অভিমত

বৈদেশিক শ্রমবাজারে বাংলাদেশী শ্রমিকের দক্ষতা ও টেকসই উন্নয়ন

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় প্রধান ভূমিকায় রয়েছে তৈরি পোশাক শিল্প ও প্রবাসী আয়। বিশ্বব্যাংকের তথ্যমতে, ২০২৩ সালে বাংলাদেশের প্রবাসী আয় ছিল জিডিপির ৫ দশমিক ৩ শতাংশ। বাংলাদেশ থেকে প্রতি বছর গড়ে এক মিলিয়নের বেশি শ্রমিক বিদেশে কাজ করতে যান, যাদের বেশির ভাগই অদক্ষ। অথচ বিশ্বব্যাপী অদক্ষ শ্রমিকের চাহিদা কমছে এবং চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাবে উন্নত প্রযুক্তির মাধ্যমে তাদের প্রতিস্থাপিত করা সহজ হচ্ছে। এ অবস্থায় দক্ষ শ্রমিকের জোগান বাড়াতে না পারলে বিদেশের শ্রমবাজারে বাংলাদেশের শ্রমিকের সংখ্যা দ্রুতই কমতে থাকবে।

জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে অভিবাসীরা বিশ্বের ১৭৬টি দেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কাজ করছেন। ২০২৩ সালে বিদেশে কাজ করতে গেছেন ১৩ লাখ ৫ হাজার ৪৫৩ জন, যা ২০২২ সালে ছিল ১১ লাখ ৩৫ হাজার ৮৭৩ জন। ২০২৪ অর্থবছরে প্রায় ৪৪ শতাংশ অভিবাসী কর্মীর গন্তব্য ছিল সৌদি আরব এবং ২২ শতাংশের গন্তব্য ছিল মালয়েশিয়া। মধ্যপ্রাচ্য ও পূর্ব এশিয়ায় বাংলাদেশী শ্রমিক মূলত নির্মাণ শ্রমিক, কৃষি শ্রমিক, গাড়ি চালনা, বৃক্ষরোপণ, কারখানা, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, রেস্টুরেন্ট, কফিশপ, হোটেল, ছোট দোকান ইত্যাদিতে সাধারণ কর্মী হিসেবে কাজ করেন।

এ প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির টেকসই উন্নয়নে বড় ধরনের ভূমিকা রাখছেন। তারা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে পাঠিয়েছেন ২৩ দশমিক ৯১ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ সালে রেমিট্যান্স আয় ছিল ২১ দশমিক ৬১ বিলিয়ন ডলার। ২০২১-২২ সালে তা ছিল ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলার।

তার পরও বিদেশে আমরা নিজেদের শ্রমবাজার ধরে রাখতে প্রতিনিয়ত ব্যর্থ হচ্ছি। বিদেশের মাটিতে এ অভিবাসীরা নানা ধরনের বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন, যা রাষ্ট্রীয় ভাবমূর্তির ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। এ ব্যর্থতার কারণ ও তার প্রতিকার নিয়ে এখনই চিন্তাভাবনা করতে হবে।

দক্ষ শ্রমিকের চাহিদা বিশ্বব্যাপী বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, শ্রীলংকা ও ফিলিপাইনে শিক্ষা ব্যবস্থার আমূল সংস্কার করা হয়েছে। এ দেশগুলো বর্তমানে বিশ্বব্যাপী উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন কর্মীর কারিগর হিসেবে খ্যাত। অন্যদিকে আমাদের পরিস্থিতি বিপরীত। আমরা প্রযুক্তিগত বা কারিগরি শিক্ষা খাতকে উপেক্ষা করেই চলেছি। দেখা যায় প্রায় সময়ই কম মেধাবী ছাত্রদের আমরা কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেতে উৎসাহ দিই। সে কারণে কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়াশোনাকে সম্মানজনক মনে করা হয় না। এতে শিক্ষার্থীরাও মনোবল কম পায়। তাই স্বল্প আয়ের পরিবারও আজকাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠানোর চেষ্টা করে।

কারিগরি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা এবং এখানে পড়াশোনা করেও উচ্চ বেতনে সম্মানজনক কাজের সুযোগ আছে, এ-বিষয়ক সঠিক তথ্য এখনো অনেকে বিশ্বাস করে না। এর আরেকটা বড় কারণ আমাদের কারিগরি প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠানগুলোর সার্টিফিকেশন পদ্ধতি দুর্বল ও সর্বজনগ্রহণযোগ্য নয়। একই কারণে নিয়োগদাতাদের কাছেও আমাদের কারিগরি প্রতিষ্ঠানগুলোর গ্রহণযোগ্যতা নেই বললেই চলে। তার প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ে যখন আমাদের শ্রমিকরা একই যোগ্যতা নিয়ে ইন্ডিয়ান ও শ্রীলংকান এমনকি নেপালিদের থেকেও পিছিয়ে থাকে। সুতরাং সার্টিফিকেশনকে বৈশ্বিক মানে নিয়ে যাওয়া খুবই জরুরি।

তাছাড়া বৈশ্বিক বাজারে টিকে থাকতে হলে ভাষাগত দক্ষতাও অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ইউরোপসহ অনেক দেশেই স্কুলে শিশুদের অন্তত তিনটি ভাষা শেখানো হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সঙ্গে ভাষার সংযোগ খুবই বৈষম্যমূলক। এখানে ধনিক শ্রেণীর বিদ্যালয়গুলোয় ইংরেজিই প্রধান ভাষা। সরকারি বিদ্যালয়গুলোয় বাংলা এবং অপেক্ষাকৃত পিছিয়ে পড়া ও মোটাদাগে দাতব্য ও সামাজিকভাবে পরিচালিত ইসলামিক বিদ্যালয়গুলোয় আরবি, ফার্সি ও উর্দু শেখানো হয়। আমাদের শ্রমবাজারের বড় গন্তব্য যে মধ্যপ্রাচ্য, সেখানে আরবি ও ইংরেজির কদর বেশি, কিন্তু আমাদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যেখানে ইংরেজি শেখায় সেখানকার শিক্ষার্থীরা শ্রমিক হিসেবে বাইরে যান না। আবার যে মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের আরবি শেখানো হয় তারাও অর্থাভাব ও সাংস্কৃতিক কারণে বাইরে শ্রমিক হিসেবে কাজে যান না। এ অবস্থায় কারিগরি জ্ঞান ও বৈদেশিক শ্রমবাজারের জন্য আমাদের তরুণদের কীভাবে উপযোগী করে তোলা যাবে?

বাংলাদেশ থেকে কী পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক বিদেশে যাচ্ছেন তা বিএমইটির তথ্যেই পরিষ্কার হয়ে উঠেছে। ২০২৩ সালে ৩ লাখ ৮ হাজার দক্ষ শ্রমিক বিদেশে গেছেন, যা মোট শ্রমিকের ২৩ দশমিক ৬৯ শতাংশ। ২০২২ সালে গিয়েছিলেন মাত্র ১ লাখ ১ হাজার ৭৩১ জন, যা মোট শ্রমিকের ১৭ দশমিক ৭৬ শতাংশ। ২০২১ সালে গিয়েছিলেন ২১ দশমিক ৩৩ শতাংশ দক্ষ শ্রমিক। দক্ষ শ্রমিকের পাশাপাশি অর্ধদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যাও কমেছে। দক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিকের সংখ্যা কমলেও বেড়েছে পেশাদার শ্রমিকের সংখ্যা, যা অবশ্য মোট সংখ্যার ১ শতাংশেও পৌঁছতে পারেনি।

একটি আন্তর্জাতিক তুলনায় দেখা যায়, বাংলাদেশে মাত্র ১৪ শতাংশ শিক্ষার্থী কারিগরি শিক্ষা নেয়। জার্মানিতে এ হার ৭৩ শতাংশ, জাপানে ৬৬, সিঙ্গাপুরে ৬৫, অস্ট্রেলিয়ায় ৬০, চীনে ৫৫ ও মালয়েশিয়ায় ৪৬ শতাংশ।

তাছাড়া বিদেশে বাংলাদেশী শ্রমিকদের দক্ষতা-অদক্ষতার বিতর্কে একটি শুভংকরের ফাঁকি রয়ে গেছে। বিদেশী কোম্পানিগুলোর প্রতিও তাদের সরকারের দক্ষ শ্রমিক নেয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। তা না হলে তারা কর্মী নেয়ার জন্য কোটা বাড়াতে পারে না। তাই অনেকসংখ্যক অদক্ষ শ্রমিক দক্ষ কোটায় ভুয়া কিংবা অসম্পূর্ণ সার্টিফিকেট জমা দিয়ে বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন, যা মূল হিসাবকে প্রভাবিত করছে। কারণ আমরা বিএমইটির সংযুক্ত ট্রেনিংপ্রাপ্তদের সংখ্যা ও বিদেশগামী দক্ষ শ্রমিক সংখ্যার মধ্যে বিস্তর ফারাক দেখি, যে ফারাকটা কীভাবে পূরণ করা হয় তা নিয়ে একটা প্রশ্ন থেকেই যায়।

দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে সরকারের বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের অধীন জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর আওতায় ৭০টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। এছাড়া ৪০টি টিটিসি প্রকল্পভুক্ত ২৮টি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র রয়েছে। আরো রয়েছে তিনটি শিক্ষানবিশ প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। বিএমইটি ও কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রতি বছর গড়ে ৬০-৭০ হাজার ছেলেমেয়ে নানা ধরনের প্রশিক্ষণ নিয়ে বের হচ্ছেন। যদিও সেখান থেকে কতজন বছরে বিদেশে যেতে পারছেন তার কোনো তথ্য তাদের কাছে নেই। অথচ এ প্রতিষ্ঠানগুলোয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থাগুলোর বিশাল বিনিয়োগ রয়েছে।

দক্ষতাসংক্রান্ত সামগ্রিক গুমোট পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য দেশের নীতিনির্ধারকদের কর্মতৎপরতাকে দায়ী করা যায়। তারা গন্তব্য দেশগুলোর সঙ্গে আলোচনার সময় কীভাবে আরো বেশি শ্রমিক পাঠানো যায় সে বিষয়েই গুরুত্ব বেশি দিয়ে আসছেন। কিন্তু দক্ষতা বাড়ানো বা অভিবাসী শ্রমিকদের অধিকার রক্ষাসংক্রান্ত আলোচনায় খুব একটা জোর দেয়া হয় না। ফলে বিদেশে আমাদের শ্রমিকরা বিভিন্নভাবে শোষণ-বঞ্চনার শিকার হন, যার মূল কারণ অদক্ষতা। এ কারণে মধ্যবিত্ত পরিবার ও সচেতন তরুণরা সুযোগ থাকা সত্ত্বেও বিদেশে কাজ করার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না।

গোটা বিশ্বের অর্থনীতিতে ‘চতুর্থ শিল্প বিপ্লব’-এর সুবাদে অদক্ষ শ্রমিকরা ক্রমে অকার্যকর হয়ে পড়ছেন। তাদের কাজের সুযোগ সংকুচিত হয়ে আসছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংক, বায়ো টেকনোলজির সঙ্গে অটোমেশন প্রযুক্তির মিশেলে পরিবর্তিত হতে শুরু করেছে শিল্প কাঠামো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে পণ্য উৎপাদন, অপারেশন থিয়েটারের কাজ ও আইনি সেবা পর্যন্ত দেয়া যাচ্ছে। জায়ান্ট কোম্পানিগুলো প্রযুক্তি ব্যবহার করে পণ্য ও সেবার উৎপাদন খরচ অনেক কমিয়েছে; পণ্যের গুণগত মান বাড়িয়েছে। পিডব্লিউসির মতে, স্বয়ংক্রিয় প্রযুক্তির জন্য ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্বের ৮০ কোটি শ্রমিক বর্তমান চাকরি হারাবেন।

রেমিট্যান্সনির্ভর বাংলাদেশের অর্থনীতিকে টেকসই উন্নয়নের মহাসড়কে তোলার জন্য বাংলাদেশের নীতিনির্ধারকদের প্রথম কাজ শ্রমবাজারের বৈশ্বিক চাহিদার একটি বস্তুনিষ্ঠ প্রাক্কলন করা এবং সে অনুপাতে দেশের তরুণদের মধ্যে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যকর উদ্যোগ নেয়া। সেজন্য শিক্ষা ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজাতে হবে এবং দক্ষ শ্রমিকদের সামাজিক সম্মান বৃদ্ধিপূর্বক একটি জাতিগত ওয়েভ তৈরি করতে হবে। তা না হলে দ্বিতীয় রিপাবলিক যে তরুণদের হাত ধরে সৃষ্টি হয়েছে তাকে অর্থবহ করা কঠিন হবে।

আলাউদ্দীন মোহাম্মদ: পিএইচডি ফেলো, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব মালয়েশিয়া (আইআইইউএম) ও ইনস্টিটিটিউট ফর পলিসি, গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইপিজেড) নির্বাহী পরিচালক

আরও