আলোকপাত

শিল্প বিপ্লব-উত্তর উন্নয়নের নিচে বিষ বিস্ফোরণ

শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ব্যাপক অগ্রগতির জন্য সর্বাধিক পরিচিত সময়টি কেবল মানব ইতিহাসের গতিপথই পরিবর্তন করেনি, বরং আমাদের গ্রহের ইতিহাসকেও বদলে দিয়েছে। এ সময়কালে সৃষ্ট প্রযুক্তিগত

শিল্প বিপ্লব, প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ব্যাপক অগ্রগতির জন্য সর্বাধিক পরিচিত সময়টি কেবল মানব ইতিহাসের গতিপথই পরিবর্তন করেনি, বরং আমাদের গ্রহের ইতিহাসকেও বদলে দিয়েছে। এ সময়কালে সৃষ্ট প্রযুক্তিগত অগ্রগতি অনেকের জীবনযাত্রার মানকে ব্যাপকভাবে উন্নত করেছে। শিল্প বিপ্লবের ফল হিসেবে মানুষের কায়িক পরিশ্রমের অনেক লাঘব হয়েছে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষ এতটাই হয়েছে যে একবিংশ শতাব্দীতে এসে দেখা যাচ্ছে যে মানুষের অনেক কাজই করে দিচ্ছে যন্ত্র।

ব্রিটেনে প্রথম শিল্প বিপ্লব শুরু হয়েছিল ১৮ শতকের শেষ থেকে ১৯ শতকের গোড়ার দিকে। প্রথম শিল্প বিপ্লবের শুরু বাষ্প ইঞ্জিনের মাধ্যমে এবং সে ইঞ্জিন পরিচালনার জন্য পোড়ানো হতো কয়লা। দ্বিতীয় শিল্প বিপ্লবে ভারী শিল্পের উদ্ভব ঘটে, যা ইউরোপ ও আমেরিকা হয়ে ধীরে ধীরে পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলে বিস্তার লাভ করতে থাকে। এ সময় ইউরোপের দেশ যুক্তরাজ্য, জার্মানি, ফ্রান্স দ্রুত শিল্পোন্নত হতে থাকে এবং এ কারণে তাদের জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও দ্রুত বেড়ে যায়। শিল্পায়নের এ পর্যায়ে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহারের কারণে বায়ুদূষণ, বন উজাড় ও গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বেড়ে যায়।

শিল্প-কারখানার উৎপাদনে উৎকর্ষের কারণে কৃষিকাজ অনেকটা স্তিমিত হতে থাকে এবং অকৃষি পেশা বিস্তার লাভ করতে থাকে। ফলে কৃষি অপেক্ষাকৃত উপেক্ষিত হয়। কলকারখানার বিকাশের সঙ্গে যেমন অর্থনীতির চাকা দ্রুত গতি পায় তেমনি শিল্প-কারখানা থেকে যেসব দূষক কোনো রকম পরিশোধন ছাড়াই প্রাকৃতিক জলাশয়ে নির্গত হচ্ছে তাতে ভয়াবহভাবে দূষিত হতে থাকে নদীনালা, খাল-বিলসহ সব জলাশয়। এছাড়া অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য গ্রামের লোক শহরমুখী হতে থাকায় নগরগুলোয় দূষণ বাড়তেই থাকে। আবার দ্রুত ঘনবসতিতে পরিণত হওয়ার কারণে অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ তৈরি হয়। শিল্প বিপ্লবের শুরুতে এ কারণে বিশ্বের বিভিন্ন নগরী জনস্বাস্থ্য বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে থাকে।

পরবর্তী সময়ে অবশ্য শিল্প বিপ্লবের কারণে চিকিৎসা ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখা যায়। রসায়ন ও জীববিজ্ঞানের বিকাশের ফলে ভ্যাকসিন আবিষ্কার, উন্নত অস্ত্রোপচারের কৌশল উদ্ভাবন এবং উন্নত জনস্বাস্থ্য প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা চালু হয়। গুটিবসন্তের টিকা ও জীবাণুনাশক পদ্ধতির মতো উদ্ভাবন উচ্চ মৃত্যুহার কমাতে অবদান রেখেছে। নগরায়ণ শেষ পর্যন্ত উন্নত স্যানিটেশন ব্যবস্থা এবং হাসপাতাল প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হয়, যা জনস্বাস্থ্যের উন্নতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

মোটাদাগে শিল্প বিপ্লবের পর মানুষের কাজের ধরন পরিবর্তন হতে থাকে। আগেই উল্লেখ করেছি যে শিল্প বিপ্লবের পর মানুষ কৃষি থেকে অকৃষিতে ঝুঁকতে থাকে। মজার বিষয় হলো, এর মাঝে সামাজিক পরিবর্তনও শুরু হয়ে যায়। কারখানা মালিকরা অধিক উৎপাদন ও মুনাফার জন্য শ্রমিকদের ওপর চাপ সৃষ্টি ও শোষণের জাল বিস্তার করতে থাকেন। শিল্পোন্নত শহরগুলো সাধারণ মানুষের উপস্থিতিতে তার জৌলুশ হারাতে শুরু করে এবং এর দায় চাপানো হয় সাধারণ শ্রমিক শ্রেণীর ওপর। অন্যদিকে কারখানার গুমোট পরিবেশ, বিষাক্ত রাসায়নিকের সংস্পর্শ, যন্ত্রপাতির চাপে বিপজ্জনক পরিবেশ চেপে বসে শ্রমিকদের ঘাড়ে। শুরু হয় শ্রমের দাসত্ব, শিশুশ্রম, এমনকি সপ্তাহে ৬-৮ ডলারের বিনিময়ে ১২-১৪ ঘণ্টা কাজ করতে বাধ্য করা হয় কর্মীদের। যারা স্বল্প পারিশ্রমিকে কাজ করতে অস্বীকৃতি জানায় তারা কাজ হারায়, বেকার হয়ে পড়ে। অর্থাৎ শিল্প বিপ্লবের পর মানবিকতার চেয়ে অধিক মুনাফা লাভ এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নই মুখ্য হয়ে ওঠে।

শিল্প বিপ্লব-উত্তর সমাজের দৃষ্টি নিবদ্ধ হয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দিকে। বিপ্লবের বিস্তার ঘটেছে নানা শাখা-প্রশাখায়। এ সময়ে বাষ্প ইঞ্জিনসহ নানা যান্ত্রিক প্রযুক্তির উদ্ভাবন ঘটে, যা পরবর্তী সময়ে ব্যাপক প্রসার লাভ করে এবং শিল্পের নানা শাখায় বিপ্লব ঘটায়। এরই পথ ধরে দশকের পর দশক প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে আধুনিক চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ওষুধের আবিষ্কার শিল্প বিপ্লবের জন্য বিরাট মাইলফলক। শিল্প বিপ্লবের অগ্রগতির সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভোগের পরিমাণও বাড়তে থাকে। ফলে নাগরিক সুবিধা লাভের আশায় মানুষ নগরে বসবাসে আগ্রহী হতে থাকে। এ কারণে নগরায়ণ তীব্রতর হয়, বিশেষ করে শিল্প-কারখানাকেন্দ্রিক নগর গড়ে উঠতে থাকে। যেমন ইউরোপের গ্লাসগো, ম্যানচেস্টার কিংবা বার্মিংহামের মতো নগরগুলোর বিকাশ শিল্পায়নের সঙ্গে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত। আশঙ্কার কথা হলো, শিল্পের প্রসারের সঙ্গে এসব অঞ্চলে দূষণও ছড়িয়ে পড়ে। কয়লাচালিত শিল্প-কারখানাগুলো থেকে নির্গত ধোঁয়া এ শহরগুলোর আকাশকে ঘন ধোঁয়াশায় কালো অন্ধকার করে তোলে। এক সময় লন্ডনের বুক চিরে প্রবাহিত টেমসের মতো নদী বর্জ্যের আঁস্তাকুড়ে পরিণত হতে থাকে।

শিল্প বিপ্লবের কারণে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটলেও পরিবেশ করুণ পরিণতির দিকে ধাবিত হতে থাকে। প্রথমে উদ্ভাবিত ইঞ্জিনের জন্য জ্বালানি হিসেবে কয়লার ব্যবহার শুরু হয় এবং পরবর্তী সময়ে তেলের ব্যবহার শুরু হলে দুই উৎস থেকে প্রচুর কার্বন নিঃসরণ শুরু হতে থাকে। শিল্প বিপ্লবের কারণে দূষক নির্গমন বেড়ে যাবে এমন চিন্তা হয়তো শুরুতে কারো মাথায় আসেনি এবং সে কারণে তখন এ নিয়ে কোনো নিয়ম-কানুনও তৈরি করা হয়নি। মানুষ তখন শুধু উৎপাদন ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিকেই বড় করে দেখেছে এবং সে ধারা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে। ফলে পরিবেশ-প্রতিবেশ নিয়ে যেমন নিরপেক্ষভাবে ভাবার সময় হয়নি তেমনি উন্নয়নের সঙ্গে দূষণ রোধে গুরুত্বও আরোপ করা হয়নি। যতই সময় যাচ্ছে ততই শিল্প বিপ্লব-উত্তর কলকারখানার দূষণের প্রভাব পরিষ্কার হচ্ছে। আমাদের কলকারখানাসহ নানা কর্মকাণ্ডে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি চালনার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সেই শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে চলে আসছে, শুধু জ্বালানির ধরনে কিছু পরিবর্তন হয়েছে। দীর্ঘকাল ধরে জীবাশ্ম জ্বালানি পুড়িয়ে শক্তি উৎপাদন করতে গিয়ে সারা বিশ্ব, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশগুলো কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের চিমনি বানিয়েছে, তাতে দিন দিন বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়েই চলছে এবং ফলাফল হচ্ছে বিশ্ব উষ্ণায়ন।

১৭৫০ সালে শিল্পায়ন শুরুর আগে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ২৭৫ পিপিএম যা বেড়ে হয়েছে ৪১৫ পিপিএম। ১৯৬০ সালে প্রতি বছর কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বৃদ্ধির হার ছিল ১ পিপিএম যা বছরপ্রতি ৩ পিপিএমে উন্নীত হয়। মানুষ তার উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বছরে প্রায় ৩০ বিলিয়ন টনেরও বেশি কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছাড়ছে। ১৮ শতকের পর থেকে এ পর্যন্ত বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ৪০ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে বলে মনে করা হয় এবং এর ফলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা বেড়েছে, যা জলবায়ু পরিবর্তন ও আবহাওয়ার চরম অবস্থার জন্য দায়ী। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের সঙ্গে সঙ্গে উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে মিথেন ও নাইট্রাস অক্সাইড। তথ্যমতে, ১৮ শতকে বায়ুমণ্ডলে নাইট্রাস অক্সাইডের ঘনত্ব ছিল ৭২২ পিপিবি এবং ২০২৩ সালে তা বেড়ে হয় ১৯৩১ পিপিবি, অন্যদিকে নাইট্রাস অক্সাইডের পরিমাণ ২০ শতাংশ বেড়ে প্রাক-শিল্প বিপ্লবকালের ২৭০ পিপিবি থেকে বেড়ে ৩৩৬ পিপিবি হয়েছে। শিল্প বিপ্লব-উত্তর সময়ে প্রায় ২ দশমিক ৩ ট্রিলিয়ন কার্বন ডাই-অক্সাইড বায়ুমণ্ডলে যুক্ত হয়েছে বলে মনে করা হয়। নির্গত এ কার্বন ডাই-অক্সাইডের প্রায় অর্ধেক মহাসাগর এবং অন্যান্য বাস্তুতন্ত্র দ্বারা শোষিত হলেও অবশিষ্টাংশ বায়ুমণ্ডলে রয়ে গেছে, ফলে বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব বৃদ্ধি পেয়েছে। ১৮ শতক থেকে এ পর্যন্ত কার্বন ডাই-অক্সাইডের ঘনত্ব ৪০ শতাংশেরও অধিক বেড়েছে, যার কারণে জলবায়ু পরিবর্তন এবং এ জনিত তাপমাত্রা বেড়ে চরম আবহাওয়ার সৃষ্টি হচ্ছে।

পরিবেশের ওপর শিল্প বিপ্লব কী প্রভাব ফেলছে তা বুঝতে আমাদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। শিল্পায়ন ও এর সঙ্গে সম্পর্কিত অর্থনৈতিক উন্নয়নের নেশায় মানুষ এতটাই বিভোর হয়ে পড়ে যে পরিবেশ-প্রতিবেশে শিল্পায়নের প্রভাব নিয়ে চিন্তা করার ফুরসত হয়নি। যেমন গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন এবং নানা উৎস থেকে সিএফসি নির্গমন হয়ে বায়ুমণ্ডলের ওজোন স্তরে যে বিরাট ক্ষয় সাধন করে ফেলেছে সেটি আমরা ১৯৮০ দশকের আগে টের পাইনি। জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়টি জনসাধারণের কাছে যেমন অনেকাংশে শুরুতে বিশ্বাসযোগ্যতা পায়নি তেমনি রাজনৈতিক স্বীকৃতি পেতেও কয়েক দশক লেগেছে। আশির দশকের মধ্যে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে যেসব গবেষণা পরিচালিত হয়েছে এবং সেখান থেকে যেসব মডেল তৈরি করা হয়েছে, বলা চলে সেগুলোর প্রতিটিই প্রমাণ করেছে যে মানবসৃষ্ট কারণে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন বেড়েছে এবং এ কারণে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রা বেড়ে চলছে। যদিও ১৯৯০ সালের গোড়ার দিকে ইন্টারগভর্নমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ (আইপিসিসি) গঠনের আগ পর্যন্ত মানুষ স্বীকার করত না যে মানুষের কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের সম্পর্ক আছে।

বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের বৃদ্ধিতে সবচেয়ে বেশি ভূমিকা রাখছে শিল্প-কারখানাসহ নানা মাধ্যমে যন্ত্র চালনা ও শক্তি উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার। এ কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করতে হবে যে জলবায়ু সংকটের মূলে রয়েছে উন্নত দেশগুলোর দীর্ঘদিনের ধারাবাহিক সীমাহীন কার্বন নির্গমন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও জার্মানির মতো শিল্পোন্নত দেশগুলো শিল্প বিপ্লবের পর থেকে বৈশ্বিক নির্গমনের পেছনে বিরাট ভূমিকা রাখছে এবং বিশ্বব্যাপী ৭৯ শতাংশ কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী উন্নত দেশগুলো। যেমন অস্ট্রেলিয়ায় মাথাপিছু কার্বন নির্গমন ১৮ দশমিক ৯৯ টন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ দশমিক ৯৫ ও কানাডায় ১৪ দশমিক ২৫ টন, যা বিশ্বব্যাপী গড় নির্গমন (৪ দশমিক ৬৬ টন) থেকে অনেক বেশি। মোটের ওপর উচ্চ আয়ের দেশগুলোর গড় জনপ্রতি কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন নিম্ন আয়ের দেশগুলোর তুলনায় ৩০ গুণ বেশি। সার্বিক হিসেবে উচ্চ এবং উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশগুলো সিংহভাগ কার্বন নির্গমনের জন্য দায়ী। যদিও বিশ্বের অর্ধেকটা নিম্ন-মধ্যম এবং নিম্ন-আয়ের দেশ নিয়ে গঠিত, কিন্তু বৈশ্বিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের ২০ শতাংশেরও কম নির্গমন হয় এ দেশগুলো থেকে। এক্ষেত্রে দরিদ্র দেশগুলোর অবদান ১ শতাংশেরও কম। কার্বন নির্গমনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবদান নগণ্য হলেও সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলো, তবে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত প্রভাব প্রশমনে চাপ সৃষ্টি করা হয় উন্নয়নশীল দেশগুলোর ওপর। উন্নয়নশীল দেশগুলো যখন তাদের অর্থনীতি গতিশীল করার চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন সেখানে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমনকারী জীবাশ্ম জ্বালানি পরিহারের চাপ তারা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। ফলে কার্বন নির্গমনের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে তা রক্ষা করা হয়ে উঠছে না।

উন্নত রাষ্ট্রগুলো সীমাহীনভাবে তাদের শিল্প-কারখানা থেকে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন করেছে এবং তার বিনিময়ে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে। একই পথ ধরে উন্নয়নশীল কিংবা দরিদ্র রাষ্ট্র সবাই চায় সমৃদ্ধি অর্জন করতে। যেসব দেশ উন্নয়নের জন্য বায়ুমণ্ডলকে বিষাক্ত করেছে এবং করে চলছে তারা উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরামর্শ দিচ্ছে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন প্রশমনের এবং এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে দ্বন্দ্ব লেগেই আছে এবং এর প্রতিফলন দেখা যায় কপ-সহ নানা পরিবেশ সম্মেলনে। সম্প্রতি আজারবাইজানের বাকুতে অনুষ্ঠিত কপ২৯ সম্মেলনে উন্নয়নশীল দেশগুলো জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় দূষণকারী উন্নত দেশগুলোর কাছে যে আর্থিক সহায়তার জন্য দাবি তুলেছিল তা নিয়ে নাটক অসহায় দেশগুলোকে হতাশ করেছে।

কার্বন নির্গমন নিয়ন্ত্রণে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের তাগাদা থাকলেও উন্নয়নশীল কিংবা দরিদ্র দেশগুলোর এ ব্যয়বহুল প্রযুক্তি এবং অবকাঠামোতে যে বিনিয়োগ প্রয়োজন তা বহন করার ক্ষমতা নেই। ফলে এসব দেশকে তার উন্নয়ন ও উৎপাদনের জন্য জীবাশ্ম জ্বালানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। উন্নত এবং উন্নয়নশীল ও দরিদ্র দেশগুলোর মধ্যে এমন বৈষম্য কমাতে হলে উন্নত দেশগুলোকে শুধু নির্গমন কমালেই চলবে না, বরং উন্নয়নশীল দেশগুলোকে পরিচ্ছন্ন জ্বালানি (শক্তি) ব্যবহারে সক্ষম করার জন্য আর্থিক ও প্রযুক্তিগত সহায়তা প্রদান করতে হবে। কার্যত উন্নত ও উন্নয়নশীল কিংবা দরিদ্র রাষ্ট্রের মধ্যে বৈষম্য রেখে গ্রিনহাউজ গ্যাস নির্গমন প্রশমন কিংবা জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ন্ত্রণ কতটুকু ফলপ্রসূ হবে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ। শিল্প বিপ্লবের শুরু থেকে নির্দ্বিধায় যে বায়ুদূষণ হচ্ছে তা এখন বিষের বেলুন হয়ে বিশ্বকে হুমকি দিচ্ছে এবং এ নির্গমন এখনই নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে এর বিস্ফোরণ থেকে ধনী কিংবা গরিব কোনো দেশই রেহাই পাবে না।

ড. এএসএম সাইফুল্লাহ: অধ্যাপক ও চেয়ারম্যান, এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স অ্যান্ড রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট বিভাগ, মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

আরও