পদ্মা সেতু

দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের আবেগ ও যুগ যুগের ভোগান্তির গল্প

অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে দেখা দিত অন্য বিপদ। রাতের ঘন কুয়াশায় মেঘনা বা কীর্তনখোলা নদীর চোরা চরে লঞ্চ আটকে যেত। যদি সোজাভাবে আটকে যেত তাহলে তেমন ভয়াবহ সমস্যা হতো না, তবে লঞ্চ যদি কিছুটা কাত হয়ে চরে আটকে যেত আর যখন ভাটির সময় পানি কমে যেত তখন অনেক সময় সেটা আরো বেশি কাত হয়ে ডুবে যেত। তখনকার দিনে লঞ্চ

[গতকালে পর]

অন্যদিকে শুকনো মৌসুমে দেখা দিত অন্য বিপদ। রাতের ঘন কুয়াশায় মেঘনা বা কীর্তনখোলা নদীর চোরা চরে লঞ্চ আটকে যেত। যদি সোজাভাবে আটকে যেত তাহলে তেমন ভয়াবহ সমস্যা হতো না, তবে লঞ্চ যদি কিছুটা কাত হয়ে চরে আটকে যেত আর যখন ভাটির সময় পানি কমে যেত তখন অনেক সময় সেটা আরো বেশি কাত হয়ে ডুবে যেত। তখনকার দিনে লঞ্চ দুর্ঘটনায় মৃত্যু ছিল নিত্যদিনের ঘটনা, সে কারণে কুয়াশার সময় লঞ্চ খুব ধীরে ধীরে চলত আর লঞ্চের সামনে সারেংয়ের একজন অভিজ্ঞ সহকারী লম্বা বাঁশ নিয়ে পানির গভীরতা মাপতে মাপতে অগ্রসর হতো আর সে লোক এক অদ্ভুত ছন্দে ছন্দে পানির গভীরতা অনেকটা গানের সুরে সুরে দুর্বোধ্য ভাষায় চিত্কার করে তিনতলায় অন্ধকারে উন্মুখ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা তার ওস্তাদকে জানাত আর সে অনুযায়ী হেড সারেং ঠিক করত কোন পথে এগোবে নাকি ইঞ্জিন বন্ধ করে পরবর্তী জোয়ারের জন্য অপেক্ষা করবে। সারেং বা সুকানিদের বেশির ভাগই ছিল চট্টগ্রামের মানুষ তাই স্পষ্টভাবে বোঝা যেত না তারা কী বলছে। ইঞ্জিন বন্ধ করে বসে থাকাও ছিল বিপজ্জনক কেননা সে সময়ে লঞ্চ ডাকাতি ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। লম্বা ছিপ নৌকায় করে ডাকাতরা এসে সবকিছু ছিনিয়ে নিয়ে চলে যেত। মেঘনার ওইসব চরাঞ্চল ছিল মোটামুটি দেশের সব ধরনের প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণের বাইরে, এদের কাছে লঞ্চের যাত্রীরা ছিল চরম অসহায়, তারা বিনাবাক্যে সবকিছু তাদের দিয়ে দিত শুধু শারীরিকভাবে অক্ষত থাকার আশায়। অনেক সময় ডাকাতরা কোনো কোনো যাত্রীকে হত্যা পর্যন্ত করত। নিরাপত্তার জন্য প্রতি লঞ্চেই প্রায় অকেজো থ্রি নট থ্রি রাইফেলসহ এক জোড়া আনসার থাকত, তাদের বেশির ভাগ মনোযোগই থাকত লঞ্চে ব্যবসারত নানা প্রকারের হকারদের ওপর হাঁকডাক করার কাজে আর তাদের নিজেদের জন্য বরাদ্দকৃত কেবিন জায়গা না পাওয়া যাত্রীদের কাছে চড়া দামে ভাড়া দিতে। ডাকাত আক্রমণের সময় কেউ তাদের কোনোদিন অ্যাকশনে দেখেছে এমন কখনো শোনা যায় নাই।

অন্যদিকে লঞ্চ বা স্টিমারের মধ্যে একদল সাধারণ যাত্রীবেশী ভ্রাম্যমাণ ডাকাতও থাকত। এরা সারাটা পথ সাধারণ যাত্রীদের মতো নিরীহ আচার-আচরণ করলেও গাবখান চ্যানেলে এলেই হঠাৎ করিত্কর্মা হয়ে উঠত। ১৮ কিলোমিটার লম্বা গাবখান চ্যানেলটি কাটা হয় ১৯১৭ সালে যা ঝালকাঠির সুগন্ধা-বিশখালি নদীর সঙ্গে পিরোজপুরের সন্ধ্যা নদীকে সংযুক্ত করেছে। চ্যানেলটি বেশ সরু আর এর মাথায় সিগনাল বসানো আছে এক মাথা দিয়ে বড় জাহাজ ঢুকলে অন্য মাথা দিয়ে জাহাজ না ঢুকে অপেক্ষা করে। এই সরু চ্যানেলটিই এসব ভ্রাম্যমাণ ছদ্মবেশী ডাকাতদের জন্য খুব অনুকূল কর্মক্ষেত্র, এখানে এলেই তারা আগে থেকে টার্গেট করা যাত্রীর জিনিসপত্র নিয়ে অকস্মাৎ পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে, তবে প্যাডেল স্টিমার হলে প্যাডেলের সামনের অংশ থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে না কেননা তা করলে প্যাডেলের আঘাতে তাদের নিশ্চিত মৃত্যু হবে। আমি এমনও দেখেছি গাবখানে এসে এক মহিলার কানের সোনার দুল টান দিয়ে ডাকাতটি পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আর সোনার দুলের সঙ্গে ওই হতভাগ্য মহিলার কানের অর্ধেকও সে ছিঁড়ে নিয়ে গেছে, মহিলার এক কান থেকে টকটকে লাল রক্ত ঝরে পড়ছে আর মহিলা যখন ঘটনা বুঝতে পেরেছেন তখন তিনি চিত্কার করে অজ্ঞান হয়ে গেছেন আর যাত্রীরা সব উত্তেজিত হয়ে হইহই করা শুরু করেছে কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে।

অনেক সময় লঞ্চ বা স্টিমার যখন এসব ডুবন্ত চরে খুব শক্তভাবে আটকে যেত তখন কোনো কোনো সময় ১২ ঘণ্টা থেকে ২৪ ঘণ্টা পর্যন্তও লঞ্চকে আটকে থাকতে হতো, তখন পানি খাবারের তীব্র সঙ্কট দেখা দিতো। সে সময় যাত্রীরা জেলেদের নৌকায় করে আশপাশের গ্রাম থেকে বাজার করে এনে চরের মধ্যে রান্নাবান্না শুরু করে দিতো। সে গভীর দুর্যোগের মধ্যেও একধরনের পিকনিক পিকনিক ভাব চলে আসত তখন। সে সময় কোনো মোবাইল টেলিফোন ছিল না আর সাধারণ টেলিফোনেও কানেকশন পাওয়া ছিল পরম ভাগ্যের ব্যাপার তাই অন্যদিকে যাত্রীদের আত্মীয়স্বজনরা লঞ্চ আসতে না দেখে চরম দুশ্চিন্তায় পড়ে যেত।

এভাবে চাঁদপুর থেকে ছাড়ার - ঘণ্টা পর লঞ্চ বরিশাল পৌঁছাত, সেখানে দু-এক ঘণ্টা থেকে লঞ্চ পৌঁছাত ঝালকাঠি, তারপর গাবখান চ্যানেল পার হয়ে কাউখালি তারপর হুলারহাট। পিরোজপুর শহরের ঘাটের নামই হুলারহাট। হুলারহাট যখন পৌঁছাত তখন সকাল প্রায় ১০টা থেকে ১১টা। হুলারহাটে আবার কুলিদের অত্যাচার, সে অত্যাচার অতিক্রম করে মালপত্র নিয়ে কালিগঙ্গা নদীতে মাঝির বৈঠা বাওয়া নৌকায় প্রায় চার মাইল উজানের পথ, তারপর আমাদের গ্রাম উদয়কাঠি এসে আমার বৃদ্ধ দাদার নৌকা ভিড়ত, ততক্ষণে বেলা প্রায় ১২টা থেকে ১টা। তার মানে লঞ্চ যদি ভাগ্যক্রমে চরে আটকে না যেত বা কুয়াশায় দেরি না করত তবে ঢাকা থেকে রওনা দেয়ার প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর দাদা বাড়িতে পৌঁছাতে পারতেন আর যখন পৌঁছাতেন ততক্ষণে অসহনীয় ভোগান্তি আর ক্লান্তিতে তার শরীর সম্পূর্ণ অবসন্ন। যারা শুধু একবারের জন্য এমন যাত্রা করেছে তাদের কারো কারো কাছে হয়তো পুরো ব্যাপারটা অনেকটা পিকনিক পিকনিক মনে হতে পারে কিন্তু যারা সারা জীবনে বারবার এমন দুঃসহ দীর্ঘ যাত্রা করতে বাধ্য হতো তাদের কাছে এটা এমন উপভোগ্য মনে হতো না কখনো। তারা সারাজীবন থেকে পরিত্রাণের পথ খুঁজে বেড়াতেন।

জলপথের দীর্ঘ ক্লান্তিকর যাত্রা সময়ের বিকল্প পথ খোঁজার আকাঙ্ক্ষা থেকেই আশির দশকের মাঝামাঝি বৃহত্তর ফরিদপুর, বরিশাল বা পিরোজপুর, বাগেরহাট অঞ্চলের মানুষসহ সমগ্র দক্ষিণাঞ্চলের মানুষেরা সেই প্রাচীন সিল্ক রুটের অভিযাত্রী বণিকদের মতো নিজেরা নিজেরাই ঢাকা থেকে এসব দুর্গম কষ্টসাধ্য দক্ষিণাঞ্চলের সড়ক রুটগুলো ব্যবহার করা শুরু করে। বিখ্যাত ভাগ্যকূল জমিদারদের লঞ্চঘাটকে কেন্দ্র করে মাওয়া ফেরি চালু হয় ১৯৮৬ বা ১৯৮৭ সালে, তখন ঘাট ভেঙে গেলে বা পানিতে তলিয়ে গেলে বাসের মালিক-শ্রমিকরা নিজেরা নিজেরাই ঘাট মেরামত করে নিত। সে সময় প্রথমদিকে শুধু সকালে আর বিকালে দুবার মাত্র ফেরি চলত, তবে তার কিছুকাল আগে থেকেই দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ ঢাকা থেকে বুড়িগঙ্গা পাড় হয়ে, তারপর ধলেশ্বরীর দুটো আলাদা স্রোত শ্রীপুরের মুশুরগাঁও খাল পার হয়ে ভাঙা ভাঙা পথে হেরিংবন্ডের ভাঙাচোরা রাস্তায় নানা প্রকার লক্কড়-ঝক্কড় মুড়িরটিন মার্কা বাস বা টেম্পোতে পার হয়ে বহু কষ্ট করে মাওয়া পৌঁছাত, সেখান থেকে ছোট লঞ্চ বা স্পিডবোটে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে পদ্মা নদী পাড় হতো। সেখান থেকে আড়িয়াল খাঁ নদী, তারপর মোল্লার হাট বা পাটগাতিতে মধুমতী নদী পার হতো। যারা মোল্লারহাটের নদী পার হতো তারা এরপর ফকিরহাট হয়ে বাগেরহাট গিয়ে সেখান থেকে দড়াটানা নদী পার হয়ে বলেশ্বর নদীর তীরে এসে অপেক্ষা করত। বলেশ্বর পার হলেই পিরোজপুর সদর, আর যারা খুলনা যেত তারা মোল্লারহাট হয়ে রূপসার তীরে এসে রূপসা পাড় হয়ে খুলনা যেত। অন্যদিকে যারা টুঙ্গিপাড়া হয়ে পাটগাতিতে মধুমতি নদী পাড় হয়ে আসত তারা নদী পার হওয়ার পর ভীষণ ভাঙাচোড়া প্রায় গ্রাম্য রাস্তা দিয়ে মাটিভাঙ্গা হয়ে নাজিরপুরে এসে নাজিরপুর নদী পার হয়ে পিরোজপুর পৌঁছাত। আবার অন্যদিকে যারা বরিশাল যেত তারা ভাঙ্গা থেকে শিকারপুর আর বাবুগঞ্জে সন্ধ্যা আর সুগন্ধা নদী পাড়ি দিয়ে বরিশাল পৌঁছাত, আর যারা পটুয়াখালী হয়ে কুয়াকাটা যেত তাদের কষ্ট ছিল বর্ণনাতীত, বরিশাল থেকে আরো -৬টা ফেরি পারাপারে দুঃসহ অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হতো নিত্যদিন।

এভাবে আমাদের মতো পিরোজপুরের মানুষ অবশেষে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে যখন বলেশ্বর পাড়ে আসতাম তখন দেখতাম ফেরি বসে আছে কিন্তু ফেরিতে উঠতে দিচ্ছে না কেননা সারা দিনে খুব কম সংখ্যক গাড়িই এই ফেরি ব্যবহার করত আর ফেরি সম্পূর্ণ না ভরলে ফেরি চালু করত না। তাই ফেরির কর্মচারীরা সারা দিনই অলস সময় কাটাত, জিজ্ঞেস করতেই বলত সারেং নাই অথবা অন্য কোনো ঝামেলা আছে। যখন বলা হতো, ভাইজান, ভালোমন্দ ব্যবস্থা হবে আনে, ফেরি চালু করেন।

অবশেষে ভালো-মন্দের কারণে ফেরি চালু হতো এবং কয়েক মিনিটের মধ্যে আমরা ছোট বলেশ্বর পাড়ি দিতাম, নামার আগে ফেরির লোকজনের হাতে কিছু ভালো-মন্দ দিয়ে পিরোজপুর শহরে পদার্পণ করতাম কিন্তু ততক্ষণে চরম দুঃসহ ভ্রমণ ক্লান্তিতে আমাদের শরীর মন সম্পূর্ণ অবসন্ন। ছিল দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের হতভাগ্য জীবনযাপন।

চিন্তা করা যায়, নিজের দেশের রাজধানী থেকে নিজের বাড়ি ফিরতে দক্ষিণাঞ্চলের প্রায় - কোটি মানুষের জীবনে এটা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা? তাদের আর অন্য কোনো পথ ছিল না। ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় তাদের দুঃসহ জীবন মেনে নিতে হতো। বাস বা লঞ্চ যাতেই ভ্রমণ করি না কেন দুটোতেই বড় বড় করে লেখা থাকত, সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।

আসলেই কথা সঠিক। সময়ের চেয়ে জীবনের মূল্য তো বেশিই কিন্তু দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের সময়ের কোনো মূল্যই ছিল না। তাদের ছিল অবহেলিত স্থবির ঢিলেঢালা জীবন, চাইলেও সে জীবনে দ্রুততার কোনো জায়গা ছিল না আর তার সঙ্গে ভোগান্তির কোনো অন্ত ছিল না।

বাস্তবতাকে থেকে উত্তরণের স্বপ্নকে ধারণ করেই ১৯৮৬ সালে মোটামুটি বৃহত্তর ফরিদপুর আর বরিশালের লোকজন মিলে পদ্মা সেতু বাস্তবায়ন পরিষদ গঠন করেন পদ্মা সেতুর দাবিতে নানা ধরনের আন্দোলন করা শুরু করে। ছাত্র বয়সে খবরের কাগজে এদের নানা আন্দোলনের কর্মসূচি আমি আগ্রহ নিয়ে পড়তাম। পরিষদের শুধু একজনকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনতাম, তিনি ছিলেন এর প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি, আমার বাবার বন্ধুর ছোট ভাই, নাম খোকা শিকদার, তাকে দেখলেই বাবা জিজ্ঞেস করতেন, পদ্মা ব্রিজ কতদূর?

তিনি উত্তরে বলতেন যে ব্রিজের কথা বলার কারণেই নাকি লঞ্চে বা হাটবাজারে মানুষ তাকে পাগল ডাকা শুরু করেছে। এদেশের এলিট শ্রেণীর অনেকেই পদ্মা সেতুর দাবিদার প্রায় সবাইকেই একসময় পাগল ভাবত কিন্তু কে না জানে পৃথিবীর বড় বড় পরিবর্তনগুলো এমন দূরদর্শী পাগলদের মাথা থেকেই প্রথম বেরিয়ে আসে।

এরপর জনমানুষের প্রচণ্ড চাপেই গত প্রায় তিন দশকে আস্তে আস্তে উপরোল্লিখিত ফেরি পারাপারের নদীগুলোতে একে একে সেতু নির্মাণ হতে শুরু হয়। এভাবেই ১৯৮৯ সালে বুড়িগঙ্গা সেতু, ১৯৯৭-৯৮ সালে ধলেশ্বরীর দুটি সেতু, ১৯৯৮ সালে অস্থায়ী বেইলি ব্রিজ সরিয়ে শ্রীপুরে মুশুরগাঁও সেতু, তারপর একে একে ২০০০ সালে মোল্লারহাট সেতু, ২০০১ দড়াটানা সেতু, ২০০২ সালে গাবখান সেতু, ২০০৩ সালে শিকারপুর দোয়ারিকা সেতু, ২০০৫ সালে আড়িয়াল খাঁ রূপসা সেতু এর আগে বলেশ্বর সেতু অনেক পরে পাটগাতি সেতুর কাজ শেষ হয় কিন্তু বাকি থাকে পদ্মা সেতুর কাজ, পদ্মা সেতুর জন্যই সব সেতু হয়ে যাওয়ার পরও পুরো রুটগুলো পূর্ণতা পাচ্ছিল না আর মানুষের চরম ভোগান্তিরও অবসান হচ্ছিল না। মাওয়া বা জাজিরা প্রান্তে এসে মানুষকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হতো, অনেক রোগী ঘাটে অপেক্ষা করতে করতেই মারা যেত। কোনো কোনো সময় আমি নিজেই -১০ ঘণ্টা অপেক্ষা করেছি ফেরির জন্য। কারণেই পদ্মা সেতু ছিল পুরো প্রক্রিয়াকে পূর্ণ করার জন্য অত্যন্ত আবশ্যকীয়।

অবশেষে পদ্মা সেতু দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ যাতায়াত শুরু করেছে। প্রথমদিন তারা হয়তো একটু মাত্রাতিরিক্ত আবেগ দেখিয়ে ফেলেছে, তবে একে ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখা যেতে পারে। আজ আমার দাদা বা বাবা কেউ বেঁচে নেই কিন্তু তাদের প্রজন্ম সম্মিলিতভাবে আমাদের একটি স্বাধীন দেশ দিয়ে গেছেন আর স্বাধীন দেশ পেয়েছি বলেই যে যাত্রাপথ অতিক্রম করতে আমার দাদার প্রায় ২৪ ঘণ্টা বা কখনো কখনো তার চেয়েও বেশি সময় লাগত পদ্মা সেতু হওয়ার কারণে সে একই পথ অতিক্রম করতে আজ তার পৌত্রের লাগছে মাত্র তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা। আলহামদুলিল্লাহ। কারণেই পদ্মা সেতু আর স্বাধীনতা আজ একাকার হয়ে গেছে, কারণেই পদ্মা সেতু আমাদের কাছে অনন্য।

ব্রিজের সঙ্গে বিভিন্ন স্তরে নির্মাণের সঙ্গে জড়িত সবাইকে, এর ডিজাইন টিম উপদেষ্টা প্যানেলের সব সদস্য যারা সবাই প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন তাদের সবাইকে জানাই আমার আন্তরিক অভিনন্দন। আমার শিক্ষক মরহুম জামিলুর রেজা চৌধুরী স্যারের স্মৃতির প্রতি জানাই গভীর শ্রদ্ধা আর বিশেষভাবে অভিনন্দন জানাতে হবে প্রধানমন্ত্রীকে যিনি তার প্রধানমন্ত্রিত্বের দাপ্তরিক পরিসীমার বাইরে গিয়েও তার ব্যক্তিগত অনমনীয় কমিটমেন্টের জায়গা থেকে খুব দৃঢ়ভাবে প্রকল্পটি সম্পন্ন করে ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছেন এবং এর বাস্তবায়নেও নিজেকে জড়িত রেখেছেন একদম প্রথম থেকেই। তা না হলে প্রকল্পটির অবস্থা হতে পারত চরম ভোগান্তি উদ্রেককারী প্রায় একই সময়ে শুরু হওয়া ঢাকা-জয়দেবপুর প্রজেক্টের মতো অমন মাতাপিতাহীন যেটা কোনোদিন শেষ হবে কিনা তা বোধ হয় কেউই জানে না।

ভূমিকা হিসেবে এত দীর্ঘ আর আপাত বিরক্তিকর গল্পগুলোর অবতারণা করলাম কারণে যে যুগের পর যুগ ধরে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের দীর্ঘ, দুঃসহ, বিপত্সংকুল ভোগান্তি জর্জরিত যাত্রার কষ্টকর স্মৃতিকে প্রেক্ষাপট হিসেবে সামনে নিয়ে এসে বিবেচনা না করলে মানুষ বুঝতে পারবে না পদ্মা সেতু কেন দক্ষিণাঞ্চলের মানুষের কাছে এমন পরম আবেগ সিক্ত একটি স্থাপনা। পদ্মা সেতুর মাধ্যমে তাদের কাছে যুগ যুগ ধরে চলে আসা আঞ্চলিক অবিচার অসহনীয় ভোগান্তির অবসান হতে চলেছে। কারণেই আমাদের মতো দক্ষিণবঙ্গের মানুষদের কাছে পদ্মা সেতু হলো সুদীর্ঘকালের বঞ্চনা, অবহেলা আর আঞ্চলিক অবিচার দীর্ঘ অসহনীয় ভোগান্তির পরিসমাপ্তির প্রতীক এবং একই সঙ্গে নতুন দিনের নতুন স্বপ্নের সম্ভাবনার স্মারক, সে কারণে পদ্মা সেতু নিয়ে আমাদের আবেগ একটু বেশিই। [শেষ]

 

মাহফুজুল হক জগলুল: স্থপতি, ফেলো আইএবি

আরও