বিশ্ব অর্থনীতি

বৈশ্বিক অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি, অনিশ্চয়তা নিয়ে আসছে নতুন বছর

কভিড মহামারীর প্রভাব সবেমাত্র কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, তখনই একরাশ নয়া প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সামনে এল ২০২৫ সাল।

কভিড মহামারীর প্রভাব সবেমাত্র কাটিয়ে উঠতে শুরু করেছে বৈশ্বিক অর্থনীতি, তখনই একরাশ নয়া প্রতিবন্ধকতা নিয়ে সামনে এল ২০২৫ সাল। মুদ্রাস্ফীতির বিরুদ্ধে লড়াই করে অর্থনৈতিক মন্দাকে সামাল দিয়েই ২০২৪ সালে বিশ্বব্যাপী কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো তাদের সুদহার কমাতে সক্ষম হয়েছে।

গত হওয়া (২০২৪ সাল) বছরে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপে শেয়ারবাজার রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছিল। ২০২৪ সালকে ফোর্বস ‘অতি-ধনীদের জন্য একটি উল্লেখযোগ্য বছর’ হিসেবে ঘোষণা করেছে, কেননা এ বছরে ১৪১ জন নতুন বিলিয়নেয়ার সুপাররিচের তালিকায় নিজেদের নাম লিখিয়েছেন।

বিশ্বের দুই শক্তিশালী ও বড় অর্থনীতির দেশ আমেরিকা ও ভারত। ২০২৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় দেশ দুটির নির্বাচন। কিন্তু কভিড মহামারীর পর বিশ্বজুড়ে কঠিন অর্থনৈতিক বাস্তবতা, দ্রব্যমূল্যের বৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতিতে স্বাভাবিক জীবন পরিচালন কঠিন হয়ে পড়েছিল। যার জন্য রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের ওপর জনগণের আস্থার ভিত নড়বড়ে হয়ে গেছে। পুরো বছরজুড়েই ভারত থেকে শুরু করে দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপ ও যুক্তরাষ্ট্রে বর্তমান সরকারগুলোর বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করেছিল সাধারণ মানুষ।

ধারণা করা হচ্ছে ২০২৫ সাল আরো কঠিন হতে চলেছে। ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রেসিডেন্সি যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আমদানি শুল্ক আরোপ করে, তবে বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য যুদ্ধ শুরুর ক্ষেত্রে তা একটি মুখ্য ভূমিকা রাখবে, যা কিনা নতুন ধরনের মূল্যস্ফীতি, বৈশ্বিক মন্দা ঘটাবে। আর বর্তমানে ঐতিহাসিকভাবে নিম্ন স্তরে থাকা বেকারত্ব বৃদ্ধি পেতে পারে ২০২৫ সালে।

ইউক্রেন ও মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত, জার্মানি ও ফ্রান্সের রাজনৈতিক অচলাবস্থা এবং চীনা অর্থনীতি নিয়ে প্রশ্ন সমগ্র বিশ্ব পরিস্থিতি আরো জটিল করে তুলছে। একই সঙ্গে বেশ কয়েকটি দেশের জন্য বাড়তি চিন্তার উদ্বেগ ঘটাবে জলবায়ুর ক্ষতি মোকাবেলায় ব্যয়িত অর্থ।

বিশ্বব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, কভিড মহামারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ায় দেড় দশক ধরে বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলো সবচেয়ে বেশি অর্থনৈতিক সংকটে রয়েছে। পিছিয়ে পড়া এসব দেশের জন্য প্রয়োজন

নতুন হেডওয়াইন্ড, যেমন শিথিল বাণিজ্য বা তহবিল শর্তাবলি।

উন্নত দেশগুলোর নাগরিকরা মনে করছেন তাদের ক্রয়ক্ষমতা, জীবনযাত্রার মান এবং ভবিষ্যৎ জীবন ক্রমেই অবনতির দিকে যাচ্ছে। এমতাবস্থায় উন্নত অর্থনীতির দেশগুলোয় দেশের নাগরিকদের সরকারের প্রতি বিশ্বাস ফেরানো হবে রাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। আর এ সমস্যাগুলোক মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হলে চরমপন্থী দলগুলোর উত্থান সুনিশ্চিত।

জাতীয় বাজেটগুলোর জন্য নতুন ব্যয়ের খাতসংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এরই মধ্যে কভিড-পরবর্তী সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা, সেনাবাহিনী সুসজ্জিত করা এবং বৃদ্ধ জনসংখ্যার দেখভাল করার মতো ব্যয়ের খাত রাষ্ট্রগুলোর জন্য নতুন সংযোজন। শুধু শক্তিশালী অর্থনীতির দেশগুলোই এ ধরনের খাতে ব্যয়ের জন্য রাজস্বের জোগান দিতে সক্ষম। আগের মতো কেবল ঋণ বাড়িয়ে কাজ করার সিদ্ধান্তে আটকে থাকলে আর্থিক সংকট চক্রেই আটকে পড়ার ঝুঁকি থাকবে রাষ্ট্রগুলোর।

বছরের শেষ সংবাদ সম্মেলনে ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিন লাগার্দে বলেছেন, ২০২৫ সালে অনিশ্চয়তা থাকবে অফুরন্ত। ট্রাম্প ১০-২০ শতাংশ আমদানি শুল্ক আরোপ করবেন কিনা তা নিয়ে এখনো ধোঁয়াশা রয়েই গেছে। আমদানি শুল্ক আরোপিত হলে চীনের জন্য তা ৬০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পেতে পারে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে। কিন্তু অনেকেই মনে করছেন এটা কেবলই ট্রাম্পের নতুন কৌশল আলোচনা শুরু করার জন্য। আর সিদ্ধান্তে অটল থাকলে এর প্রভাব বোঝা যাবে কোন কোন সেক্টর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং কারা পাল্টা ব্যবস্থা নেয়।

বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি চীন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ক্রমবর্ধমান পরিবর্তনের সম্মুখীন হওয়ায় বেশ চাপের মুখেই পড়েছে। অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের উচিত উৎপাদন খাতের অতিরিক্ত নির্ভরতা কমিয়ে আনা এবং বিশ্বের অন্যান্য নিম্ন আয়ের দেশে বিনিয়োগ করা।

কভিডের পর যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে পিছিয়ে পড়া ইউরোপ কি পারবে তাদের চলমান সংকটের সমাধান করতে? বিনিয়োগের অভাব থেকে শুরু করে দক্ষতার ঘাটতি মেটাতে? প্রথমেই ইউরোপের দুই শীর্ষ অর্থনীতি—জার্মানি ও ফ্রান্সে চলমান রাজনৈতিক অচলাবস্থার সমাধান করতে হবে।

ট্রাম্পের নীতি মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি করলে ডলারের মান বৃদ্ধি এবং ফেডারেল রিজার্ভের সুদহার কমানোর গতি ধীর হয়ে আসার তীব্র সম্ভাবনা থাকবে, যা কিনা অন্যান্য নিম্ন অর্থনীতির দেশের জন্য খারাপ খবর হবে। এছাড়া ইউক্রেন ও রাশিয়ার মধ্যে চলমান যুদ্ধের অধিকাংশ প্রভাবই বিশ্ববাসীর অজানা। এ সংঘাত চলতে থাকলে বিশ্ববাজারে জ্বালানির দামকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করবে।

তবে এখন পর্যন্ত নীতিনির্ধারকরা এবং আর্থিক খাতগুলো আশা করছে যে বিশ্ব অর্থনীতি এসব সমস্যা পার করতে পারবে এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকাররা সুদের হার স্বাভাবিক স্তরে ফিরিয়ে আনতে সক্ষম হবেন। কিন্তু আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল তাদের সর্বশেষ বিশ্ব অর্থনৈতিক পূর্বাভাসে যে সংকেত দিয়েছে তা হলো: অনিশ্চিত সময়ের জন্য প্রস্তুত হোন।

মার্ক জন: ইউরোপিয়ান ইকোনমিকস এডিটর, রয়টার্স

ভাষান্তর: মৌটুসী জুবাইদা রহমান

আরও