কামাল,
জানি, তোর জন্মদিন উপলক্ষে আমার এ শুভেচ্ছাবার্তা কোনো দিনই তোর হাতে পৌঁছবে না। কিন্তু তবু বড় মায়ায় তোকে লিখছি।
তোর বয়স আজ ৭১ হলো। আমরাও সে সংখ্যা ছুঁইছুঁই করছে। আসল ব্যাপার কি জানিস, দিন-মাস-বছর পেরিয়ে আমাদের বয়স বেড়েছে, কিন্তু তুই ব্যাটা ওই ২৫-এ রয়ে গেলি। দেখ না, আমাদের বুড়ো বয়সের ছবি আছে, তোর কিন্তু ২৫-এর পরে ছবি নেই। তোর বয়স ২৫-এর পরে বাড়ল না, আর আমরা বয়সের সেতুতে একটার পর একটা সেতু-স্তম্ভ পার হয়ে এলাম। তোকে দেখে আমার হিংসা হয়, বুঝলি রে চিরতরুণ!
ক’দিন আগেই খুঁজছিলাম একটা দরকারি কাগজ। পাচ্ছিলাম না কোথাও। এধার-ওধার ঘাঁটতে ঘাঁটতে হঠাৎ বেরিয়ে এল পুরনো এক হলদেটে বড় খাম। জানি, ওখানে থাকার কথা নয় প্রয়োজনীয় কাগজটি, তবু কী মনে করে খুলতে চেষ্টা করলাম খামটির মুখ। তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হুড়মুড় করে খামটির সব কাগজপত্র ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। বিরক্ত লাগল নিজের ওপর এই অহেতুক কাজ বাড়ানোর জন্য।
নিচু হয়ে কাগজপত্র তুলতে গিয়ে হঠাৎ দেখলাম, অন্য কাগজের ফাঁকে উঁকি দিচ্ছে একটি ছবি। একটু বিবর্ণ ছবিটা, এখানে-ওখানে রঙ চটে গেছে, মুচড়েছেও কিছুটা। ওটা হাতে নিতে নিতে মনে হলো, বহুকালের পুরনো কোনো ছবি সন্দেহ নেই। চোখের সামনে ছবিটা আনতেই হঠাৎ পৃথিবীটা দুলে উঠল। বসে পড়লাম সামনের চেয়ারে।
এ কি, এ কোন ছবি? কোথায় লুকিয়ে ছিল এ ছবি এত কাল? কেমন করে ওটা বন্দি হয়ে ছিল একটি বিবর্ণ হলদে খামে? এ ছবি তো ১৯৭৫ সালের ১২ আগস্টের। রাত্তির তখন ৯টার মতো। ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের মিলনায়তনে তোলা। তুলেছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান চিত্রগ্রাহক প্রয়াত আজমল হক—আমাদের সতীর্থ রোকেয়া মীনাক্ষী হকের বাবা। সবে আমরা, মানে সলিমুল্লাহ হল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযেগিতায় সূর্য সেন হলকে হারিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো শিরোপা পেয়েছি।
ওই তো ছবিতে হাস্যোজ্জ্বল তুই। বাঁ হাতে তার আমাদের বিজয় শিরোপাটি, ডান হাতে সে ধরে আছে আমার ডান হাত। কামাল দাঁড়িয়ে আছে মঞ্চের সামনে নিচে, আমি আসীন সাদুর কাঁধে মঞ্চের ওপরে। মঞ্চ আর তার আশপাশে আনন্দে উদ্বেলিত সলিমুল্লাহ হলের ছাত্ররা। মনে হলো, এ ছবি তোলার ৪৮ ঘণ্টা পরই তো কামালের জীবনপ্রদীপ নিভে গেছে নৃশংস আততায়ীদের হাতে। খুব সম্ভবত এটাই ওর জীবনের শেষ ছবি। এ ছবি তো অমূল্য!
আমার চোখ ঝাপসা হয়ে এল। আমার চারপাশ লুপ্ত হয়ে গেল, বর্তমান মুছে গেল, চলচ্চিত্রের মতো সময়ের চাকা ঘুরতে লাগল পেছনে—৪৩ বছর আগে। ওই তো পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছি ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্রের আলোকোজ্জ্বল মিলনায়তন। করতালি, আনন্দ-চিত্কার আর উল্লাসে ফেটে পড়ছে মিলনায়তন। সবে ঘোষিত হয়েছে যে এক তীব্রতম প্রতিদ্বন্দ্বিতার পরে সলিমুল্লাহ হল দ্বিতীয় আন্তঃহল বিতর্ক প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত পর্বে সূর্য সেন হলকে হারিয়ে শিরোপা অর্জন করেছে। আমার সহবিতার্কিকরা দলনেতা হিসেবে আমার হাত আঁকড়ে ধরেছে যুদ্ধজয়ের গর্বে, আনন্দে, তৃপ্তিতে।
১৯৭৫ সালের ১২ আগস্ট তোলা। টিএসসিতে। তুলেছিলেন তদানীন্তন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখ্য চিত্রগ্রাহক প্রয়াত আজমল হক
পরিষ্কার মনে আছে সেদিনের পুরস্কার প্রদানের পালাটির কথা। ওই তো বিজয়ী দলের দলনেতা হিসেবে শিরোপা গ্রহণ করছি জাতীয় সংসদের অধ্যক্ষ আবদুল মালেক উকিলের কাছ থেকে। পাশে সহাস্যে দাঁড়িয়ে আছেন আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সভাপতি অধ্যাপক আবদুল মতিন চৌধুরী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের সহসভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম।
পুরস্কার বিতরণী শেষে বিশিষ্ট ব্যক্তিরা মঞ্চ থেকে নেমে গেলে যেন বাঁধ ভেঙে গেল। তুমুল আনন্দ-নৃত্যে, গানে, উচ্চকণ্ঠ ধ্বনিতে ফেটে পড়ল সারা মিলনায়তন। তার নেতৃত্বে শেখ কামাল। সলিমুল্লাহ হলের একদল ছাত্র ততক্ষণে হইহই করতে করতে মঞ্চ দখল করে নিয়েছে—তাদের আনন্দ-চিত্কারে কান পাতা দায়, তাদের উদ্দাম নৃত্যে মিলনায়তন মঞ্চ টলটলায়মান। হঠাৎ অনুভব করলাম, আমি আর মঞ্চভূমিতে দাঁড়িয়ে নেই, উঠে গেছি একজনের কাঁধে—খুব সম্ভবত শক্তিমান সাদুর কাঁধেই বোধহয়।
আমার ডান হাতে তখন কাঠ আর তামায় তৈরি ভারী বিজয় শিরোপা। তাই নিয়ে সাদুর কাঁধে আমি টলটলায়মান। বাঁ হাতে চেষ্টা করছি ওকে ধরে রাখতে। আমার অবস্থা দেখে মঞ্চের একেবারে পাশ ঘেঁষে ছুটে আসে কামাল। আমার হাত থেকে তুলে নেয় ওই ভারী শিরোপা তার বাঁ হাতে। ডান হাত উঁচু করে দৃঢ়ভাবে ধরে রাখে আমার ডান হাত, যাতে আমার ভারসাম্য রক্ষিত হয়, যাতে আমি পড়ে না যাই। ঠিক সে সময়ই ঝলকে ওঠে আজমল হকের ক্যামেরা—তৈরি হয় ইতিহাস।
মনে আছে সে রাতে ছাত্র-শিক্ষক কেন্দ্র থেকে কামাল আমাকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয়ে আসবেন—চারদিকে সাজ সাজ রব। অপরাজেয় বাংলার স্থাপত্যে ঝাড়পোছ চলছে, রঙ দেয়া হচ্ছে, ঝাঁ ঝাঁ বাতি তার চারদিকে। ‘চল, চল, হামিদ ভাইয়ের তাজমহল দেখে আসি’—বলেছিল সে। ওই এক ঠাট্টা ছিল আমাদের। অপরাজেয় বাংলার স্থাপত্যের প্রতি সে সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ম. হামিদের নিবিড় টানের কারণেই আমরা এ নিয়ে হামিদ ভাইকে ক্ষ্যাপাতে চেষ্টা করতাম। হামিদ ভাই মিষ্টি হাসতেন। ১৬ আগস্ট আমার অর্থনীতি পরীক্ষা। আমি গাঁইগুঁই করছি দেখে কামাল লোভ দেখাল, ‘চল, চা খাওয়াব তোকে।’
না, ফেরাতে পারিনি ওকে। ও ছাড়ার পাত্র ছিল না, যেতেই হয়েছিল ওর সঙ্গে অপরাজেয় বাংলার পাদদেশে। হামিদ ভাইকে পেয়েছিলাম সেখানে, আর ভাগ্যক্রমে মিলে গিয়েছিল এক চাওয়ালা। দু-এক কথার পরে হামিদ ভাই তার তদারকি কর্মে ফেরত গিয়েছিলেন। কামাল আর আমি কিছু এলোমেলো গল্প করেছিলাম। এক পর্যায়ে আমি উঠে পড়লাম। পরীক্ষা প্রস্তুতির তাড়া ছিল আমার। যখন চলে আসি, তখন কামাল আমার হাত ধরেছিল আনন্দের উদ্বেলতায়, বন্ধুত্বের উষ্ণতায়, সখ্যের মমত্বে। পরিষ্কার মনে আছে, বিদায় মুহূর্তে ও বলেছিল, ‘দেখা হবে।’
না, আর দেখা হয়নি আমাদের—কোনোদিন আর হবে না। আজ যখন ঝাপসা চোখে ছবিটির দিকে তাকিয়েছি, তখন মনে হয়েছে, সে রাতে কামালের এক হাত আমার ভার তুলে নিয়েছিল, অন্য হাত আমাকে ধরে রেখেছিল, যাতে আমি ভারসাম্য না হারাই, যাতে আমি পড়ে না যাই। কিন্তু মাত্র ৪৮ ঘণ্টার মাথায় হত্যাকারীর গুলি যখন ওর দিকে ছুটে গিয়েছে, ঝাঁজরা করে দিয়েছে ওকে, ও যখন পড়ে গিয়েছিল, তখন তো ওকে আমি ধরতে পারিনি, ওকে তো আমি রক্ষা করতে পারিনি, ওকে আমি বাঁচাতে পারিনি। কামাল, এ দুঃখ আমি কোথায় রাখি? এ লজ্জা আমি কী করে ঢাকি? পৃথিবীর কোন অন্ধকার গহ্বরে আমি লুকোই?
তোরই
সেলিম
সেলিম জাহান: সাবেক পরিচালক, মানব উন্নয়ন প্রতিবেদন দপ্তর এবং দারিদ্র্য দূরীকরণ বিভাগ, জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি, নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র