আলোকপাত

হত্যাকাণ্ডকে ঘিরে পাল্টাপাল্টি বয়ান নিরসনে নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রাণপণ সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে চড়ে অন্য দেশে ‘পালিয়ে’ যান। এ ‘‌পালিয়ে’ যাওয়ার বয়ানের মধ্যে কিছু অন্য বয়ান কি আছে? শেখ হাসিনা গদি ছেড়ে না দিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তৈরি হতো না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন আমরা প্রথমে ‘স্বৈরাচারের পলায়ন’ সংক্রান্ত বিভিন্ন বয়ানের বিশ্লেষণ করে দেখি।

গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার প্রাণপণ সংগ্রামের পরিপ্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হেলিকপ্টারে চড়ে অন্য দেশে ‘পালিয়ে’ যান। এ ‘‌পালিয়ে’ যাওয়ার বয়ানের মধ্যে কিছু অন্য বয়ান কি আছে? শেখ হাসিনা গদি ছেড়ে না দিলে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার তৈরি হতো না। তাই অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের আলোচনায় যাওয়ার আগে আসুন আমরা প্রথমে ‘স্বৈরাচারের পলায়ন’ সংক্রান্ত বিভিন্ন বয়ানের বিশ্লেষণ করে দেখি।

‘পলায়নের’ প্রথম ব্যাখ্যা: সেনাবাহিনীর চূড়ান্ত ভূমিকা

একটি বয়ান হচ্ছে, শেষ মুহূর্তে সেনাবাহিনী তাকে বলে দিয়েছে যে আমরা আপনাকে গণরোষের হাত থেকে রক্ষা করব না। ছাত্র-জনতার মিছিলটি শাহবাগ থেকে গণভবনের দিকে একটু আগেই রওনা দিয়েছে। ৪৫ মিনিটের মধ্যে এখানে এসে পৌঁছবে। আমরা ওই মিছিল আটকাব না, গুলিও করব না। আপনাকে এখন ঠিক করতে হবে আপনি কী করবেন? আপনি ভারতের সঙ্গে যোগাযোগ করে সেখানে চলে যেতে চাইলে সে ব্যবস্থাটুকু আমরা করে দিতে রাজি।

ভারত বা ভারতের আগরতলা হয়ে দিল্লি যাওয়ার যে পদ্ধতি সেটা যেভাবেই নির্ধারিত হোক না কেন, এটুকু নিশ্চিত যে ভারত ও শেখ হাসিনার পারস্পরিক সম্মতি ছাড়া ব্যাপারটি এভাবে ঘটতে পারত না। অর্থাৎ ভারতও রাজি হয়েছে এবং তিনিও ভারতেই যেতে রাজি হয়েছেন। ভারতে ‘পালানোটা’ তাই শেখ হাসিনা ও ভারত সরকার উভয়ের চূড়ান্ত সম্মতিক্রমেই সম্পন্ন হয়েছে। তাহলে শেখ হাসিনার ভারত পলায়নে সেনাবাহিনী ও ভারত উভয়ের একটি সম্মতি নিশ্চয় ছিল। প্রাসঙ্গিক একটি প্রশ্ন হচ্ছে, না পালিয়ে অন্য কোনো সুযোগ বা অন্য কোনো পন্থায় আত্মসমর্পণ করা যেত কি? অর্থাৎ তিনি কি সেনাবাহিনীকে বলতে পারতেন—যেন তাকে তারা কোনো নিরাপদ স্থানে বন্দি করে রাখে। পরে বিচার ও শাস্তি যা প্রাপ্য তা দেবে। এভাবে বিষয়টি ঘটলে তা তার জন্য সম্মানজনক হতো। ‘পালিয়ে’ শব্দটি তখন আমাদের ব্যবহার করতে হতো না। একই সঙ্গে এখন আমরা আরো যোগ করতে পারি—শেখ হাসিনার অনেক কুখ্যাত সহচরকে (সালমান এফ রহমান, আনিসুল হক ইত্যাদি) একটি বিশেষ ব্যবস্থায় সেনা হেফাজতে রাখা হয়েছে বলে দেখা যাচ্ছে। আমরা আশা করতে পারি, পরবর্তী সময়ে তাদের স্বচ্ছতার সঙ্গে এবং বিধি মোতাবেক বিচার হবে। এ সম্মানজনক ব্যবস্থা শেখ হাসিনার জন্যও হতে পারত। 

‘‌পলায়নের’ অন্যান্য অপ্রত্যক্ষ ব্যাখ্যা

পলাতক প্রধানমন্ত্রীর বয়স হয়েছে। তিনি এমনিতেই এবার রাজনীতি থেকে হয়তো অবসর গ্রহণ করতেন। তার উত্তরাধিকার হিসেবে তিনি কাউকে চয়ন করার কথা ভাবছিলেন কি? অপ্রত্যাশিতভাবে আগেই বাধ্য হয়ে বিদায় হওয়ার দরুন তিনি কি এ রকম ভেবেছেন যে, ভারতে গিয়ে তিনি সেখানে তার উত্তরাধিকারকে তৈরি করে পরবর্তী সময়ে দেশে তাকে পুনরায় ক্ষমতা গ্রহণের জন্য পাঠাবেন। বর্তমানে তার পুত্র জয়ের কথাবার্তার মধ্যে এ রকম কিছু আগাম রাজনৈতিক সংকেত বর্তমানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। তবে একেক সময় একেক কথা বলায়, সে ব্যাপার চূড়ান্ত কিছু বলা ‘‌যাচ্ছে না’। 

তবে ১৭ বছরের সামষ্টিক পরিস্থিতি যে পর্যায়ে শেখ হাসিনা নিয়ে গিয়েছিলেন, তাতে তার বিরুদ্ধে বহু অসন্তুষ্ট শক্তির (জাতীয় ও আন্তর্জাতিক) পুঞ্জীভূত বিক্ষোভ জমা হয়েছিল। বিরোধী ও অত্যাচারিত-বিক্ষুব্ধ এ শক্তিগুলো বা গোষ্ঠীগুলো (জঙ্গি, জামায়াত-বিএনপি-আমেরিকা যেমন তার বিরুদ্ধে ছিল, তেমনি বৈষম্য, গুম, খুন, সেন্সরশিপ দ্বারা দমিত, মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার অসংখ্য সাধারণ গণতান্ত্রিক নাগরিকও তার বিরুদ্ধে চলে গিয়েছিলেন) যখন দেখল যে, ছেলেমেয়েরা দল-মত নির্বিশেষে পথে নেমে প্রাণ ‘‌দিচ্ছে’ তখন প্রথমে শিক্ষকরা ও পরে অভিভাবকরা এবং অবশেষে সব বিরোধী শক্তি পথে নেমে আসে। 

শেখ হাসিনা উপলব্ধি করেন যে, ‘‌It is a lost game’. অতএব এ পলায়ন/বিতাড়ন ছিল তারই নিজস্ব কর্মফল। ছাত্র আন্দোলন, সেনাবাহিনী, দল, কেউই শেষ মুহূর্তে তার পাশে থাকেনি।

পলায়নের যে বয়ানই দেয়া হোক না কেন, শেখ হাসিনাকে বিচারের সম্মুখীন করার দাবিটি থেকেই যাবে এবং বিচার হওয়াটা এক দিক দিয়ে ভালো, কারণ এটি অনেকগুলো সন্দেহ প্রতি সন্দেহের নিরসন ঘটাবে। যেমন শেখ হাসিনা তখন আত্মরক্ষার সুযোগ পাবেন এবং তার ষড়যন্ত্রতত্ত্ব নির্ভর নিজস্ব কথাগুলোও আমরা শুনতে পাব। তারপর বিচারে তিনি আগস্ট হত্যাকাণ্ডের জন্য দোষী সাব্যস্ত হলে তার শাস্তি হবে। তবে এখানে স্বচ্ছতা ও আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগ বা ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সময় যেমনটি করা হয়েছিল। আগস্ট হত্যাকাণ্ডকে আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গণহত্যা বলা উচিত না রাজনৈতিক হত্যা বলা উচিত তা নিয়ে বিতর্ক আছে। বিচারের আগে বিতর্কটির মীমাংসা হওয়া উচিত।

হাসিনার নতুন বয়ানগুলো

হাসিনার সমর্থকরা দাবি করেন যে, তিনি ক্ষমতায় থাকতে চাইলে ছাত্র-তরুণদের আরো অনেকে মারা যেত এবং সেজন্যই তিনি সংঘাতে না গিয়ে স্বেচ্ছায় ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। এমনকি আন্দোলনের সৈনিক আবু সাঈদের মৃত্যুর পর তার পরিবারের সংগে সহমর্মিতা জানিয়ে হত্যার বিচারও চেয়েছিলেন তিনি। গণভবনের দরজাও খুলে রাখার বার্তা দিয়েছিলেন আর বহু আগেই কোটা বিলুপ্ত করে মূল দাবিটি মেনেই নিয়েছিলেন। কিন্তু কোনোটিই আন্দোলনকারীরা আমলে নেয়নি। সুতরাং হাসিনা সমর্থকদের মতে, আন্দোলনকারীরা প্রকৃতপক্ষে শুরু থেকেই সরকার পরিবর্তনের লক্ষ্য নিয়ে আন্দোলন চালাচ্ছিলেন; কোটা ছিল উপলক্ষ মাত্র। কিন্তু এ যুক্তি ধোপে টেকে না। কারণ ২০১৮ সালে যখন কোটা বিলুপ্তির দাবি মেনে নিয়েছিলেন শেখ হাসিনা তখন আন্দোলন দ্রুতই বন্ধ হয়ে যায়। 

এবারের আন্দোলনও সাধারণ ছাত্রদের দ্বারাই শুরু হয়। আদালতের অস্পষ্ট রায়ে ২০১৮-এর কোটা বিলুপ্তির পরিপত্র বাতিল হয়ে গেলে এটি শুরু হয়। শেখ হাসিনার বেফাঁস উক্তিতে তা জ্বলে ওঠে। ঠিক সময়ে ঠিক কাজটি হলে এ আন্দোলন হয়তো উৎখাত ও হত্যাকাণ্ড পর্যন্ত গড়াত না। কেউ উৎখাতের উদ্দেশ্য নিয়ে আন্দোলনের ভেতরে ঘাপটি মেরে বসে থাকলেও তারা এটাকে সে পথে নিয়ে যেতে পারত না—আন্দোলনের Mishandling-ই তাদের জন্য সেই সুবর্ণ সুযোগ তৈরি করে দিয়েছিল। আর সামগ্রিকভাবে দেশের পরিস্থিতিও আন্দোলনের অনুকূল ছিল। 

শেখ হাসিনা আন্দোলনে গোপনে বিদেশী প্ররোচনার কথাও এখন পুনরায় বলছেন। এখন দাবি করা হচ্ছে যে, ২০২৩ সালের ২১ জুন শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ‘‌সেন্ট মার্টিনস’ দ্বীপ একটি বিদেশী শক্তি লিজ নিতে চেয়েছে, তবে দেশের সম্পদ বিক্রি করে দিয়ে ক্ষমতায় বসার তার কোনো ইচ্ছা নেই।’

এ থেকে অনুমিত হয় যে, আমেরিকা তাকে সুনজরে দেখছে না। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যতে আমেরিকার ইচ্ছা পূরণ না হলে তারা তার ক্ষমতায় থাকাটা কঠিন করে তুলবে। এরপর তিনি গত ৭ জানুয়ারির জাতীয় নির্বাচনের পূর্বমুহূর্তে আরেকবার বলেছিলেন, ‘জনৈক শ্বেতাঙ্গ তাকে দেশের অংশবিশেষ বিদেশের দ্বারা সামরিক উদ্দেশ্যে ব্যবহারের জন্য দিতে বলেছে।’ কিন্তু আমেরিকা চাক বা না চাক—একটি প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা গত জানুয়ারিতে সরকার গঠন করেন ও ভারত, চীন, রাশিয়া, আমেরিকাসহ সব দেশই তার সরকারকে মেনে নেয়। কিন্তু গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনের পর থেকে আমরা জানি যে, দেশের ভেতরের রাজনৈতিক শক্তি তথা জামায়াত, বিএনপি, বামপন্থী, মধ্যপন্থী সবাই এ নির্বাচন প্রত্যাখ্যান করেছে, কার্যত তারা হাসিনার সরকারকে সবাই মুখে বলুক আর না বলুক, মনে করতেন অনির্বাচিত সরকার (গত নির্বাচনে যেহেতু ভোটারদের মাত্র এক-তৃতীয়াংশ ভোট দিয়েছিলেন!)।

এ কথা ঠিক এখানে তিনি ‘‌বিদেশী’ বা ‘‌শ্বেতাঙ্গ’ বলতে আমেরিকানদেরকেই বুঝিয়েছেন। নিকট অতীতে আমেরিকান পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে ‘‌সরকার পরিবর্তনের’ জন্য যড়যন্ত্রমূলক আন্দোলন করার অনেক উদাহরণ আছে। এমনকি দুর্নীতিবাজ-স্বৈরাচারী, অনির্বাচিত, অগণতান্ত্রিক শাসকের বিরুদ্ধে পরিচালিত ‘‌জনপ্রিয় আন্দোলন’-এ ছদ্মবেশে কলকাঠি নেড়ে এ ধরনের আন্দোলন পরিচালনা ও সরকার পরিবর্তনের ঘটনা সাম্প্রতিককালে কয়েকটি দেশে আমেরিকা ঘটিয়েছে। যে কেউ আকাশ-জালে ‘Colour Revolution’ নাম দিয়ে খুঁজলে এ রকম এক ডজন সরকার পরিবর্তনের উদাহরণ দেখতে পাবেন। একাধিক সাবেক সোভিয়েত প্রজাতন্ত্রে (জর্জিয়া, ইউক্রেন ইত্যাদি) আমেরিকা ও পশ্চিমা সমর্থন নিয়ে দুর্নীতিপরায়ণ-স্বৈরতান্ত্রিক শাসকদের যেভাবে জনপ্রিয় গণ-আন্দোলনের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিল, বাংলাদেশেও সে ধরনের একটি রঙিন বিপ্লবই আগস্টে হয়েছে বলে হাসিনা ও হাসিনা সমর্থকরা এখন দাবি করছেন। ভারতীয় প্রচারমাধ্যমেও তা বেশ প্রচার হচ্ছে। এখন পর্যন্ত এটি একটি সম্ভাব্য অনুমান। তবে এ অভিযোগ উত্থাপনের পরপরই মার্কিন কর্তৃপক্ষ ক্যাটাগরিক্যালি তা অস্বীকার করেছেন।

যেকোনো ‘‌স্বৈরাচারী সরকার পরিবর্তনের’ জনপ্রিয় আন্দোলনে নানা শক্তি খেলতে পারেন। বিদেশীরা গত আগস্ট আন্দোলনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট পক্ষ হলেও তারা সামনের প্রধান দৃশ্যমান শক্তি ছিলেন না। দৃশ্যমান প্রধান শক্তি ছিল ‘‌ছাত্র-জনতা’। অদৃশ্য কলকাঠি নাড়ার বিষয়টা ‘‌ষড়যন্ত্র তত্ত্বেও অন্তর্ভুক্ত বিষয় এবং এখন পর্যন্ত প্রমাণসাপেক্ষ। 

বাংলায় প্রবাদ আছে যে যখন দাবানল তৈরি হয় তখন কেউ কেউ সে সুযোগে আলু পুড়িয়ে খেতে চেষ্টা করে যেমন সাম্প্রদায়িক শক্তি, ভাস্কর্য ধ্বংসকারী, হিন্দু সম্পত্তি দখলদার এবং সাধারণভাবে এক লহমায় ভোল পাল্টানো অপশক্তিগুলোকে আমরা আন্দোলনের বিজয় পরবর্তী সময়ে মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেখছি। হয়তো নাখোশ মার্কিনরাও বর্তমানে তাদের চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলানোর জন্য তৎপর হবে। এসব ‘‌বক্তব্য’ সত্য হলেও এ আন্দোলনে এত অল্প সময়ে এত বেশি সংখ্যক শিশু ও তরুণ নিহত হয়েছে যে একে আমরা অনায়াসেই রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড/গণহত্যা নামে অভিহিত করতে পারি। আর একে ঘিরে এসব পাল্টাপাল্টি বয়ান নিরসনের জন্যই যত দ্রত সম্ভব এসবের একটি নিরপেক্ষ তদন্ত ও বিচার হওয়া উচিত।

ড. এমএম আকাশ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

আরও