অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, বেসরকারি গবেষণাপ্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মাননীয় ফেলো। বর্ণাঢ্য কর্মজীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২৫ বছর শিক্ষকতা করেছেন। গবেষণাকর্মের জন্য বিশ্ববিদ্যালয়টির মর্যাদাপূর্ণ ইব্রাহিম স্মৃতি স্বর্ণপদকে ভূষিত হন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট সদস্য হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। মূল্যস্ফীতির সাম্প্রতিক চিত্র, ঘাটতি বাজেট মেটাতে ও আসন্ন বাজেট প্রণয়নের আগে সরকারের করণীয়, চলমান পরিস্থিতিতে আর্থিক ও ব্যাংক খাতের পুনরুদ্ধারসহ নানা প্রসঙ্গে কথা বলেছেন বণিক বার্তায়। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সাবরিনা স্বর্ণা
সরকারের পক্ষ থেকে প্রাথমিকভাবে আগামী অর্থবছরের জন্য মূল্যস্ফীতির একটা লক্ষ্যমাত্রার কথা বলা হচ্ছে। চলতি অর্থবছরে মূল্যস্ফীতির হারের লক্ষ্যমাত্রা ছিল সাড়ে ৬ শতাংশ, যা এখনো পূরণ হয়নি। দেশের বর্তমান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে মূল্যস্ফীতির সামগ্রিক চিত্রটা কীভাবে দেখছেন?
এ চড়া মূল্যস্ফীতির হার বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার উত্তরাধিকার সূত্রে পেয়েছে। ২০২২ সালে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৈশ্বিক বাজারে খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে যায়, যার অভিঘাত আমাদের অর্থনীতিতেও পড়ে। এ জের এখনো টানতে হচ্ছে। যদিও অনেক দেশ দ্রুতই এ বাড়তি মূল্যস্ফীতির রাশ টানতে সক্ষম হয়েছিল, কিন্তু আমাদের দুই সংখ্যার উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো অব্যাহত আছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে অন্তর্বর্তী সরকার চলতি অর্থবছর যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা এখনো সেভাবে কাজে আসেনি। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি, রাজস্বনীতির পরিবর্তন তথা অনেক পণ্যের শুল্ক প্রত্যাহার করা বা কমানো হয়েছে, বাজার ব্যবস্থাপনায় বিশেষ পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তার পরও আশানুরূপভাবে মূল্যস্ফীতি কমেনি। যদিও বর্তমানে মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে। তবে মূল্যস্তর এখনো অনেক ওপরে আছে। জুনের মধ্যে মূল্যস্ফীতি কমিয়ে ৬ বা সাড়ে ৬ শতাংশে নামিয়ে আনতে পারলেও মূল্যস্তর অনেক বেশিই থাকবে। কারণ মজুরি বৃদ্ধির হার থেকে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার অবনমন ঘটেছে এবং তা অব্যাহত থাকবে। তবে স্বস্তির বিষয় হলো, আমাদের রিজার্ভের পরিমাণ ধীরে ধীরে হলেও বাড়ছে। এর দুটি ইতিবাচক দিক আছে। এক. বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীল পর্যায়ে থাকায় আমদানীকৃত পণ্যের মূল্যস্ফীতির যে প্রবণতা ছিল তা এখন আর নেই; দুই. পণ্য আমদানির ক্ষেত্রে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) খোলা-সংক্রান্ত সীমাবদ্ধতাগুলো আর নেই বললেই চলে। ফলে পণ্যের সরবরাহ বেড়েছে। কিন্তু খাদ্যের জোগানের বড় অংশই আসে আমাদের নিজস্ব উৎপাদন ব্যবস্থা থেকে, যার জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ। কিন্তু আমাদের বিনিয়োগ এখনো স্তিমিত অবস্থায় আছে। বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে মূল্যস্ফীতি হয়তো কিছুটা কমে আসবে, কিন্তু ভোক্তার স্বস্তি ফিরতে আরো সময় লাগবে বলে মনে হয়। কারণ উৎপাদনের ক্ষেত্রে যেসব অনুঘটক পণ্য আছে, সেগুলোর দাম কমছে না। আবার গ্যাস, বিদ্যুৎ প্রভৃতির দাম পুনর্মূল্যায়ন হওয়ায় উৎপাদন খরচ বাড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে কাঙ্ক্ষিত ফলাফল পাওয়ার জন্য বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, ভোক্তার আয় বৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি—এ চারের মধ্যে সংশ্লেষ প্রয়োজন।
মার্কিন কৃষি বিভাগের সাম্প্রতিক এক প্রাক্কলন মতে, বাংলাদেশের শেষ দুটি বন্যা ও সামগ্রিক পরিস্থিতির কারণে বাংলাদেশকে প্রায় চলতি অর্থবছরে ৮০ লাখ টনের বেশি চাল ও গম আমদানির প্রয়োজন পড়বে। যদিও এখন পর্যন্ত আমদানি সেভাবে পরিলক্ষিত হচ্ছে না। আমদানির পরিমাণ না বাড়লে মূল্যস্ফীতির ওপর কী ধরনের প্রভাব পড়বে?
জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) এ-সংক্রান্ত প্রতিবেদন এবং মার্কিন কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান দেখেছি আমি। সাম্প্রতিক সময়ে সরকার আমদানির পরিমাণ বাড়ালেও তা স্বস্তির পর্যায়ে এখনো যায়নি। আমাদের বর্তমান মজুদ কী পরিমাণ আছে এবং এবারের আমন উৎপাদন কেমন হয়েছে আর সামনে আমাদের সবচেয়ে বড় বোরো মৌসুম আসছে—এসব বিবেচনায় নিয়ে দেখতে হবে যে আমাদের কতটা আমদানির প্রয়োজন রয়েছে। তবে এটা ঠিক আমাদের মজুদ আরো বাড়াতে হবে, বিশেষ করে চাল ও গমের মজুদ বাড়াতে হবে, যাতে করে এসব পণ্যের দাম বাড়লেও খোলা বাজারে বা ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে বিক্রি করে বাজারের ওপর চাপ কিছুটা কমানো যায়। আর বাজার ব্যবস্থাপনায় দক্ষতার পরিচয় দিতে হবে, যাতে বাজার সিন্ডিকেট কোনো কারসাজি না করতে পারে। পাশাপাশি বাজার ও আমদানিকারকদের মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা বজায় থাকে এবং কেউ যেন কৃত্রিম সংকট তৈরি করে একচেটিয়া মুনাফা অর্জন করতে না পারে তা যথাযথভাবে তদারকি করতে হবে।
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হয়েছে। যদিও মূল্যস্ফীতির হার উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কমেনি। বরং বেসরকারি খাতে ক্রমে ঋণপ্রবাহ কমতেও দেখা যাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে অন্তর্বর্তী সরকার আগামী অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন বলে মনে করছেন?
স্তিমিত বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহে যে এখন পর্যন্ত চাঞ্চল্য আনা সম্ভব হয়নি, এটিই সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তার কারণ। বিনিয়োগ না হলে সরবরাহ হবে না, সরবরাহের পরিমাণ না বাড়লে চাহিদা-জোগানের মধ্যে যে পার্থক্য সেটাও আমরা কমাতে পারব না। দেশী বা বিদেশী উভয় ক্ষেত্রেই বিনিয়োগকারীরা অস্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিবেশ, আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ইত্যাদি কারণে অনিশ্চয়তায় ভুগছেন। যে কারণে নতুন কোনো বিনিয়োগ হচ্ছে না। ক্যাপিটাল মেশিনারিজ আমদানির ক্ষেত্রেও আমরা সেটা দেখেছি। রফতানি প্রবৃদ্ধি ভালো হয়েছে তবে তা অতিরিক্ত সক্ষমতা ব্যবহার করে। নতুন বিনিয়োগ করে যে গত আট মাসে রফতানি বেড়েছে তা নয়। দ্বিতীয়ত, আমরা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করতে গিয়ে যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছি তার নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বিনিয়োগের ওপর। এ সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়ার পেছনেও রয়েছে পুঞ্জীভূত সমস্যা।
প্রায় প্রতিটি ব্যাংকে সীমাহীন খেলাপি ঋণ রয়েছে। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে ঋণের উচ্চমাত্রার সুদহার নির্ধারণ ব্যতিরেকে উপায় ছিল না। ডিপোজিটর ১০০ টাকা দিলেও ব্যাংক ঋণ দিতে পারছে ৬০-৬৫ টাকা। ফলে ঋণের বাড়তি খরচ বিনিয়োগকারীদের বহন করতে হচ্ছে। আবার গ্যাসের সরবরাহ বাড়ানোর কৌশল হিসেবে অভ্যন্তরীণ উৎস অনুসন্ধান ও উত্তোলনকে গুরুত্ব না দিয়ে এলএনজি আমদানিকে প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। অদক্ষতা-দুর্নীতির কারণে গ্যাসের দামও ব্যাপক বেড়েছে। দেখা যাচ্ছে, উৎপাদনকারীদের জন্য প্রতিটি ক্ষেত্রে খরচ বাড়ছে। বিনিয়োগ হ্রাসের সঙ্গে সঙ্গে সরবরাহে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আগামী বাজেটে এ ধরনের অনিশ্চয়তা কেটে যাবে। কেননা এর মধ্যেই আমরা একটা গণতান্ত্রিক সরকার পাব বলে আশা করছি। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া শুরু হলে দেশী-বিদেশী বিনিয়োগ বাড়বে বলে আশা করা যায়। এতে কর্মসংস্থান থেকে শুরু করে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বাড়বে। আগেই বলেছি, মূল্যস্তর অনেক বেশি থাকবে আর তার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে হলে মানুষের আয় বাড়াতে হবে। আর তা করতে হলে সম্পদ আহরণ ও তার যথাযথ ব্যবহার এবং বার্ষিক উন্নয়ন পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
আমাদের ঘাটতি বাজেট বেড়ে যাচ্ছে, যা পূরণে সরকারের ঋণও বাড়ছে। অন্যদিকে মূল্যস্তর কমানোর জন্য শুল্ক কমানো বা প্রত্যাহার করা হচ্ছে। তাতে রাজস্ব আয়েও প্রভাব পড়ছে। এই যে ঘাটতি বাজেট, সরকারের ঋণ, রাজস্ব আদায় কমে যাওয়া—সামগ্রিক পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী?
আমাদের কর-জিডিপি অনুপাত ৭ দশমিক ৩ শতাংশ এবং রাজস্ব-জিডিপি অনুপাত ৮ দশমিক ২ শতাংশ। আমাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ও অবকাঠামোসহ মৌলিক খাতগুলোয় প্রয়োজনীয় ব্যয় করতে পারছি না। রাজস্ব আয় ও রাজস্ব ব্যয় আমাদের সমান। উন্নয়ন বাজেটের পুরোটাই আমাদের অভ্যন্তরীণ বা বৈদেশিক ঋণ নিতে হয়। আমাদের ঘাটতি বাজেট পূরণ করতে হয় ঋণ নিয়ে। বর্তমানে এ ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ছে। এ পরিস্থিতিতে একমাত্র উপায় হচ্ছে আয় বাড়ানো, অর্থাৎ রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধি। আমাদের সমগোত্রীয় সব দেশের তুলনায় আমাদের আয় অনেক কম। পৃথিবীর সব দেশেই উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে প্রত্যক্ষ করের হার বাড়তে থাকে। কিন্তু আমাদের দেশে উল্টো চিত্র—পরোক্ষ করের ওপর নির্ভরশীল। এ কারণে পণ্যের দাম বেড়ে যায়। এ পরোক্ষ করের বোঝা সাধারণ মানুষের ওপর পড়ে। আর প্রত্যক্ষ করের হার বেশি হলে এক. রাজস্ব আদায় বাড়ে; দুই. আমাদের যে আয়, ভোগ ও সম্পদের বৈষম্য আছে তা অনেকটা লাঘব হয়। আমাদের এ জুলাই বিপ্লবের মূল চালিকাশক্তি ছিল সামাজিক বৈষম্য। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ প্রয়োজন। তাই জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) ঢেলে সাজাতে হবে, প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আধুনিকায়নের মাধ্যমে এটাকে শক্তিশালী করতে হবে। এছাড়া দেশ থেকে যেভাবে টাকা পাচার হয়েছে, আগামীতে সেই প্রবণতা কিছুটা হলেও কমে আসবে বলে আশা রয়েছে। তাই বাজেট প্রণয়নের সময় কীভাবে প্রত্যক্ষ কর বাড়ানো যায়, ই-টিনকে আরো কার্যকর করে কীভাবে কর ফাঁকি দেয়ার পরিমাণ কমিয়ে আনা যায় প্রভৃতি নির্দেশনা থাকতে হবে। তাহলে রাজস্ব আয় থেকে খরচ করেও আমাদের কিছু অতিরিক্ত অর্থ থাকবে যা আমরা উন্নয়ন বাজেটে ব্যয় করতে পারব। এতে ঋণের যে চক্রাকারে পড়ে গেছি, সেখান থেকে কিছুটা হলেও পরিত্রাণ পাওয়া যাবে।
দীর্ঘ সময় ধরে রাজস্ব আয় বা প্রত্যক্ষ কর বাড়ানোর মতো আলোচনার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি আমরা। কেন বাস্তবায়ন হয় না, সেটি একটি প্রশ্ন। সেই সঙ্গে অর্থনীতিবিদ বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে যাদের থেকে এ আলোচনাগুলো বেশি এসেছে, তাদের অনেকেই এখন অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্বে আছেন। সে জায়গা থেকে আপনি কতটুকু আশাবাদী?
এনবিআরকে অগ্রাধিকার না দেয়া বা একই কথা বছরের পর বছর বলা, কিন্তু কোনো কোনো ইতিবাচক ফলাফল না পাওয়া—এগুলোর পেছনে মূলত রাজনৈতিক অর্থনীতির দায় আছে। রাজস্ব আয় বা প্রত্যক্ষ কর বাড়াতে গেলে যাদের হাতে টাকা আছে, তাদের ওপর করারোপ করতে হবে। যারা ঋণখেলাপি হয়ে দেশের টাকা বাইরে নিয়ে গেছে, তাদের কর দেয়ার আগ্রহ নেই। পরোক্ষ কর দিয়ে সাধারণ মানুষের ওপর কর বসিয়ে দেয়া সহজ। দ্বিতীয়ত, যেসব খাত থেকে ভ্যাট আহরণ হয়, তা পুরো খাতের কেবল ভগ্নাংশ মাত্র। আবার যেটা উঠে আসে তা থেকে সরকার তার চেয়েও কম পায়। এসব ক্ষেত্রে অনিয়মের পথগুলো বন্ধ করতে হবে। আমরা দীর্ঘদিন ধরেই জিরো টলারেন্সের কথা শুনতেছি। যেহেতু এটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত একটি খাত, তাই এখান থেকেই জিরো টলারেন্স নীতি গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশন বড় ভূমিকা পালন করতে পারে। এনবিআরের কর্মকর্তার সঙ্গে গ্রাহকের যোগাযোগের দরকার নেই। ডিজিটালাইজেশন হয়ে গেলে ভ্যাট বা কর পরিশোধ স্বয়ংক্রিয়ভাবে হয়ে যাবে। গত ২০ বছরে এগুলোর পেছনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করা হয়েছে। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়নি। বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, ভ্যাটের অটোমেশনের মাত্র ৪৩ শতাংশ কাজ হয়েছে। কিন্তু এ জায়গাগুলোয় আমাদের অনেক ধরনের সুযোগ আছে। বিভিন্ন স্বার্থসংশ্লিষ্ট গোষ্ঠীর স্বার্থের কারণে এটি আগে করা হয়নি। এখন এদিকে নজর দিতে হবে। সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় ২০১৫ সালে কর-জিডিপির অনুপাত ছিল ১১ শতাংশ। ২০২০ সালে এ হারকে ১৬ শতাংশে উন্নীত করার কথা ছিল। বর্তমানে এ হার ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এ খাতে বিপুল টাকা খরচ করার পর এখন ১১ থেকে ৮ শতাংশে নেমে এসেছে। কিন্তু এর জন্য কোনো জবাবদিহিতা নেই। এক্ষেত্রে কীভাবে টাকা ব্যয় হলো তার জবাবদিহি নেই। অনেক সময় বাইরে থেকে কোম্পানি নিয়ে আসা হয়েছে এবং তারা কাজ শেষ না করে চলে গেছে। সেখানে আমাদের ব্যবস্থাপনার জন্য টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
আমাদের দেশে গত ২০-২৫ বছরে আইটি প্রফেশনালের ক্ষেত্রে বেশ উন্নতি হয়েছে। কভিডের সময় তারা অনেক সার্ভিস অনলাইনে দিয়েছেন। কিন্তু দেশীয় কোনো প্রতিষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে পারেন? না। কারণ আমাদের বৈদেশিক উন্নয়ন সহযোগীরা ডিজিটালাইজেশনের জন্য ২০০-২৫০ মিলিয়ন ডলারের প্রকল্প নিয়ে আসেন এবং সেখানে শর্ত হিসেবে থাকে, ৫০ মিলিয়ন ডলারের কাজের কোনো অভিজ্ঞতা না থাকলে তারা সেখানে অংশগ্রহণ করতে পারবেন না। তাই আমাদের দেশের যারা আইটি প্রফেশনাল রয়েছেন, তাদের সুযোগ দিতে হবে। এগুলোর জন্য বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী দাঁড়িয়ে গেছে। এক্ষেত্রেও নজর দিতে হবে।
কর ও ভ্যাট ফাঁকির যেসব জায়গা রয়েছে সেগুলো বন্ধ করতে হবে। ভ্যাট আহরণে স্বচ্ছতা আনতে প্রায় তিন লাখ ইলেকট্রনিক ফিসক্যাল ডিভাইস ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (ইএফডিএমএস) চালুর কথা ছিল এনবিআরের। এখন সেটি ১০ হাজারও হয়নি। মানুষ ভ্যাট দিচ্ছে কিন্তু সরকার পাচ্ছে না। এখন আমাদের বড় সুযোগ আছে। এ সুযোগ কাজে লাগাতে পারলে অব্যাহতভাবে তা আমাদের সামনে ইতিবাচক ফল দেবে।
বিগত সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি, অনিয়ম ও অর্থ পাচারের মতো ঘটনা ঘটেছে। সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যাংক ও আর্থিক খাত। আগামী বাজেটে সামগ্রিকভাবে অর্থনীতি, বিশেষত ব্যাংক খাত পুনরুদ্ধারে কী ধরনের পদক্ষেপ নেয়া যায়?
ব্যাংক খাতে ব্যাপক পরিমাণে ঋণ খেলাপি হয়েছে। লুটপাট ও অর্থ পাচার করা হয়েছে। একই কথা শেয়ারবাজারের ক্ষেত্রেও বলা যায়। লুটপাট ও অর্থপাচারের ক্ষেত্রে কোনো আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাকি ছিল না। সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা, সুশাসন, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা—এ আঙ্গিকে বাজেটকে দেখতে হবে। এক বাজেট দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করা যাবে না। তবে কিছু কিছু সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে। যারা কর ফাঁকি দিচ্ছে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া যাবে। তবে ঋণখেলাপির বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংককে তৎপর হতে হবে। অর্থ পাচারের বিষয়ে ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টিলিজেন্স ইউনিটকে করতে হবে। তবে একটা বাজেট দিয়ে সব কিছু করা যাবে না। বাজেট একটি শক্তিশালী জায়গা, যেখানে একটি সিগন্যাল দিতে পারি।
বাজেটের মাধ্যমে সরকারের ব্যয় হয়। যদি সরকারের এ ব্যয় সাশ্রয়ী ও সুশাসনের সঙ্গে করা যায় এবং সময়মতো প্রকল্পগুলো শেষ করা যায়, তাহলে এ অর্থকে ভালোভাবে কাজে লাগানো যাবে। এ বাজেটে আমরা আশা করছি, অর্থ আহরণ, রাজস্ব ব্যয় ও উন্নয়ন ব্যয়—এ তিন দিকেই পরিবর্তন দেখতে পাব। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মাধ্যমে একটি পরিবর্তন এসেছে, তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণভাবে বাংলাদেশ অগ্রসর হবে এবং এর প্রতিফলন আমরা দেখতে পাব।