ্টনের ওপর জোর দেয়। তবে এক্ষেত্রে অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে যেন উদ্যোক্তাদের ওপর খুব বেশি চাপ না পড়ে বা তারা যেন অনুৎসাহিত না হন। এক্ষেত্রে চীনের উদাহরণও খুব একটা সহায়ক নয়। কারণ সেখানে আয়বৈষম্য ১৯৮০-এর দশকের সংস্কারপূর্ব সময় থেকে বর্তমান পর্যন্ত অনেক বেশি পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা আমাদের সামনে তুলে ধরে বেসরকারি মালিকানার অধীনে বাজার অর্থনীতির শক্তিগুলো একবার উন্মোচন হয়ে গেলে কমিউনিস্ট রাজনৈতিক ব্যবস্থাও ব্যক্তিগত আয় সম্পদ কেন্দ্রীকরণ থেকে মুক্ত থাকতে পারে না। তাছাড়া একটি সর্বগ্রাসী শাসন ব্যবস্থা, যেখানে ন্যূনতম মানবাধিকার নিশ্চিত করাটাও প্রায় অনিশ্চিত, তেমন একটি রাষ্ট্র কখনই আদর্শ উদাহরণ হতে পারে না।

তাছাড়া একটি সূত্র এরই মধ্যে বিদ্যমান, এমনকি তা যদি শুধু ধারণাগত মডেলের মধ্যেও সীমাবদ্ধ থাকে। ধারণাটি হলো, কীভাবে বাজার অর্থনীতির শক্তিকে কাজে লাগানোর পাশাপাশি ব্যক্তিগত সম্পদের নিরবচ্ছিন্ন কেন্দ্রীভূতকরণকে ব্যর্থ করে একটি কল্যাণ রাষ্ট্রের জন্য পর্যাপ্ত বেসরকারি তহবিল তৈরির প্রক্রিয়া একত্র করা যায়।

সোভিয়েত ইউনিয়নের কমান্ড ইকোনমি ব্যর্থতা চীনের সমসাময়িক অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি অর্জন বাজার বেসরকারি উদ্যোক্তাদের অপরিহার্য ভূমিকার বিষয়টি প্রমাণ করে। অন্যদিকে আয় পুনর্বণ্টন নীতির ভালো-মন্দ নিয়ে বিতর্কগুলো করপোরেট ব্যবসার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক শক্তিকে কীভাবে ধারণ করা যায়, সে সম্পর্কে খুব বেশি নির্দেশনা দেয় না। বিশেষ করে যা গণতন্ত্রকে কলুষিত করে এবং বৈশ্বিক দারিদ্র্য দূরীকরণ বা পরিবেশ রক্ষার জন্য যেকোনো গভীর কল্যাণমুখী সংস্কারের উদ্যোগকে বাধা দেয়।

এখানে আমি যে নতুন অর্থনৈতিক ব্যবস্থার ইঙ্গিত করছি তা ১৯৬৪ সালের নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ জেমস মিডের লেখা স্বল্প পরিচিত গ্রন্থ ইফিশিয়েন্সি, ইকুয়ালিটি অ্যান্ড দ্য ওনারশিপ অব প্রপার্টি থেকে এসেছে। বইয়ে তিনি একটি প্রস্তাব রেখেছেন। প্রস্তাবটিকে তিনি আখ্যায়িত করেছেন সম্পত্তির মালিক গণতন্ত্র বলে। যেখানে ব্যবসায়িক শেয়ার অধিগ্রহণের মাধ্যমে সম্পদের পোর্টফোলিও অর্জনের জন্য একটি রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ তহবিল তৈরি করা যেতে পারে। তার ভাষায়, টপসি টারভি ন্যাশনালাইজেশন; যা যথাযথভাবে উত্তরাধিকার কর প্রবর্তনের নকশা করে। সম্পদের রিটার্ন তখন দরিদ্রদের জন্য সামাজিক লভ্যাংশ বা মৌলিক আয় হিসেবে ব্যবহার করা যেতে পারে। তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন, এটি উচ্চ আয়করের মাধ্যমে সৃষ্ট আয় পুনর্বণ্টন করে উদ্যোক্তাদের অস্বস্তি এড়াবে। ১৯৮০ ১৯৯০-এর দশকে যুক্তরাষ্ট্রের সোস্যাল ডেমোক্র্যাটরা ধারণাটিকে গুরুত্ব না দেয়ায় পরবর্তী সময়ে তা হারিয়ে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি-তে পরিণত হয়।

অবাক করা বিষয় হচ্ছে, সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে অতিরক্ষণশীল প্রশাসন কর্তৃক জনসম্পত্তির মালিকানার ধারণা পুনরুজ্জীবিত হয়েছিল। বিশেষ করে যখন অর্থনৈতিক সহায়তা প্রদানের শর্ত হিসেবে কভিড-১৯-এর প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত কোম্পানির জন্য ইকুইটি স্টকের প্রস্তাব করা হয়; সাধারণ ভাষায় বেল আউটের জন্য ইকুইটি এর আগে আমেরিকায় ২০০৮-০৯ সালের আর্থিক সংকটকালে জেনারেল মোটরসকে আর্থিক সহায়তা  দেয়ার সময় মার্কিন কোষাগার কর্তৃক নন-ভোটিং কোম্পানির স্টক অধিগ্রহণ করা হয়েছিল। পশ্চিমা পুঁজিবাদের গভীরে প্রোথিত সংস্কৃতিতে ব্যবস্থাগুলোকে শুধু অস্থায়ী হিসেবে কল্পনা করা হয়। ধারণা করা হয়েছিল, কোম্পানিগুলো ঋণ পরিশোধ তারল্য সংকট থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সরকার সম্পদের মালিকানা ছেড়ে দেবে।

যা- হোক, খানিকটা কম উন্নত দেশে মডেল নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষার সুযোগ অনেক বেশি। দেশগুলোয় প্রচুর পরিমাণ পুঁজি পাচারের ফলে অনেক সুচালিত ব্যক্তিগত ব্যবসা ঋণ পরিশোধের সমস্যায় পড়ে। সমস্যা এটা নয় যে ব্যবসাগুলো যথেষ্ট লাভজনক নয়; বরং সমস্যা হচ্ছে ব্যবসার লাভের অর্থটা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকার বিভিন্নভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে বাধ্য হয়, যেমন অতিরিক্ত ঋণের অনুমতি রেয়াতি সুদে বিদ্যমান ঋণ পুনর্নির্ধারণ। প্রকৃত অর্থে ঋণের সুদের হার, যা মূল্যস্ফীতিকে প্রভাবিত করে, প্রায়ই নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এভাবে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর একটা ভারী বোঝা চাপিয়ে দেয়া হয়, যা ব্যাপকভাবে অর্থনীতির ক্ষতি করে। এক্ষেত্রে সরকার লভ্যাংশ প্রদানকারী সম্পদ অর্জনের মাধ্যমে কোম্পানিগুলোকে উদ্ধার করতে পারে এবং লভ্যাংশ থেকে আয় জনকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করার জন্য একটি পাবলিক ট্রাস্ট তৈরি করতে পারে।

কল্যাণমূলক অর্থনীতির মডেলআসুন, আমরা এটিকে ডেমোক্রেটিক শেয়ার্ড ক্যাপিটালিজম নামে আখ্যায়িত করি; যা বরং ইউটোপিয়ান বলে মনে হবে, যেমনটা সম্পত্তির মালিকানাধীন গণতন্ত্র সম্পর্কে অর্থনীতিবিদ জেমস মিড ভেবেছিলেন। অর্থনীতিবিদরা একসময় তথাকথিত ওয়াশিংটন কনসেনসাসের বেসরকারীকরণ, উদারীকরণ সম্পর্কে বলেছিলেন, এটি হবে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানির (এসওই) যুগে ফিরে যাওয়ার ধারণার মতো উদ্বেগজনক। তবে সরকারের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোম্পানিগুলো কিন্তু শুধু সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের লাভ-সর্বোচ্চ প্রণোদনার অভাবের কারণে অব্যবস্থাপনায় জর্জরিত ছিল না; বরং এটি জনসাধারণের সম্পদের অপচয়ের উৎস হিসেবেও প্রমাণিত ছিল এবং আমলা রাজনীতিবিদরা তা তাদের সব ধরনের সুবিধা আদায়ের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করত।

এখানে প্রস্তাবিত ধারণাটি শুধু গভীর রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি মানসিকতার একটি মৌলিক পরিবর্তন নিয়ে কাজ করবে। সরকার যেসব কোম্পানির অংশীদারিত্ব অর্জন করবে, তাদের ব্যবস্থাপনাকে যেকোনো বেসরকারি ব্যবসার মতো সম্পূর্ণ স্বাধীনভাবে কাজ করার অনুমতি দিতে হবে। যদিও স্বাভাবিক বাজার নিয়ন্ত্রণ কাঠামোর অধীনে ব্যবস্থাপনার কর্মক্ষমতা শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ সর্বাধিক করার ক্ষেত্রে বিশুদ্ধভাবে বিচার করা হবে। মানসিকতার ধরনের পরিবর্তন স্বাভাবিক ব্যবসার পরিস্থিতিতে আসবে না, তবে কেবল সংকটের সময়ে এটা ঘটতে পারে। বিশেষ করে যখন একজন শাসক বুঝতে পারেন যে তার বৈধতা কার্যকারিতা ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে। কে জানে, ভবিষ্যতে বাজার অর্থনীতির একটি নতুন আরো বেশি মানবিক কোনো মডেল উন্নত বিশ্বের পরিণত পুঁজিবাদের পরিবর্তে পরিবর্তনের মধ্যে থাকা উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে উদ্ভূত হবে কিনা?

 

. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: অর্থনীতিবিদ; ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক অধ্যাপক; সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ইকোনমিক রিসার্চ গ্রুপের চেয়ারম্যান

ইংরেজি থেকে ভাষান্তর: রুহিনা ফেরদৌস

আরও